প্রসঙ্গ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: ড. মুতাজ আল খতিবের মুখোমুখি

(প্রাককথন : সিরিয়া বিপ্লব যেন একটা ফ্লাইট রেকর্ডার। হঠাৎ করে এটি ফেটে পড়েছে। অনেককাল অন্ধকারে থাকার পর ইতিহাসের নতুন নতুন পাতা বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। আগে শুধু সেখানে একটি আওয়াজই ছিল—আসাদের সিরিয়া। কিন্তু বিপ্লবের সিরিয়া নামে সেখানে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। হঠাৎ করেই যেন সেই ফ্লাইট রেকর্ডার ভেঙে বিপ্লবী সিরিয়ার নামে ছড়িয়ে পড়ল অনেক চিন্তাধারা, মতামত, ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। এসব অবশ্য আগেও কিছুটা ছিল। তবে বিশেষভাবে ইসলামী সশস্ত্র ধারা এতটা সুস্পষ্টভাবে আগে কখনোই জেগে ওঠেনি। এজন্যই কখনো সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের ঘোষণার কথা শোনা যায়। কখনো আবার কিছু মানুষকে দেখা যায় ইসলামী খেলাফতের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছে। অন্যদিকে আবার দেখা যায় সালাফিজমের নাম ধারণ করে, কিছু লোক শিরিক বেদাতের আওয়াজ তুলে কবর মাজার ভাঙ্গার কাজে লিপ্ত। চতুর্থ আরেকটি দল ভালো কাজের আদেশ ও জুলুম প্রতিরোধের জন্য আবার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে বসছে।

এসব বিষয়াদি ঘিরে সিরিয়ার বিপর্যস্ত যুবকদের মাঝে অনেক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। ফেসবুকের ‘আহফাদুল কাওয়াকাবী’ নামক পেজে বিভিন্ন যুবক প্রশ্ন পাঠাচ্ছে সিভিল স্টেট, ইসলামী খেলাফত, ডেমোক্রেসি ইত্যাদি বিষয়ে। এসব বিষয়ে সেই পেজের যুবকদের সাথে আলাপ করেছেন ড. মুতাজ আল খতিব—তিনি ফোরাম অফ রিজিওনাল স্টাডিস বার্লিনের একজন গবেষক। আলজাজিরা চ্যানেলের ধর্ম ও জীবন বিষয়ক একটি প্রোগ্রামের আয়োজক। এছাড়া কাতার ও বৈরুতের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া ফ্যাকাল্টির একজন সাবেক স্বল্পকালীন প্রভাষক ছিলেন তিনি। তাছাড়া তিনি হাদিসশাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেছেন। হাদিসের ইজাজত নিয়েছেন আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও ড. নুরুদ্দিন ইতার-এর কাছ থেকে। ফাতেহের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহিল বাকি)

 প্রশ্ন: জিহাদের পরিচয় কী? সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে জিহাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী বলেন?

 মু’তাজ: ইসলামী শরীয়ায় জিহাদের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। আলেমদের বিভিন্ন দল জিহাদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে গবেষণা করেছেন। যেমন, ফকীহগণ গবেষণা করেছেন জিহাদের লড়াইগত মর্ম নিয়ে, এর বিস্তারিত বিধানাবলী নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। এই অর্থেই জিহাদের ব্যবহার ব্যাপক। তাসাউফের আলেমগণ নফস ও অন্তরের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। জিহাদের মাধ্যম ও স্তরগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ওলামায়ে কেরাম জিহাদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন— ‘জিহাদের অর্থ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা। এখানে শত্রুর অর্থ তিন রকম হতে পারে। ১. প্রকাশ্য ও বাহ্যিক শত্রু। তাদের ক্ষেত্রে জিহাদ হবে ময়দানে লড়াই করা। ফকিহগণ এই প্রকারটি নিয়ে গবেষণা করে। ২. বায়বীয় শত্রু বা শয়তান। ৩. আত্মিক শত্রু বা নফস। শেষোক্ত দুই প্রকার নিয়ে আলোচনা করেন দাওয়াত, তাবলীগ ও তাসাউফের আলেমগণ। শেষোক্ত দুই প্রকার সম্পর্কেও কোরআনের উক্তি আছে, যেমন–‘আল্লাহর রাস্তায় হক আদায় করে মুজাহাদা করো।’ (সুরা হজ: ৭৮) [১]

জিহাদের শাব্দিক অর্থ হলো— প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিতাল ফরজ হওয়ার পর শরিয়তে জিহাদের একটা পারিভাষিক শব্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোরআনের মাদানী আয়াতগুলোর মর্ম থেকে বোঝা যায়, জিহাদের অর্থ হলো— ‘প্রাণ, সম্পদ, ভাষা অথবা অন্য কিছুর মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় লড়াইয়ের প্রচেষ্টা চালানো।’

আমাদের প্রশ্ন ছিল সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জিহাদের প্রথম অর্থ সামনে আসবে; অর্থাৎ প্রকাশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করা। কারণ, সিরিয়ার বর্তমান সরকারী রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যারাই কোন না কোন মাধ্যমে এই সরকারের মোকাবেলা করছে, তারা মূলত প্রতিরক্ষামূলক জিহাদে রত। আর উলামাদের নিকট এটা স্বীকৃত বিষয়। কারণ, ধর্ম, প্রাণ ও ইজ্জত রক্ষায় শত্রুর মোকাবেলা করা— সকল আলেমের ঐক্যমতে আবশ্যক। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন—“যেই আধিপত্যবাদী শত্রু মানুষের ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করে দিচ্ছে, ঈমান আনার পর সবকিছুর আগে আবশ্যক হল সেটার প্রতিরোধ করা।” সিরিয়া আপন রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি, বক্তব্য ও আচরণের মাধ্যমে জনগণের সুস্পষ্ট শত্রু হয়ে উঠেছে। আধুনিক রাজনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় ইন্টার্নাল কলোনিয়ালিজম। স্বার্থবাদী অথবা বিবেকহীন ছাড়া সিরিয়ার এই বিষয়টি আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

তবে হ্যাঁ.. জিহাদের ক্ষেত্রে অনেক বিধান আছে। ইসলামী ফিকহের বিশাল একটি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে এসবের আলোচনা। বাস্তবতা, রাজনৈতিক, ভৌগলিক ও সামরিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বিধান রূপান্তর লাভ করেছে। একে ঘিরে জন্ম হয়েছে অনেক ইজতিহাদ। তবে এখন সেসবের ভেতর ঢোকার অবকাশ নেই।

এই জিহাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা যায় এটা তখনই থামবে যখন সরকারি রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক পতন ঘটবে অথবা ঘটানো হবে। এরপর জনগণের মনের মাঝে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা তথা শরিয়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। নতুনভাবে রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে ময়দানের জিহাদ থেমে যাবে। কিন্তু চিন্তা, ভাষা ও সম্পদের জিহাদ চলবে। এভাবেই একসময় এই দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আচার ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতীক হয়ে উঠবে। ভাঙ্গার পর গড়ে তোলাও জিহাদের সামগ্রিক মর্মের মধ্যে প্রোথিত।

প্রশ্ন: ইসলামের বোঝাপড়ায় লিবারেলিজমের মর্ম কি? ইসলামপন্থী ও লিবারেলদের মাঝে সম্পর্কের স্বরূপ কেমন?

মু’তাজ: ইসলামিক ডিসকোর্সে লিবারেলিজমের সম্পর্ক নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা আছে। গত শতকের ষাটের দশক থেকে আরব বিশ্বে লিবারেলিজম বা উদারতাবাদ নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে। গত শতকের শুরুর দিকে অবশ্য এটা নিয়ে ততটা আলোচনা ছিল না। তখন তর্ক হতো মর্ডানাইজেশন বা আধুনিকীকরণের বিভিন্ন দাবি ও অনুষঙ্গ (যেমন, সেক্যুলারিজম) নিয়ে। লিবারেলিজম মূলত একটা জটিল ধারণা। এর নির্দিষ্ট কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আছে। কিন্তু কার্যত উদারতাবাদ আধুনিকীকরণ ধারণার অনেকটা কাছাকাছি। লিবারেলিজমের দাবি হল— স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, একসাথে বিভিন্ন চিন্তাগত ও রাজনৈতিক মতামতের উপস্থিতি ইত্যাদি। আর মর্ডানাইজেশন বলতে বোঝায়, সব ধরনের ট্রাডিশনের বিরোধিতা—আরবীয় হোক বা ইসলামী, চিন্তাগত হোক বা সামাজিক, সভ্যতাগত হোক বা রাজনৈতিক। সভ্যতা, সমাজ ও রাজনীতির মর্ডানাইজেশনের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। এর মাধ্যমে প্রচলিত ধারা ও টেক্সট থেকে হলিনেস উঠিয়ে দেয়া হয়।

