ফিফার সহায়তায় ফিলিস্তিনের ফুটবল ডাকাতির গল্প

রাকিবুল হাসান নাঈম:

‘ফিলিস্তিনিদের জন্য খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি প্ল্যাটফর্ম। ফিলিস্তিনি ফুটবল ম্যাচের প্রতিটি দিক, তথা দলের নাম, জার্সি, খেলোয়াড় এবং শহীদদের নাম এর সাক্ষ্য বহন করে। ফিলিস্তিনে ফুটবল একটি রাজনৈতিক তৎপরতা।’

-রামজি বারুদ, ফিলিস্তিনি লেখক

অবৈধভাবে ইহুদিদের দখলকৃত পশ্চিম তীরের ছয়টি ফুটবল ক্লাবকে ইসরায়েলি লীগে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত রাখতে ফিফাকে অনুরোধ করেছিল ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিব্রিল আল রাজুব ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, এক্ষেত্রে উয়েফা হতে পারে আমাদের দৃষ্টান্ত। ২০১৪ সালে সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করার পর রাশিয়াও চেয়েছিল ক্রিমিয়ান ক্লাবগুলো রাশিয়ান লীগে খেলুক। কিন্তু ফিফা অনুমোদন দেয়নি। অথচ ২০১৭ সালে ফিফা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা দখলকৃত পশ্চিম তীরের ক্লাবগুলোকে দখলদার ইজরাইলের লীগে খেলতে বাধা দিবে না। অথচ, চলতি বছর ইউক্রেনের উপর সামরিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সকল ক্লাব ও জাতীয় দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ফিফা) ও ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা (উয়েফা)।

এই চিত্রটি প্যালেস্টাইনের সাথে বিশ্বব্যাপী ফুটবল ব্যবস্থার ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে ভালো একটি ভূমিকা রাখবে। বুঝা যাবে, ফিলিস্তিনের সঙ্গে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস অবহেলার ইতিহাস, ঔপনিবেশিক বৈধতার ইতিহাস। ফিফার সহায়তায় অনেক আগেই ফিলিস্তিনের ফুটবল দল ‘চুরি’ হয়ে গিয়েছিল ইহুদিদের হাতে। সেই ইতিহাসই আজকের নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়।

জাতীয় দল ডাকাতির গল্প

১৯২৮ সালে ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হবার পরের বছরই ফিফাতে যোগ দিয়েছিল তারা। কিন্তু ফিফা ফিলিস্তিনি বা আরব ছিল না, ছিল ইহুদি অভিবাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ইউনিয়ন এবং সম্পূর্ণরূপে ইহুদি দলের আধিপত্যে পরিচালিত। প্রথমদিকে, নতুন ফেডারেশন হিসেবে ফিলিস্তিনি দলের পক্ষে ফিফায় যোগ দেওয়া যুক্তিসঙ্গত ছিল না। তার ওপর এ দেশে আরবরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ইহুদিরা সংখ্যালঘু। কিন্তু তবুও ফিফা তাদেরকে দলে নেয়। কারণ, ফিফা আরবদেরকে ফিফায় যোগ দিতে আহ্বান জানিয়ে আসছিল। ফিলিস্তিনি দলকে অনুমোদন দিয়ে ফিফা নিকৃষ্ট একটি কাজ করে। তারা ফিলিস্তিনি দলের কর্তৃপক্ষ বদলে দেয়। সেখানে নিয়োগ পায় ইহুদিরা। ইজরাইলিরা যেমন দেশ দখলের চেষ্টা করছিল, তেমনি দখল করে নেয় ফিলিস্তিনের ফুটবল দল। নাম একই থাকে, জার্সিও একই থাকে। ফিফাও এই দলকে আরবদের দল বলে প্রচার করতে থাকে।

ইহুদিরা ফিলিস্তিন ফুটবল দলের লোগো এবং ভাষাকে হিব্রুতে রূপান্তর করার আগে দলের একটি জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করেছিল। তাতে তারা ব্যবহার করেছিল ইহুদিবাদি প্রত্যাশা। সঙ্গীতের চরণে লিখেছিল, ‘আমাদের বুকে এখনও প্রত্যাশা আছে, আছে ইহুদি হৃদয়, যার বয়স হাজার বছর। আমাদের চোখ তাকিয়ে আছে জায়নবাদের দিকে, যেন আমরা হতে পারি একটি স্বাধীন জাতি।’

ফিফা এই ইহুদি ফেডারেশনকে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে থাকে। এই দল ১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলে। ‘৩৪ সালের বিশ্বকাপে মিশরের সঙ্গে খেলেছিল দুই ম্যাচ। প্রথমটিতে ৮–১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। তবে মিশর লক্ষ্য করেনি, যে দলটির সঙ্গে তারা খেলেছে, তা আসলে ফিলিস্তিনের নয়, বরং ইহুদিদের।

ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের ভূমি হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য খেলাধুলা ছিল ইহুদিবাদী আন্দোলনের প্রবেশদ্বার। ইহুদিবাদীরা অপেশাদার অ্যাথলেটিক্সের মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

