মুনশী নাঈম:
২০২৩ সাল থেকে সারাদেশে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রথম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে স্কুল ও মাদরাসায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান শুরু হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে পঠিতব্য দশটি বিষয় হল— বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্মশিক্ষা। এ বিষয়গুলো যেমন স্কুলে পাঠদান করা হবে তেমনি সমানভাবে মাদরাসায়ও পাঠদান করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
মাদরাসার শিক্ষকগণ বলছেন, ৭ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক এখনো সামনে আসেনি। তবে পাইলটিং কার্যক্রমের জন্য ৬ষ্ট শ্রেণিতে যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হয়েছে, এগুলোর বিভিন্ন বিষয় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস, আদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে, বিশেষত মাদরাসা শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এগুলো মাদরাসা তো দূরে, এ দেশের স্কুলেও পাঠদান করার উপযোগী নয়। শিক্ষকরা মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণের দাবি জানিয়ে আসলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি।
এনসিটিবির দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এই শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপানোর কার্যক্রম চলছে।
কোন বইয়ে কী রয়েছে?
পাইলটিং এর জন্য নির্ধারিত ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ১০টি পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে ৯টি পাঠ্যপুস্তকে অত্যন্ত সুকৌশলে ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে ভিনদেশী কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা হয়েছে। ৯টি বই থেকে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলা: এই বইয়ে কাল্পনিক ও অবাস্তব ছড়া, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া শেখানোর মতো কল্পনানির্ভর শিক্ষাহীন গল্পের পাশাপাশি কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে গান শোনা, গান শেখা, বাদ্যযন্ত্র যেমন, হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা, ঢোল ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্রিকেট খেলা ও টেলিভিশনের সামনে বসার আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির আগের বাংলা বইতে হযরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে একটি কবিতা থাকলেও নতুন বইতে তা রাখা হয়নি। তাঁর সম্পর্কিত নতুন কোনো প্রবন্ধ, কবিতা কিংবা ছড়া অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।
ইংরেজি: এই বইয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিভিন্ন পৃষ্ঠায় মানুষের সাথে কুকুরের ছবি এবং নেকড়ে বাঘের ছবি দেওয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই অংশবিশেষ। তাছাড়া একটি গল্পে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান এ চার ধর্মের চারজন বন্ধুর পরস্পর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খুবই আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ এবং হিন্দুদের দুর্গা পূজায় অংশগ্রহণ করে সকলে একত্রে নাচের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপনের বর্ণনা রয়েছে। এতে হিন্দুদের পুজায় অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। যা মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও বিশ্বাস থেকে আপত্তিকর।
গণিত: এই বইয়ে মেয়েদের ৭৭টি ছবি উপস্থাপিত হয়েছে, যার একটিতেও হিজাব নেই। বইটিতে বেশিরভাগ অমুসলিম নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: এই বইয়ে ‘বিবর্তনবাদ’ এর মিথ্যা ও বিতর্কিত তত্ত্ব রয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে কীভাবে বানর বা এই জাতীয় অন্য প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ বর্ণনার পাশাপাশি ছবি দ্বারা এ বিবর্তনকে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ‘লুসি’ নামক কথিত কঙ্কালকে মানুষের পূর্বসূরী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুসির ছবিও দেওয়া হয়েছে বইটিতে। তাছাড়া বইটির অনুসন্ধানী পাঠে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমন সব মনগড়া বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, যা কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলামানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থি। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনায় প্রাচীন মানুষ ও দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবির পাশাপাশি গ্রীক, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বিভিন্ন দেব দেবীর বর্ণনা ও ভাস্কর্য এবং দেব দেবী সম্পর্কিত নানা অলীক বিশ্বাস তুলে ধরে পৌত্তলিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহার, হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমার বহু ছবি দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধস্তূপে ভক্ত ও উপাসনাকারীদের ছবিও রয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো মসজিদ কিংবা মুসলিম নিদর্শনের ছবি ও বর্ণনা নেই। বাস্তব কিংবা কল্পিত ছবি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবিই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন পাঠে প্রকৃতি, অনুসন্ধান, সুরেশ, দীপা, দীপঙ্কর, তিথি, টুকটুক এ ধরনের নামের আধিক্য রয়েছে, যা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। এমনকি একটি লেখায় ‘আনোয়ারা ও আশরাফুন্নেসা’র মতো দুটি সুন্দর মুসলিম নামকে গল্পচ্ছলে হেয় করে ‘বেমানান’ বলা হয়েছে।
