প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে সমকামিতার আইন

মৌলভি আশরাফ:

প্রাচীন গ্রিসে শরীরচর্চার সময় নিয়ম ছিল বিবস্ত্র থাকার। শরীরচর্চা কেন্দ্রে সাধারণত অভিজাত মহলের পুরুষরা যেত, তাদের সীমালঙ্ঘিত আমোদপ্রিয়তা একসময় গতি পায় সমকামিতায়। গ্রিকদের সমকামিতাকে বলা হয় ‘পাইদেরাস্তিয়া’— অর্থাৎ বালকপ্রেম। একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে দাড়িগোঁফহীন উঠতি বালকের প্রেম। এক্ষেত্রে বয়স্ক পুরুষটিকে বলা হতো ‘এরাস্তেস’ বা প্রেমিক আর বালকটিকে ‘এরোমেনোস’ বা প্রেমাস্পদ।

অভিজিৎ রায় তার ‘সমকামিতা’ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে প্রাচীন সভ্যতায় সমকামিতার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমে খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিসের কথা আনেন, এবং সমকামিতাকে ‘সভ্য সমাজের স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তি’ আখ্যা দেন। আমার আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার ‘কারণ’ বলা যায় এই অধ্যায়কেই।

সভ্যতা কোনো সমাজের জনসাধারণের আচরিত কর্মকে বলা হয় না, সভ্যতা হলো কৃত্রিমতার আবরণযুক্ত একটি মৌলিক গুণ। ক্লাইভ বেল তাঁর ‘সভ্যতা’ পুস্তকে বলেন :

‘সভ্যতা সহজাত ব্যাপার নয়, সাধনার সৃষ্টি। সেইজন্য সভ্য মানুষ কৃত্রিম।… সভ্যমানুষ জন্মলাভের পর নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যায়— বিশ্বাস, ধারণা ও বাসনা-কামনার পরিবর্তনের ফলে সে নবজন্ম লাভ করে। কিন্তু বিচারবুদ্ধি ও মার্জিতির ফলে তার ব্যক্তিত্ব সবসময়ই পরিচ্ছন্ন ও আবর্জনামুক্ত, অর্থাৎ অবিকৃত। অসভ্যদের অবস্থা ঠিক তার বিপরীত…। জঙ্গল স্বাভাবিক, বাগান স্বাভাবিক নয়।…কেননা বাগান পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত— কৃত্রিম হলেও তা বিকৃত নয়।’ (মোতাহের হোসেন চৌধুরী অনূদিত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। পৃষ্ঠা ৬২)

গ্রিকরা সভ্য তাদের মাঝে জন্ম নেওয়া কতিপয় প্রভাবক মহান ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিকের জন্য— যাঁরা জগৎ ও জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে উন্নত চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানচর্চার ধারা বজায় রাখবার মতো সূত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাদের অভিজাতদের হেঁয়ালিপনা ও অনৈতিক কারবার নিশ্চয় সভ্যতার দলিল নয়।

দর্শনকে বলা হয় মস্তিষ্কপ্রসূত সকল জ্ঞানের মা। হালে আমরা ইউরোপীয় যে দর্শন চর্চা করি, তার সূতিকাগার গ্রিসস্থ আথেন্সে। মোদ্দাকথায় বলা যায় সক্রেটিস-উত্তর সময়ে তাঁর শিষ্য প্লেটোর হাত ধরে গ্রিকদর্শন একটি নির্দিষ্ট কাঠামো পায়, এবং প্লেটোর কলমে প্রথমবারের মতো আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা অঙ্কিত হয়— গত আড়াই হাজার বছর ধরে যা রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনায় প্রতিনিয়ত প্রাসঙ্গিক, এমনকি গত শতকে যে ধারণার পরিবর্তিত রূপ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

দার্শনিক প্লেটোর লেখায় বারংবার সমকামিতার আলাপ এসেছে। ‘সিম্পোজিয়াম’ পুস্তকে সক্রেটিসের মহানত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আলসেবাইয়াদিজ তার সাথে সক্রেটিসের রাত্রিযাপন এবং কোনোপ্রকার যৌনকার্য না করার কাহিনি উল্লেখ করেন। অভিজিৎ রায় তার ‘সমকামিতা’ বইতে এই ঘটনাকে উল্লেখ করেন বটে, কিন্তু ভিন্ন অর্থ দান করে গতি পাল্টে দেন— পরবর্তীসময়ে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ’ হওয়া আলসেবাইয়াদিজের সঙ্গে সক্রেটিসের মিলন হলে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসের চাকা অন্যদিকে ঘুরতো, এ মতো আঁচ করে তিনি ‘সংযমী’ হোন। অথচ সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড হয় ৪০৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ‘ত্রিশ স্বৈরাচারীর’ পতনের চার বছর পর গণতন্ত্রবাদী শাসকদের ছলাকৌশলে, তাঁর গণতন্ত্রবিরোধিতা ও গণতন্ত্রসমর্থক প্রায় পনেরো শ’ লোককে হত্যাকারী তিন শিষ্য আলসেবাইয়াদিজ ক্রিতিয়াস আর কারিমিদিজের গুরু হওয়ার কারণে;— অর্থাৎ অভিজিৎ রায় যে চাকা ঘোরার কারণ বাতলিয়েছেন, তা ইতোমধ্যে ঘুরে গিয়েছিল।

