পশ্চিম আফ্রিকা : ফ্রান্সের মানবতাবিরোধী অপরাধ

ভাষান্তর: মুহাম্মদ সাজিদ করিম

তারা এসেছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ করতে। শতাধিক মানুষ জড়ো হয়েছিল পশ্চিম আফ্রিকার মালির বোউনতি গ্রামের উপকণ্ঠে। কয়েকজন গাছের নিচে বসে চা খাচ্ছিল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের একজন, ৭১ বছর বয়সী মাদাব্বেল দিয়েলো বলেন, খাবার পরিবেশন করা হবে ঠিক এই সময় আকাশে আবির্ভূত হল ফরাসি যুদ্ধবিমানগুলো। কিছুক্ষণ পর দিয়েলো একটি বিকট আওয়াজ শুনলেন, এরপর আরেকটা। এরপরে শুধু মনে আছে উনি মাটিতে পড়ে আছেন আর তার ক্ষতবিক্ষত পা থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে। দেখলেন উনার আশেপাশে অনেক মানুষের হাত পা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একজনের নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে আসছে তার পেট থেকে। পাশের গ্রাম থেকে যারা সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল তারা দিয়েলোকে কাছের একটি শহরের ক্লিনিকে নিয়ে যায়।

জানুয়ারিতে এই হামলার অনেকদিন পর ফোনে কথা বলার সময়ও তিনি যেন আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। সেই হামলাতেই আহত হয়ে তার পাশের বিছানায় শুয়ে ছিলেন তার চাচাতো ভাই মামুদো দিয়েলো। তার তিন ভাতিজা এখন শুধুই স্মৃতি, `মানুষ টুকরো টুকরো হাত-পা-মাথাগুলো একসাথে জড়ো করে কবর দিয়ে দিয়েছিল।’

ফরাসি সরকারের মিথ্যাচার

বোউনতিতে ফরাসি হামলায় ২২ জন নিহত হন। ফরাসি সরকার জোর গলায় দাবি করছে যে, নিহতরা সবাই জঙ্গি ছিল, যাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্স মালিতে যুদ্ধ করছে। কিন্তু মাদাব্বেল আর মামুদো-সহ বোউনতির ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শী, ‘ডের শ্পীগেল’ যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তারা বলেছে ঘটনা পুরোটাই ভিন্ন। সেখানে কেউই সশস্ত্র ইসলামপন্থী দলের সদস্য ছিল না।

বোউনতির একজন কৃষক আলিও বারী বলেন, `কারো কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। একটা চাকুও না। আমরা একটা বিয়ে উদযাপন করছিলাম আর তারা বিমানে করে এসে আমাদের উপর বোমা ফেলে গেল।’

মালিতে অবস্থিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের তদন্তকারীদেরও মত একই। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যদিও নিহতদের ভেতর তিনজনের সম্পর্ক ছিল সশস্ত্র ইসলামপন্থী দল ‘কাতিবা সেরমা’র সাথে, বাকি হতাহতদের সবাই ছিল সাধারণ মানুষ।

ফরাসি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ফ্র্যাংকো লেকোয়েন্ত্রে বলেছেন, ড্রোন ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে যে তার সৈন্যরা একেবারে নির্দোষ। কিন্তু তার বাহিনী সামরিক নিরাপত্তার অজুহাতে সেই ড্রোন ফুটেজ কাউকে দেখাতে নারাজ।

বোউনতির ঘটনা এমন একটা সংঘাতকে সামনে নিয়ে এসেছে যা সবার অলক্ষ্যে দূর সাহারায় সংঘটিত হচ্ছে। প্রায় আট বছর ধরে ফরাসি সৈন্যরা মালিতে অবস্থান করছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে উত্তর মালিতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী দলগুলো দমনের নাম করে এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে তা ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা যুদ্ধগুলোর একটি হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে।