ষাটের দশক থেকে লিবারেলিজমের সাথে ইসলামপন্থীদের বোঝাপড়ার বিভিন্ন রূপ আমাদের সামনে এসেছে। মূলধারার ইসলামপন্থীদের অনেকেই লিবারেলিজমের বেশ কিছু মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যেমন, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, প্লুরালিজম (রাজনৈতিক বিভিন্নতা), ডায়লগ এমং সিভিলাইজেশনস (সভ্যতার সংলাপ) ইত্যাদি। তারা ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করার। পাশ্চাত্যের সাথে কিভাবে শত্রুতার মাত্রা কমানো যায়, এটাও তাদের একটা মৌলিক চেষ্টার অন্তর্ভুক্ত।

যদিও মূলধারার লিবারেলদের সাথে ইসলামপন্থী লিবারেলদের বিস্তর ফারাক রয়েছে মূলনীতি ও মৌলিকত্বের দিক থেকে। এরমধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্র হলো— ১. আধুনিকায়নের পদ্ধতি, ২. টেক্সট থেকে হলিনেস উঠিয়ে দেয়া, এক্ষেত্রে ইসলামপন্থীরা আগে বাড়েনি। যদিও হলিনেসের ধারণাটা ইসলামী চিন্তায় একেবারেই অপরিচিত। ৩. ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক, ৪. শরীয়তের উৎসগত গ্রহণযোগ্যতা, ৫. রাষ্ট্রের কাঠামো ও প্রকৃতি, ৬. ইসলামের প্রথাগত ধারা, ৭. ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে অবস্থান ইত্যাদি। [২]

 প্রশ্ন: অনেকে মনে করে সিভিল স্টেটের ধারণা ইসলামী রাষ্ট্রের পরিপন্থী? প্রশ্ন হল, সিভিল স্টেট মানে কি? সেখানে শরীয়ত বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু?

 মু’তাজ: বর্তমানে সিভিল টেস্ট ধারনাটা অনেক তর্ক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। অথচ আগে এটা নিয়ে এতটা তুলকালাম ছিল না। বিদ্যমান বিপ্লবের দেশগুলোতে ইসলামপন্থীদের উত্থানের সাথে সাথে, রাষ্ট্রের ধারণা, প্রকৃতি ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই পর্যন্ত রাষ্ট্রের আধুনিক নগরিকরণ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-পর্যালোচনা ও লেখালেখি হয়েছে মিশরে। সিভিল স্টেটের ব্যাখ্যায় অনেকে নিছক সেক্যুলারিজমের কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকে আবার মনে করেন ইসলামি রাষ্ট্র‌ই প্রকারান্তরে সিভিল স্টেট। অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রে থিওক্র্যাটিক শাসন নেই (খ্রিস্টীয় পরিভাষায়), নেই বিলায়াতে ফকিহ (শিয়া রাজনৈতিক পরিভাষায়)। স্বাভাবিকভাবে বলা যায়— মোল্লাতন্ত্র নেই। [৩]

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিভিল স্টেট বলতে দুটি বিষয় বোঝায়। এক. সেটি হবে অসামরিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ এখানের নাগরিকগণ সভ্য হবেন, সামরিক নয়। দুই. সেটি গির্জা ও ধর্মতান্ত্রিক শাসনের বিপক্ষে থাকবে। অর্থাৎ এখানে কোন যাজকীয় অনুশাসন চলবে না। আর সামগ্রিকভাবে সিভিল স্টেট বলতে বোঝায়, এমন রাষ্ট্র— যেখানে বিভিন্ন কানুন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি রাখা হয়। বিভিন্ন নিয়ম-কানুন জারি করার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অধিকাংশের মত গ্রহণ করা হয়। যেগুলোকে মনে করা হয়, সমাজ ও জনগণের স্বার্থের অনুকূল।

ইসলামপন্থীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সিভিল স্টেটের ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন ইমাম মোহাম্মদ আবদুহু রহিমাহুল্লাহ। ফারাহ আনতুনের সাথে সেকুলারিজম, ধর্ম ও রাষ্ট্র নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল তার। সে সময় তিনি সিভিল স্টেটের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন এবং ইসলামের সাথে সেটার কোনো সংঘাত দেখেননি। মোহাম্মদ আবদুহু অবশ্য ইসলামিক স্টেট নিয়ে কোন কথা বলেননি। কারণ, তার অনেক পরে গিয়ে ইসলামিক স্টেটের ধারণা মুসলিম বিশ্বে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের মত মুসলিম সংস্কারপন্থীরা কামনা করতেন এমন একটা আধুনিক রাষ্ট্র, যেখানে ট্রাডিশনাল ফিকহি ধারার বাইরে ধর্ম স্থাপিত হবে নৈতিকতা ও সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে।

এই চিন্তার অনেকটা গ্রহণ করে পরবর্তীতে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কয়েকজন চিন্তাবিদ। তারা ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, সেটি আদতে সিভিল স্টেট‌ই। এই কথা তারা বলতে বাধ্য হয়েছেন, যখন সেক্যুলার ও লিবারেল চিন্তাবিদরা তাদের সম্পর্কে বলতে লাগলো যে, তারা যাজকীয় থিওক্র্যাটিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে নেমেছে। যদিও হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা তাকিউদ্দিন নাবহানী ও হিন্দুস্তানের আবুল আ’লা মওদুদী ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিভাষা ব্যবহার করতেন। এবং এতে কোন সমস্যাও দেখতেন না। কারণ, তখন তাদের সামনে সেকুলারদের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আপত্তিগুলো এতটা জোরালোভাবে আসেনি বা দেখা দেয়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বেশ কয়েকজন চিন্তাবিদ ও লেখক (যেমন, তারিক আল বিশরি, ইউসুফ আল-কারদাভী, মুহাম্মদ ইমারা, ফাহমি হুওয়াইদি প্রমুখ) সিভিল স্টেটের অন্তর্ভূক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন। যেমন, নাগরিকত্ব, প্লুরালিজম, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বৈধতা, জনগনের অধিকার ইত্যাদি। বর্তমান (২০১২ সাল) মরোক্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির অন্যতম নেতা ড. সাদুদ্দিন একটা গবেষণাপত্র লিখেছেন ‘আল-ইসলাম ওয়াদ দাওলাতুল মাদানিয়্যাহ’ (ইসলাম ও সিভিল স্টেট) নামে। সেখানে তিনি উসুল ও ফিকহের গ্রন্থাবলি ঘেটে একটা শরয়ী ভিত্তি দাঁড় করার চেষ্টা করেছেন সিভিল স্টেটের। বিশেষত উসুলুল ফিকহের উলামাদের নিকট স্বীকৃত, ইমামত অধ্যায়ে নবী সা.এর কথা ও কাজ সংক্রান্ত মাসআলা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন।

উসুলুল ফিকহের আলেমগণের নিকট একটা স্বীকৃত কথা আছে, “নবী সা.এর সকল কাজ ও কথাই ওহির অন্তর্ভূক্ত নয়। কিছু নবীজির মানবিক কাজ। আর কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওহির অন্তর্ভূক্ত। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নবীজি যেসব কাজ করেছেন, সেগুলোর অধিকাংশই নবীজির মানবিক সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত। তাই নবীজির এ অধ্যায়ের সকল কাজ মানুষের জন্য আবশ্যকীয় নয়। [৪] বরং সেখানে ইজতিহাদের অধিকার আছে আলেমগণের। নবী সা. বিভিন্ন বিচারের ফায়সালা করতে গিয়ে, আল্লাহর পক্ষ থেকে জানতে পারেননি, কে দোষী আর কে মুক্ত। দলিল প্রমানাদির আলোকেই তিনি বিচার করেছেন।” অনেক আলেম তো বলেছেন, নববী চিকিৎসা অধ্যায়ে যত হাদিস রয়েছে, সেগুলো মানবিক বিষয়ই; ওহির অন্তর্ভূক্ত নয়। এই মতের পক্ষে আছেন কাজি ইয়াজ মালেকি, ইবনে খালদুন প্রমুখ। [৫]

ইমামত সম্পর্কে নবীজির কর্মের প্রকৃতি আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয় যে, যে কোন শাসকের বিধান ও সীদ্ধান্তাবলি থেকে ইসলাম হলিনেস উঠিয়ে দিয়েছে। জাতির বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিবে, সেটা একান্তই মানবিক। এখান থেকে বোঝা যায়, ইসলামে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি পার্থিব বিষয়। এই রাষ্ট্রের শাখাগত সীদ্ধান্তগুলো মানুষই গ্রহণ করে। [৬] সামাজিক জীবনের সহজিকরণের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রে চূড়ান্ত লক্ষ্য রাখা হয় বাস্তবতা ও বৈষয়িকতার। তেমনিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক কোন অদৃশ্য শক্তি থেকে সরাসরি বিধানাবলি লাভ করে না। বরং সে সমাজের একজন সাধারণ সদস্য। সে বৈধতা লাভ করে জনগনের পক্ষ থেকে, যারা তাকে নির্বাচন করেছে। জনগনের বিভিন্ন বিষয়ে সে দায়িত্বশীল; দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে জনগনের বিষয়ে জবাবদিহিতা করতে হবে।

