ফাঁসি ও নিষিদ্ধ সময় : দ্বিতীয় দশকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি

মোঃ আশরাফ আজীজ ইশরাক ফাহিম:

একবিংশ শতক শুরু হয় জামায়াতের জন্য অপার সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা নিয়ে। নয়া শতকের শুরুতেই জামায়াত বিএনপির সাথে জোট গঠন করে রাষ্ট্রশক্তির অংশীদার হয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশেই প্রথম ও একমাত্র ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক হতে পারে। জামায়াতের আমীর মাওলানা নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ক্যাবিনেট মিনিস্টার হন।

তবে ক্ষমতায় থাকাকালেই জামাত সম্ভবত বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের কাছে সবচেয়ে বেশী নেতিবাচক ইমেইজ গ্রহণ করে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং ঘরোয়া রাজনীতিতে ঘটতে থাকা কিছু ঘটনার আঁচ তাতক্ষনিকভাবে জামায়াতের গায়ে না লাগলেও একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জামায়াতের সাথে হওয়া নজিরবিহীন জুলুমের রাস্তা তৈরী করে দেয়। স্থান সঙ্কটের কারণে আমি খুব সংক্ষেপে এই ঘটনাগুলি উল্লেখ করে মূল আলোচনায় চলে যাচ্ছি।

নাইন ইলেভেন ছিল একটা যুগান্তকারী মুহুর্ত। এর ফলে ইসলামপন্থী দলগুলির ক্ষমতা ও কর্মপদ্ধতি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন, বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগ-ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে নৈরাজ্য-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও শিবিরকে খুব সন্তর্পনে পা ফেলতে হয়। কারণ, ছাত্র ইউনিয়ন যখন সন্ত্রাস করে সেটা শুধুই সন্ত্রাস। কিন্তু শিবির সহিংসতায় জড়ালে সেটা হয়ে যায় টেররিজম-জঙ্গীবাদ।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নাম করে জামায়াতকে কোনঠাসা করার প্রক্রিয়াটা নব্বইয়ের দশকে শুরু হলেও একবিংশ শতকের প্রথম দশকে হালে পানি পায়। জামাত ক্ষমতার সঙ্গী হওয়ায় ক্ষমতার ব্যাপারে মানুষের সন্দিগ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতবিদ্বেষকে উসকে দেওয়া সহজ হয়। সাথে সেকুলার মিডিয়া ও সুশীল সমাজের নিয়মিত প্রোপাগান্ডা তো ছিলই। শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের সাথে জামায়াতের দূরত্ব তৈরী হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, রগ কাটা পার্টি ইত্যাদি শ্লোগানের মাধ্যমে জামায়াত-শিবির অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে অবাঞ্ছিত হয়ে যেতে থাকে। একাত্তরে সেকুলার বাঙালি জাতীয়তবাদের করা বিহারী গণহত্যাসহ অন্যান্য পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ প্রশ্ন জোরালোভাবে হাজির করতে না পারা সহ নানান ব্যর্থতাকে সাথে নিয়ে দ্বিতীয় দশক শুরু হয়। দ্বিতীয় দশকে মূলত এই সমস্যাগুলিই আরও প্রকট আকার ধারণ করে সর্বসম্মুখে হাজির হয়।

শাহবাগ

শাহবাগের মাধ্যমে একাত্তর প্রশ্নে জামায়াতকে নাজেহাল করা হয়। শাহবাগের বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের ডিস্কোর্সটা এমন যে এখানে পাকিস্তানকে সমর্থন করা বা পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করার অর্থই যুদ্ধাপরাধ। আর যারাই একাত্তরে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে তারা যুদ্ধাপরাধী। জামাত বারবার বলেছে যে তারা একাত্তরে রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। কিন্তু এটা তো যথেষ্ট না। সামরিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও কি সেটা যুদ্ধাপরাধ?

