ফরিদ উদ্দিন মাসুদের শাহাবাগ যাত্রা : তাত্ত্বিক মূল্যায়ন

মেহবুব মুসান্না :

মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ. (আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন এবং সৎপথে রাখুন) কে নিয়ে এটা সার্বিক মূল্যায়নধর্মী কোন লেখা নয়। তবে আমি মনে করি তাকে নিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার। যেভাবেই হোক তিনি নিজেকে নানা ইস্যুতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে রাখতে পেরেছেন। অত্যন্ত নির্মোহভাবে যদি মূল্যায়নের কাজটা করা যায়, তাহলে আমরা ব্যক্তি মাসুদকে অতিক্রম করে এখানে একটি চিন্তা ও প্রবণতাকে খুঁজে পাবো। বাংলাদেশে ইসলামিক এক্টিভিজমে এই চিন্তা ও প্রবণতার ব্যাপারে আমাদের অবস্থানগত একটি সমাধানে যাওয়া একান্ত দরকার। এই সামান্য লেখায় সে রকম বিস্তারণের সুযোগ নেই এবং আমার মতো ছোট মানুষের পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

শুধু প্রসঙ্গত একটি কথা বলে রাখি, একজন তরুণ হিসেবে আমার কাছে তাঁর দুটি দিক রয়েছে। এক হলো—শিশুকাল থেকে বার বার শুনে এসেছি তিনি তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী, প্রজ্ঞাবান, গভীর জ্ঞানের ধারক, মনীষী। তার ব্যাপারে নানা রকমের অসাধারণ গল্প শুনে শুনে অবাক হয়েছি। কিন্ত আমার সময়টিতে তিনি এমন কিছু করেননি যার দ্বারা আমি গল্পের উঠোন পেরিয়ে তার প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের গভীরতার কোন বাস্তব-দর্শন লাভ করতে পারি। ফলে, তিনি আমার কাছে একই সাথে একজন মিথ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় একজন সাধারণ মানুষ, যাকে নিয়ে নানা বিতর্ক হয় এবং তিনি নিজেও প্রশ্নবিদ্ধ নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ‍দুটো সত্য স্বীকার করি—কওমি অঙ্গনে বাংলা চর্চার আন্দোলনে তিনি পথিকৃতদের একজন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনে দীর্ঘ সময় প্রধাণের ভূমিকায় থেকে অসংখ্য দরকারি ও মূল্যবান বই বাংলায় প্রকাশ করে এ দেশে ইসলাম চর্চার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া তার বাচনভঙ্গি সুন্দর, চেহারায় ধারালো আভিজাত্য ও সম্মোহন রয়েছে। তার বাঙলা-গদ্য নিটোল, ঝরঝরে, সুখদ। তিনি তার মত করে বুদ্ধিমানও বটে। কিছু কিছু বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আছে, আমার নিজস্ব মূল্যায়ন থেকে একে আমি সঠিক মনে করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার সময়টিতে তাঁর এমন কোন কাজ আমি দেখি না, যা তাকে সত্যিকার অর্থে একজন বিরাট মনীষীরূপে প্রমাণ করতে পারে।

এর বিপরীতে তার এমন অনেক বক্তব্য ও কর্ম দেখেছি, যেগুলো আমার বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে, আমার ধারণাকে বদলে দিয়েছে এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ‍মিথগুলোর ব্যাপারে ‘আসলেই কি এমন?’ প্রশ্নযোগে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। ফলে, আমি আহত হয়েছি, কখনো বিক্ষু্ব্ধও হয়েছি। যাই হোক, তার সামগ্রিক কর্মচাঞ্চল্যের যথার্থ বিশ্লেষণের দায়ভার সময়ের হাতে তুলে দিয়ে আমি আমার মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করি।

২.

তিনি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছেন বোধ করি শাহবাগে গমনকে কেন্দ্র করে। এর আগে উলামা ছাত্র মহলে আলোচিত হলেও বিতর্কিত হয়ে জনপরিসরে প্রবেশ সম্ভবত এই প্রথম। তার যাওয়াটি কি সঠিক? বিষয় অনেক পুরোনো এবং বহুল চর্চিত। ফলে, নতুন করে আবার এই প্রশ্ন হয়তো অনেকের জন্য বিরক্তিকর ঠেকবে। এজন্য এর চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে আমি খুব সাধারণ দৃষ্টিতে কয়েকটি বিবেচনা সামনে আনতে চাই।

শাহবাগে যাওয়ার পেছনে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ হাফিজাহুল্লাহ এর সাধারণ যে যুক্তি, তা খুব পরিস্কার। কাদের মোল্লা একজন যুদ্ধাপরাধী। তিনি খুন, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সাথে জড়িত। তাই তার ফাঁসির দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক। শাহবাগের গণজমায়েত ছিল এই ইস্যুতেই। সুতরাং, এই ইস্যুতে আমি তাদের সাথে সংহতি জানিয়েছি। কেননা অপরাধ যে-ই করুক, ইসলাম তার বিচারকে কামনা করে। এর বাইরে শাহবাগে যারা এসেছিল, তারা কে কেমন, কীরকম আদর্শকে লালন করে, তাদের সে সকল কিছুর সাথে আমি একাত্মতা পোষণ ক হতে যাইনি।