তবে হ্যাঁ.. ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামিয়্যাহ’ বা ইসলামিক স্টেট হলো নতুন একটি পরিভাষা। গত শতকের বিশের দশকে এই পরিভাষাটি ফকিহদের লেখালেখিতে উঠে আসে; যেমন, আবদুল ওয়াহাব খাল্লাফ। তিনিই সর্বপ্রথম আধুনিক যুগে এই পরিভাষাটা ব্যবহার করেন। তারপর শাইখ হাসান আল-বান্না তার লেখালেখিতে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে এই পরিভাষাটি তুলে আনেন। সেখান থেকে ইসলামী আন্দোলনগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য হয়ে উঠে ‘ইসলামিক স্টেট’।

এখন কথা হল, সিভিল স্টেটে শরীয়া ব্যবস্থার কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব?— এর উত্তরে বলা যায়, শরীয়ার বাস্তবায়ন বলতে আপনি কোন ধরণের মূলনীতি বা পদ্ধতি বোঝাচ্ছেন, তা স্পষ্ট করুন। একেক ফিকহে একেক বিষয়ের বাস্তবায়ন ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। এখন এখানে সকল ফিকহের মিশ্রিত উপস্থিতি থাকবে নাকি যে কোন একটি নির্দিষ্ট ফিকহের? কোন্ প্রকারের আলেমদের ইজতিহাদ এই রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হবে?— ইত্যাদি প্রশ্নও খুব স্বাভাবিকভাবে এখানে চলে আসে।

তবে মিশরে পরবর্তীতে আরোপিত আদর্শগত প্রশ্নের বাইরে গিয়েও বলা যায়, সিভিল স্টেট মানেই ইসলামী শরীয়তের বিরোধিতা নয়। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের অধীনেও সংবিধান থেকে তারা শরীয়তের উৎসগত ধারাকে বাতিল করতে পারেনি। অথচ এরকম ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের চেয়ে সিভিল রাষ্ট্রে– স্বাধীনতা ও জনগণের ইচ্ছার পরিবেশে শরিয়া আরো পোক্তভাবে স্থাপিত হতে পারে।

তবে আমি গুরুত্বের সাথে আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, এটা সবসময় নির্দিষ্ট করতে হবে যে, শরীয়ত বাস্তবায়ন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও শত্রুতাবশত বিভিন্ন আবেগ ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে, যেই দল বিপরীত দলকে শরীয়াহ থেকে বের করে দেয়, অনবরত বিপরীত দলকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত আক্রমণ করে, তাদের বক্তব্যের উপর শরীয়তের ভিত্তি স্থাপিত নয়।

 প্রশ্ন: খিলাফত শব্দের অর্থ কি? খিলাফত কি শরীয়তের মৌলিক কোন ধারণা, নাকি শাসনতন্ত্রের একটি আরোপিত অবস্থা– যেটি মুসলমানরা অনুসরণ করে এসেছে?

 মু’তাজ: খিলাফত, আল-ইমামাতুল উজমা, ইমারতুল মুসলিমীন— ফুকাহাদের নিকট এই তিনটি শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দ তিনটির অর্থ হলো— ‘দুনিয়া এবং ধর্মের স্বার্থ রক্ষার্থে ইসলামী হুকুমতের নেতৃত্ব প্রদান।’ মুতাকাল্লিম ওলামাগণ অবশ্য ইমামতকে ‘আকাইদে সাম‌ঈয়া’ (কোরআন হাদিসে উল্লেখিত বিষয়)-এর কাতারে উল্লেখ করেছেন। তারা এর সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন— ইমামত হল, ধর্ম ও পার্থিব রাজনীতি রক্ষার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্ব। কোরআন হাদিসের বক্তব্য ও ইসলামী ইতিহাসের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকটা সামনে রেখে ফকিহগণ কোন নির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করে সেটার উপর বিধান আরোপ করে দেননি যে, এটি খিলাফত, আর সেটি ইমারত। ইসলামী ইতিহাসে শাসনের বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা গিয়েছে। শুরু হয়েছিল খিলাফত দিয়ে। এরপর এসেছে ইমারত ও সালতানাত। এরই ধারাবাহিকতায় উপনিবেশের পর রাষ্ট্রের বর্তমান রূপটি এসে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাচীন ও আধুনিক যুগে, আহলে ইলমদের মধ্যে হতে কেউই বলেননি, এটাই ইসলামের নির্দিষ্ট শাসন কাঠামো। সকলেই একমত যে, কোরআন এবং সুন্নতে নববী— শাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেনি। তবে কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে শাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, বিধান ও সামগ্রিক মূলনীতি রয়েছে—যেগুলোর মাধ্যমে ইসলামী শাসন অন্যান্য মতবাদ অথবা মানবগঠিত আইন থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এছাড়া অন্যান্য শাখাগত অনেক মাসালা ইজতিহাদী বিষয়। এজন্যই শাফয়ী মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম জুয়াইনি রহ. বলেছেন— ‘ইমামত অধ্যায়ের অধিকাংশ মাসায়েল কাতয়ী বা সুনির্দিষ্ট ধারার মধ্যে পড়ে না। এগুলো সম্পর্কে ইয়াকিন বা চূড়ান্ত বিশ্বাস করাও যায় না।’ অর্থাৎ এগুলো ফকীহগণের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা শরীয়তের মূলনীতি ও সামগ্রিক ধর্মীয় স্বার্থকে সামনে রেখে যুগ বিবেচনায়, এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেবেন। আদ-দাওলাতুল ইসলামিয়া বা ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা আসার পর খেলাফতের ধারণা ইসলামপন্থীরা অনেকটা বাদ দিতে বসেছে। মূলধারার ইসলামী রাজনীতি যারা করেন, তাদের মধ্যে খিলাফতের ধারণা এখনো ধরে রেখেছেন হিযবুত তাহরীরের কিছু চিন্তাবিদ; যেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তকীউদ্দিন নাবহানি।

 প্রশ্ন: গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ধারণাগুলো কি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক?

 মু’তাজ: গণতন্ত্রের স্বাভাবিক অর্থ হলো— বিধান প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের অধিকার। শাসকের শাসনকাল, শাসন পদ্ধতি জনগণ যেখানে নির্ধারণ করে দেয়। গণতন্ত্রের অধীনে অনেকগুলো ধারণা চলে আসে। যেমন, নির্বাচন, অধিকাংশের মতে রায়, বিভিন্ন দলের অস্তিত্ব, সরকারের বিরোধী দল, স্বাধীনতা প্রভৃতি। আধুনিক রাষ্ট্র ভাবনায় গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ধারণা বলা হয়। তবে গণতন্ত্রের মুখে ইসলামপন্থীদের অবস্থান প্রচন্ড বিরোধপূর্ণ। তাছাড়া গণতন্ত্র যেসব ধারণার জন্ম দিয়েছে, সেগুলো হুবুহু সামনে রাখলে ইসলামী রাজনীতির মৌলিক ধারণাগুলোর সাথে বেশ কিছু অসঙ্গতি তৈরি হয়।

তবে শেষমেষ, বিভিন্ন দেশ, কাল ও প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ ও পরিবর্তন দেখে ইসলামপন্থীরা মতামত দিয়েছে— গণতন্ত্র শরীয়ত ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং এটি শূরা ব্যবস্থার সঙ্গে মিল রাখে; যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন দুনিয়াবি বা ইজতিহাদী বিষয়ে মতামত প্রদান করার স্বাধীনতা দেয়া হয়। আর নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের পক্ষ হতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— “ঐ সকল লোকদের নামাজ কবুল করা হয় না, যারা মানুষের ইমামতি করে। অথচ জনগণ তার প্রতি বিতৃষ্ণ।” এখানে নামাজের ইমামতির কথা বলা হয়েছে। আধুনিক কয়েকজন ফকিহ নামাজে ইমামতির উপর ইমামতে উজমার কিয়াস করেছেন। আরেকটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইমাম তারাই, যাদেরকে তোমরা ভালোবাসো এবং যারা তোমাদেরকে ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দোয়া করো এবং তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে।” এখান থেকে বোঝা যায়, শাসক ও শাসিতের ক্ষেত্রে থাকতে হয় পারস্পারিক সন্তুষ্টির সম্পর্ক। এখান থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়, শাসক অথবা ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের একটা ইচ্ছাধিকার ইসলামী শরিয়ায় রয়েছে। প্রাচীন ইসলামী ফিকহে শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের একটা সীমাবদ্ধ ইখতিয়ার দেখা যায়, অর্থাৎ আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ। এটা নির্বাচিত আলেমদের একটা পরিষদ। তারা পরামর্শক্রমে শাসক নির্বাচন করে। ধারণার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিভিন্নতা সত্ত্বেও, বলা হয়— আধুনিক যুগে গণতন্ত্র শাসক নির্বাচনের ইসলামী পদ্ধতির মধ্যে যেন বিস্তৃতি প্রদান করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এই পদ্ধতিতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। ভারসাম্য ঠিক থাকে কর্তব্য ও অধিকারের ক্ষেত্রে। যেই সমাজে ন্যায়পরায়ণতা নেই, সেই সমাজে মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার উপর শুধুই কর্তব্য চাপিয়ে দেওয়া হয়।

গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো, অধিকাংশের মতের উপর রায় দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আধুনিক যুগে প্রাচীন ফিকহের উপর গভীর গবেষণা চালিয়েছেন শায়েখ আহমেদ রাইসুনী ও ড. ইউসুফ কারযাভী। তারা বলেছেন, ইসলামী ফিকহে কিছু বিষয় আছে, যেকোনো সুনির্দিষ্ট, যেখানে অদল বদল করার কোনো অবকাশ নেই। আবার কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সুনির্দিষ্ট নয়; বরং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা দেওয়া হয়। ইসলামিক স্টেটে প্রথম প্রকারে গণতান্ত্রিক মূলনীতি প্রয়োগ হবে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে পারে; যদিও প্রাচীন ফিকহে অগ্রাধিকারের আরো অনেক মানদন্ড ছিল।

তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো— অধিকাংশের মতামতের সাথে হক বাতিল অথবা ভুল সঠিকের কোন সম্পর্ক নেই। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত। এটার মধ্যে তারা নিজেদের স্বার্থ দেখছে।

রাজনীতির বেশিরভাগ মাসলা-মাসায়েল, ফকিহগণ যেগুলোকে ‘আস-সিয়াসাতুশ শারয়িয়াহ’ নামে অভিহিত করেছেন— সেগুলোর ভিত্তি স্বার্থ ও ক্ষতির দৃষ্টিভঙ্গির উপর। ইসলামী রাজনীতি কোন চূড়ান্ত বিধান দেয় না। এজন্যই এতে প্রতি যুগেই ফকিহদের চিন্তার বিবর্তন দেখা যায়। আর ইজতিহাদী বিষয়ে পূর্ববর্তীদের ইজতিহাদ পরবর্তী লোকদের জন্য আবশ্যকীয় নয়; যদি এক্ষেত্রে পূর্বের চেয়েও উত্তম পন্থা থাকে। এজন্যই প্রাচীন ফকীহগণ সামগ্রিক ফিকহ থেকে আলাদা করে আলোচনা করেছেন রাজনৈতিক ফিকহ নিয়ে। কারণ সামগ্রিক ফিকহের বোঝাপড়ার সাথে রাজনৈতিক ফিকহের অনেক ভিন্নতা রয়েছে।

 প্রশ্ন: ‘রিজালুদ্দিন’  বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা কি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতে পারেন? কখন তার জন্য রাজনীতির ময়দানে যাওয়া সঙ্গত আর কখন সঙ্গত নয়?

 মু’তাজ: প্রথমেই একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, রিজালুদ্দিন মূলত খ্রিস্টীয় চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটা পরিভাষা। এটার মাধ্যমে তারা সাধারণত যাজক অথবা পাদ্রী বুঝিয়ে থাকে। এ সম্পর্কিত তাদের নির্দিষ্ট কিছু ধারণাও রয়েছে। আমরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আলিম, ফকিহ, দায়ী বলে যা বোঝাই, ‘রিজালুদ্দিন’ বলে আদতে সেগুলো বোঝানো হয় না।

দুঃখজনক বিষয় হলো আমাদের ধর্মীয় পরিবেশে এসব পরিভাষাগুলো একটা আরেকটার সাথে গুলিয়ে গিয়েছে। মানুষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মাঝে যোগ্যতার বিবেচনায় পৃথক না করে সবাইকে একতালে বলে চলেছে ‘রিজালুদ্দিন’। অথচ ইসলামী ইতিহাসে আমরা যেমনটা দেখে আসছি, আলেমদের মাঝে পার্থক্যটা স্পষ্ট করা জরুরি। ফকিহ, উসুলবিদ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ওয়ায়েজ প্রমুখদের মাঝে পার্থক্য করাটা অত্যন্ত জরুরি। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, এসব গুণে একত্রে ভূষিত। কিন্তু বর্তমানে শুধুমাত্র বক্তা-ওয়ায়েজদের আধিক্যই পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মাঝে ফকিহ খুবই কম। আমাদের সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে ফিকহ খুবই স্বল্প। ফিকির ও চিন্তা নেই বললেই চলে। ছাত্রদের যেই ইলমি যোগ্যতা দেখে আসছি, এতে তারা ফকিহ অথবা মুফতির (পূর্ববর্তীদের পরিভাষা অনুযায়ী) স্তরে খুব কমই পৌঁছতে পারে।

এখন কথা হল ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পড়াতে পারবেন কিনা? অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ময়দানের রাজনীতিতে তাদের জড়ানো উচিত নয়। কারণ কর্মগত রাজনীতি আয়ত্তে না থাকার দরুন, তারা এক্ষেত্রে ভালো কিছু করতে পারেন না। এর জন্য বিশেষ যোগ্যতা থাকা দরকার। কোরআন আমাদের সামনে একটা সুন্দর মূলনীতি তুলে ধরেছে, “যদি তোমরা না জানো, তাহলে সে বিষয়ে বিজ্ঞদের জিজ্ঞাসা করো।” মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আহলে জিকির বা বিজ্ঞ বলে আয়াতে বোঝানো হয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের। রাজনীতিজ্ঞান একটা শাস্ত্র। আর ময়দানের রাজনীতি আরেকটা শাস্ত্র। রাজনীতিজ্ঞান থাকলেই যে কেউ ময়দানের রাজনীতিতে সফল হতে পারবে, এমনটার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।

তেমনিভাবে, দাওয়াত-কার্য ও ময়দানের রাজনীতিকে পারস্পারিক গুলিয়ে ফেলা— রাজনীতি ও দাওয়াতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষয়। কারণ, দাওয়াতের মূলনীতি ও ধরনের সাথে রাজনীতির মৌলিক অমিল রয়েছে। নৈতিক ও তাত্ত্বিকভাবেও একে অপরের সম্পূর্ণ বিরোধী। সিরিয়ার দাওয়াতের মানুষরা যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সিরিয়ার ধর্মীয় ভবিষ্যতের জন্য ঘোর কালো অন্ধকার নেমে আসবে।

দাওয়াত-কার্য পরিচালিত হয় সকল ফুকাহাদের নিকট স্বীকৃত বেশ কিছু ধর্মীয় মাসালার ভিত্তিতে, যেগুলোর মাধ্যমে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা হয়। এগুলোর বিনিময় নেওয়া হয় না মানুষের কাছ থেকে। আর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিত্তি— প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বীতা, নিজেকে ভালো প্রমাণ করা, দলগত স্বার্থ, জনগণের আস্থা আদায় ইত্যাদির উপর। এর জন্য বিশেষ যোগ্যতা, প্রশাসনিক চরিত্রের সাথে পরিচয়, দলবদ্ধ করা, নেতৃত্ব প্রদান ইত্যাদি গুণাবলীর খুবই প্রয়োজন। অন্যান্য দলের সাথে কখনো লড়াই, কখনো আবার মিত্রতাসহ বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। এসব করতে গিয়ে একজন দায়ী ও স্বীকৃত আলেম তার আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জায়গা থেকে সরে পড়ে। তার কাছের মানুষরাও তার প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। এতে দীনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মানুষ মনে করে দ্বীনকে ব্যবহার করে তারা জনগণকে নিজেদের দলে ঢোকাতে চাচ্ছে। এখানে আরো অনেক কথা রয়েছে। এসব বিস্তারিত উল্লেখ করার অবকাশ নেই এখানে। [৭]

 প্রশ্ন: ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা কি ইসলামের মৌলিক কোন অংশ? অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র মানেই কি, এর থাকতে হবে কিছু নির্দিষ্ট বিধানাবলী, এগুলো বাস্তবায়ন না করলে মুসলমান গুনাহগার হবে?