যুদ্ধের আগে, যুদ্ধের সময়, ও যুদ্ধের পরে বিহারী হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনও যুদ্ধাপরাধ।
শুধু তাই না, নন-কম্ব্যাটান্ট এবং সিভিলিয়ান পাকিস্তানী হত্যাও যুদ্ধাপরাধ। যেমন, হুমায়ুন আহমেদ ও জাফর ইকবালের নানাকে হত্যা করাটা যুদ্ধাপরাধ যেহেতু উনি নন-কম্ব্যাটান্ট তো বটেই, সিভিলিয়ানও ছিলেন।
অনেকে ভুলে যান যে শান্তি কমিটি কিন্তু কোন কম্ব্যাট্যান্ট ফোর্স না। এটা একটা সিভিলিয়ান কমিটি। মুসলিম লীগ, জামাতসহ প্রো-পাকিস্তান সিভিলিয়ান যতজনকে হত্যা করা হয়েছে সব যুদ্ধাপরাধ।
অধিকন্তু, যুদ্ধবন্দীদের নির্যাতন এবং হত্যা যুদ্ধাপরাধ। যেসমস্ত রাজাকার, আল বদর, আল শামসকে যুদ্ধের পর নির্যাতন এবং/অথবা হত্যা করা হয়েছে সেগুলিও যুদ্ধাপরাধ। বা এমনকি যুদ্ধের সময়ও আত্মসমর্পনের পর তাদেরকে হত্যা করা হলে সেটাও যুদ্ধাপরাধ।

আজকে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ চমকে উঠবে যদি তাদেরকে বলা হয় যে একজন পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করেও যুদ্ধাপরাধী হতে পারে কারণ তাদের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে যুদ্ধাপরাধ কেবল পাকিস্তানপন্থীরাই করতে পারে। যুদ্ধ আর যুদ্ধাপরাধ তো এক না। যুদ্ধাপরাধ যেকোন পক্ষই করতে পারে।
পাকিস্তানে বিহারী গনহত্যাকে জাতীয়ভাবে খানিকটা হাইলাইট করা হলেও বাঙ্গালী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধাপরাধ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কোন ধরণের বয়ানই নির্মাণ করে নাই।

কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। একমাত্র ভুট্টোর দল পিপিপি সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। একাত্তরে উভয় পাকিস্তানের শাহবাগীরা ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভেঙ্গেছে – এই ন্যারেটিভ এস্টাবলিশ করা গেলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দেশেই শাহবাগীদের পরাজিত করা সম্ভব ছিল।
কিন্তু পাকিস্তানে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি কখনোই বিহারী ও বাঙ্গালী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধাপরাধকে পাকিস্তানের জাতীয় ইস্যু বানায় নাই। বাংলাদেশ জামাতের সাথেও পাকিস্তান জামাতের যোগাযোগে সমস্যা ছিল যেটা আমি পাক জামাতের আমীর সিরাজুল হকের এক সাক্ষাতকার থেকে এবং ট্রাইবুনালের ব্যাপারে পাক জামাতের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝতে পারি। নিদেনপক্ষে বিহারী গনহত্যাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে চাপ দিতে পারত পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি। সেটা হয় নাই।