ফ্রান্স ‘অপারেশন বারখানে’র অংশ হিসেবে মালি এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পাঁচ হাজারেরও বেশি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। তাদের জোরদার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সশস্ত্র ইসলামপন্থীরা পুরো সাহেল জুড়ে, বিশেষ করে মালি, বুর্কিনা ফাসো এবং নিজারে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রো জার্মানিসহ অন্য দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের নির্মূল করতে আরো বেশি সক্রিয় হবার জন্য। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর জার্মান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় বিদেশি মিশন এখন মালিতে। সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ না করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জার্মানরা বর্তমানে মালির সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

ফরাসি সরকার চায় মালিতে ইসলামপন্থীদের অগ্রযাত্রা এবং সাহেল থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা বন্ধ করতে। কিন্তু যখনই অপারেশনের তথ্য ও স্বচ্ছতার বিষয় আসে, ফরাসি সরকার মুখ খুলতে নারাজ। এমনকি তাঁদের এই মিশনের সহযোগী দেশগুলোকেও তারা যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে না।

ডের শ্পীগেল এবং একটি অনলাইন পোর্টাল ‘দি নিউ হিউম্যানিটারিয়ান’ মাসের পর মাস অনুসন্ধান করেছে বারখানে মিশন-এর ব্যাপারে। রিপোর্টাররা বেশ কয়েক দফা মালিতে গিয়ে টহলে সৈন্যদের সাথে ঘুরেছেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং অভ্যন্তরীণ ডকুমেন্টগুলোও পড়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ফরাসি সৈন্যরা এবং তাদের সহযোগী মালির সেনাবাহিনী সম্ভবত আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেমন আফগানিস্তান, মালি ঠিক তাই হতে চলেছে ফ্রান্সের জন্য। একটি অনন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যাতে বারবার অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ দিলেও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সশস্ত্র সংঘাতগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন একটি এনজিও ACLED এর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন পক্ষের আক্রমণে প্রায় ৮ হাজার সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।

সরকারের প্রতি ক্ষোভ

এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় উত্তর-পূর্ব মালির একটি শহর, ‘গসি’তে মালি সেনাবাহিনীর সাথে সাথে ফরাসি সেনারাও টহল দিচ্ছিল। পরনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং রাইফেলসহ তারা গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করছিল। এক তরুণ ফরাসি অফিসার বেঞ্জামিন বলছিলেন, ‘আমরা আমাদের শক্তিমত্তা দেখাতে চাই।’ এক কিশোর ভয়ে ভয়ে তার সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে থামিয়ে ফরাসি ভাষায় বেঞ্জামিন জিজ্ঞেস করল, ‘ভয় পাচ্ছ কেন? কী সমস্যা?’ মালির সৈন্যরা দেশের ভিন্ন প্রান্ত থেকে আসায় তারাও তার কথা বুঝতে পারছিল না। এক স্থানীয় ব্যক্তি দৌড়ে এসে সুপারিশ করায় তার মোবাইল চেক করে ছেড়ে দেয়া হলো।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বারখানে অপারেশনের অংশ হিসেবে ফরাসি সৈন্যদেরকে ৩ থেকে ৪ মাসের জন্য মালিতে পাঠানো হয়। তাদের অনেকেই বয়সে তরুণ এবং তারা প্রায়ই পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।

ফ্রান্স তার সাঁজোয়া যান, যুদ্ধবিমান আর ড্রোনে তাদের প্রতিপক্ষ থেকে সামরিকভাবে অনেক এগিয়ে। কিন্তু নিয়মিত যুদ্ধের বাস্তবতায় এগুলোই সবকিছু নয়। আফগানিস্তানে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের মত, ফ্রান্সও নিয়মিত সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছে কিন্তু এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে না। এই সশস্ত্র ইসলামপন্থী দলগুলো, যারা সাহেলের অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের অনেকের সাথে আল কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা জনগণের ভেতরে একেবারে শিকড় গেড়ে বসেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি মালির জনগণের ক্ষোভকে তারা কাজে লাগাতে পারছে।

মালির কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দুর্বল এবং দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কুখ্যাতি রয়েছে। নয় মাসে দ্বিতীয়বারের মতো মালির সেনাবাহিনী সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে। এখন মালির ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কর্নেল আসিমি গৈতার হাতে।