 মু’তাজ: ইসলামে রাষ্ট্রীয় ধারণা ইসলামী সমাজের মধ্য থেকে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামী সমাজের মূল্যবোধ ও স্বার্থের সাথে এর সম্পর্ক জড়িত। আর আমি আগেই বলে এসেছি ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ধারণাটা নতুন একটা ধারণা। এখানে আর একটু বলে নেই।

হাসানুল বান্না থেকে শুরু করে ইখওয়ানুল মুসলিমিন রাষ্ট্রকে ইসলামের একটা মৌলিক রোকন বা ফরজ বানিয়ে নিয়েছে। আহলুস সুন্নাহর ফকিহ ও মুতাকাল্লিমগণ এমনটা বলেননি। ইমামত প্রতিষ্ঠাকে সুন্নি ফিকহে আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি কোন মৌলিক বিষয় নয়। ইমাম জুয়াইনি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন— “ইমামত আকাইদের অংশ নয়। বরং এটি সামগ্রিক পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব। আর কর্তা ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে সকল কথাই ধারণা ও ভাবনার ভিত্তিতে স্থাপিত (মাবনি আলায-যন্)।”

তার ছাত্র আবু হামেদ গাজালি (মৃ. ৫০৫ হি.) স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “জেনে রাখ, ইমামতের ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেওয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মাকুলাত শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত‌ও নয়। বরং এটি একটি ফিকহী বিষয়। এর মাধ্যমে অনেক দলাদলি সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সঠিক পদ্ধতিতে ডুবে থাকার চেয়ে, এ বিষয়ের মধ্যে না ঢোকাই ভালো। আর ডুবে থেকে যদি ভুল করে, তাহলে তো তার পরিণতি নিয়ে আর কোন কথাই নেই।” [৮]

ফিকহী আনুষাঙ্গিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, মানে হলো— এর সঙ্গে ঈমান ও কুফুরের মাসালা সম্পৃক্ত নয়। বাস্তবায়নের দিক থেকে এটি আবশ্যক। তবে এটি ঈমান ও আকাইদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ইসলাম রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ঈমানের জন্য জরুরী দুটি বিষয় হিসেবে সাব্যস্থ করেনি। [৯]

 প্রশ্ন: সিরিয়ায় উপস্থিত সালাফি জিহাদী ধারার নুসরা ফ্রন্ট আর আহরারুশ শাম দল সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

 মু’তাজ: কোন জামায়াত অথবা সংঘ সম্পর্কে মত আরোপ করতে হলে সেই দলের সামগ্রিক চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, কাজকর্ম ও ব্যক্তিগঠন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জানা থাকতে হয়। আর ব্যক্তিগতভাবে তাদের সম্পর্কে আমি এটা থেকে বঞ্চিত। এজন্য তাদের বিষয়ে মতামত দেওয়া আমার ক্ষেত্রে জটিল। ইসলামী পদ্ধতি আমাদের শিক্ষা দেয়, মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে অথবা বিধান আরোপ করার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা ও আচরণের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়; ব্যক্তি কিংবা দলকে নয়। এজন্য আমরা সাধারনত কাজ ও কথাকে ঘিরে মতামত দিতে পছন্দ করি, ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে নয়। আমরা বলি, যে ব্যক্তি অমুক কাজটি করবে তার হুকুম– অমুক। এক্ষেত্রে আমরা সাধারণত ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করা পছন্দ করি না। এজন্য আপনারা কিছু নির্দিষ্ট কাজ অথবা কথা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারেন আমাকে। সেটা সম্পর্কে আমি আপনাদেরকে উত্তর দিতে পারব।

প্রশ্ন: হালব শহরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কিছু দল ইসলামিক স্টেট ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

 মু’তাজ: এই ঘোষণা সবার মত আমিও শুনেছি। আমি মনে করি, এটি ধর্ম ও বিপ্লবী জিহাদের ভবিষ্যৎ— উভয়ের জন্যই সুস্পষ্ট ক্ষতি। এর বৈধতা, প্রকৃতি, গঠন সম্পর্কেও শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক আপত্তি রয়েছে। এটা আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সামগ্রিক স্বার্থকে বিনষ্ট করবে। তাদের দলের বাইরে জনগণের ন্যূনতম সমর্থন ও সহযোগিতাও তাদের নেই। তাদের ভিতরগত কাঠামো দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এর কোন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও বাস্তবিক বৈধতা নেই। [১০] কোন চিন্তাকে কেবল ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে একটা বাণী মনে পড়ল হাসান আল বান্না রহমতুল্লাহি আলাইহির। তিনি বলেছিলেন— “তোমরা নিজেদের এবং অন্য মানুষের হৃদয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করো। তাহলে তোমাদের ভূমিতে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।”

 প্রশ্ন: ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য কি আবশ্যক— বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সম্পর্ক তৈরি করে দেওয়া? নাকি শরিয়া অনুযায়ী জনগণের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করে দেয়াই যথেষ্ট?

 মু’তাজ: ইসলাম হলো একটা সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। এতে রয়েছে ব্যক্তিগত কর্তব্যবোধ। সাথে সাথে রয়েছে ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব। আর মানুষের মৌলিক কর্তব্য তার নিজের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ব্যক্তিগত। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাঁর কর্তব্য রয়েছে। এর উপরেই নির্ভর করে দুনিয়া ও আখিরাতে তার সওয়াবপ্রাপ্তি ও জান্নাতের নিশ্চয়তা। ব্যক্তিগত কর্তব্যবোধের উপরই শরীয়তের অধিকাংশ আহকাম অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু সামষ্টিক কর্তব্যবোধও ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্যই ফকিহগণ ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় কাজগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ১. ওয়াজিবে আইনি, ২. ওয়াজিবে কিফায়া। প্রথম প্রকার হলো ব্যক্তিগত আবশ্যকীয় বিষয়। কোন ব্যক্তি যদি সেটা না করে তাহলে সে গোনাহগার হবে। আর দ্বিতীয় প্রকার হল সামগ্রিক দলবদ্ধ ওয়াজিব। এখানে ব্যক্তিকে সম্বোধন না করে জামাতকে সম্বোধন করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকারের উদাহরণ হল, সামগ্রিক স্বার্থরক্ষা, পূণ্যের আদেশ প্রদান ও মন্দ কাজ হতে বাধা প্রদান, আল্লাহর নিদর্শনাবলী প্রতিষ্ঠা করা, সমাজের সামগ্রিক প্রয়োজন মেটানো—সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যা খুবই প্রয়োজন।

এখানে আরেকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলার সম্মোধন সাধারণত জামাতের প্রতি হয়, রাষ্ট্রের প্রতি নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ মুমিনদেরকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করেছেন, কোন ক্ষেত্রে দলবদ্ধভাবে সম্বোধন করেছেন। সুতরাং দীন রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব হল ব্যক্তি ও সমাজের উপর। ব্যক্তিকে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা গৌণ। তবে হ্যাঁ.. রাষ্ট্র জনগণকে সামগ্রিক এবাদতগুলো পালনের সুযোগ করে দিবে।

ইসলামের সাথে খ্রিস্টধর্মের পার্থক্য এখানেই যে—খ্রিস্ট ধর্মে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোন মাধ্যম ব্যবহার করতে হয়; পাদ্রী হোক অথবা রাষ্ট্র। কিন্তু ইসলামে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, “যদি আপনাকে আমার কোন বান্দার জিজ্ঞেস করে আমার সম্পর্কে। তাহলে আপনি বলে দিন, আমি নিকটেই। যখন কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করে, তখন তার প্রার্থনা কবুল করা হয়।”

 প্রশ্ন: ধর্ম কি জীবনের সামষ্টিক গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, নাকি জীবন‌ই হবে ধর্মের জন্য উৎসর্গিত?

