.jpg)
রাগিব রব্বানি :
বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে—দেশের প্রতিটা এলাকায়ই শীতের মওসুম জুড়ে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। শীতের মওসুম ছাড়া অন্য মওসুমেও এখন মাহফিলের আয়োজন হয় উল্লেখযোগ্য হারে।
শীতের মওসুমে দেশের প্রায় সবকয়টি এলাকায়ই প্রতিদিন কোনো না কোনো জায়গায় মাহফিল থাকে। মাহফিলের অন্যতম একটা অনুষঙ্গ মাইকের ব্যবহার। প্যান্ডেলের বাইরে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাইক লাগানো হয় প্রায় প্রতিটা মাহফিলেই। এসব মাইকের আওয়াজ স্বাভাবিকভাবেই মাহফিলের আশপাশের বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সমস্যার সৃষ্টি করে। ফলে ধর্মপ্রাণ অনেক সাধারণ মানুষও এ নিয়ে বিরক্তিবোধ করেন।
বিশেষত শহর বন্দর ও ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় যেসব মাহফিল হয়, সেগুলোতে মাইকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষকে বেশ কষ্ট পোহাতে হয়। শিশু এবং শিক্ষার্থীদের বেলায় এ সমস্যাটা বেশি হয়।
রাজধানীর দনিয়া শনির আখড়া এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে থাকেন মাওলানা মাহফুজুল আলম। তাঁর বাসার আশপাশে একদিন দুইদিন তিনদিন ব্যাপী অন্তত চার থেকে পাঁচটা মাহফিল হয় প্রতি বছর। মাহফিলগুলো আয়োজনের সময় পুরো এলাকা জুড়ে মাইক টানানো হয়। কোনো কোনো মাহফিলের মাইক তাঁর বাসা বরাবরও বাঁধা হয়। তিনি জানান, এই সময়গুলোতে অতিরিক্ত শব্দদূষণ তাঁদেরকে বেশ কষ্ট দেয়। তিন ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে, মাহফিলের মাইকের আওয়াজে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাও প্রায় বন্ধ রাখতে হয় এই সময়।
মাওলানা মাহফুজ বলেন, ওয়াজ মাহফিলের জন্য এরকমভাবে মানুষকে কষ্ট দেওয়া তো কোনোভাবেই উচিত না। যতটা জানি, ইসলামও কখনো এটাকে অনুমোদন করে না। কারণ, মাহফিলের জন্য এতো বেশি মাইকের ব্যবহার তো কোনো জরুরতের মধ্যেই পড়ে না। মাইক মূলত দূরের মানুষকে ওয়াজ শোনানোর জন্য, কিন্তু এখনকার সময়ে ব্যস্ততম নগরীতে দূরে বসে কয়জন লোক ওয়াজ শোনে? প্রত্যেকেই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওয়াজ শোনার ইচ্ছে হলে মাহফিলস্থলে বা প্যান্ডেলের ভেতরে গিয়ে শোনে। বাইরে বসে থাকে না। তাই এ বিষয়ে আমাদের মুরব্বি ওলামায়ে কেরামকে নতুন করে ভাববার অনুরোধ থাকবে। অন্তত ব্যস্ততম নগরীগুলোতে বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের মাইকের ব্যবহার যেন প্যান্ডেলের ভেতরই সীমিত রাখা হয়, সে ব্যাপারে তাঁরা সচেতনতা তৈরিতে প্রয়াসী হবেন বলে আমি আশা করছি। অন্যথায় এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে একটা বিরক্তিভাব এবং নেগেটিভ ধারণা ব্যাপকভাবে জন্ম নেবে। অলরেডি অনেকের মধ্যে বিরক্তিভাব চলেও এসেছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের প্রসিদ্ধ হাসানাত ফার্মেসির কর্ণধার সালেহ আহমদ। পারিবারিকভাবেই ধর্মপ্রাণ। তিনি জানান, তাঁর বাসার আশপাশেও প্রতিবছর বেশ কয়েকটি মাহফিল হয়। কোনো কোনো মাহফিলের মাইক তাঁর বাসা বরাবর রাখা হয়। বাসায় তাঁর অসুস্থ পিতামাতা। মাইকের জোর আওয়াজে তাঁদের বেশ কষ্ট পোহাতে হয় মাহফিলের দিনগুলোতে।
তিনি বলেন, ধর্মীয় প্রোগ্রাম, কিছু বলতেও পারি না কাউকে। আবার মাইকের আওয়াজে অসুস্থ বাবা-মা’র কষ্টও হয় খুব। সুযোগ থাকলে তাই মাহফিলের দিন অন্য কোনো আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিই। সবসময় পারি না, তাঁদের শারীরিক অবস্থা স্থানান্তরিত হবার মতো ভালো থাকে না সবসময়।
তবে ধর্মীয় ঘরানার অনেকে, বিশেষ করে ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে তো কেবল মাহফিলের মাইকের আওয়াজের কারণে শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে না। শব্দদূষণের আরও অনুষঙ্গ আছে। বিভিন্ন দিবসে, রাজনৈতিক প্রোগ্রামে এলাকাজুড়ে মাইকের অবাধ ব্যবহার থাকে, সংখ্যালঘু ধর্মের পূজা-অর্চনায়ও জোর সাউন্ডে মাইক বাজিয়ে গান-বাদ্য করা হয়, শহর-বন্দরের অনেক বাসাবাড়িতে বিয়ে খতনা ইত্যাদি উপলক্ষে অবাধে গান বাজিয়ে আশপাশের লোকজনের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া হয়, এসব আগে বন্ধ করা দরকার। ওয়াজ মাহফিলের মাইকের আওয়াজ সাধারণভাবেই মানুষজন মেনে নেন।
তবে এ ব্যাপারে মাওলানা মাহফুজ বলছেন, আমাদের শহর-বন্দরে ওয়াজ মাহফিলের মাইকই যে কেবল শব্দদূষণ করছে, আমি এমনটা বলতে চাচ্ছি না। শব্দদূষণের অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ, এবং অন্যতম কারণ, আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি। এ ছাড়া যানবাহনের হর্ণের শব্দ, মানুষের হল্লা চিৎকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামের মাইকের আওয়াজও আমাদের কষ্ট দেয়। সবচেয়ে বেশি যেটা হয় ঢাকা শহরে, বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে গান-বাজনা। এই জিনিসটা একদিক দিয়ে যেমন ধর্মবিরুদ্ধ কাজ, অপরদিকে গান-বাজনার উচ্চ আওয়াজ আশপাশের বাসা-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করে। এগুলো আমি বলব, আইন করে নিষিদ্ধ করা উচিত।
তিনি বলেন, ওয়াজ মাহফিলের শব্দদূষণ আর গানবাজনার শব্দদূষণ এক না। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। গান-বাজনা করা হয় ধর্মকে ডিঙিয়ে, এটা যে হারাম এবং ইসলামবিরুদ্ধ কাজ, যারা এটা করছে তারাও ভালোভাবে জানে। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে অতিরিক্ত মাইকের ব্যবহারের কারণে যে শব্দদূষণের সৃষ্টি করা হয়, সেটা ইসলামকে লেভেল হিসেবে ব্যবহার করে করা হয়। অথচ ধর্মীয় আলোচনা শোনানোর জন্য মানুষকে কষ্ট দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাইক ব্যবহার ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করবে বলে আমার মনে হয় না।