বাংলাদেশে উইঘুর আল্লামা : আব্দুর রহমান কাশগড়ির ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন

বাংলাদেশে উইঘুর আল্লামা : আব্দুর রহমান কাশগরির ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন

আহমাদ সাব্বির:

আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগড়ি ছিলেন একজন বিস্ময় পুরুষ৷ তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল প্রবাদতুল্য৷ ১৯১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তুর্কিস্তানের কাশগড়ে তাঁর জন্ম৷ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, আচার-ব্যবহার ও চালচলনেও ছিল গাম্ভীর্যতা, কিন্তু বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না এসব কিছুতে৷ মধ্য-এশীয় মুসলিম জনগণের যে মর্মান্তিক ইতিহাস, সেই ইতিহাসের একজন জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন তিনি৷ হৃদয়ের গহীনে তিনি অব্যক্ত দুঃখ-বেদনার এক মহাসাগর বয়ে বেড়াতেন; যা প্রকাশ হতে দিতেন না কখনো৷ নিরন্তর সাধনার দ্বারা বেদনার সেই তপ্ত লাভা সবসময় আড়াল করে রাখতেন৷

চিরকুমার ছিলেন তিনি৷ তাঁর আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন সম্পর্কে সেভাবে কিছুই জানা যায় না৷ কেবল এতটুকুই জানা যায় যে তুর্কিস্তানের কাশগড়ে তাঁর জন্ম৷ বাবা ছিলেন একজন সামন্ত শাসক৷ কমিউনিস্টরা যখন বিপ্লবের নামে সে দেশে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে আত্মরক্ষার জন্য তখন দলে দলে মানুষ দেশত্যাগ করে৷ সেই দেশত্যাগী মানুষের কাফেলায় শরিক হয়ে তিনি হিন্দুস্তানে চলে আসেন।

তখন তিনি নিতান্তই কিশোর৷

ভাগ্যক্রমে লখনৌর নদওয়াতুল ওলামার এতিমখানায় তাঁর আশ্রয় হয়। নদওয়াতেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন৷ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যখন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী তখন কোনো এক অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে নদওয়াতুল ওলামাতে যান৷ সেখানে গিয়ে আল্লামা কাশগড়ির সাথে তাঁর দেখা হয়৷ আল্লামা কাশগড়ির অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাঁকে বিস্মিত করে৷ কাশগড়িকে তিনি অনুরোধ করেন কলকাতা মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য৷ আল্লামা কাশগড়ি সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে কলকাতা মাদরাসায় যোগদান করেন৷ পরবর্তী সময়ে কলকাতা আলিয়া ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনিও ঢাকা চলে আসেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঢাকা আলিয়াতেই তিনি কর্মরত থাকেন৷ ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরেই মৃত্যুবরণ করেন৷ আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়৷ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ৷ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কাশগড়ি সাহেবের খোঁজখবর রাখতেন৷ ভোলেননি তাঁকে।

আল্লামা কাশগড়ির দুঃখ-জাগানিয়া একটি অতীত ছিল৷ কখনো আনমনে তাঁর কোনো ছাত্রের সামনে যখন সেই অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন তখন শ্রোতার হৃদয়ও হু হু করে উঠতো৷ দুচোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল নেমে আসতো অঝোর ধারায়৷ অতীতের সেসব কথা মনে করে মাঝে মাঝেই তিনি উদাস হয়ে পড়তেন৷ একাকী বসে ছোট বাচ্চার মতো ডুকরে কেঁদে উঠতেন৷

কাশগড়ের সবচাইতে ধনী ব্যক্তি ছিলেন তাঁর বাবা৷ সেই সাথে ছিলেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন একজন আলেম৷ আবদুর রহমান ছাড়াও তাঁর আরও একজন পুত্রসন্তান এবং দুই কন্যাসন্তান ছিল৷ বিপ্লবের নামে কমিউনিস্ট জালেমরা যখন সারা দেশের নেতৃত্বস্থানীয় ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায় তখন তারা আল্লামা কাশগড়ির আব্বা বড়ভাই ও বড় দুই বোনকেউ তুলে নিয়ে যায়৷ কমিউনিস্টরা একবার যাকে তুলে নিয়ে যেত তার আর কোনো হদিস মিলত না৷ আল্লামা কাশগড়ির আব্বা ও ভাই-বোনেরাও আর ফিরলেন না৷ তাদের কোনো খবরও পাওয়া গেল না৷ কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, কোনো সংবাদ এলো না।

তাদের যে ফলের বাগান খামার পশুপাল ও সম্পত্তি ছিল সব কমিউনিস্টরা দখল করে নিলো৷ আর আবদুর রহমান ও তাঁর আম্মাকে থাকার জন্য ছোট্ট একটা খামারবাড়ি দেওয়া হলো মাত্র৷ আবদুর রহমান কাশগড়ির আম্মা স্বামী ও সন্তান হারানোর শোকে ততদিনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