এই যুক্তির মধ্যে একটা সরলতা আছে, নিষ্কলুষ মনোবৃত্তির ধারণা আছে। আমার আপত্তিটা এখানেই। আমি মনে করি সরলতা ও নিষ্কলুষ মনোবৃত্তি নয়; এখানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কিছু জটিল প্রশ্নকে বিশেষ কারণে বুঝতে না চাওয়ার স্বেচ্ছা-বোকামি আছে। একে সোজা বাংলায় বলতে গেলে খুব খারাপ একটা শব্দ উঠে আসবে, এ জন্য আমি ‘স্বেচ্ছা-বোকামি’ শব্দ বলে দিয়ে একটি ঘুর্ণ-পথ অবলম্বন করেছি।

৩.

একটি বিষয় বলে নিই। যুদ্ধাপরাধ (যুদ্ধকালে অন্যায়ভাবে খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, দেশের জনগণের অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান ইত্যাদি) যে-ই করুক, তার বিচার আমি চাই। এই অপরাধী শুধুমাত্র একটি দলের নয়, বরং এমন মানুষ যেখানেই আছে—আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত, বাম বা নির্দলীয় নাগরিক—সকলেরই বিচার করতে হবে, নিরপেক্ষভাবে এবং ইনসাফের সাথে। কিন্তু আওয়ামীলীগ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’-এর নামে একটি দলীয় বন্দুক তৈরী করেছে, যাকে তারা ব্যবহার করেছে নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার কাজে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পথকে সুগম করতে। এখানে অনেক কেলেংকারী হয়েছে, স্বেচ্ছাচারিতা ও বেইনসাফি হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় এর বিবরণ এসেছে। স্কাইপি কেলেংকারি তো বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল। ফলে আওয়ামীলীগ এর এই ধূর্ততা ও রাজনৈতিক কদর্যতাকে ধরতে পারা ছিল কমন সেন্স। তা না করে মাওলানা ফরীদ মাসুদ দা. বা. এই বন্দুকটিকে অত্যন্ত জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন এবং এই ট্রাইবুনাল প্রচুর স্বেচ্ছাচারিতাসহ যে রায় দিয়েছে, তিনি তাকে না মেনে আরো অনেকের সাথে দাবি জানিয়েছেন, ট্রাইবুনাল যেন আরো বেশি স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ফাঁসির রায় প্রদান করে। মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে থেকেও আওয়ামীলীগের এই অন্যায় প্রকল্পের সমালোচনা করতে না পারাটা এই ইস্যুতে একজন আলেম হিসেবে তার বিশেষ এক ব্যর্থতা।

৪.

স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতা ও ক্ষমতাশ্রিত সাংস্কৃতিক বলয় এই দেশে ইসলামি চিন্তা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলমান। তৃণমূল পর্যায়ে ইসলামি জযবায় মানুষ উদ্দীপ্ত, কিন্তু ক্ষমতা-লগ্নতা বিশেষ রকমের এই সংস্কৃতিটি একটি আধিপত্য সৃষ্টি করেছে।

তারা স্বাধীনতা, চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদিকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। সাথে সেক্যুলারিজম ও লিবারালিজমের চর্চার মাধ্যমে ইসলামকে দমন করতে চেয়েছে। সেদিন শাহবাগের আন্দোলনের সূচনা যারা করেছিল, এবং পরবর্তীতে যারা এর নেতৃত্বে এসে যুক্ত হয়েছে, তারা হলো সেই আদর্শের সন্তান। এই ‘ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট’ কারা, তাদের চেহারা কী, তাদের চিন্তা-চেতনা কেমন—এসব তো লুকানো ছিল না। এবং সেদিন তারা শাহবাগে নিজেদের আদর্শ, চিন্তা, প্রবণতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি খুলে রেখে সাধারণ দেশপ্রেমিক হিসেবে এসে হাজির হয়নি। ফলে, ইস্যু যা-ই হোক, সেদিন শাহবাগে এই দলটির উত্থান মানে বাংলাদেশে বিশেষ রকমের এই ‘প্রগতিশীল’দের উত্থান। সুতরাং, শাহবাগে সেদিন কেবলমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষের গণজমায়েত হয়েছিল—শাহবাগ আন্দোলনকে যারা এমন সরলভাবে বিচার করবেন, বলতে হবে তার রাজনৈতিক বুদ্ধিকম, অথবা তিনি শ্রোতাকে ধোঁকাগ্রস্ত করতে চাচ্ছেন। শাহবাগ আন্দোলন ছিল মূলত একটি বিশেষ রকমের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। যদি এই ‘বিপ্লব’কে রুখে দেওয়া না যেত, তাহলে আজকে বাংলাদেশের চেহারা ভয়ংকর রকমের অন্যরকম হতো। মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ কি এই আন্দোলনের এই ক্রিটিক্যাল দিকটা বুঝেন? আমি মনে করি বুঝেন, এবং এরপরও কেন গেলেন সে জন্যই আমি আহত হয়েছি।