ইমেজ সঙ্কট

স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্সের ফলে শিবিরের সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা এলিট তারা আর ফেসবুক প্রোফাইলে শিবির যুক্ত করেন না। কানাডা-আমেরিকায় পড়াশোনা করছেন এবং এককালে শিবিরের নেতা বা কর্মী ছিলেন? ফেসবুক প্রোফাইলে তার কোন প্রমাণ নাই। বড় কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন যে চাকরির প্রতি সোলায়মান সুখন ভক্ত বাঙ্গালী যুবক যুবতী লালায়িত? ফেসবুক প্রোফাইলে শুধু ঐ প্রতিষ্ঠানে চাকরির তথ্যই আছে, শিবির সংশ্লিষ্টতার তথ্য নাই। দেশের মধ্যে থাকলে এটা তো আরও সত্য। বড় বড় মিডিয়া হাউজ, সরকারি-বেসরকারি চাকরি, সিভিল সোসাইটিতে ঢুকতে গেলে সবার আগে শিবির পরিচয় লুকাতে হয়।
যেহেতু জামাত-শিবিরের “সফল” এবং এলিট মহলে প্রবেশ করতে মুমকিন হওয়া সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মীরা তাদের রাজনৈতিক অতীত লুকায় কিন্তু ছাত্রলীগ, বা বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠন (উদাঃ ছাত্র ইউনিয়ন) থেকে “সফল” এবং এলিট হওয়া ব্যক্তিবর্গ তাদের পরিচয় লুকান না, এর ফলে যে চিত্রটা দাঁড়ায় তা হচ্ছে শিবির লুজারদের সংগঠন, অন্যদিকে অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা অনেক “খিউল”। অন্যসব সংগঠন থেকেই কেবল “সফল” আর এলিট হওয়া যায়। আর শিবির করে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া “গ্রামের চাচাতো ভাইরা”। কারণ কেবলমাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া “গ্রামের চাচাতো ভাই”রা তাদের শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে।

ফলে, রাজনৈতিক দল হিসাবে জামাত-শিবিরের আকর্ষণ শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের কাছে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। এমন এক সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা যেখানে সত্যের চেয়ে ইমেইজ-খিউলনেস বেশী পলিটিকাল ওয়েট ক্যারি করে, সেখানে এধরণের ইমেইজ ক্রাইসিস শুধু রিক্রুটমেন্টে না বরং রিটেইন করার ক্যাপাসিটিতেও আঘাত হানে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকে ভাবতে শুরু করে খিউল হওয়ার জন্য এই দল ত্যাগ করা বা দলীয় সংশ্লিষ্টতার কথা গোপন করা জরুরী। তখন তারা দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে সেকুলারদের সাথে দহরম মহরম শুরু করেন। এর ফলে দলের অভ্যন্তরে বিভেদ, ইগো ক্ল্যাশ, সাইকোলজিকাল-সোশাল সলিডারিটি ভেঙ্গে পড়ার মত ঘটনা তৈরী হয়।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত শিবিরের ছেলে বলতে একজন আদর্শবাদী মেধাবী ছাত্র বোঝানো হত। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে শিবিরের ছেলের সেই ইমেজটা হারিয়ে যায়। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশটার মাঝে শিবিরের আবেদন ফিকে হয়ে আসে।

জামায়াত বা শিবির করে যে সোশাল ও সাইকোলজিকাল সলিডারিটি পাওয়া সম্ভব সেই সলিডারিটির মূল্য ফিকে হয়ে আসে। অনেকে এই সলিডারিটির বদলে শাহবাগীদের সান্নিধ্যকে বেশী আকর্ষণীয় মনে করতে থাকেন।
প্রতিষ্ঠান হারানোঃ সূচনালগ্ন থেকে প্রথম দশক পর্যন্ত জামায়াত অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছিল। গনমাধ্যম থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও শিক্ষাখাতে জামায়াতের ছিল বিশাল অংশীদারিত্ব। দ্বিতীয় দশকে এর বড় অংশ বেহাত হয়ে যায়। এর ফলে জামায়াত-শিবিরের সাথে যুক্ত হওয়ার আর্থিক প্রনোদনা হ্রাস পায়। আগে ইসলামী ব্যাংকে চাকরির আশায় শিবির করলেও এখন আর সেই সুযোগ নাই। দেখা যেত শিবিরের মধ্যে যারা একটু সংস্কৃতমনা এদেরকে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থায় চাকরি দেওয়া বা দেশ-বিদেশে নানান সুবিধা পাইয়ে দেয়া হত। বর্তমানে এসবের অভাবে শিবিরের ঐসমস্ত ছেলেরা শাহবাগী অল্টারনেটিভের দ্বারস্থ হচ্ছে।

