পাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃতি: আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরা বিরক্ত-বিব্রত

রাকিবুল হাসান নাঈম:

নতুন কারিকুলামে রচিত হওয়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বইগুলোতে মুসলিম ইতিহাসকে শুধু এড়ি্য়েই যাওয়া হয়নি, বরং মুসলিম ইতিহাসের প্রতি করা হয়েছে এক ধরণের বিষোদগার। বাংলায় প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনকে অভিহিত করা হয়েছে ‘বিদেশীদের শাসন’ বলে। মুসলিম বিজেতা বখতিয়ার খিলজীকে বলা হয়েছে দখলদার। পাঠ্যবইয়ে মুসলিম ইতিহাসের এই বিকৃতি নিয়ে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরা বিরক্ত-বিব্রত। তারা বলছেন, বইগুলো পড়লে মনে হবে, এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানের কোনো সংযোগই ছিল না। হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিতে বইগুলো লেখা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

দেখা গেছে, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর বইগুলোর বিভিন্ন অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কথা আনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে। শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুপস্থিত। কোথাও কোন উল্লেখ নেই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে আলেমগণের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের। অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণীর বইতে বারবার কলকাতাকেন্দ্রিক বেঙ্গল রেনেসাঁ (নবজাগরণ), স্বদেশী আন্দোলন এবং ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা এসেছে।

হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিতে লেখা হয়েছে মুসলিম ইতিহাস

হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিতে মুসলিম ইতিহাস লেখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পঞ্চগড় নূরুল আলা নূর কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ্য আলহাজ্ব মাওলানা ড. মোঃ আবদুর রহমান। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘বইগুলো পড়লে মনে হবে, এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানের কোনো সংযোগই ছিল না। মনে হয়, এদেশের মুসলমানদের শেকড় হিন্দুভূমি ও শাসন থেকে এসেছে। বইগুলো আমি ঘেঁটে দেখেছি। বইগুলোতে যেসব ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো দেখে মনে হয়, এদেশে কোনো মুসলিম ঐতিহ্য নেই। নাস্তিকরা সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য এসব কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। কারণ, প্রধানমন্ত্রীকে আমি দেখেছি, মুসলিম ইতিহাসের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। তিনি মুসলিম ইতিহাস পড়েন এবং পড়েছেন।’

ড. মোঃ আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘এনসিটিবির এক মিটিংয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামি ইতিহাস বাদ দেয়ার প্রস্তাব আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দেননি। তিনি বলেছেন, আমি মুসলিম ইতিহাস পড়েছি। আমরা মুসলিম। মুসলিম ইতিহাস বাদ যাবে না। সে মিটিংয়ে আমিও ছিলাম। ইসলামি ইতিহাস যেহেতু তারা বাদ দিতে পারেনি, তাই মুসলিম ইতিহাসটাকে বিকৃত করে দিয়েছে। এতে সরকার যেমন বিব্রত, তেমনি আমরাও বিব্রত।’

একই কথা বলেন জামেয়া-ই-আহমাদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা ষোলশহরের সাবেক অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা আছিয়র রহমান। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস লেখা হয়েছে মুসলিম শাসনামলের, তা বিকৃত। এগুলো শুধু সংশোধন নয়, পরিবর্তন করে নতুন করে সাজাতে হবে। এখানে হিন্দুদের দৃষ্টিতে মুসলিম ইতিহাসকে দেখা হয়েছে। এতে আমরা যেমন বিব্রত, ছাত্র এবং অভিভাবকরাও বিব্রত। যে চক্রটি এই কাজ করেছে, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তারা জাতির সঙ্গে গাদ্দারি করেছে। দেশের মুসলমানদের অজান্তে তাদের পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ইতিহাস বিকৃত করে দিয়েছে।’

