পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিদ্বেষ: ভুল স্বীকার করে যা বলছে এনসিটিবি

রাকিবুল হাসান নাঈম:

২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে যে পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান শুরু হয়েছে, তাতে ইসলামবিদ্বেষ এবং মুসলিম ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি স্বীকার করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, এ বছর যে বইগুলো দেয়া হয়েছে, সেগুলো পরীক্ষামূলক সংস্করণ। সারাদেশে বইবিতরণ শেষ হলে সবার মতামত নেয়া শুরু হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে বইগুলো সংস্করণ করে আগামী শিক্ষাবর্ষে পরিমার্জিত একটি সংস্করণ দেয়া হবে। যে ভুলগুলো হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে দুঃখও প্রকাশ করেছেন সদস্যরা।

আলেমরা বলছেন, এসব পাঠ্যপুস্তকে যেমন মুসলিম ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, তেমনি শিশুদের মনে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিকৃত মানসিকতা। শিশুরা এসব বই পড়ে ভালো মানসিকতা শেখার বদলে শিখবে ইসলাম বিদ্বেষ, ধর্মহীন জীবন যাপন। এই দুই শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে মূলত তিনটি আপত্তিকর বিষয় বেশ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে—১. ইসলামবিদ্বেষ, ২. মুসলিম ইতিহাসের বিকৃত বয়ান, ৩. যৌন বিকৃতি স্বাভাবিকীকরণ।

‘এটা ঠিক হয়নি’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় এনসিটিবির উচ্চ মাধ্যমিক শাখার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মোঃ মোসলে উদ্দিন সরকারের সঙ্গে। নতুন পাঠ্যপুস্তকের প্রসঙ্গ তুলতেই ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘নতুন পাঠ্যপুস্তকে আগের পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলোই সংক্ষেপ করা হয়েছে। আর কিছু করা হয়নি। বইগুলো পড়লে দেখবেন, তাতে নতুন কিছু যুক্ত করা হয়নি।’

বইগুলোতে আগের বিষয়গুলো সংক্ষেপ করা হয়েছে এমন নয়। কোনো কোনো বইতে সেটা করা হয়ে থাকতে পারে। তবে নতুন পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিদ্বেষ এবং মুসলিম ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। বিভিন্ন বইয়ের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরার পর এনসিটিবির এই কর্মকর্তা বললেন, ‘আমি টেক্সট বুক রচনা কমিটিতে ছিলাম না। তাই অত বিস্তারিত বলতে পারবো না। তবে যে ভুলগুলো করা হয়েছে, কয়েকজন থেকেই শুনেছি, সেগুলো করা আসলেই ভুল ছিল। এটা ঠিক হয়নি।’

এনসিটিবির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই বইগুলো আমাদের পরীক্ষামূলক সংস্করণ। সারাদেশে বই বিতরণ শেষ হলে আমরা মতামত নেয়া শুরু করব। লেখক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, আলেম এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের থেকে অভিমত নেব। তারপর প্রত্যেকের মতামতের ভিত্তিতে বইগুলো সংস্কার করা হবে।’

প্রতিবেদককে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার পরামর্শও দেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে বিব্রত চেয়ারম্যান

মুঠোফোনে কথা হয় এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ ফরহাদুল ইসলামের সঙ্গে। পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিদ্বেষ এবং মুসলিম ইতিহাস বিকৃতির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমি এখন সরাসরি টেক্সট বুক রচনায় নেই। ২০২২ সালের মে পর্যন্ত আমি পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। তারপর চেয়ারম্যান পদে এসেছি। এখানে আমার মূল দায়িত্ব হলো, বইগুলো সমন্বয় করে প্রকাশ করা এবং বিতরণ করা। আর আমি যেহেতু চেয়ারম্যান, আমি দায় এড়াতে পারবো না। অভিযোগগুলো শুনেছি। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি।’

তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্যারেক্টার সবাইকে মেনে চলতে হয়। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে—বই হতে হবে নির্ভুল। কোনো ধর্মকে আঘাত করা যাবে না। কোনো গোত্রকে আঘাত করা যাবে না। কিন্তু নতুন পাঠ্যপুস্তকে যা করা হয়েছে, তা নিয়ে আমরা আসলেই বিব্রত। আমি চেয়ারম্যান একা তো এতগুলো বই পড়ে দেখতে পারবো না। দেখতে পারিওনি।

ইতিহাস বইয়ে ভুল কেন?

