নোয়াখালী গ্রেফতার কাণ্ড : ধর্মঅবমাননা-বিশ্বাসের সীমা কোথায়?

মুনশী নাঈম:

‘ইসলামে মূর্তিপূজা এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। অতএব কোনো মুসলমান পূজাকে উইশ করতে পারেনা। পূজায় শুভেচ্ছা জানানো হারাম, স্পষ্ট কুফুরী।’

ফেসবুকে এমন পোস্ট দেয়ায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে মো. ইয়াসিন রুবেল নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার পোস্টে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কার অভিযোগ তুলে শনিবার (১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পরই প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন, মুসলিম দেশে ইসলামের একটি মৌলিক আকীদার কথা বলাও কি অপরাধ? ইসলামে মূর্তিপূজা এক ভয়ঙ্কর অপরাধ বলা কি ধর্মকে অবমাননা?

দেশের ইসলামিক স্কলারগণ বলছেন, নোয়াখালির গ্রেপ্তারের ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি কাজ। ইসলামের একটি মৌলিক আকীদার কথা বলার কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হয়, তবে এটার চেয়ে বড় উস্কানীমূলক কাজ আর হতে পারে না। কেননা এর মাধ্যমে হাজারো মুসলিমকে উস্কিয়ে দেওয়া হয়।

‘এটা ধর্ম অবমাননা নয়’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর ড. মো. আবদুর রশিদ ফাতেহকে বলেন, নোয়াখালিতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ধর্ম অবমানা নয়। বরং তার কথাটাই ঠিক। ইসলামের মৌলিক কথা এটাই। তবে সে এটা এই সময় না বলে অন্য সময় বললেও পারতো।’

ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. শেখ মুহাম্মদ ইউসুফ মনে করেন, গ্রেপ্তার হওয়া রুবেল কোনো ধর্ম অবমাননা করেনি। কিন্তু এই সময়ে কথাগুলো বলার কারণে সনাতন ধর্মালম্বীরা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সে এই সময় এটা না বলে অন্য বললে এতটা সমস্যা হতো না।

আলেমরা কী বলছেন?

দেশের আলেমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রুবেলকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন, পূজা দেখার জন্য মন্দিরে যাবার অনুমতিও ইসলাম দেয় না। এটাই ইসলামের একেবারে মৌলিক ও সাফ কথা। এই সাফ কথা যদি কারো কাছে উস্কানীমূলক মনে হয়, তবে তাদের নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের পুনরায় পরীক্ষা করা দরকার। ইসলামে শিরকের কোন অবস্থান না থাকার বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের সামনে কেন বেশি বেশি আলোচনা করা দরকার, এর জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত নোয়াখালির সাম্প্রতিক ঘটনাটি।

দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমাদুল্লাহ ফেসবুকে উক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লিখেন, আপনি যদি নিজ বিশ্বাসে সত্যবাদী তথা ঈমানদার হয়ে থাকেন তবে একজন মুসলিম হিসেবে আপনি শির্কের আয়োজনে শামিল কিংবা শরীক হতে পারেন না। এটা উদারতা নয়, বরং ঈমানের ব্যপারে উদাসীনতা। বিশ্বের সকল মুসলিম স্কলারদের ঐকমত্যে এটি হারাম এবং ঈমান-বিধ্বংসী কাজ। সুতরাং একজন মুসলমানকে এই ধরণের সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে হবে।’ পাশাপাশি তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কার্যকলাপ ও উৎসব পালনে স্বাধীনতা প্রদানের কথাও বলেন।

মুফতি তারেকুজ্জামান বলেন, ইসলামের ওপর আক্রমণ আসতে আসতে এখন খোদ কুরআনের ওপর চলে এসেছে। কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় যে বিধান বলেছে, সেটাকেই এখন উগ্রবাদ ও উস্কানি বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এভাবে মুসলিমদের জীবনযাত্রায় পরাধীনতার শেকল দিন দিন কেবল দীর্ঘই হচ্ছে। পরিপূর্ণ পরাধীনতা ও কাফিরদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য করার আগ পর্যন্ত তারা এতে ক্ষান্ত হবে না। এজন্য বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম কখনো হিকমাহ ও বিচক্ষণতার অজুহাতে ইসলামকে কাটছাট করার পক্ষপাতী নন।

এই জটিল সময় ‍উত্তরণে তিনি বলেন, মূল ইসলামের ওপর কতটুকু আঘাত আসছে, আর সেটার প্রতিরোধে আমাদের করণীয় ও কর্মপন্থা কী, তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের উচিত, হকপন্থী আলিমদের শরণাপন্ন হয়ে এবং নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাদির সাহায্য নিয়ে দ্বীনের প্রকৃত বার্তা জেনে নেওয়া। শীঘ্রই হয়তো সেদিন সমাগত, যেদিন মুসলিমদের জন্য ইসলামের সঠিক বিধান জানাটা কষ্টকর, এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়বে। ইতিহাসে এর অনেক নজির গত হয়েছে। একসময় যেখানে কুরআন-হাদিসের আলোচনায় পরিবেশ সরগরম থাকতো, পরবর্তী সময়ে সেখানে এমন বিপর্যয় এসেছিল যে, ইসলামের মৌলিক বিধান জানাটাও অসম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। তাই সময় থাকতে আমাদের মুসলিম ভাইদের ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদা, দ্বীনের মৌলিক বিধান ও প্রয়োজনীয় মাসআলা জেনে নেওয়া উচিত।

মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসউদ লিখেন, ইসলামে মূর্তিপূজা সবচে বড় গুনাহের কাজ। কেননা এটি শিরক। সুতরাং কোন মুসলিম পূজাতে উইশ করতে পারে না। পূজা দেখার জন্য মন্দিরে যাবার অনুমতিও ইসলাম দেয় না। এটাই ইসলামের একেবারে মৌলিক ও সাফ কথা।

নোয়াখালির ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলামের একটি মৌলিক আকীদার কথা বলার কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হয়, তবে এটার চেয়ে বড় উস্কানীমূলক কাজ আর হতে পারে না। কেননা এর মাধ্যমে হাজারো মুসলিমকে উস্কিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা অতিউৎসাহী হয়ে এমন হীন কর্ম করেছে, এদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রবল প্রতিবাদ ও নিন্দাবাদ হওয়া উচিত। ইসলাম যেমন মুসলিমের জন্য পূজায় যাওয়া, পূজাতে শুভেচ্ছা জানানো কখনোই সমর্থন করে না, তেমনি অন্য ধর্মের যারা মূর্তিপূজা করে তাদের মূর্তি ভাঙ্গা বা পূজাকে বানচাল করার অনুমতিও দেয় না। হিন্দুরা তাদের মত নিজেদের ধর্ম পালন করুক। অযথা মুসলিমদের গ্রেফতার করে আমজনতাকে না ক্ষেপানোতেই দেশ ও দশের কল্যাণ।

 

 

আগের সংবাদ‘ঢাকার ৭৭ ভাগ স্কুল-শিক্ষার্থী পর্ন-এডিক্টেড, আমরা ঘুমিয়ে থাকতে পারি না’
পরবর্তি সংবাদ‘সব বিষয়েই পারদর্শিতা হোক’ : দারুর রাশাদ খুলছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়