৫.
কারো কারো বক্তব্য হলো—পরবর্তীতে বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্লগারদের যে ইসলাম বিদ্বেষ ও আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটূক্তির বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা তার শাহবাগ গমনের পরের ঘটনা। তিনি তখন এসব জানতেন না। এর মানে কি? জানলে তিনি যেতেন না? যদি এমনই হতো, তাহলে এসব প্রাকশিত হওয়ার পর তিনি সেখানে যাওয়ার কারণে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতেন। তা দেননি। বরং এরও অনেক পরে আবার বলেছেন সেখানে গিয়ে আমি জীবনে সবচেয়ে বড় নেক কাজটি করেছি। এমনকি ব্লগারদের এসব কটূক্তির কারণে গণজাগরণ মঞ্চ কি একটিবারের জন্যও প্রতিবাদ জানিয়ে এসবের নিন্দা করেছে? করেনি। বরং, এই একটিভিস্টদেরকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে এবং তাদের আদর্শকে প্রমোট করে একে প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছে। এসব জানার পরও তিনি তার কাজটিকে নেক কাজ হিসেবেই আখ্যায়িত করে গেছেন।

৬.

জামাতে ইসলামির সাথে আমার আদর্শিক দ্বন্দ্ব আছে। আমি মাওলানা মওদুদির বক্তব্য দেখেছি। আমি তার সাথে নানা ইস্যুতে একমত নই। এমনকি মওদুদি চিন্তার বাইরে জামাত-শিবির এ দেশেরে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে নানা সময় অবস্থান নিয়েছে, তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। উলামায়ে কেরামকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা তাদের অন্যতম একটি চরিত্র। আমি জামাত-শিবিরকে অপছন্দ করি। কিন্তু এটাও স্বীকার করি, আমার অপছন্দের বিষয়গুলোর বাইরে জামাত বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ইসলামি চিন্তা ও মনোভাব গড়ে তোলার পেছনে অবদান রেখেছে। তারা ইসলামকে প্রমোট করে। একে আমি অস্বীকার করব কেন? এবং জামাতের সাথে আওয়ামীলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ বা প্রগতিপন্থিদের বিরোধটা ‘মাওলানা মওদুদি’-র বিশেষ চিন্তা নিয়ে নয়। বিরোধ হলো ইসলাম নিয়ে। আমার জামাত-বিরোধিতা ও জাসদ-ছাত্র ইউনিয়নের জামাত বিরোধিতা এক পর্যায়ের নয়। জাসদ ও বামগণ জামাতকে যে অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করে, সে অবস্থানে আমিও বামদের শত্রু। ফলে, সাধারণ অবস্থায় জামাত আমার চিন্তার বিপরীত হলেও বামদের সাথে লড়াইরত জামাত আমার বন্ধু। আজকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে, তার সূচনা হয়েছিল জামাতকে অন্যায়ভাবে দমন করার মাধ্যমে। এ জিনিসটা বুঝবো না কেন? এটা কমনসেন্স। মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ এ জায়গাটা কখনো বুঝতে চাননি। তিনি জামাত বিরোধিতা করতে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সমস্ত জুলুম ও অন্যায়কর্মকে সমর্থন করেছেন। এবং এর মাধ্যমে তিনিও এই ফ্যাসিবাদ কায়েমের একজন প্রত্যক্ষ সহযোগী। জামাতের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি শাহরিয়ার কবিরদের মত প্রকাশ্য ইসলাম বিদ্বেষিদের সাথে গলায় গলায় ভাব রেখে চলেন। জঙ্গিবাদের ইস্যুতেও তার মধ্যে এই প্রবণতা কাজ করেছে। আমি মনে করি এই অন্যায় একরোখা জেদ তাকে শাহবাগের ব্যাপারে সমস্ত বিবেচনা এড়িয়ে সেখানে গিয়ে সংহতি জানাতে প্ররোচিত করেছে, এবং হেফাজতের মত নাস্তিকতা বিরোধী একটি তাওহিদি আন্দোলনে একাত্ম হতে তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বর্তমান বাংলাদেশে তাওহিদী জনতার মধ্যে তার যে খারাপ ইমেজ তৈরী হয়েছে, এর প্রধান সূচনা হয়েছিল এই অন্যায় কর্মটির মাধ্যমেই। দোয়া করি আল্লাহ তাআলা তাকে সঠিক বুঝ দান করুন। এই দোয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে?

আগের সংবাদ শাপলার পক্ষে-বিপক্ষে ধর্মীয় চিন্তার প্রভাব
পরবর্তি সংবাদদেশে আরও ৫ করোনা রোগী শনাক্ত