সক্রেটিসের মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর, আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লেখা প্লেটোর এই পুস্তকে প্রথমে ‘ফিলাইয়া’ বা প্রেম সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের ধারণা উল্লেখ করা হয়, এরপরে সক্রেটিস সেসব যুক্তি খণ্ডন করেন ডায়ালেক্টিক্যাল পদ্ধতিতে। যদিও শেষতক প্রেমের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয় না, কিন্তু অভিজিৎ রায় আলাপচারিতার প্রথমদিকে উল্লিখিত একটি গ্রিক মিথকে (যা পরে খণ্ডন করা হয়) তার মতবাদ প্রমাণে ব্যবহার করেন। যা লুকোচুরি ব্যতীত অন্য কিছু নয়। (সমকামিতা। অভিজিৎ রায়। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪১)

সমকামিতা গ্রিকদের মাঝে থাকলেও তা যে জ্ঞানীদের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় ছিল, এই বিবরণই তার প্রমাণ। তবে সমকামিতা বিষয়ে মহামতি প্লেটোর সবচেয়ে স্পষ্ট ধারণা প্রকাশ পেয়েছে,— অভিজিৎ রায়ের একেবারে এড়িয়ে যাওয়া, অথচ প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ— ‘রিপাবলিক’ এর তৃতীয় পুস্তকে, আদর্শ রাষ্ট্র কেমন হবে এ নিয়ে প্লেটোরই দুই জ্যেষ্ঠ ভাই গ্লাউকন এ আদিমানতাসের সঙ্গে সক্রেটিসের আলাপচারিতায়—

(এখানে প্রথম পুরুষ খোদ সক্রেটিস) : আমি বললাম, ‘…তোমার যে একজন বালক-প্রেমিক আছে বা পূর্বে ছিল, তা জানি।… কিন্তু আমাকে এর উত্তর দাও : আত্মসংযম আর অতিরিক্ত ভোগসুখ কি একসাথে চলতে পারে?’

গ্লাউকন : ‘অবশ্যই না; অতিরিক্ত ভোগসুখ একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতাকে তছনছ করে ফেলে, যেমন অতিরিক্ত বেদনা।’

: ‘অতিরিক্ত ভোগসুখ কি অন্য কোনো সদগুণের সহযোগী হতে পারে?’

: ‘না।’

: ‘ঔদ্ধত্য আর লাম্পট্য?’

: ‘হাঁ, এরাই হলো তার মূল সহযোগী।’

: ‘যৌনসম্ভোগের চাইতে বড়, তীব্রতর কোনো সুখের কথা কি ভাবতে পার?’

: ‘না তা ভেবে পাই না; এর চাইতে বড় উন্মত্ত ভোগসুখ তো আর নেই।’

: ‘আর যে-মানুষ সংযমী ও কন্দর্পকান্তি, তার সুশৃঙ্খল ও পরিশীলিত প্রেমই হচ্ছে খাঁটি প্রেম; তা-ই না?’

: ‘তা তো অবশ্যই।’

: ‘তাহলে সত্যিকারের প্রেমের কি উন্মত্ততার সাথে, অতিরিক্ত কিছুর সাথে কোনো সংযোগ থাকতে পারে?’

: ‘না, তা থাকা উচিত নয়।’

: ‘তাহলে এ কথার অর্থ কি এমন দাঁড়ায় না যে, প্রেমিক এবং প্রেমিকের বালক-বন্ধু, যারা অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে এবং ভালোবাসার পাত্র হয়, তাদের এই ভোগসুখের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা থাকা উচিত নয় এবং তাতে নিমজ্জিত হওয়াও উচিত নয়?’

