মুনশী নাঈম:
২০২৩ সালে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলামে পাঠদান শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলামে পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে বদলাচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতিও। এখানে পরীক্ষার চেয়ে বেশি শ্রেণিশিক্ষকের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে। এরমধ্যে কোনো বিষয় ৫০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন, বাকি ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। কোনো বিষয়ে আবার শতভাগই শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোনো ক্লাসেই ধর্মীয় শিক্ষাকে পরীক্ষার তালিকায় রাখা হয়নি। অর্থাৎ কোনো ক্লাসেই ধর্মীয় বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে না। বরং এ বিষয়টির শতভাগই শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একটি সিন্ডিকেট ধর্মশিক্ষাকে সঙ্কুচিত করার বা ক্রমবিতাড়নের সুপরিকল্পিত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম অন্তঃসারশূন্য সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবে।
যেভাবে নেয়া হবে পরীক্ষা
বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে। নতুন এই কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকছে না কোনো বিভাগ বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপরেই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করতে পারবে এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আলাদা দুটি বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না থাকলেও বিদ্যালয়েই শ্রেণিশিক্ষকের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে নতুন এই শিক্ষাক্রমে। অর্থাৎ সাময়িক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক পরীক্ষা না থাকলেও শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীন। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৫০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু বিষয় শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীনই করা হবে।
এনসিটিবির তথ্য বলছে, প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা থাকছে না। ওই শ্রেণিগুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে শতভাগ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন অর্থাৎ পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ। ৬০ শতাংশই ধারাবাহিক মূল্যায়ন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্পকলা (বিদ্যমান চারু ও কারুকলা) এগুলো শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলামে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান, বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন (বছর শেষে পরীক্ষা) ৪০ শতাংশ। বাকি বিষয় জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি (বিদ্যমান বিষয়- চারু ও কারুকলা) শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। আর নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণির বাকি বিষয়গুলোয় শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এ প্রসঙ্গে কথা হয় সরকারি মাদারাসায়ে আলিয়ার আধুনিক আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মুহাম্মদ মহসীন কবীরের সঙ্গে। ধর্মীয় বিষয়ের পরীক্ষা না নেয়ার পরিণতি উল্লেখ করে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘ধর্মীয় বিষয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটা আর দশটা বিষয়ের মতো না, যেটা না পড়লে হবে না। আলেমরাও অনেকদিন ধরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে আসছেন। সেখানে পরীক্ষা নেয়ার তালিকা থেকেই ধর্মীয় বিষয়টি বাদ দেয়া হলো। সরকার কেন এমনটা করেছে, জানি না। তবে পরীক্ষা নিলে ছাত্রদের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব থাকতো। তারা মন দিয়ে বিষয়টি পড়তো। পরীক্ষা না থাকার কারণে এটা আর হবে না। ধর্মীয় বিষয়টিকে আর শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব দিবে না।’
আরবির এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘যেকোনো পাঠ্যক্রম করার আগে গবেষণা করতে হয়। কোন মেথডের পরিণতি কী, ফলাফল কী। ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার তেমন কোনো গবেষণা করেছে কিনা জানি না। তবে এতটুুকু বলতে পারি, শিক্ষার্থীরা বিষয়টি আর তেমন কদর করে পড়বে না।’
এ প্রসঙ্গে আরও কথা হয় আলেম লেখক ও অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নবপ্রজন্মকে বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী ও আধুনিক করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই। তবে একথাও অনস্বীকার্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, মানবিক, সৎ, আদর্শ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধর্মশিক্ষা ও পরীক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা দেখছি, একটি সিন্ডিকেট ধর্মশিক্ষাকে সঙ্কুচিত করার বা ক্রমবিতাড়নের সুপরিকল্পিত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত। পাবলিক পরীক্ষায় ইসলামী শিক্ষা না নিয়ে কেবল সিলেবাসে রেখে জাতির সাথে ধোঁকাবাজি করা হচ্ছে। আমরা তো আমাদের সন্তানদের ধর্মহীন বানাতে দিতে পারি না। তাই বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা আগের মতো বহাল রাখতে হবে।’
তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তেক্ষেপ কামনা করে বলেন, দেশের আলেম-ওলামা এবং পীর-মাশায়েখদের সাথে আলোচনা করে মাদরাসার জন্য মাদরাসা ও ইসলামবান্ধব স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। আমরা একটি সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে চাই, যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার সাথে সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় করে একটি নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম অন্তঃসারশূন্য সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবে।’
উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ক একটি স্মারকলিপি পেশ করেছেন। তাতে তারা বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই তৈরী করতে হবে। স্কুলের জন্য রচিত বইগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতির পক্ষে রচিত হয়নি। তাই বিশেষজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যবইগুলো সংশোধন করতে হবে। স্কুলের ধর্ম শিক্ষাকে বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাধারণ শিক্ষায় ১০টি বিষয়ে এক হাজার নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মাদরাসা শিক্ষার জন্য মূল বিষয় ঠিক রেখে সমন্বয় সাধন করে এক হাজার নম্বর নির্ধারণ করতে হবে।