বিজ্ঞান: এই বইয়ে পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে কালপুরুষের ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ কুরআনের বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের কোনো উল্লেখ পুরো বইতে নেই। উপরন্তু মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। বইটিতে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে এবং ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা: এই বইয়ে ছেলে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে নির্লজ্জ বর্ণনা রয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অত্যন্ত বেমানান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের যৌথ ক্লাসে বেহায়াপনা শিক্ষাদানের শামিল। তাছাড়া ছেলে মেয়েদের পারস্পরিক আগ্রহ, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সংযমের শিক্ষা ব্যতীত উল্লেখ করে ফ্র্রি-মিক্সিং ও অবাধ যৌনতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা সমাজ ও দেশে নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে। উক্ত বইয়ে ‘বয়ঃসন্ধিকালে মনের যত্ন’ অনুচ্ছেদে রাগ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম নির্দেশিত সুন্দর পদ্ধতি পরিকল্পিতভাবে পাশ কাটিয়ে ৫০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো গণনার মতো অবৈজ্ঞানিক কল্পিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।
জীবন ও জীবিকা: এই বইয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের জীবনাচার অনুপস্থিত। প্রতিদিনের কাজে মুসলিম জীবনাচারের উল্লেখ নেই, খাবারের আদব কায়দায় নেই ইসলামী শিষ্টাচার। গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া সুদভিত্তিক ব্যাংকিং, নাটক, মেয়েদের ফুটবল খেলা, টিভি দেখা ও অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি: এই বইয়ে দূর্গাপূজার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি: এই বইয়ে মুসলিম কৃষ্টি-কালচার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পুরো বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সংগীত, নৃত্য, অভিনয় এবং এর তাল, লয়, রস, মুদ্রা ইত্যাদি। এগুলোর বহু বিষয় ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বইটির প্রচ্ছদও ঢোল, তবলা ও মূর্তির ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বইটিতে যাত্রাপালা, সার্কাস, বাউল গান, লোকনাটক, পুতুলনাচ ও গানের অনুষ্ঠানকে আমাদের ‘সংস্কৃতির অমূল্য অংশ’ এবং ‘জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়’ বলা হয়েছে।
ক্ষুব্ধ মাদরাসার শিক্ষকরা
দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আ খ ম আবুবকর সিদ্দিক ফাতেহকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এ ধরণের পাঠ্যপুস্তক মাদরাসা ও স্কুলে পাঠদানের জন্য পাঠায়, তা মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। মানুষ ভাবতে শুরু করবে, সরকারকে ইসলাম ও মুসলমানদের ঐতিহ্যবিরোধী। তাই পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ঐতিহ্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটি ধর্ম ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সকল অর্জনকে ম্লান করে দিবে। এই প্রকল্পটি সরকারের জন্য কল্যাণকর হবে না বরং আত্মঘাতীমূলক হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দাবি জানিয়ে আসছি, মানবন্ধনও করেছি, যেন মাদরাসার জন্য আলাদা পাঠ্যপুস্তক তৈরী করা হয়। মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা রক্ষার্থে স্বতন্ত্র পাঠ্যক্রম ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মুহাম্মাদ জহীরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ফাতেহকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মাদরাসা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে পাঁচটি কর্মশালায় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করেছেন। আমরা মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ও মান বজায় রেখে এবং এ দেশের মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষাক্রম ও পুস্তক প্রণয়নের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছি। কর্তৃপক্ষও বারবার এ বিষয়ে মাদরাসার প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু তার ফল দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে মাদরাসা শিক্ষকরাও এনসিটিবির সাথে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আমরা বলে আসছি বারবার, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণে যেন আলেমদেরও রাখা হয়। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণে তাদের সহযোগিতা নেয়া হয়নি। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তকের দাবির কোনো সুরাহা হয়নি।