গ্লাউকন তখন জোরেশোরে প্রত্যুত্তর করল : ‘ঠিক তা-ই। তাদের অবশ্যই কোনো সম্পর্ক করা উচিত নয়।’

: তাহলে আমি ধরে নিতে পারি, যে (আদর্শ) রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি, তাতে তুমি এমন আইন প্রণয়ন করবে যে, প্রেমিক তাদের বালক-বন্ধুর সাথে মেলামেশা করতে পারবে, আর তার (প্রেমিকের) উদ্দেশ্য যদি ভালো হয়, আর বন্ধুটি যদি অনুমতি প্রদান করে, তবে পিতা যেভাবে পুত্রের সাথে আচরণ করে তেমনভাবে তাকে চুমু দেওয়ার, স্পর্শ করার সুযোগ দেওয়া যাবে তাকে; কিন্তু সে যার প্রতি অনুরক্ত, তার সাথে মেলামেশা যেন এর বাইরে কোনো কিছুর প্রতি সন্দেহ জাগ্রত না করে; তা ঘটলে তাকে রুচিবান অথবা সুশিক্ষিত মানুষ বলে বিবেচনা করা হবে না।’

: ‘হাঁ, আমাকে সেভাবেই আইন প্রণয়ন করতে হবে।’…

(প্লেটোর রিপাবলিক। পাঠক সমাবেশ। পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪)

এছাড়াও জীবনের শেষদিকে লেখা ‘আইনকানুন’ গ্রন্থে সমকামিতা প্রসঙ্গে প্লেটোর সংযোজন উল্লেখ না করলেই নয় :

‘পুরুষের মাঝে বীজ বপন করা অপ্রাকৃতিক ও অবৈধ।’ (পুস্তক ৮, পেঙ্গুইন সংস্করণ ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৩৪০)

সমকামিতা বিষয়ে প্লেটোর সামগ্রিক লেখায় সর্বাগ্রে যে দিকটা স্পষ্ট হয়— তিনি জানতেন সমকামী কারা হয় এবং কেন তারা সমকামী। তাঁর প্রজ্ঞামতিত্ব তাই সমকামিতাকে আত্মসংযমের বিপরীত এবং ঔদ্ধত্য ও লাম্পট্যের সহযোগী নয় কেবল, অতিরিক্ত ভোগসুখের ফলাফল বিকৃত কাম আখ্যা দিয়েছে। নারীকামনার কথা এখানে অনুল্লিখিত, কেননা নারীকামনা অতিরিক্ত ভোগসুখের ফল নয়, প্রাকৃতিক— মানবজাতির বংশরক্ষার স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়া।

যৌনতা ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বিষয়। উপভোগের চেয়ে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আগত সন্তান। প্লেটো সিম্পোজিয়াম পুস্তকে বলেন, ‘প্রেম হলো অমরত্ব লাভের বাসনা।’ মানুষের জীবন প্রথমে লক্ষ্যহীন, পরে অপূর্ণ। কারোর লক্ষ্য তৈরি হয় প্রভাবে, কারোর হয় প্রণয়ে। যেভাবেই হোক, সৃষ্টি হয় অপূর্ণতার— কেউই শেষ তক পৌঁছুতে পারে না। বিয়ে হলো জনসাধারণের প্রথম লক্ষ্য তৈরি৷ এর ফলে সন্তান-সন্ততি হয় এবং বেঁচে থাকার ‘চক্র’ তৈরি হয়— আয় ব্যয় ও নিজের অপূরণীয় ইচ্ছার বিস্তার ঘটানোর চক্র। প্রত্যেকেই চান তিনি যা হতে পারেননি তাদের সন্তান যেন তা-ই হয়। প্লেটো একেই বলেছেন অমরত্বের বাসনা, আর এর ফলেই মানবজাতি বংশপরম্পরায় জ্ঞানবিজ্ঞান ধারণ করে আজকের উৎকর্ষতা অর্জন করেছে। সমকামিতায় এই ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়। ভোগবাদ শুধু আজকের জন্য বাঁঁচতে বলে, অথচ আগামীর ভাবনা না ভাবা কোনো জ্ঞানীর কর্ম নয়।

একখানা কৈফিয়ত দিয়ে উপসংহার টানি— সক্রেটিস কিংবা প্লেটো সমকামিতার সমর্থক হলে তা স্বাভাবিক হতো, আমি এমত পোষণ করি না, এই আলোচনা তার জন্যেও নয়। আমি শুধু একথা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছি যে, অভিজিৎ রায় যাদেরকে প্রামাণ্য বানিয়ে হাজির করেছেন আসলে তাঁরা তা নন, বরং তার বিপরীত প্রমাণ।

আগের সংবাদমুসলিম সভ্যতায় গোয়েন্দা ব্যবস্থা
পরবর্তি সংবাদসাইয়েদাতুত তাবিইয়াত হাফসা বিনতে সীরীন