নয় বছরে লেখক ফোরামের অর্জন কী?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ইসলামি ধারার তরুণ লেখকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম প্রতিষ্ঠার ৯ম বছর পার করেছে। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ফোরামের ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শানদার অনুষ্ঠান। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কর্মরত এবং সারাদেশে ছড়ানো তরুণ লেখকদের নিয়ে ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ফোরামের যাত্রা। দীর্ঘ পথচলাকেই একটা সাফল্য হিসেবে দেখছেন অনেকে। তারা বলছেন, দৃশ্যমান সাফল্য এখনও না দেখা গেলেও অভ্যন্তরীণ প্রভাব দৃঢ় হচ্ছে। দিনদিন তা ক্রমশ দৃশ্যমান হবে।

তবে কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘ এই পথচলায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করতে পারেনি এই ফোরাম। বার্ষিক অনুষ্ঠান, ট্যুর আর স্মারক প্রকাশেই থমকে আছে কার্যক্রম। বানানরীতি তৈরী করলেও সেটাকে সবার সামনে আনতে পারেনি তেমন করে। সেই বানানরীতিও কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

টিকে থাকাটাই বড় সাফল্য

আলেম লেখক ও সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ টিকে থাকাটাকেই গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, লেখকদের ফোরাম নতুন কিছু নয়। বাম লেখকদের বিভিন্ন ফোরাম ছিল। আলেম লেখকদের ফোরাম হিসেবে ৯ বছর পার করে ফেলেছে বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম। দীর্ঘ এই সময় টিকে থাকা এবং ক্রমান্বয়ে একটু একটু অগ্রসর হওয়াটা কম নয়। এটাও অনেক কিছু।

টিকে থাকাটাই কিভাবে অনেককিছু? মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, লেখক ফোরাম যদিও বড় বড় কাজ করতে পারেনি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছে। একক অনেক লেখককে ঐক্যের একটা সুতোয় গেঁথে রেখেছে। প্রত্যেকে নিজের মতো লিখছে, অনুবাদ করছে, সম্পাদনা করছে। কিন্তু তাদের পরস্পরের মধ্যে বছরে দুএকবার বিভিন্ন উপলক্ষে আলাপ হয়। মত বিনিময় হয়। বিভিন্ন সময় তারা কর্মশালাও করে। আমি বলি, যদি আগামী দশবছর লেখক ফোরাম এভাবেই এগিয়ে যায়, বাড়তি কিছুও না করে, তবুও ফোরাম সফল। এই উত্তাপটা আমরা একসময় অনুভব করতে পারব।

লেখক ফোরাম কী করেছে?

দীর্ঘ এই পথচলায় ফোরাম একটু একটু অনেক কিছুই করেছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে—তারা তরুণ আলেম এবং মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে সুস্থ লেখালেখির একটা চেতনা তৈরী করেছে।

মাসিক নকিবের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নূরুল করীম আকরাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের হাত ধরে গত প্রায় এক দশকে এমন শতাধিক তরুণ যুবা লেখিয়ে হয়ে উঠেছে, যাদেরকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি জানি। মূলধারা ও ইসলামিক ধারার প্রতিটি অঙ্গন যারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। গণমাধ্যম, সাহিত্যাঙ্গণ ও লেখালেখির জগতে যারা ভালো একটা রেভুলেশন করে চলেছেন।’

আলেম চিন্তক মনযূরুল হক বলেন, আলেমদেরও মাতৃভাষায় লিখতে হবে, লেখালেখি শিখতে হবে—এই দায় থেকেই লেখক ফোরাম দাঁড়িয়েছে। যদিও অগুণতি অলেখক এখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, শুধু ফেসভ্যালুর জোরে। লেখার গুণগত মান ফোরামের নেতৃত্বের মানদণ্ড কি না—সেই প্রশ্নেরও সমাধান হয়নি। গুটিকতক মুখচেনা ‘লেখক’ এর বাইরেও কোনও কোনও সভা আলোকিত করেছেন পরিচিত ওয়ায়েজ, কর্পোরেট শিল্পী কিংবা ভবঘুরে যাজকেরা। প্রেসক্লাবে ঘাপটি গেড়ে থাকা অন্য দশটা সাংবাদিক ফোরামের মতোই এই ফোরামের হাবভাব ও কর্মসূচী। কিন্তু আরেকটু গভীরে গিয়ে ইতিবাচক নিয়তে ভাবলে বোঝা যাবে—আপত্তিগুলোই আসলে লেখক ফোরামের সার্থকতা। লেখক ফোরামের যা সামর্থ্য তা তারা করেছেন, আমাদের আশার সিকিভাগেরও প্রতিফলন তাতে ঘটেনি নিশ্চয়ই—কিন্তু যেটুকু সামর্থ্য তারা দেখিয়েছেন।

