ফিলিস্তিনি জেলসাহিত্য

হবিবুল্লাহ বাহার:

কোন মার্জিত রুচিসম্পন্ন মানুষই কারাবাস পছন্দ করবেন না নিশ্চয়ই। কারাগারের দুঃসহ বদ্ধজীবন, করুণ নিঃসঙ্গতা, পুষ্টিকর খাদ্য ও বিনোদনের অভাব, মানসিক যাতনা, শোচনীয় প্রতিবেশ, অপমান, বৈষম্য ও লাঞ্ছনা- সব মিলিয়ে অসহনীয় এ পরিবেশ মানুষকে বিকারগ্রস্থ করে তুলতে যথেষ্ট। কিন্তু এমন প্রতিকূল মুহূর্তগুলোতেও বিস্ময় জাগানিয়া সৃজনশীলতার পরিচয় দেন সংগ্রামী মানুষেরা। একান্ত নিজস্ব এই সময়ে তারা রচনা করেন প্রতিরোধ সংগ্রামের মহাকাব্যিক আখ্যান। জেলের কষ্টকর তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো দার্শনিক ভাবের রূপ নিয়ে তাদের হৃদয়ের প্রতিটি অলিন্দে সৃজন করে অপার এক শক্তির। জেল অভিজ্ঞতায় থাকে বিপ্লবাত্মক চেতনার বিপুল উপাদান। স্বজাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নিরাময়কল্পে সাহিত্য সাধকদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়।

নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়া ফিলিস্তিনি সাহিত্যসেবীদের ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য। দখলদার ইজরাইলের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের জেল সংগ্রামের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। ইজরাইলি নিপীড়ন ফিলিস্তিনি সাহিত্যে সৃষ্টি করেছে ‘জেল সাহিত্য’ নামের গৌরবময় এক স্বতন্ত্র সাহিত্য ধারার। ফিলিস্তিনি জেল সাহিত্য বিশ্বের সবচাইতে সমৃদ্ধ প্রতিরোধ সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।

দখলদার ইজরাইলের অমানবিক নিপীড়ন, জাতিগত নিষ্পেষণ, আগ্রাসন ও হত্যালীলার বিপ্রতীপে ফিলিস্তিনিদের বুকে দানা বেঁধেছে বিপ্লবের অগ্নিবীণা। এখানে সশস্ত্র যুদ্ধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে ওৎপ্রোতভাবে। সশস্ত্র লড়াইয়ে ফিলিস্তিনিরা ইতোমধ্যেই সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জনতার সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রধান সহযোগী হয়ে উঠেছে বিপ্লবীদের জেল সাহিত্য। এ সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তেজস্বী বিপ্লবী প্রতিবাদী মনোভাব, হৃদয়াবেগ ও ভাবোচ্ছ্বাসের আধিক্য, প্রাঞ্জলতা ও মর্মস্পর্শী ভাবের সরব উপস্থিতি ও বীর রসের যোজনায় রূপকাশ্রিত প্রকাশভঙ্গি।

ফিলিস্তিনি জেলবন্দীদের বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প

পৃথিবীর অন্যতম নির্দয় নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ইজরাইলি কারাগারগুলোর কুখ্যাতি রয়েছে। এখানে নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের এতসব নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করা হয় যা কল্পনাতীত। বন্দিদের আইনি সুরক্ষা নেই। বিনা বিচারে আটক রাখা হয় এবং জোরপূর্বক তথ্য আদায়ের লক্ষ্যে বন্দীদের অমানবিকভাবেভাবে পিটানো, দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখা, খাদ্য-পানীয় না দেয়া, তীব্র আলোর ঝলকানি, প্রবল শীতের রাতে বরফে শুইয়ে দেয়া, ইলেকট্রনিক শক, চাবুক মারা, যৌন নির্যাতন, মাথায় কালো ব্যাগ পরিয়ে দেয়া, বাথরুমের ভিতরে রাতে ঘুমাতে বাধ্য করা, ওয়াটার বোর্ডিং, হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলাসহ আইন-বহির্ভূত নানা উপায়ে নির্যাতন করা হয়। ফিলিস্তিনিদের বিপ্লবী হয়ে ওঠা ছিল এই নির্মম নিপীড়নের যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া। গবেষণা জরিপগুলো বলছে, ৮০ ভাগ ফিলিস্তিনিকেই জীবনের কোন একটি সময় জেলে কাটাতে হয়েছে।