অপরদিকে মালিতে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে ফ্রান্স এবং জার্মানিতে ক্ষোভ বাড়ছে। বেশকিছু জার্মান রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করেছেন, জার্মান সৈন্যদের মালি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল চান এই মিশন চলমান থাকুক,‘আমরা বিশ্বাস করি যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও আমাদের অবস্থান প্রয়োজন।’

ক্ষমতাসীনদের অনুরোধে ফ্রান্স মালিতে জড়িয়ে পড়ে ২০১৩ সালে, যখন সশস্ত্র ইসলামপন্থীরা উত্তর মালি দখল করে ধীরে ধীরে রাজধানী বামাকোর দিকে এগোচ্ছিল। বলা হয়েছিল ফরাসিরা শুধু কিছু সপ্তাহের জন্য মালিতে অবস্থান করবে। কিন্তু যতদিন গেছে, তারা এই সংঘাতের আরো গভীরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে। সেই সাথে দীর্ঘ হয়েছে লাশের সারি। যুদ্ধ শুরুর পর পঞ্চাশেরও বেশি ফরাসি সৈন্য নিহত হয়েছে। কিন্তু এ সংখ্যার সাথে মালির জনগণের হতাহতের সংখ্যার তুলনাও হবে না।

ঈদ্রিসা মাইগা, মধ্য মালির এক কৃষক, ২০১৩ সালে তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে হারিয়েছেন। তিনি দাবি করেন তারা প্রাণ হারিয়েছে ফ্রান্সের চালানো রকেট হামলায়। তিনি ক্ষতিপূরণের জন্য গণমাধ্যম, সরকার এমনকি ফ্রান্সেও চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সবাই তাকে একটাই জবাব দিয়েছে, কোন সাধারন মানুষ মারার পেছনে ফ্রান্সের হাত নেই।

ফ্রান্সের সরকার তার সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে সাধারণ মানুষের হতাহতের ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কেবল সাতজন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে মালি থেকে পাওয়া রিপোর্ট বলে প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। জার্মানির মত মালিতে অবস্থানরত দেশগুলোর জন্যও এ ব্যাপারে তদন্ত করা বেশ কঠিন।

যেহেতু মালিতে ফ্রান্স অনেকটা স্বাধীনভাবে অপারেশন পরিচালনা করছে, তাই সে শান্তিরক্ষা মিশনের অন্যান্য দেশগুলোর নিকট জবাবদিহি করে না। জার্মান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বোউনতির ঘটনায় তাদের কাছে ‘নিজস্ব কোন তথ্য’ নেই।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছে, এ ঘটনার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। জার্মান এমপি এবং মালিতে অবস্থানরত জার্মান অফিসারদের সাথে সাম্প্রতিক এক ভিডিও চ্যাটে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন, ‘একটা ন্যূনতম নিরাপত্তার স্বার্থে বারখানের মত একটি শক্তিশালী মিশনকে চলমান রাখতে হবে যদিও আমাদের দেশের অনেকে তা অপছন্দ করেন।’

ফরাসি বাহিনী তার হাতে বেসামরিক জনগণের হতাহতের ঘটনা যে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করছে সে বিষয়ে প্রমাণ রয়েছে। ডের শ্পীগেলের হাতে পড়া একটি অভ্যন্তরীণ ‘বারখানে’ ডকুমেন্টে দেখা যায়, ফরাসি সৈন্যরা মধ্য মালির একটি গ্রামে এক মোটরসাইকেল আরোহীকে আত্মঘাতী হামলাকারী ভেবে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। এ ঘটনায় জড়িত সৈন্যদের কোনরূপ জবাবদিহির সম্মুখীন না করে শোকাহত পরিবারকে টাকা দিয়ে বিষয়টা চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মালি সরকারের উপদেষ্টা এবং নৃতত্ত্ববিদ ব্রেমে এলি ডিকো সতর্ক করেছেন, এ ধরনের যুদ্ধাপরাধগুলোর ব্যাপারে ঠিক মতো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের দলভারি হচ্ছে।