 মু’তাজ: মানুষ আল্লাহর মৌলিক সম্বোধনের ক্ষেত্র। কোরআনের বিধানাবলী আবর্তিত হচ্ছে মানুষকে ঘিরে। ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের স্বার্থে। অর্থাৎ মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এই ভাবনাটা অবশ্য ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে ব্যক্তি এভাবে ভাববে না। ইসলামের সামনে তাকে উৎসর্গিত হতে হবে।

‘মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়’— এই বিষয়টা বিভিন্নভাবে আমরা দেখতে পাই। যেমন কাউকে যদি কুফুরি কথা বলতে একান্তই বাধ্য করা হয়, তাহলে তার মানবসত্তাকে বাঁচানোর জন্য, হৃদয় বিশ্বাস না করে মুখে উচ্চারণ করার অবকাশ দিয়েছে ইসলাম। তাছাড়া জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে অনেক সময় অনেক স্বীকৃত হারাম বিষয়‌ও হালাল হয়ে যায়। তাছাড়া শরীয়তে আমরা দেখতে পাই, সফর অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন বিধানকে সহজ করে দেওয়া হয় মানুষের জন্য। তার সামর্থের দিকটা সামনে রেখে। ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি খুবই সুন্দরভাবে বলেছেন— “মানুষের ক্ষেত্রে শরীয়তের উদ্দেশ্য পাঁচটি। ১. তাদের ধর্ম রক্ষা করা, ২. তাদের প্রাণ বাঁচানো, ৩. আকল ও বুদ্ধিবৃত্তি রক্ষা। ৪. বংশ রক্ষা, ৫. মানুষের সামগ্রিক স্বার্থের বিবেচনা।”

ইমাম শাতেবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “প্রত্যেক আসমানী ধর্মেই এ বিষয়টা লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ধর্ম মানুষ থেকে পৃথক নয়। মানুষ ছাড়া ধর্মের কোনো অস্তিত্বই নেই। সুতরাং ধর্মের মৌলিক কাজ হল, ইহকালে ও পরকালে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা।”

প্রশ্ন: শরীয়ত কি শুধুই কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও বিধানাবলী? নাকি সাথে সাথে একটি সামাজিক কাঠামো, যার মাধ্যমে নৈতিকতা, ন্যায়পরায়নতা ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা হয়? এই ধারণার ক্ষেত্রে বর্তমান আলেমদের অবস্থান কেমন?

মু’তাজ: শরীয়ত একটা প্রাচীন পরিভাষা। তবে এই পরিভাষাটা নতুনভাবে সামনে আসে গত শতকের আশির দশকের দিকে। বিশেষত ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মাধ্যমে। আরব বিশ্বে যেসব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেগুলোর মুখোমুখি প্রতিরোধ ভূমিকায় দাঁড়াতে এই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।

তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, শরীয়ত ও ফিকহের মাঝে পরিভাষাগত পার্থক্য আছে। ফিকহ বলা হয় ওই ঐতিহ্যগত সম্পদকে, যা দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু হয়ে ফকিহগণের লেখালেখি থেকে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আর শরীয়ত হল, ঐসকল অকাট্য বিধান যেগুলোর ক্ষেত্রের মানুষের কোন ইজতিহাদের দখল নেই। [১১] কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আধুনিক ইসলামী রাজনৈতিক ডিসকোর্সে এ দুইটা বিষয়ের মাঝে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়। ফিকহের মধ্যেও অবশ্য শরীয়ত উপস্থিত। কিন্তু শরীয়তের বাস্তবায়ন বলে এমন কিছু বোঝায়, যা বিচারসংশ্লিষ্ট কিছু ফিকহি বিষয়। শরীয়ত মানে শুধু কিছু বিধানাবলী নয়। শরীয়ত হল একজন মুসলমানের জীবনচালনার সামগ্রিক পদ্ধতি। আকীদা থেকে নিয়ে শুরু করে, এর অন্তর্ভুক্ত হবে ইবাদত, অন্যদের সাথে মুয়ামালাত, নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক ফিকহী মাসায়েলের কিছু অকাট্য বিষয়। আর বিশেষভাবে হুদুদ কিসাস সম্পর্কে বলা যায়, এগুলো শরীয়তের ন্যায়প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়েল। এগুলো কি সামষ্টিক শরীয়ত ভেবে বসে থাকা ভুল। তবে হ্যাঁ.. হুদুদ কিসাস শুধু জানলেই হবে না। সেইসাথে জানতে হবে, এগুলোর সামষ্টিক মর্ম কি? এগুলো বাস্তবায়নের শর্ত কি? আধুনিক যুগে সেগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি কি? এখানে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। সেগুলো উল্লেখ করার অবকাশ অবশ্যই এখানে নেই।

‘শরীয়ত বাস্তবায়ন’— ধারণাটা আধুনিক। আবিষ্কৃত হয়েছে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আন্দোলন থেকে। এই ধারণার পেছনে বিদ্যমান রয়েছে দুইটা স্বীকৃত আকীদা। ১. বর্তমান সমাজ থেকে শরীয়ত উঠে গিয়েছে। এটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ২. রাষ্ট্রের‌ই দায়িত্ব শরীয়তকে রক্ষা করা। সমাজ বা উম্মতের নয়। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা করার জন্য ইখওয়ানুল মুসলিমীন থেকে এই কথাটা চালু হয়। অথচ শরীয়ত যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সকল যুগেই বিদ্যমান রয়েছে, এটা একটা স্বীকৃত বিষয়। ফিকহী ট্রাডিশনকে সামগ্রিকভাবে অস্বীকার করার মতো কোনো ঘোষণা মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে আসেনি। আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতি ও অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে, ইসলামী বিধানাবলী পালনের ক্ষেত্রে, সেটা স্বাভাবিক। সমাজ অথবা রাষ্ট্র কখনো ভুলের উর্ধে নয়। কিন্তু এর জন্য এটা বলা যায় না, শরীয়ত সমাজ থেকে উঠে গিয়েছে। আর বর্তমানে যে বিভিন্ন ফিকহী কানুনের সংস্কার করা হচ্ছে, এটা শুধুমাত্র এখন শুরু হয়নি। প্রতিযুগেই কিছু-না-কিছু ফিকহী কানুনের সংস্কার করা হয়েছে। ওসমানী খেলাফত শুরু হওয়ার পরে, সেটা আরো বর্ধিত রূপ পায়। ফিকহী কানুনের সংস্কারের কারণে কোন দায়ী, আলেম অথবা ফকিহ বলেননি, সমাজ থেকে শরীয়ত উঠে গিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি শুরুর দিকে হাসান আল বান্নার উদ্ধৃতিতে বলেছিলেন, সমাজে শরীয়ত বাস্তবায়নের আগে অন্তরের ভেতর শরীয়ত বাস্তবায়ন করার কথা। এই বাক্য থেকে অনেকে মনে করে, স্বাভাবিকভাবে শরীয়ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আপনি কি মনে করেন, সাহাবায়ে কেরামের সমাজে অন্তরে শরীয়ত করার পরে সমাজে শরীয়ত কায়েম করা হয়েছে?

মু’তাজ: এখানে অন্তরে শরীয়ত বাস্তবায়ন বলতে বোঝানো হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে শরীয়তের বাস্তবায়ন। অর্থাৎ অন্তরে শুধু ধর্মের কথা পুষে রাখলে হবে না। তার ব্যক্তিসত্তার ভেতরে ধর্মীয় বিধানাবলীকে পরিপূর্ণরূপে স্থাপন করতে হবে। অনেককে দেখতে পাবেন, নিজের ক্ষেত্রে শরীয়তের কোন ধারধারে নেই, কিন্তু রাষ্ট্রে শরীয়ত কায়েম করার জন্য মিছিল-মিটিংয়ে পাগলপারা। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন, “কেন তোমরা যা করো না, সে বিষয়ে মানুষকে বলে বেড়াও।” কোরআন সম্বোধন করেছে মূলত ব্যক্তি ও উম্মাহকে; শাসক ও রাষ্ট্রকে নয়। সুতরাং রাষ্ট্র যদি নাও থাকে তবুও শরীয়তের আহকাম বিধান কায়েম থাকবে। শরীয়তের একটা বিষয় শুধু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। সেটা হলো আইন ও কানুন বিষয়ে। সেটাও রাষ্ট্র না থাকলে রহিত হয়ে যাবে না। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমিনের অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, রাষ্ট্র না থাকলে বুঝি কানুন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আর সৈয়দ কুতুব রহমতুল্লাহি আলাইহির মতে তো, শরীয়ত কখনো পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়, কখনো পুরোপুরি উঠে যায় শরীয়ত। এটা ভুল চিন্তা। তবে হ্যাঁ.. শরীয়ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্তরভেদ আছে। প্রত্যেকেরই বাস্তবায়নের মধ্যে কিছু সংকট থাকেই। কেউ চূড়ান্ত দৃষ্টান্তের কাছাকাছি পৌঁঁছতে পারে, কেউবা আবার দূরে থাকে। চূড়ান্ত দৃষ্টান্তের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। আমাদেরকে যতটুকু সম্ভব তাদের কাছাকাছি পৌঁছার চেষ্টা করতে হবে। পুরোপুরি না পৌঁছতে পারলে আমরা ধর্মহীন হয়ে যাব, এমন ভাবনা যে ভাবে— সে মূলত সকল মানুষকে জাহান্নামী বানাতে চায়।

প্রশ্ন: ইসলামী রাষ্ট্রে কি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পরিপূর্ণ থাকবে নাকি শরীয়ত ও সমাজ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে?