আবদুর রহমান কাশগড়ির বয়স তখন চৌদ্দ-পনের৷ ভালো-মন্দ বিবেচনার বোধ তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে কমিউনিস্ট জালিমদের আঘাতে তারা যে একেবারে নিঃস্ব ও ধ্বংস হয়ে গেছেন, এতটুকু বুঝতে তাঁর অসুবিধা হতো না।

দেয়ালে পিঠ যখন ঠেকে যায় তখন খবর আসে একদল মুসলিম যুবক কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে৷ লুকিয়ে লুকিয়ে তারা গেরিলা হামলা করছে৷ তাদের সফলতার খবরা-খবরও আসছে৷ এমন অবস্থায় কমিউনিস্ট জালেমরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে৷ তারা এবার শিশু-কিশোর নির্বিবাদে পাকড়াও শুরু করে।

আবদুর রহমান কাশগড়ির আম্মা তার একমাত্র ছেলের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন৷ অবশেষে নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিনি আবদুর রহমান কাশগড়িকে হিন্দুস্তানগামী এক মুহাজির কাফেলার সাথে পাঠিয়ে দিতে মনস্থির করেন৷ তিনি ভাবেন—দূরে হলেও আমার সন্তান বেঁচে তো থাকুক!

আবদুর রহমান যখন হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় আম্মাকে খুব অনুরোধ করেছিল তার সাথে বেরিয়ে পড়ার জন্য৷ কিন্তু তিনি তাঁর স্বামী ও বাকি সন্তানদের আশা তখনো ছাড়েননি৷ যদি তারা ফিরে আসে! আর বাড়ি ফিরে যদি তাঁকে না পায়!

এক সন্ধ্যারাতে, আকাশে তখন চাঁদ ছিল না, চারপাশে আবছা অন্ধকার, সেই আধো আলো, আধো অন্ধকারের ভেতর কিশোর আবদুর রহমান হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান৷ অনেকটা পথ পেরোনোর পরও দেখতে পান দূরে টিলার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর আম্মা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে।

কাফেলাটি পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আবদুর রহমানের কানে আসে তাঁর আম্মার চিৎকার৷ আম্মা আব্দুর রহমানের নাম ধরে ডাকছেন।

তারপর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যখনই আনমনা হয়ে উঠতেন আল্লামা আবদুর রহমান, কানে এসে আঘাত করত তাঁর আম্মার চিৎকার৷ ‘আবদুর রহমান’ ‘আবদুর রহমান’ বলে তিনি ডেকে চলেছেন৷

এমন দুঃখ নদী হৃদয়ে ধরে বেঁচে থাকতেন আল্লামা আবদুর রহমান কাশগড়ি৷

এই দুখী মানুষটার আপন বলতে কেউ ছিল না৷ চিরকুমার তিনি ঢাকা আলিয়ার আবাসিক ছেলেদেরকেই সন্তানবৎ স্নেহ করতেন৷ ছাত্ররাই ছিল তাঁর আপন৷ শিক্ষক হিসাবে তিনি তাই সকলের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন অল্পদিনেই৷

আল্লামা কাশগড়ি আরবি সাহিত্যের একজন নামকরা লেখক ছিলেন৷ তাঁর রচিত কবিতার বই ‘আয-যাহরাত’ কায়রোর একটি নামকরা প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত একাধিক বই এ দেশের মাদরাসাগুলিতে পাঠ্য ছিল৷ তিনি ‘আল-মুফিদ’ নামে একটি অভিধানও সংকলন করেন৷ অভিধানটির বৈশিষ্ট্য ছিল—আধুনিক আরবি ভাষার যে সকল শব্দ আমাদের দেশের প্রচলিত প্রাচীন আরবি অভিধানগুলোতে পাওয়া যায় না সেগুলো সেখানে ছিল। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘মাহক্কুন নাকদ’, ‘শের ইবনি মুকবিল’, ‘ফারহাঙ্গে কাশগড়ি’।

নীরবে নিভৃতে জীবন যাপন করে গেছেন তিনি৷ ভীষণ দুঃখী এই মানুষটার দুঃখই ছিল এগিয়ে যাবার প্রেরণা৷ কাশগড়ের নির্যাতিত মুসলিম জনপদের তিনি যেন ছিলেন বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি৷ অন্য অনেকের ভিড়ে তাঁকেও আমরা হারিয়ে বসেছি৷ মুছে দিয়েছি স্মৃতির ক্যানভাস থেকে চিরতরে৷

জাতি হিসাবে এটা আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি!

আগের সংবাদসিনিফিকেশন অব ইসলাম : চীন তৈরি করছে যেভাবে নিজস্ব ইসলাম
পরবর্তি সংবাদউইঘুরদের ওপর ভয়াবহ নজরদারি : বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