‘ভারত এখন দারুল হারব’ : যেভাবে শুরু হয় তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া

জহুরুল ইসলাম

বৃটিশদের শ্যেনদৃষ্টি:

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুভাগে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে প্রথম তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এরপর দিনে দিনে এ-অঞ্চলে বাণিজ্যিক অবস্থান সুদৃঢ় করার পাশাপাশি অর্থনীতির লাগামও তারা হাত করে নেয়।

ধন-ধান্য-পুষ্পে ভরা এই উপমহাদেশকে ইংরেজরা চিরদিন লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ হিসেবেই দেখেছে। তাই বণিক সেজে এসেও শুধু বাণিজ্যিক মুনাফাতে তারা সন্তুষ্ট থাকেনি। বরং হা করে গিলতে চেয়েছে এ-অঞ্চলের সর্বময় কর্তৃত্ব।

কান টানলে মাথা আসে। আর মাথা এলে শরীর নিয়েই আসে। ভূখণ্ড করতলগত করতে চাইলে বুদ্ধিতে জাতিকে হারিয়ে তাদের সংস্কৃতিকে ধসিয়ে দিতে হবে—এই কূটবুদ্ধি ইংরেজরা জাতিগতভাবে প্রাপ্ত। তাই ছলে-বলে-কৌশলে শাসকবর্গ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানে তারা পুশ করেছে তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষ।

উম্মাহর দীনি ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় দেখে নির্লিপ্ত থাকা জাতির প্রকৃত দরদী ওলামায়ে কেরামের ধর্ম নয়। জাতির এই সংকটকালে কুটকৌশলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র ধরলেন উম্মাহর সূর্যপুরুষ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.। তিনি ক্ষুরধার কলমে রচনা করলেন অনেক গ্রন্থ। তার লিখনীতে ফুটে উঠল দীনের মৌলিক বিষয়াদি ও ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুনের যথার্থতা। তার এই লেখাগুলো ছিল ইংরেজদের আগ্রাসনের মূলে এক কঠিন আঘাত।

এরই অব্যবহিত পরেই যখন স্পষ্ট হলো, এ-জাতি ভিনদেশীদের মায়াজাল জড়িয়ে পড়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে, তখনই এই শিকল ভাঙ্গার আহ্বানে প্রথম সরব হয়ে ওঠেন এ-মাটিরই আরেক সূর্যসন্তান শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ.।

নতুন কর্মপন্থা:

ভারতবর্ষে দুইশ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে ইংরেজরা যে কূটজাল তৈরি করেছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ ছিল না। তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি—সবদিক থেকে এই মানচিত্রকে সাপ্টে ধরেছিল। তাই তাদের ধারালো নখর থেকে ভূখণ্ডকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল নানামাত্রিক উদ্যোগ-অভিযানের। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. নানারকম কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।

মুসলমান মাত্রই আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর কুদরত ও শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করে। তবু কখনো ঈমান ঝিমিয়ে এলে তাকে উজ্জীবিত করার জন্য একটি ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগানের প্রয়োজন পড়ে। এটা একটা জাগতিক বাস্তবতা। শুরুযুগ থেকেই পৃথিবীর যেখানে ইসলামের শরীরে জরা ধরার অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সারিয়ে তোলার জন্য দীনের মৌলিকত্বকে ঠিক রেখে বিশেষ বিশেষ সংস্কারের পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে সুগঠিত ও সুচালিত করার জন্য বিশেষ শিরোনামেরও ব্যবহার করা হয়েছে। দীন হেফাজতের জন্য এই পন্থা গ্রহণের ধারা প্রাচীন। উপমহাদেশে দীনের পুনরুজ্জীবনের জন্য শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার নাম ‘তরিকায়ে মোহাম্মাদিয়া’।

তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার পরিচয়:

তরিকায়ে মোহাম্মাদিয়া উনিশ শতকের প্রথম দিকে সংঘটিত মুসলিম পুনর্জাগরণী আন্দোলন। নবীজি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শিত পথ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। আন্দোলনের কার্যক্রম মূলত কয়েকটি ধারায় বিভক্ত ছিল।

প্রথমত, শিরক ও বিদআতের উচ্ছেদ। কারণ, হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের বাতিল আকিদা-বিশ্বাস ইসলামি আকিদার ওপর দিন দিন প্রভাব বিস্তার করে চলছিল। ইংরেজদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি এসব ভ্রান্ত মতবাদও ইসলামের চলার পথে বাধা তৈরি করছিল। তাই এগুলোর মূলোৎপাটন ছিল সময়ের দাবি।