ফিলিস্তিনেদের প্রচেষ্টা

এই প্রারম্ভিক ইহুদিবাদী হাইজ্যাকিংয়ের মুখোমুখি হয়ে ফিলিস্তিনিরা অপেক্ষাকৃত বিলম্বিত, কিন্তু তীব্র ক্রীড়া প্রতিরোধের প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। ১৯৪৫ সালে জাফার ইসলামিক ক্লাবে অবস্থিত রিয়েল প্যালেস্টাইন ইউনিয়নের সাথে ২৫টি ক্লাব যুক্ত ছিল। ফিলিস্তিনি ক্লাবগুলির বিরুদ্ধে ইহুদিবাদীদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, গ্রেপ্তার এবং হয়রানি সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের মধ্যে ক্লাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬০ টিতে। রিয়েল প্যালেস্টাইন ইউনিয়ন মিশরের মধ্যস্থতায় ফিফার স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জায়োনিস্ট ফেডারেশনের চাপে তা আর হয়ে উঠেনি।

রিয়েল প্যালেস্টাইন ফেডারেশনের উল্লিখযোগ্য লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল: ফিলিস্তিনের আরব ক্লাবগুলির মধ্যে সমন্বয় এবং ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলির মধ্যে ক্রীড়া সম্পর্ক স্থাপন। সেই চল্লিশের দশকে ফিলিস্তিনিরা দলের জন্য যে নাম বাছাই করেছিল, তা ছিল ইসলামিক সামরিক ইতিহাস দ্বারা অনুপ্রাণিত। যেমন একটি দলের নাম ছিল ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’, আরেকটির নাম ছিল ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবি’। ফিলিস্তিনে খেলাধুলা ছিল নতুন প্রজন্মের একটি অভিব্যক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার বিষয়ে তাদের সচেতনতা।

নাকবার পরে, ফিলিস্তিনিরা তাদের চুরি হওয়া স্বদেশের মতোই তাদের চুরি হওয়া প্রতীক পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ লক্ষ্যে ফিলিস্তিনি ফেডারেশন কাজ চালিয়ে যায়। তারা ১৯৫১ সালে আবার ফিফাতে যোগদানের জন্য চেষ্টা করে। ইসরায়েলি ফেডারেশনের ষড়যন্ত্রে ফিফা যোগদানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ হিসেবে তারা বলে, পশ্চিম তীরের কোনো আন্তর্জাতিক আইনি মর্যাদা নেই।

ষাটের দশকেও ফিলিস্তিনিদের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। এবার গাজা স্ট্রিপের মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়। কারণ গাজার তো আন্তর্জাতিক মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু ফিফা এবার বলে বসে, প্যালেস্টাইন নামে কোন রাষ্ট্র নেই, এবং তাই প্যালেস্টাইন ফেডারেশনের অনুরোধ গ্রহণ করা যাবে না। এ অস্বীকৃতি সত্ত্বেও থেমে যায়নি তারা। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৯ সারে আরও দুবার চেষ্টা করে ফিফায় যোগদানের। ‘ফিলিস্তিনের কোন আন্তর্জাতিক আইনি মর্যাদা নেই’ এই অজুহাতে ফিফা তাদের প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে অসলো চুক্তি এবং ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দেশে ফিরে আসার পর ১৯৯৮ সালে ফিফা ফিলিস্তিনের সদস্যপদ গ্রহণ করে।

শেষকথা

ফিফায় যোগদানের পর থেকে ফিলিস্তিনি ফুটবল অনেক ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হয়েছে৷ ২০১২ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজার ফিলিস্তিন স্টেডিয়াম, ফিলিস্তিনি অলিম্পিক কমিটির ভবন, ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, ইয়ারমুক স্টেডিয়াম, আল-শামস ক্লাব, আল-শুহাদা ক্লাব, আল-শামস ক্লাবে বোমাবর্ষণ করে। নুসিরাত ক্লাব, রাফাহ স্টেডিয়াম এবং অন্যান্য ক্রীড়াঙ্গন লক্ষ্যবস্তু বানায়। তারা ফিলিস্তিনের খেলাধুলার অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে চায়। কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সমস্ত বাধা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি দল এগিয়ে যাচ্ছে। এএফসি এশিয়ান কাপে ফিলিস্তিন এ পর্যন্ত ২ বার অংশগ্রহণ করেছে, যার প্রত্যেকবার তারা গ্রুপ পর্বে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়াও, ফিলিস্তিন ২০১৪ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের শিরোপা জয়লাভ করেছে। পাশাপাশি জাতীয় দল টানা তৃতীয়বারের মতো ২০২৩ এএফসি এশিয়ান কাপের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছে। তবে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন তাদের এখনো তাড়া করে।

সূত্র: আল জাজিরা

আগের সংবাদআফটার স্কুল মাকতাব : প্রাথমিক ধর্মশিক্ষায় নতুন প্রয়াস
পরবর্তি সংবাদইসলামি ব্যাংকে অস্থিরতা : আলেমদের উদ্বেগ