তরুণ আলেম লেখক ও সম্পাদক হামমাদ রাগীব বলেন, লেখক ফোরামের (সাবেক/বর্তমান) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে হোক কিংবা সাংগঠনিক যে-কেউ সহজে সম্পর্ক গড়তে পারে, যে কারও মতামতকে তারা মূল্যায়ন করেন এবং বছরে এক/দুবার হলেও ফোরামের সকল সাধারণ সদস্যের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখেন। এটা অনেক বড় জিনিস।

তরুণ আলেম লেখক ও অনুবাদক জুবায়ের রশীদ বলেন, লেখক ফোরামের অনেক অর্জনই আছে। নয় বছরে নয়টা সম্মেলন করে সমচিন্তার লেখকদের একত্রে বসার সুযোগ, বরেণ্যদের লেখালেখির জার্নি ও অভিজ্ঞতামূলক আলোচনা থেকে অনুজদের শেখা। নয়টা স্মারক ফ্রি উপহার দেওয়া। বাংলা একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে একটি বানানরীতি। একটি লেখক অভিধান, পববর্তী লেখক অভিধানের কাজ চলমান। নয়টা ইফতার মাহফিলে লেখকদের মিলনমেলা। লেখকদের নিয়ে বছরে একটা আনন্দ ভ্রমণ, ঢাকার বাহিরে।

তিনি আরও বলেন, এসবের মাধ্যমে মূলত সমচিন্তার লেখকদের মাঝে পরিচয়, সম্পর্ক গড়ে তোলা উদ্দেশ্যে। একজন যাইনুল আবিদীন সাহেবের সাথে একটা পূর্ণ দিন কাটানো, একজন শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের কাছ থেকে লেখালেখির সবক পাওয়া লেখক হবার স্বপ্ন দেখা অসংখ্য তরুণের স্বপ্ন, লেখক ফোরাম এই সুযোগটা নিজের গরজে করে দেয়। অসংখ্য লেখক কর্মশালার আয়োজন, যেখানে আমাদের অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের সরাসরি আলোচনায় নবীনদের হাতেখড়ি, অন্তত লেখালেখি সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা ধারণা তারা পায় কর্মশালা থেকে।

তবে লেখক ফোরাম নিয়ে সমালোচনাও আছে বেশ। ইসলামি ঘরানার তরুণ লেখকদের জাতীয় সংগঠন হিসেবে ফোরামটি নিজেদের পরিচয় দিলেও তরুণ ও নবীন লেখকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এর সঙ্গে। গত নয় বছরে ‘গৎবাঁধা’ কিছু প্রোগ্রাম ছাড়া তরুণ লেখকদের কল্যাণে চোখে পড়ার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি সংগঠনটি। এমনটাই দাবি অনেকের। তারা বলছেন, ইসলামী লেখক ফোরাম ইসলামি লেখকদের সংগঠন। এর মূল কাজই ইসলামি ঘরানার লেখকদের অধিকার আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখা, তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং তাঁদেরকে আবর্তিত করে তৈরি নানামাত্রিক সংকট নিয়ে কাজ করা। কিন্তু বিগত এক দশকে কল্যাণমূলক মৌলিক উদ্যোগ ফোরামের খুব কম। যা এক/দুইটা হয়, সেগুলোতে কেবল সহযোগী হিসেবে তাদের ব্যানার ব্যবহার করা হয়।

কেউ কেউ বলছেন, লেখক ফোরাম যে বানানরীতি তৈরী করেছে, ফোরাম তা ভালোমতো প্রচার করতে পারেনি। ফলে এই রীতি কেবল রীতি তৈরীকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সব লেখকদের এক প্লাটফর্মে আনারও যেই সদিচ্ছা, সেটাও ততটা শক্তিশালী নয়। প্রকাশনীগুলোর সঙ্গে তাদের বোঝাপড়াও খুব ভালো নয়।

সমালোচনা ডিঙিয়ে নিজের মতো পথ চলছে লেখক ফোরাম। ফোরামের সাবেক সভাপতি, লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা জহির উদ্দীন বাবর বলেন, ফোরাম তার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ফোরাম আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করবে।

আগের সংবাদ‘বিশ্ব ইজতেমার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত থাকবে’
পরবর্তি সংবাদবিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ২১ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