দ্বিতীয়ত, তরিকায় মোহাম্মদিয়াকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একদল নিষ্ঠাবান কর্মীর, যারা নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা-পরিশ্রম করবে। শাহ সাহেব এমন ক’জন উপযুক্ত কর্মী পেয়েও গিয়েছিলেন। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তার কেন্দ্রীয় পরিষদ ছিল। পরিষদের আমির ছিলেন শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রহ.। সংগ্রাম বিভাগের আহ্বায়ক ও আমির ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহিদ রহ. এবং তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন শাহ ইসমাইল শহিদ ও মাওলানা আবদুল হাই রহ.। শাহ আবদুল আজিজ রহ.—এর পর এঁরাই মূলত তরিকায় মোহাম্মদিয়ার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যান।

আন্দোলনের আরেকটি মৌলিক পদক্ষেপ ছিল গণজাগরণ তৈরি করা। যে কোন বিরাট সংস্কারকাজে হাত দেয়ার আগে ব্যাপকভাবে গণজাগরণ ও সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. দিল্লির কুচাচিলান মাদরাসায় প্রতি সপ্তায় দু’বার করে জনসভা করতে শুরু করেন। এতে বিরাট সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটতে থাকে এবং এর মাধ্যমে শাহ সাহেবের আন্দোলনের চেতনা জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

নিখিল বাংলায় এই তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া ছিল ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী আন্দোলন। হাজি শরিয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন— এসবই তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া দ্বারা প্রভাবিত এবং এগুলো তরিকায় মোহাম্মদিয়ারই অনিবার্য ফল।

সাইয়েদ সাহেবের সম্পৃক্ততা

সাইয়েদ আহমদ শহিদ রহ.–এর জন্ম রায়বেরেলিতে, ১৭৮৬ সালে। বাল্যকাল থেকেই তিনি হকপন্থী ও সোচ্চার মানসিকতার অধিকারী। আঠারো বছর বয়সে এক কাফেলার সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে তিনি লখনৌ যান। মাত্র চার মাস না যেতেই তার শাহ সাহেবের সান্নিধ্য গ্রহণের প্রবল বাসনা তৈরি হয় এবং তিনি দিল্লিতে শাহ সাহেবের দরবারে উপস্থিত হন। সেখানে হযরতের একান্ত সান্নিধ্যে পাঁচটি বছর কাটিয়ে তার দেয়া শিক্ষা-দীক্ষা, দিলের তড়প ও মিশন নিয়ে রায়বেরেলি ফিরে আসেন।

এরপর থেকে সাইয়েদ সাহেবের আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তার আখলাক ও চেতনায় মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। ১৮২১–এর দিকে তিনি প্রায় সাতশ শিষ্যের বিরাট কাফেলা নিয়ে হজে যান। সাইয়েদ সাহেবের জীবনে এই হজ এক স্মরণীয় ঘটনা। এই সফর তার দাওয়াতি চিন্তা ও সংস্কারি চেতনাকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়।

হজ থেকে ফিরে তিনি আন্দোলনকে আরো জোরদার করেন। এই পবিত্র আন্দোলন তার মন-মস্তিষ্কে মিশে যায় এবং ভারতবর্ষের আজাদির অভিপ্রায়ে তিনি সর্বাত্মক জিহাদের প্রস্তুতি শুরু করেন।

জিহাদের এই মোবারক ধারাতে একেক করে পরিচালিত হয় নানা অভিযান এবং এই সূত্রেই গাঁথা হয় ঐতিহাসিক বালাকোট আন্দোলন।

বালাকোট আমাদের হৃদয়ের গহীনে থাকা এক স্ফুলিঙ্গের নাম। বালাকোট আমাদের ইতিহাস, আমাদের রক্তের আখরে লেখা এক আজাদির উপাখ্যান। বালাকোট আমাদের চেতনা, আমাদের খুনে আঁকা একখণ্ড রক্তিম মানচিত্র।

 

 

তথ্যসূত্র :

• সিরাতে সাইয়েদ আহমদ শহিদ : আবুল হাসান আলি নদবি রহ.

• সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস : আবুল হাসান আলি নদবি রহ.

• বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস : আব্বাস আলী খান

• দেওবন্দ আন্দোলন, ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান : আবুল ফাতাহ মুহা. ইয়াহইয়া রহ.

• চেতনায় বালাকোট : শেখ জেবুল আমিন দুলাল

 

আগের সংবাদ‘পরিবার পরিকল্পনার বিষবৃক্ষ’ : রাষ্ট্র যেভাবে বন্ধ্যাত্বকরণে উৎসাহিত করছে
পরবর্তি সংবাদরোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে পারছে না মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো