রাকিবুল হাসান নাঈম:
বাংলা জয়ের সময় কয়েকটি বিহার ধ্বংস করেছিলেন বলে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অভিযোগ তোলা হয়েছে মুসলিম বিজেতা বখতিয়ার খিলজির বিরুদ্ধে। পুস্তক রচনা কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলমের মতে, পাঠ্যপুস্তকে বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তা সঠিক। তবাকাত-ই-নাসিরিতে বিহার ধ্বংসের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই বইতে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে মুসলিম এই বিজেতার উপর আরোপিত অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন আলেম লেখক ও গবেষক কবি মুসা আল হাফিজ। তার মতে, বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক বিবরণ পাঠ্য বইয়ে দেওয়া হয়েছে তা অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। লেখকরা দাবি করেছেন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি অনেকগুলো লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন। বস্তুত একটি লাইব্রেরিও ধ্বংসের ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। অনেকটা মনগড়া, নিজস্ব মতামত পাঠ্যপুস্তকে ঢুকানো হয়েছে । যা অনভিপ্রেত।
তবকাতে নাসিরির ভুল ব্যাখ্যা
মাওলানা মুসা আল হাফিজ ফাতেহকে বলেন, ‘জনাব আকসাদুল আলম তবাকাত-ই-নাসিরিতে বখতিয়ারের কয়েকটি বিহার ধ্বংসের যে তথ্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক নয়। কারণ, ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন আবু ওমর বিন সিরাজউদ্দীন জুরজানীর তবাকাত-ই-নাসিরিতে রয়েছে বখতিয়ারের সৈন্যদের কিল্লায়ে বিহারে ভুলক্রমে আক্রমণের কথা। কিল্লায়ে বিহার মানে বিহারের সেনানিবাস। এই কথাটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন সেটা মূলত ছিলো ওদন্তপুরী মঠ। তিনি ওদন্তপুরীকে শত্রুদের সেনাশিবির মনে করেন।
ঐতিহাসিক প্রমাণ তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ওদন্তপুরী মঠকে সেনাশিবির মনে করার কারণ ছিলো। লামাতারানাথ দেখিয়েছেন তখনকার বৌদ্ধ মঠগুলো সেনাশিবিরের আদলে বানানো হতো। আমরা যদি কুমিল্লায় বিহারটা লক্ষ্য করি, এর প্রমাণ পাবো। ড. সুশীলা মণ্ডলের মতে, ওদন্তপুর ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরস্থিত আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহার রাজা গোবিন্দপাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য খিলজি রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্র ধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন এবং গোবিন্দ পাল দেব নিহত হন।‘ তবকাতে নাসিরির অনুবাদক আবুল কালাম যাকারিয়ার মতে, লড়াই সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচণ্ড প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিয়েছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনাদের যৌথ প্রতিরোধের বিবরণ। মঠের ভেতরে প্রবেশ করতে প্রতিরোধের সম্মুখিন হন বখতিয়ার। ফলে যুদ্ধ হয়। তিনি জয়ী হন এবং ভেতরে প্রবেশ করে যখন দেখলেন বহু গ্রন্থ। তখন এর পাঠোদ্ধার করে বুঝতে পারলেন এটি জ্ঞানাগার, সেনানিবাস নয়। তিনি ভুল বুঝতে পারলেন। গ্রন্থ তিনি ধ্বংস করেছিলেন, এর কোনো বিবরণ তাবাকাতে নেই। কোনো গ্রন্থের একটি পাতাও ছেঁড়া হয়েছে, এমন প্রমাণ কোথাও নেই। ’
গবেষক মুসা আর হাফিজের মতে, ওদন্তপুরী আক্রমণও সংশয়পরিকীর্ণ। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে ১১৯১-৯৩ সময়কালে। কিন্তু বখতিয়ারের বঙ্গজয় এর পরের ঘটনা।
তাবকাতে নাসিরির প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) লিখেছেন, ‘খিলজির বাংলা জয় প্রশ্নে যত কাহিনী ও মতবাদ বাজারে চাউর আছে, সবই মিনহাজের ভাষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই।’ বখতিয়ারের বাংলা জয়ের ৪০ বছর পরে মিনহাজুস সিরাজ বাংলা সফর করেন এবং এ সম্পর্কে প্রচলিত মৌখিক বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করেন। রিচার্ড এম ইটন (১৯৬১-২০১৩) লিখেন, ১২০৪ সালে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা হচ্ছে মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি। ফলে সে বইটাকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন ভালো বিষয়। কিন্তু বইয়ে যা নেই, তা বইয়ে আছে বলে দাবি করাটা বিভ্রান্তিকর। বইয়ে লাইব্রেরি ধ্বংসের কোনো তথ্য নেই।
নালন্দা নিয়ে মিথ্যাচার
ড. আকসাদুল আলম বাংলাপিডিয়ায় লিখেছেন, নালন্দা তুর্কিদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কবি মুসা আল হাফিজ ফাতেহকে বলেন, ড. সাহেব বিজ্ঞ মানুষ । তিনি কীসের ভিত্তিতে দাবি করছেন নালন্দা বিদ্যাগারে তুর্কিরা আক্রমণ করেছিলো? এর ঐতিহাসিক ভিত্তিটা কী? এটা তো অনুমান ও গুজব মাত্র।
নালন্দায় তুর্কি আক্রমণ অপ্রমাণিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাবাকাতে নাসিরিতে নালন্দার কথা নেই। আছে ’কিল্লা -ই-বিহার’ এর কথা। যার মানে বিহারের কেল্লা, সেনাশিবির। বস্তুত তাবাকাতের ভাষ্যে হিসার বা দুর্গে আক্রমণের কথা আছে। কিন্তু সেখানে গ্রন্থ ও নেড়ে মাথার ব্রাক্ষণ এর বিবরণ থেকে ধারণা করা হয় এটা দুর্গ ছিলো না, এ ছিলো ওদন্তপুরী মঠ, যাকে দেখতে দুর্গ মনে হতো । এটি নালন্দা থেকে ১০ কি.মি. দূরে। নালন্দা বিদ্যালয়কে মিনহাজুস সিরাজ যেমন কিল্লায়ে বিহার বলবেন না, তেমনি বখতিয়ারও একে কেল্লা মনে করবেন না। কারণ এটি বিদ্যালয় হিসেবে ছিলো পরিচিত, বিখ্যাত।
কবি মুসা আল হাফিজ আরও বলেন, নালন্দায় তুর্কি আক্রমণ যখন অপ্রমাণিত, তবুও তিনি বাংলাপিডিয়ায় সে আক্রমণের জন্য তুর্কিদের দায়ী করলেন। অথচ এর আগেও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকবার আক্রান্ত হয় বহিরাগতদের দ্বারা। চরম বৌদ্ধবৈরী মিহিরাকুলের দ্বারা আক্রান্ত হয় স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)। ঘটে গণহত্যা। স্কন্দগুপ্ত ও তার স্থলবর্তীদের হাতে নালন্দা ঘুরে দাঁড়ালেও রাজা শশাঙ্ক মগধে প্রবেশ করে নালন্দা ধ্বংস করেন। চড়াও হন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর। বিনষ্ট করেন বুদ্ধের পদচিহ্ন। শশাঙ্কের বিনাশযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের (৬০২-৬৬৪) সফরনামায়। রাজা জাতবর্মা সোমপুর মহাবিহার আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। মঠাধ্যক্ষ্য করুণাশ্রী মিত্রকে হত্যা করেন আগুনে পুড়িয়ে। হিন্দু রাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে রয়েছে যার বিবরণ। কিন্তু ড. আকসাদুল আলম সেই ইতিহাসকে বেমালুম ভুলে গেলেন। যেটা ঘটেছিলো, সেটার উল্লেখ নেই, যেটা ঘটেনি সেটার উল্লেখ করেছেন।