ফ্রান্স মালির সেনাবাহিনীকে তাদের অপারেশনে আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে তারা মালির ১৮ হাজার সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এতকিছুর পরও মালির সশস্ত্র বাহিনী এখনো দুর্বল এবং বিশৃঙ্খল রয়ে গেছে, যারা সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছে না। এ সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন পর্যবেক্ষকরা। ফরাসি এবং জার্মান প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করে, তারাও চায় তাদের স্থানীয় সহযোগী বাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের আরো সম্পর্ক গড়ে উঠুক।

‘গসি’ শহরের বারখানে কমান্ডার সার্গে কামুস বলেন, ‘আমরা তাদের বোঝাই যে আপনারা কয়লা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে পারবেন না।’ এরপরও গত বছর সাহেলে সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের হাতে নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে।

বুর্কিনা ফাসোর সীমান্তের বুলকেসি গ্রামে মালির সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি রয়েছে যার প্রতিরক্ষা-ব্যূহ নিশ্চিত করেছে ফরাসি সেনাবাহিনী। অথচ মালির অন্য যেকোন এলাকার তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন এই এলাকার আশেপাশে; স্বয়ং সেনাবাহিনীর হাতে। ACLED এর দেয়া তথ্য অনুসারে, গত তিন বছরে এখানে ১৫৩ জন বেসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন।

বুলকেসির এক তরুণ, তিদিয়ানি দিয়ালো, দাবি করেন ২০১৮ সালে তিনি দেখেছেন মালির সৈন্যদের তার গ্রাম আক্রমণ করতে। তাদের দাবি ছিল তারা তাদের এক সহযোদ্ধার নিহত হবার প্রতিশোধ নিতে এসেছে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং গ্রাম্য নেতা ও ইমামকে ধরে নিয়ে যায়। সেইসাথে হুঁশিয়ার করে দিয়ে যায়, ‘আমরা তোমাদের বলেছিলাম, যদি আমাদের একজন মারা যায়, আমরা তোমাদের বিশ জনকে খুন করবো।’

রক্ষক বনাম দখলদার

গত জানুয়ারিতে ফরাসি আর মালির সৈন্যরা বুলকেসির নিকটবর্তী এক গ্রামে যৌথ অভিযান চালিয়েছিল। জঙ্গিদের খোঁজে অনেকগুলো বাড়ি সার্চ করে চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, মালির সৈন্যরা লোকগুলোকে চালের বস্তার মতো ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলছিল। একদিন পর তাদের দুইজনের লাশ রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুই সপ্তাহ কাস্টোডিতে রাখার পর তৃতীয় জনকে ছেড়ে দেয়া হয় আর অপরজন এখনো গায়েব। এ ঘটনার পর বুলকেসির অধিবাসীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।

মালিতে ফ্রান্সের কর্মকাণ্ডের অন্ধকার দিকগুলো মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধগুলোর জন্য খুব কমই মালির সেনাবাহিনীকে কোন জবাবদিহি করতে হয়। দিনকে দিন মালির জনগণের এক বড় অংশ এই সামরিক অভিযানের ব্যাপারে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। এ বছরের শুরুতে রাজধানী বামাকোতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে আর ফরাসি সৈন্যদের রক্ষক হিসেবে দেখেন না; দেখেন দখলদার বাহিনী হিসেবে।

মনে হচ্ছে ফরাসি রাষ্ট্রপতি সেখানে সৈন্য সংখ্যা কমানোর একটি উপায় খুঁজছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ম্যাক্রোকে বারবার ফরাসি সৈন্যদের কফিনের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থানের পর এই মিশনকে রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দেয়া কঠিন হয়ে গেছে। এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি অবশেষে এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন যে, তিনি এমন কোন সরকারকে সমর্থন করবেন না, যা গণতান্ত্রিক নয়।

[জার্মান ডের শ্পীগেল ম্যাগজিনে গত ০৫ জুন, ২০২১ সংখ্যায় এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশিত হয়।]

আগের সংবাদমুসলিম জ্ঞানশাখাসমূহে ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহর অবদান : একটি সাধারণ অনুসন্ধান
পরবর্তি সংবাদশিল্প ও সুফ সুফি তাসাউফ