মু’তাজ: পরিপূর্ণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলে কোন কথা নেই। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হলে সকল আইন কানুন বাতিল হয়ে যাবে। সাথে সাথে আমরা ব্যক্তিগত অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি নই। বিশেষত নৈরাজ্য ও ফিতনার আশংকায়। ওলামা এবং দায়ীগণের কাজ হলো, মূলত সত্যটা জানিয়ে দেয়া। ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং ভ্রান্তি থেকে সাবধান করা। জোর করে যাকে মুসলমান বানানো হয়, সে মূলত মুসলমানই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন লোক মুসলমান বলে গণ্য হয় না। মুসলিম কাকে বলা হয়? ফকীহগণের সংজ্ঞা অনুযায়ী, মুসলিম হল ওই ব্যক্তি, যে মুকাল্লাফ বা দায়িত্বশীল। অর্থাৎ স্বাধীন, বালেগ ও বুদ্ধিসম্পন্ন। কোন মুসলমানকে যদি জোর করে কোন কাজ করানো হয়, সেক্ষেত্রে সে কোন সাওয়াব পাবে না। স্বাধীনতার ভিত্তিতে কোন কাজ করলে সেটার‌ই সওয়াব পাবে। তবে হ্যাঁ.. ইসলামে স্বাধীনতার একটা সীমারেখা রয়েছে। যারা মুমিনদের মাঝে পাপাচার ছড়ায় তাদের সম্পর্কে কোরআনে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। এখানে স্বাধীনতার কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়া যারা অমুসলিম অথবা কাফের রয়েছে, তাদেরকে ইসলামের পক্ষ থেকে তাদের নির্দিষ্ট বিশ্বাস, ব্যবসা ও উপাসনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: কিছু সালাফি জিহাদি দল কবর ভেঙে ফেলছে। তারা বলছে, কবর উঁচু করা জায়েজ নেই। এগুলো শিরিক। তাদের পক্ষে অনেকেই সাফাই গাচ্ছে। অনেকে আবার তাদের বিপক্ষে বলছে, এগুলো মৃতদের সম্মানহানি করা। এক্ষেত্রে শরীয়তের বক্তব্য কি?

মু’তাজ: সামগ্রিকভাবে কবরের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া মানে, মৃত ব্যক্তিদের সম্মানহানি করা। শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন লোক গুনাহগার হবে। মৃত ব্যক্তির সম্মান আর জীবিত ব্যক্তির সম্মান প্রায় এক। মৃত ব্যক্তি যদি পুণ্যবান অথবা আলিম হন, তাহলে তো কথাই নেই। এখানে দ্বিগুণ পাপ হবে। সে যে কোনো দলেরই হোক না কেন। অবশ্য আমরা দলের উপর সাধারণত মন্দ কাজের দায়ভার চাপাই না। লিবিয়ায় বিপ্লবের পর এমনটা হয়েছে। এটা মূলত দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা। সমাজে যদি কোন মন্দ বিষয়ের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটা দূরীভূত করার দায়িত্ব আলিম সমাজের; অন্যদের নয়।

প্রকৃতই যেটা মন্দ বিষয়, সেটা দূর করার তিনটি স্তর রয়েছে। এজন্য অবশ্য কিছু শর্ত‌ও রয়েছে। ১. সকলে মিলে যদি মন্দ কাজটা করতে থাকে, ২. শরীয়তের পদ্ধতিতে সেই মন্দ কাজটা দূর করতে হবে, ৩. যারা দূর করবেন, তাদেরকে আহলে এলেম হতে হবে; সাধারণ মানুষ নয়। ৪. এই মন্দ বিষয় দূর করতে গিয়ে যেন এর চেয়েও বেশি মন্দ বিষয়ের আশঙ্কা না থাকে।

মালিকী মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম মালেকের ছাত্র ইবনে কাসিমকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, “কোন লোক যদি কবরের সামনে নামাজ পড়ে, তাহলে কবর কি ‘সুতরা’ (আড়াল) হিসেবে গণ্য হবে? তখন তিনি বলেছিলেন, কবরকে সামনে রেখে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে ইমাম মালেক কোন সমস্যা মনে করতেন না; যদি সেই নামাজির মনে গাইরুল্লাহর নিয়ত না থাকে। ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, কবরের সামনে নামাজ পড়তে কোন সমস্যা নেই। কারণ, কিছু সাহাবী কবরস্থানে নামাজ পড়তেন।”

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তার মত আলেম যেখানে কবরস্থানে নামাজ পড়ার বৈধতা দিচ্ছেন, সেখানে কবর উঁচু করার কারণে, ভাঙ্গাভাঙ্গি করা কি পরিমাণ অজ্ঞতার পরিচয়।

আল্লাহ এসকল বিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

 

নোট:

[১] এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, “আল্লাহর জন্য হক আদায় করে আমল করো।” (তানভিরুল মিকবাস মিন তাফসিরী ইবনে আব্বাস, প্রকাশ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া) তাফসিরে আবিস সাউদে বলা হয়েছে,
{وجاهدوا فِى الله} أي لله تعالى ولأجلِه أعداءَ دينِه الظاهرة كأهلِ الزَّيغِ والباطنةِ كالهَوَى والنَّفسِ وعنه صلى الله عليه وسلم أنَّه رجعَ من غزوةِ تبوكَ فقال رجعنا من الجهادِ الأصغرِ إلى الجهادِ الأكبرِ

তাফসিরে কুরতুবিতে বলা হয়েছে,

قَوْلُهُ تَعَالَى: (وَجاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهادِهِ) قِيلَ: عَنَى بِهِ جِهَادَ الْكُفَّارِ. وَقِيلَ: هُوَ إِشَارَةٌ إِلَى امْتِثَالِ جَمِيعِ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ، وَالِانْتِهَاءِ عَنْ كُلِّ مَا نَهَى اللَّهُ عَنْهُ، أَيْ جَاهِدُوا أَنْفُسَكُمْ فِي طَاعَةِ اللَّهِ وَرُدُّوهَا عَنِ الْهَوَى، وَجَاهِدُوا الشَّيْطَانَ فِي رَدِّ وَسْوَسَتِهِ، وَالظَّلَمَةَ فِي رَدِّ ظُلْمِهِمْ، وَالْكَافِرِينَ فِي رَدِّ كُفْرِهِمْ.

তাফসিরে ইবনে কাসিরে আছে,
وَقَوْلُهُ: وَجاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهادِهِ أَيْ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ،

[২] এখানে শুধু তিনি ইসলামপন্থী লিবারেলদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাদের সম্পর্কে কোন নিজস্ব মন্তব্য দেননি। অথচ ট্রাডিশনাল ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ধারার সমালোচনা থাকা উচিত ছিল।

[৩] থিওক্রাটিক শাসন বলতে বোঝায়, যেখানে সার্বভৌমত্ব থাকে শাসকের বা কোন নির্দিষ্ট পাদ্রিগোষ্ঠীর। আর ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব থাকে কেবল আল্লাহর।

[৪] রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে নবীজি সা.এর সাথে খোলাফায়ে রাশেদিনের কয়েকটি মতভেদ তুলে ধরে ইবনুল কায়্যিমিল জাওয়িয়া বলেছেন,

وَالْمَقْصُودُ: أَنَّ هَذَا وَأَمْثَالَهُ سِيَاسَةٌ جُزْئِيَّةٌ بِحَسَبِ الْمَصْلَحَةِ، تَخْتَلِفُ بِاخْتِلَافِ الْأَزْمِنَةِ، فَظَنَّهَا مَنْ ظَنَّهَا شَرَائِعَ عَامَّةً لَازِمَةً لِلْأُمَّةِ إلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ.

وَلِكُلٍّ عُذْرٌ وَأَجْرٌ وَمَنْ اجْتَهَدَ فِي طَاعَةِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهُوَ دَائِرٌ بَيْنَ الْأَجْرِ وَالْأَجْرَيْنِ، وَهَذِهِ السِّيَاسَةُ الَّتِي سَاسُوا بِهَا الْأُمَّةَ وَأَضْعَافُهَا هِيَ تَأْوِيلُ الْقُرْآنِ وَالسُّنَّةِ.
(আত-তুরুকুল হুকমিয়্যাহ, মাকতাবাতু দারিল বায়ান, পৃ. ১৯)

ইবনুল কায়্যিমিল জাওযিয়াহ ইমামত সংক্রান্ত কাজগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন,
وَمَأْخَذُ النِّزَاعِ أَنَّ النَّبِيَّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – كَانَ هُوَ الْإِمَامَ وَالْحَاكِمَ وَالْمُفْتِيَ وَهُوَ الرَّسُولَ، فَقَدْ يَقُولُ الْحُكْمَ بِمَنْصِبِ الرِّسَالَةِ فَيَكُونُ شَرْعًا عَامًّا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَقَوْلِهِ: ( «مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ» ) .

