নতুন পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিদ্বেষ: আলেমরা কী বলছেন?

মুনশী নাঈম:

২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে যে পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান শুরু হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন আলেমরা। এসব পাঠ্যপুস্তকেকে তারা হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যপুস্তক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, এসব পাঠ্যপুস্তকে যেমন ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, তেমনি শিশুদের মনে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিকৃত মানসিকতা। শিশুরা এসব বই পড়ে ভালো মানসিকতা শেখার বদলে শিখবে ইসলাম বিদ্বেষ, ধর্মহীন জীবন যাপন।

এই দুই শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক পড়ে জানা গেছে, বইগুলোতে মূলত তিনটি আপত্তিকর বিষয় সবেশ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে—১. ইসলামবিদ্বেষ, ২. মুসলিম ইতিহাসের বিকৃত বয়ান, ৩. যৌন বিকৃতি স্বাভাবিকীকরণ।

বখতিয়ার ধ্বংসকারী নয়

নতুন পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম শাসকদের উপর আরোপিত অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন আলেম লেখক ও গবেষক মুসা আল হাফিজ। ফাতেহকে তিনি বলেন, বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক বিবরণ পাঠ্য বইয়ে দেওয়া হয়েছে তা অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। লেখকরা বইয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রও উল্লেখ করেননি। অনেকটা মনগড়া, নিজস্ব মতামত দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে। যা অনভিপ্রেত।

তিনি বলেন, খিলজির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা ৪২৭ সালে নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করেন তিনি। আসলেই কি তাই? অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। কিন্তু তখনো খিলজির আগমনই ঘটেনি। যদুনাথ সরকার অবশ্য খিলজির আগমনকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, খিলজি এসেছিলেন ১১৯৯ সালে। কিন্তু তাতেও ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংসের দায় তার ওপর চাপে না।

বইয়ে বলা হয়েছে, খিলজি কয়েকটি বিহার আক্রমণ করেছেন । এটাও ভুল কথা। ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন আবু ওমর বিন সিরাজউদ্দীন জুযানির তবাকাত-ই-নাসিরিতে রয়েছে, বখতিয়ারের সৈন্যদের ওদন্তপুরীর মঠে ভুলক্রমে আক্রমণের কথা। মিনহাজের ভাষ্য মতে, ২০০ সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার বিহার দুর্গ আক্রমণ করেন। ওদন্তপুরীকে শত্রুদের সেনাশিবির মনে করেন। হামলায় বহু খুনোখুনি হয়। মূলত এটি সেনাশিবিরের মতোই ছিল। এর চার দিকে ছিল বেষ্টনী প্রাচীর। কিন্তু বখতিয়ার যখন দেখলেন, সেখানে প্রচুর বই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন এটি দুর্গ নয়, তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন।

ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে ১১৯১-৯৩ সময়কালে। বলাবাহুল্য, বখতিয়ারের বঙ্গজয় এর পরের ঘটনা। বস্তুত ওদন্তপুরী আক্রমণও সংশয়পরিকীর্ণ। বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে সুখময় মুখোপাধ্যায় বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল গ্রন্থে ড. আবদুল করিম, বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখান, তবকাতে নালন্দা অভিযানের কোনো বিবরণ নেই, বখতিয়ার আদৌ নালন্দায় অভিযান করেননি। বস্তুত কোনো প্রত্ন তত্ত্বিক অনুসন্ধানেও বখতিয়ারের নালন্দা আক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মুসলিম শাসকরা বিদেশী?

পাঠ্য বইগুলোতে মুসলিম শাসকদের বিদেশী বলা হয়েছে। সুলতানি আমলকে দেখানো হয়েছে খারাপভাবে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় ওমরগণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. আ ফ ম খালিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলা যতদিন স্বাধীন ছিল, তা ছিল সুলতানি শাসনামলে। দিল্লির চোখে চোখ রাঙিয়ে তারা বাংলা স্বাধীন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাস উলটে সুলতানদের বিরুদ্ধে পাঠ্যপুস্তকে বিষোদগার করছে। বিষয়টি মর্মান্তিক।

তিনি আরও বলেন, বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয়ের আগে এই অঞ্চল শাসন করেছে সেন সাম্রাজ্য। সেন বংশ বাঙালি ছিল না, তারা ছিল দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের অধিবাসী। তারা বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষান্ত হননি, তারা বৌদ্ধ ভাণ্ডারের সব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জনসাধারণ স্বস্তি ও মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার জন্য ইসলামকে স্বাগত জানায়। মুসলমানরা দখলদার নয়, ত্রাণকর্তা। আলেম লেখকদের উচিত মুসলিম ইতিহাস নিয়ে বাংলায় বেশি বেশি কাজ করা। নয়ত আমাদের আগামী প্রজন্মকে মুসলমানদের সঠিক ইতিহাস জানানো বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রতিরোধ করতে হবে হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কথা হয় আলেম লেখক ও সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, এমনিতেই সাধারণত কোনো মুসলিম সেকুলার দেশগুলোর এমন অনেক নিয়ম থাকে, যেগুলো মুসলমানদের আহত করে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজের বা রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জড়িত নীতি ও পলিসি নির্ধারণকারীদের যদি নিজের থেকে আরও বেশি মুসলিম বিরোধিতার ইচ্ছে না থাকে, পাশাপাশি যদি অন্য জাতি-গোষ্ঠি-আদর্শের প্রতি আনুগত্য ও দায়বদ্ধতা না থাকে, তাহলে সরাসরি কষ্টদায়ক কাজের পরিমাণটা কম থাকে। কিন্তু এগুলো শুরু হলে, এগুলোর সঙ্গে দায়িত্বশীলরা জড়িত থাকলে এর পরিমাণ বেড়ে যায়।

শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যে তিনটি বিষয়ের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তাতে চেষ্টা করা হয়েছে, এদেশের কোমলমতি শিশুদের চিন্তাভাবনা যেন পুরো উলটে দেয়া যায়। এখানে ভয়ংকর দিক হলো, যারা নাস্তিক্যবাদী মনোভাব লালন করেন, তারা তাদের কাজকর্মে ধর্মের বিরোধিতা রাখেন। পাঠ্যপুস্তকেও তা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশি হিন্দুত্ববাদী শক্তি যখন নানাভাবে অগ্রসর হতে চাচ্ছে, প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে, তখন পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্ববাদের বর্ণনা এবং উপমহাদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার পাশাপাশি কথিত আধুনিক পৃথিবীতে যে অবক্ষয়মূলক জীবনযাত্র প্রচলিত, সেগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং শিশুদের মনে সহনশীল করারও চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি বিষয়গুলো নানাভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। বিষয়গুলো ভয়ংকর আপত্তিকর ও প্রতিবাদযোগ্য।

বর্তমান প্রেক্ষিতে করণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আলেম ও মুসলমানদের উচিত হলো, শুধু প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় থেমে না থাকা। বরং পাঠ্যক্রম, সংস্কৃতি, জীবনাদর্শ, নাগরিক অধিকার, বিশেষ করে যেগুলোর সঙ্গে জাতির বিশ্বাস ও জীবন গভীরভাবে জড়িত, সেগুলোর ক্ষেত্রেও পূর্ণ মনোযোগী থাকা। এগুলোর ক্ষেত্রে কোনো শক্তিকে ছাড় না দেয়া। ছাড় দিলে এবং মনোযোগী না হলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

আগের সংবাদনতুন পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে শেখানো হয়েছে ইসলামবিদ্বেষ
পরবর্তি সংবাদকানায় কানায় পূর্ণ তুরাগ তীর, ফজর পরেই শুরু বয়ান