এনসিটিবি শুনেনি শিক্ষকদের পরামর্শ

এ প্রসঙ্গে কথা হয় দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ.খ.ম. আবুবকর সিদ্দীকের সঙ্গে। পাঠ্যপুস্তক ইস্যুতে শুরু থেকেই দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে চলছেন তিনি। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘যখন কারিকুলাম তৈরী হয়, তখন একদিনের একটি মিটিং হয়েছিল। এনসিটিবি আমাদের সামনে যে রূপরেখা তুলে ধরেছিল, তাতে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। সমর্থন দেইনি। সেদিন বিষয়টি মিমাংসা হয়নি। পরে তিনদিনের আরেকটি মিটিং হয়। কিন্তু আমরা আমাদের অবস্থান থেকে নড়িনি। এই তিনদিনেও যখন বিষয়টি সুরাহা হয়নি, তখন পরে আবার তিনদিনের মিটিং হয়। কিন্তু আমাদের একটাই কথা ছিল, এই কারিকুলামের সঙ্গে আমরা একমত না। আমরা আমাদের দাবিতে অটল ছিলাম। তাই পরের তিনদিনেও কোনো সমাধান হয়নি। আমাদেরকে তখন জানানো হয়, পরে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা করা হবে। কিন্তু তারপর আর আমাদেরকে আপডেট দেয়া হয়নি বা ডাকা হয়নি। পরে শুনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়ে গেছে আমাদের না জানিয়েই।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরে যখন পাইলট কার্যক্রমের জন্য বইগুলো দেয়া হয়, তখন আমরা আবার এর বিরোধিতা করি। আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার সামনে আপত্তি তুলে ধরি পয়েন্ট আকারে। তিনি তখন বলেন, আমাদের আপত্তি নিরসন করেই বই ছাপা হচ্ছে। কিন্তু আমরা গোপনে খবর নিয়ে দেখি, শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ না মেনে এবং আপত্তিকর বিষয় পরিবর্তন না করেই বই ছাপা হচ্ছে। যখন বই ছাপা হলো, তখন আমরা ভাবলাম, কোথাও যখন কাজ হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলাম আমরা। তিনি মন দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন। আমরা তাকে আবেদন করলাম, বইগুলো যেন বাতিল করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বললেন, এত বই ছাপা হয়েছে। বাতিল তো এক আদেশে করতে পারবো না। তবে সামনে পরিবর্তন করা হবে। আপনি সবাইকে বলেন, আমি বিষয়টি দেখছি। এরপরই দেখা গেছে এনসিটিবি ও শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছ। কমিটি করেছে। এটা করেছে প্রধানমন্ত্রীর আদেশে।’

সর্বশেষ উদ্যোগ কী জানতে চাইলে দারুন নাজাতের অধ্যক্ষ বলেন, ‘এখন শুনেছি সংশোধন কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরকে রাখা হয়েছে। আমরা তার কাছে যাব। তাকেও বিষয়গুলো বোঝাবো। আমাদের সব করতে হয় নিয়মতান্ত্রীকভাবে। আশা করি, নিয়মতান্ত্রীকভাবে চেষ্টা করে সফল হবো। কারণ, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির পেছনে যে চক্রটি কাজ করছে, তারাও কিন্তু কম শক্তিশালী না। তাই চাইলেই হুট করে কিছু হয়ে যাবে না। সময় লাগবে। আমরা দোআ করছি।’

আমূল পরিবর্তন চান শিক্ষকরা

শুধু আপত্তিকর বিষয়গুলোর পরিবর্তন নয়, পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন চান শিক্ষকরা। দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ.খ.ম. আবুবকর সিদ্দীক বলেন, ‘আমরা শুধু কয়েক লাইনের পরিবর্তন চাই না। আমরা পুরো ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছি। দাবি জানাচ্ছি। সবারই এখন সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে। ইস্যুর তলে বিষয়টি হারিয়ে গেলে পরিবর্তন হবে না।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় সিলেটের শাহজালাল ইয়াকুবিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা কমর উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘আমরা পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বিব্রত। একটি মুসলিম দেশে মুসলিম ইতিহাস বিকৃত করে পড়ানোর জন্য দেয়া হয়েছে। এটা তো অযৌক্তিক। আমরা পুরো বইয়ের পরিবর্তন চাই, মাত্র কয়েক লাইনের পরিবর্তন চাই না। শুধু মাদরাসার জন্য নয়, স্কুলের জন্যও।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব এবং শ্রীপুর ভাংনাহাটি রহমানিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজীর সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘আমরা টিম গঠন করেছি। পাঠ্যবইগুলো একেকজনকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। লাইন বাই লাইন পড়ে আমরা নোট করছি। শিক্ষামন্ত্রী যেহেতু বলেছেন আপত্তিগুলো পয়েন্ট করে বলে দিতে, তাই করছি। বই যাচাই শেষ হয়ে গেলে আমরা আমাদের বিস্তারিত আপত্তি শিক্ষামন্ত্রণালয়ে জমা দিব। আমরা চাই পুরো পরিবর্তন। কেবল কয়েক লাইনের পরিবর্তন চাই না।’

আগের সংবাদট্রান্সজেন্ডার হওয়া জন্মগত বিষয় নয়: এর বায়োলজিক্যাল ভিত্তি নেই
পরবর্তি সংবাদআবারও বিদ্যুতের দাম বাড়লো