وَقَوْلِهِ: ( «مَنْ زَرَعَ فِي أَرْضِ قَوْمٍ بِغَيْرِ إِذْنِهِمْ فَلَيْسَ لَهُ مِنَ الزَّرْعِ شَيْءٌ، وَلَهُ نَفَقَتُهُ» ، وَكَحُكْمِهِ بِالشَّاهِدِ وَالْيَمِينِ وَبِالشُّفْعَةِ فِيمَا لَمْ يُقْسَمْ) .

وَقَدْ يَقُولُ بِمَنْصِبِ الْفَتْوَى، كَقَوْلِهِ لهند بنت عتبة امْرَأَةِ أبي سفيان، وَقَدْ شَكَتْ إِلَيْهِ شُحَّ زَوْجِهَا، وَأَنَّهُ لَا يُعْطِيهَا مَا يَكْفِيهَا: ( «خُذِي مَا يَكْفِيكِ وَوَلَدَكِ بِالْمَعْرُوفِ» ) فَهَذِهِ فُتْيَا لَا حُكْمٌ، إِذْ لَمْ يَدْعُ بأبي سفيان وَلَمْ يَسْأَلْهُ عَنْ جَوَابِ الدَّعْوَى، وَلَا سَأَلَهَا الْبَيِّنَةَ.

وَقَدْ يَقُولُهُ بِمَنْصِبِ الْإِمَامَةِ، فَيَكُونُ مَصْلَحَةً لِلْأُمَّةِ فِي ذَلِكَ الْوَقْتِ وَذَلِكَ الْمَكَانِ، وَعَلَى تِلْكَ الْحَالِ فَيَلْزَمُ مَنْ بَعْدَهُ مِنَ الْأَئِمَّةِ مُرَاعَاةُ ذَلِكَ عَلَى حَسَبِ الْمَصْلَحَةِ الَّتِي رَاعَاهَا النَّبِيُّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – زَمَانًا وَمَكَانًا وَحَالًا، وَمِنْ هَاهُنَا تَخْتَلِفُ الْأَئِمَّةُ فِي كَثِيرٍ مِنَ الْمَوَاضِعِ الَّتِي فِيهَا أَثَرٌ عَنْهُ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم.َ كَقَوْلِهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: ( «مَنْ قَتَلَ قَتِيلًا فَلَهُ سَلَبُهُ» ) هَلْ قَالَهُ بِمَنْصِبِ الْإِمَامَةِ، فَيَكُونُ حُكْمُهُ مُتَعَلِّقًا بِالْأَئِمَّةِ، أَوْ بِمَنْصِبِ الرِّسَالَةِ وَالنُّبُوَّةِ فَيَكُونُ شَرْعًا عَامًّا؟

এখানে সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নুবুয়তের স্তরের কাজ ও ইমামত স্তরের কাজে অনেক পার্থক্য আছে। (যাদুল মাআদ, ৩/ ৪২৯, ৪৩০)

[৫] ইবনে খালদুন বলেছেন,

وللبادية من أهل العمران طب يبنونه في غالب الأمر على تجربة قاصرة على بعض الأشخاص متوارَثًا عن مشايخ الحي وعجائزه، وربما يصح منه البعض، إلا أنه ليس على قانون طبيعي ولا على موافقة المزاج، والطب المنقول في الشرعيات من هذا القبيل، وليس من الوحي في شيء، وإنما هو أمر كان عاديا للعرب ووقع في ذكر أحوال النبي “صلى الله عليه وسلم” من نوع ذكر أحواله التي هي عادة وجبلة. لا من جهة أن ذلك مشروع على ذلك النحو من العمل فإنه “صلى الله عليه وسلم” إنما بعث ليعلمنا الشرائع، ولم يبعث لتعريف الطب ولا غيره من العاديات، اللهم إذا استعمل على جهة التبرك وصدق العقد الإيماني فيكون له أثر عظيم في النفع وليس ذلك في الطب المزاجي، وإنما هو من آثار الكلمة الإيمانية

(মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদুন, দারুল আওদাহ, পৃ.৩৯১)

[৬] অর্থাৎ শরয়ী বিষয়ের বাইরে শাসক যে ফায়সালা করবেন, তা একান্তই মানবিক। কারণ, শাসকের ইসমতের উপর বিশ্বাস রাখে না আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ। শাসকের কাজ ও কথার ইসমতের উপর বিশ্বাস রাখে শিয়ারা।

[৭] আশরাফ আলি থানুবী রহ. বলেছেন,

علما و سیاست میں کیوں نہیں حصہ لیتے؟ | اگر تم یہ چاہو کہ وہ اس سے آگے بڑھ کر سیاسیات میں عمل بھی حصہ لیں اور تمہارے سیاسی جلسوں اور مظاہروں میں شریک ہوا کریں تو یہ کام ان کا نہیں اور نیم کو اس پر انہیں مجبور کرنے کا حق ہے، تم نے مولویوں کو سمجھا کیا ہے۔ علماء جس کام کو کررہے ہیں وہ اس قدر اہم وضروری ہے کہ فقہاء نے لکھا ہے کہ جس بستی میں ایک ہی عالم ہو اور جہاد شروع ہوجائے تو اس عالم کو میدان جہاد میں جانا جائز نہیں کیونکہ علماء اگر مر جائیں گے تو علم دین کو کون سنجالے گا، اس لیے ہمارے حاجی صاحب علماء کو ہجرت سے منع کرتے تھے کہ اگر تم ہندوستان کو چھوڑ دو گے تو ہندوستان میں دین کا کیا حال ہوگا، اب لوگ اس کو تو دیکھتے ہیں کہ علماء کو سیاسیات میں پڑنے سے خورفقہاء اسلام نے منع کیا ہے۔ بس ان کو الزام دینے سے کام ہے ، مسلمانوں پر جو بھی مصیبت آئے اس کا الزام سب سے پہلے علماء پر ہے۔ (تبلیغ الحدود و القیود 15/ 241)

[৮] ইমাম গাযালি রহ, বলেছেন,

إعلم أن النظر في الإمامة ليس من المهمات، وليس أيضاً من فن المعقولات (بمعنى أنه ليس من العقائد) بل من الفقهيات. بل إنها مثار للتعصبات، والمعرض عن الخوض فيها أسلم من الخائض فيها وإن أصاب، فكيف إذا أخطأ؟
(আল-ইকতিসাদ ফিল ই’তিকাদ, পৃ. ২৩৪)

[৯] উসুলবিদ আমেদী রহ. বলেছেন,

واعلم أن الكلام في الإمامة ليس من أصول الديانات، ولا من الأمور الأبديات بحيث لا يسع المكلف الاعتراض عنها والجهل بها، بل لعمري إن المعرض عنها أرجى من الواغل فيها. فإنها قلما تنفك عن التعصب، والأهواء، وإثارة الفتن، والشحناء، والرجم بالغيب في حق الأئمة والسلف بالازراء، هذا مع كون الخائض فيها سالكاً سبيل التحقيق، فكيف إذا كان خارجاً عن سواء الطريق؟

(গায়াতুল মারাম ফী ইলমিল কালাম, পৃ. ২৩৪)

[১০] আবুল মাআলি জুয়াইনি ‘লামা’ গ্রন্থে বলেছেন,

شروط الإمامة ثلاثة : أحدها : أن يكون الإمام مستجمعا لشرائط الفتوى، الثاني: أن يكون قرشي النسب، الثالث : أن يكون ذا نجدة وكفاءة في العضلات ونزول الدواهي والملحات، فهذه عقيدة أهل السنة والجماعة تلقاها الخلف عن السلف أما فيما تكمل به هداية المسترشدين ويقع به الإقناع في أصول الدين

(হাশিয়াতুল বানায়ী আলা শারহিল যুরকানী, খ.৭, পৃ.৬০)

ইমাম বাকিল্লানী বলেছেন,
إنما يصير الإمام إماما بعقد من يعقد له الإمامة من أفاضل المسلمين الذين هم من أهل الحل والعقد والمؤمنين على هذا الشأن، ليس له طريق إلا النص والاختيار وفي فساد النص دليل على ثبوت الاختيار الذي نذهب إليه

(তামহিদুল আওয়ায়েল, পৃ. ৪৬৭)

[১১] উমর সুলাইমান আশকার ‘তারিখুল ফিকহিল ইসলামী’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬) বলেছেন,

أن الشريعة هي الدين المنزل من عند الله،
والفقه هو فهمنا لتلك الشريعة،
فإن أصبنا الحق في فهمنا كان الفقه موافقا للشريعة من هذه الحيثية،
وإن أخطأ فهمنا الحق المنزل لم يكن هذا الفهم من الشريعة، ولم يخرج عن الفقه

এক্ষেত্রে একটা চিত্র আছে,

image.png

 

আগের সংবাদ‘আল্লাহ কেন দেন বিপর্যয়?’ : বিপর্যয়ের নৈতিক ব্যাখ্যার সন্ধানে
পরবর্তি সংবাদইসলাম ও সায়েন্স ফিকশন