যেভাবে পৌছায় কাগজ-কলম

ইজরাইলি জেলে কাগজ-কলম পৌঁছানো প্রথমদিকে মোটেই সহজ ছিল না। সে সময় বন্দীদের জীবন বাজী রেখে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হতো। ১৯৭০ সালের দিকে বন্দীরা কাগজ কলমের দাবীতে একযোগে অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও রেড ক্রিসেন্টের অব্যাহত চাপে ইজরাইল সরকার সীমিত আকারে সাহিত্যের বইপুস্তক ও কলম কাগজ পৌছাবার অনুমতি দেয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনি জেল সাহিত্যের স্বর্ণযুগ।

জেল সাহিত্যের উত্থান

ফিলিস্তিনি জেল সাহিত্যের উত্থান মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকেই। ১৯৩৭সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী ইওয়াদ নাবলুসি রচনা করেন বিখ্যাত কবিতা ‘নিশিরাত ছেড়ে দাও আমাকে’। যা মুক্তি সংগ্রামে প্রেরণা, আবেগ ও শক্তির উৎস হয়ে উঠে। পরবর্তীতে ইজরাইলি দখলদারিত্বের সময় জেল সাহিত্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় আবির্ভাব ঘটে মাহমুদ দারবিশ, মুইন বাসিসু, তাওফিক যিয়াদ, সামিহ আল কাসিম, আয়িশা আওদাহ, জামিলা বাদরান ও যাকিইয়া শামুতের মতো খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকদের। স্থানীয় ও আরব বিশ্বের খ্যাতনামা সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনা সংস্থাসমুহ ফিলিস্তিনি জেল সাহিত্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের আসাফির বিলা আজনিহা (ডানাহীন পাখি), আনিল উমনিইয়াত (প্রত্যাশার ডালপালা), আওরাকুয যাইতুন (জলপাই পাতা ), আশিক মিন ফিলিস্তিন (ফিলিস্তিনের প্রেমিক) বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমাদৃত হয়।

মাহমুদ দারবিশ ছিলেন ইজরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিরোধী। জেলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দারবিশকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের সকল মুক্তিসংগ্রামীর অঘোষিত মুখপত্র। সাম্প্রতিক সময়ে ইজরাইলি হত্যার অভিযোগে সামরিক আদালতে ৬৭ বার যাবজ্জীবন দণ্ড ও ৫,২০০ বছরের জেল হওয়া ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসসাম বিগ্রেডের সাবেক প্রধান আব্দুল্লাহ আল বারগুসির আমিরুয যিল (ছায়া রাজপুত্র) উপন্যাসটি জনপ্রিয়তায় আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েছে। এছাড়াও ফিলিস্তিনি জেল সাহিত্যের ব্যাপক জনপ্রিয় বিশ্ববিখ্যাত রচনাদি, যেমন : রাশিদ হুসাইনের আস সুওয়ার ইউনশিদুন (বিপ্লবীরা গান গায়) ,খলিল উলইয়ানের সায়াত মা কবলাল ফাজর (ঊষাপূর্ব মুহূর্তগুলো), আয়িশা আওদার আহলাম বিল হুররিইয়া (স্বাধীনতা স্বপ্ন), খালিদ রাশিদ যাবদার আস সমতুল বালিগ (ভয়ঙ্কর নিরবতা), ওয়ালিদ হাওদালির মাদফানুল আহইয়া(জীবন্তদের কবর), মাহমুদ ঈসার হিকায়াতু সাবির (সাবিরের গল্প) ও আহমাদ আবু লাবনের আইয়ামুন মানসিয়্যাতুন খলফাল কুদবান (কারাগৃহের বিস্মৃত দিনগুলো) প্রভৃতি যুগ যুগ ধরে সারা দুনিয়ার লড়াকু জনতার প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

সূত্র: ফিলিস্তিনি নিউজ এন্ড ইনফো এজেন্সির আত তাজরিবাতুল আদাবিইয়াতুল ফিলিস্তিনিইয়া ফিল মুতাকালাতিল ইসরাইলিইয়া অবলম্বনে

আগের সংবাদদুই মাধ্যমেই চলবে উচ্চ আদালত
পরবর্তি সংবাদদেশে একদিনে মৃত্যু ৪৪, শনাক্ত ২৬১৭