|| তাসনিফ আবীদ ||
কয়েক বছর ধরেই দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষাক্রম নিয়ে সমাজের নানাজন, নানা পেশার মানুষের মাঝে প্রশ্ন বাড়ছে। কেউ কেউ আস্থাহীনতার কথা জানাচ্ছে। কেউ আবার সন্তানকে নিরাপদ রাখতে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি এই বিষয়টি বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। অনলাইন, অফলাইনসহ নানা জায়গায় সচেতন অভিভাবকরা অভিযোগ তুলছেন নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে। এর কারণ কী? এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থারই বা কীহবে! এর সমাধান কী হতে পারে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ আলেম মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের কাছে।
তিনি ফাতেহকে বলেন, বর্তমান পাঠক্রমে বিশৃঙ্খলা অথবা সংযোজন-বিয়োজনের নামে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন, কখনো দৃষ্টিকটু বিষয়, কখনো ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে বা আমাদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ জিনিস সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে চর্চা হচ্ছে। অভিযোগ আসছে। এই পরিস্থিতিতে আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘ঢালাওভাবে অপরিপক্ক, সেকুলার এবং পাঠ্যক্রম প্রণয়নের নিয়ম-কানুন বিষয়ে অজ্ঞ লোকদেরকে গত এক দশকের মতো সময় ধরে দায়িত্ব দেওয়ার একটি কুফল হচ্ছে এটা।’
‘এর একমাত্র সমাধান হলো, এসব এখনই সচেতনতার সঙ্গে বন্ধ করা’ -মত দেন তিনি
তার মতে, বিষয়টি যে এখন সামনে এসেছে বা নতুন এমন নয়। গত দেড়-দুই বছর আগেও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বেশ আপত্তি উঠেছিল সমাজে। সেখানে অসঙ্গতিপূর্ণ নানা বিষয় সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। এ নিয়ে সমাজের আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ, জ্ঞানীজন, সুধীজন, সচেতন নাগরিকরা আওয়াজ তুলেছিলেন। প্রথমে এই আওয়াজকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি অস্বীকার করা হয়েছিল এসব অভিযোগ। তাছাড়া শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত বেশ আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন এই আপত্তির ওপর আপত্তি তুলে। কিন্তু এর কিছুদিন পর সরকার বলেছে যে, আমরা এই বিষয় বা ওই বিষয় সংশোধন করছি।
‘বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি এই পাঁচ বছরের আগের পাঁচ বছরেরও দেখা গেছে। এর কারণ, কিছু এমন লোক যারা বাংলাদেশে বিতর্কিত; তাদের নাম পাঠ্যপুস্তকের সম্পাদনা, প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারকের জায়গায় দেখা যায়। তাদের মতো লোকেরা গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব গেলে এমনটি হওয়ারই কথা।’ -যোগ করেন এই গবেষক
তিনি বলেন, কখনো কখনো আমার কাছে এগুলোকে একটা বিশৃঙ্খলা মনে হয়। কখনো মনে হয় এগুলো আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদেরকে কিছুটা বিপথগামী করে রাখা অথবা দুর্বল করে রাখা কিংবা মূল্যবোধের সঙ্গে অসংশ্লিষ্ট করে রাখার একটা প্ল্যান হিসেবে পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে।
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, এসব ক্ষেত্রে আমি অনুরোধ করব, আপনাদের রাজনৈতিক দল-মত যেটাই থাকুক, অন্তত এটুকু বিষয় আপনাদের মাথায় রাখবেন, ‘এই সন্তানগুলো আমাদের সন্তান, এদের বেশিরভাগেরই ধর্মবিশ্বাস ইসলাম। এ জাতির সামাজিক এবং জাতীগতভাবে একটি ঐতিহ্য আছে, সংস্কৃতি আছে।’ এসব বিষয় মাথায় রেখে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে দায়িত্ব অর্পণ করবেন।
‘আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আধুনিক বিশ্ব শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য যেসব বিষয়ের দিকে গুরুত্ব দেয়. ধর্মীয় মূল্যবোধগঠিত বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওই বিষয়গুলোর প্রতি আমরাও যেন গুরুত্ব দেই।’ -বলেন তিনি
তিনি মতামত দেন, শিল্পকলা শেখানোর নামে, হাডুডু শেখানোর নামে যা হচ্ছে; এটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয় আমার কাছে। এসব বিষয় তো সমাজের ভেতর থেকে বাচ্চারা শেখে। আপনি যদি আলুর ভর্তা বানানো তাকে স্কুলে শেখান, দৌড় লাফ তাকে স্কুলে শেখান, ব্যাঙ লাফ শেখান, তাহলে সে তার জীবন থেকে কি শিখবে! শিক্ষার্থীকেও তো তার জীবন থেকে, সামাজিক উন্মুক্ত পাঠশালা থেকে নিজে নিজে কিছু শেখার সুযোগ দেয়া উচিত। ব্যাঙ লাফ যদি শিক্ষক শেখায় তাহলে এই শিক্ষার্থী নিজে থেকে কী শিখবে? আমার কাছে মনে হয় এটি শিক্ষার্থীদেরকে অথর্ব বানানোর একটি প্রক্রিয়া। পাঠ্যক্রমের বাইরেও তো শিক্ষার্থীদের শেখার জিনিস থাকতে হয়। ওই পথটাই তো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তারা মনে করছে, ‘আমরা যা শিখেছি এবং অতীতে যা ছিল সব পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা হবে। সবকিছু টিচাররা শেখাবে।’ এটা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল মেধাবিকাশের জায়গাটাকে নাকচ করে দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো যোগ করেন, পাঠ্যক্রম নিয়ে আপত্তিকর আরেকটা জায়গা হল বয়সন্ধিকালের শিক্ষা-দীক্ষা। ৫-১০ বছর যাবত পাঠ্যক্রমে এগুলো একটু বেশি আনা হচ্ছে। এটা ক্লাস সিক্স থেকে নিয়ে টেন পর্যন্ত যাদের বয়সন্ধিকাল সবেমাত্র শুরু হচ্ছে বা হবে তাদের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাঠক্রমে এর সংযোজনের ফলে ৫% যদি উপকৃত হয় ৯৫% এ বিষয়ে কৌতহলি হয়ে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে কিছু অংশ বা সীমিত অংশ ক্লাসে আলোচনা করা যেতে পারে। অথবা এটা ক্লাসে আলোচনা করার একেবারেই দরকার নেই। এসব পারিবারিক জীবন থেকেই মানুষ শিখে নেয়।
‘তবে যদি মনে করা হয় যে সতর্কতামূলক কিছু বিষয় শিক্ষাক্রমে সংযুক্ত করা দরকার; কেননা এখানে প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত অনেক ধরনের বিষয়াদি এবং স্বাস্থ্য জটিলতার কিছু বিষয়াদি থাকতে পারে। তাহলে ক্লাস টেনের পরে সহনশীল মাত্রায় এটা থাকতে পারে শিক্ষার্থীদের সতর্কতার জন্য। -উল্লেখ করেন এই শিক্ষাবিদ
তার মতে, এটাকে প্রশিক্ষণের মতো করে পড়ানো, প্রশ্ন করে করে শেখানো এবং সহশিক্ষার ক্লাসগুলোতে (যেখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসা থাকে) ইন-ডিটেলস আলোচনা করা শিক্ষার্থীদের চরিত্রের জন্য এবং মন মানসিকতার জন্য ক্ষতিকর।