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাসের বইগুলোতে মুসলিম ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বই রচনায় বিষয়টি কিভাবে ঘটেছে জানতে চাইলাম। এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এনসিটিবিতে প্রতিটি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কোনো বিষয়ে বই রচনার জন্য ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। প্রধানের দায়িত্ব বই লেখা না। তার দায়িত্ব কমিটির অন্য সবাইকে দিয়ে বই লেখানো। কে কেমন লিখছে, এনসিটিবির ক্যারেক্টার ফলো করছে কিনা, লেখাটা আসলেই হচ্ছে কিনা, এসব তদারকি করা প্রধানের দায়িত্ব।’

চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইতিহাস বিষয়ে বই রচনার কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলমকে রাখা হয় প্রধান হিসেবে। কথা ছিল তিনি পুরো বিষয়টি তদারকি করবেন। কিন্তু তিনি সময়ই দেননি। তাকে ছাড়াই বই রচনা করা হয়। পরে নভেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী বললেন, তাকে যেন কমিটিতে আবার যুক্ত করি। তিনি যেন রিভিউ করে দেন। তখন আবার এই অধ্যাপক কমিটিতে যুক্ত হন। তিনি কিছু বিষয় রিভিউ করেন। পুরো বই রিভিউ করতে পারেননি। তাই ভুলগুলো ধরা পড়েনি।’

‘পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে কাউকে হেয় করা উচিত নয়’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলমের সঙ্গে। তার মতে, পাঠ্যপুস্তকে বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তা সঠিক। তাবকাতে নিসিরির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি তার দাবির পক্ষে কথা বলেন।

তবে মুসলিম ইতিহাসকে খারাপভাবে উপস্থাপনের প্রসঙ্গে তিনি ফাতেহকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, তা নৈর্ব্যক্তিক হওয়া উচিত। সেখানে কোনো ধর্মকে হেয় করা উচিত না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই চর্চাটা নেই। আপনি যদি বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন, কোথাও ইসলামকে হেয় করা হয়েছে, কোথাও হিন্দু ধর্মকে হেয় করা হয়েছে। ভারতের ইতিহাস পড়বেন, সেখানে ইসলামকে হেয় করা হয়েছে। আমার মতে, ইতিহাস হওয়া উচিত তথ্যভিত্তিক। তথ্যগুলো নিতে হবে মূল উৎসগ্রন্থ থেকে। সেখানে অন্যকিছু দিয়ে জাজমেন্ট করা উচিত না।’

নতুন পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ইতিহাস যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে মুসলিমদের হেয় করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে এই বইগুলো অনেক আগের লেখা। আমি কমিটিতে ছিলাম। আমার সঙ্গে আরও ছয়জন ছিলেন। একটু একটু করে আমরা সংস্কার করছি। এখন নতুন কোনো সংস্কারের দরকার হলে সেটা এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। আমি কিছু বলতে পারবো না।’

পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের আশ্বাস

তবে এই বইগুলো পরীক্ষামূলক সংস্করণ বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ ফরহাদুল ইসলাম। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘যখনই নতুন শিক্ষা কারিকুলাম আসে, তখনই আমরা প্রথম বছর পরীক্ষামূলক সংস্করণ ছাপি। যেমন ১৯৯৫ সালের নতুন কারিকুলামের সময় এবং ২০১২ সালের নতুন কারিকুলামের সময়ও আমরা এমন করেছি। এবার যেহেতু নতুন কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে, বইগুলোর পরীক্ষামূলক সংস্করণ ছাপা হয়েছে। আশা করছি, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে বইগুলো আমরা সারাদেশে পৌঁছে দিতে পারবো। কাগজ সংকটে বইগুলো এবার ছাপাতে দেরী হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মার্চ থেকেই আমরা মতামত নেয়া শুরু করব। লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং আলেমদের মতামত নিয়ে বইগুলো আবার পূর্ণ সংস্কার করা হবে। কোনো বই যদি নতুন করে তৈরী করতে হয়, তাও করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী সে নির্দেশনা দিয়েছেন। সবার মতামত নিয়ে আমি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবো। ইনশাআল্লাহ, নতুন সংস্করণে এসব অভিযোগ আশা করি থাকবে না। আগামী বছর হবে বইগুলোর প্রথম সংস্করণ।‘

আগের সংবাদতিনদিন পার হলেও খোঁজ মেলেনি মাহমূদ জাফরের
পরবর্তি সংবাদপটিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা রফিক আহমদের ইন্তিকাল