বিদেশী নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়াঃ বিশ্ব রাজনীতির মধ্যে পরিবর্তনের সাথে ঘরোয়া গোলযোগ ঘনীভূত হয়ে জামায়াতের বিদেশী যে যোগাযোগ ছিল তা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে বলা যায়। একসময় সৌদি আনুকুল্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরী করে জামায়াত। মধ্যপ্রাচ্যের এই নেটওয়ার্কের ফলে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবেও জামায়াত ছিল লোভনীয় অবস্থানে। আরব রাজদরবারগুলিতে গোলাম আযমের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে আরব রাজতন্ত্রগুলি ইসলামপন্থার ব্যাপারে নেতিবাচক হয়ে উঠতে শুরু করে। এর প্রথম প্রকোপ ব্রাদারহুডের ওপর পড়লেও জামায়াতের ওপর এর প্রভাব স্পষ্ট হয় একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। আরব বসন্ত পরবর্তী বিশ্বে ইসলামপন্থা আরও অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারদের কাছে। সৌদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাওলানা মওদূদীর বই নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

জামায়াত নেতাদের হত্যা ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি কিছুই করে নাই। উপরন্তু তারা সেকুলার স্বৈরাচারকেই নানাভাবে সহায়তা করেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক পরিসরেও জামায়াত মধ্যপ্রাচ্যের সহায়তা পায় নাই। জামায়াতের স্থলাভিষিক্ত হয় আহলে হাদীস গোষ্ঠী। যদিও আহলে হাদীসের উত্থানপর্বে জামায়াতের বড় অবদান ছিল। কিন্তু জামায়াতের দুঃসময়ে আহলে হাদীসরা জামায়াতের তুমুল বিরোধিতা করে এবং সৌদি কানেকশন ও অর্থায়ন থেকে জামায়াতকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্ছিত করে।

তুরস্কের সাথে জামায়াতের সম্পর্কের একটা গুঞ্জন শোণা গেলেও আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে এটা কতখানি পোক্ত তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। সম্প্রতি তুরস্ক বাংলাদেশের সেকুলার স্বৈরশাসনের সাথে সহযোগিতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জামায়তের প্রতি তুরস্কের বিশেষ কোন সহায়তাও দেখা যায় না। জামায়াতের অনেকে তুরস্কে গিয়েছেন কিন্তু সেটাও মূলত ব্যক্তি উদ্যোগে এবং ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে। আনুষ্ঠানিক কোন সম্পর্কের ফসল বলে সেটা প্রতীয়মান হয় না। বাংলাদেশে জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থী গালি খেতে হলেও রাষ্ট্র হিসাবে কখনোই জামায়াত পাকিস্তানের বিন্দুমাত্র সমর্থন পায় নাই। এই দশকেও সেই ধারা চলমান থাকে।

বৈশ্বিক ইসলামপন্থী দলগুলির সাথেও জামায়াতের দূরত্ব তৈরী হয়েছে। গোলাম আযমের মত বৈশ্বিক পরিচয় খোদ নিজামীরও ছিল না। পরবর্তী জামায়াত নেতৃত্বের মধ্যে এই যোগাযোগের অভাব আরও প্রকটভাবে দেখা যায়। জামায়াত নেতাদের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান জামায়াতের বক্তব্য-বিবৃতি-কর্মসূচীই বলে দেয় উভয় দেশের জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগের অভাব কতখানি।

উগ্রবাদের বিস্তার ও বিফল বিনিয়োগঃ জামায়াতের ব্যর্থতার ফলে জামায়াতে নানামুখী উগ্রবাদী চিন্তা ভর করে। জামায়াত-শিবিরের একটা অংশ সন্ত্রাসবাদকে অধিক কার্যকরী ভাবতে শুরু করে। অনেকে শিবির ছেড়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে যায়। অন্যদিকে আরেকটা অংশ আবার ইসলামবিদ্বেষী নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ে। ধর্ম, ধার্মিকতা ছেড়ে তারা বিপরীত দিকের উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হয়। যেসব ব্যক্তিকে জামায়াত গড়ে তুলেছিল বা তুলছিল তারা অনেকে পরে জামায়াত তো বটেই খোদ ইসলাম ও ইসলামপন্থার ব্যাপারে আস্থাহীন হয়ে পড়ে। জামায়াত-শিবিরের সেক্টরভিত্তিক লোক তৈরী প্রজেক্ট একারণে মুখ থুবড়ে পড়ে।

সেকুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ভয়াবহ ভ্যাকুয়ামঃ জামায়াত-শিবিরের পতনের ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেকুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি। আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় জামায়াত-শিবির সবসময় বাঙ্গালীকে স্বীয় পরিচয়ের সাথে সংযোগ রাখার একটা সুযোগ রেখেছিল। একইসাথে আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজের মূলধারায় থাকা এবং ইসলামী একটা ফ্লেভার – এটা ছিল জামায়াত-শিবিরের প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের পতনের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পরিচয়ের সঙ্কট আরও জোরালো হয়ে পড়ে। এর ফলে সমাজত্যাগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সুবিধা হয়। মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীও জামায়াত-শিবিরের এই স্থান নিতে এসে সমাজে অস্থিরতা এবং হাস্যরসের জন্ম দেয়।

গভীর বি-ইসলামীকরণ

জামায়াতের পতনের সবচেয়ে বড় প্রভাব সম্ভবত বাংলাদেশের গভীর বি-ইসলামীকরণ। বাংলাদেশের পাবলিক ডিস্কোর্স এখন মৌলিকভাবে বিইসলামিয়ত। এখানে ইসলামপন্থী দলগুলি আর ইসলামী বা ইসলামপন্থী রিজনিং ব্যবহার করতে পারে না। জনপরিসরে তাদের অবস্থান জানান দিতে হয় কিংবা নানান দাবী দাওয়া নিয়ে সামনে আসতে হয় শাহবাগী রিজনিং ও ডিস্কোর্স ব্যবহার করে।

এই দশ বছরে জামায়াতের ওপর হওয়া জুলুমের সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল শুধু এই কয়টা বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তবে আমার কাছে এইগুলিই গুরুত্বসহকারে ধরা পড়েছে। জামায়াতের পতন আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরও একবার দেখিয়ে দেয় যে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের জন্য সহিংসতা ও জুলুম খুবই কার্যকরী। আত্মবিশ্বাসের সাথে ও একাগ্রচিত্তে জেল-ফাঁসি-দখল করতে থাকলে সফলতা আসবেই। একটা পর্যায়ে যেয়ে জুলুমের স্বীকৃতি-সমালোচনা হয়ত অনেকেই করবে, কিন্তু জুলুমের ফলে ঘটে যাওয়া সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের কোন প্রতিবিধান হয় না। কলোনিয়ালিজমের সমালোচনা অনেক শাহবাগীও করেন। কিন্তু কেউ আর মোঘল রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী তোলেন না। বরং কলোনিয়ালিজমের ফলে ঘটা বিইসলামীকরণের সুবিধা তারা ভোগ করেন এবং একে ধনাত্মক হিসাবেই মনে করেন। ভবিষ্যতেও কোন একসময় হয়ত নিজামী-মুজাহিদের হত্যাকান্ড নিয়ে আলোচনা হবে। কোন স্লিভলেস পরিহিতা চোশ্ত আংরেজী ও ফ্রেঞ্চ বলনেওয়ালা সুদর্শনাই করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির যে বিইসলামীকরণ হয়ে গেছে সেটার বিচার করার জন্য দৃঢ় সংকল্প ও মেহনতের আঞ্জাম দেওয়ার মত খোদার বান্দা দরকার তা আপাতত বাংলার জমিনে আছে বলে এই অধমের নজরে আসছে না।

আগের সংবাদআজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখার নির্দেশ
পরবর্তি সংবাদএবছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অভিযানে ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত