মুনশী নাঈম:
তুরস্ক যখন দেশের দক্ষিণে ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজছিল, ক্ষতিগ্রস্থদের সরানোর যুদ্ধে নিযুক্ত ছিল, দেশটি ঠিক একই সময়ে ধ্বংসস্তূপের উপর সমান গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে ঘাম ঝরাচ্ছিল। তা হলো—ভূমিকম্পে গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাই দেয়া এবং দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখা।
এই ভূমিকম্পে দেশটির ১৯ হাজারের বেশি ভবন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। ৪৭ হজাার ২১১টি ভবন গুরুতর ক্ষতির কারণে আবাসনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ১২ হাজার ২৩৫টি যান, ৭৬টি বিমান, ১২১টি হেলিকপ্টার, ২৬টি জাহাজ এবং ৪৫টি ড্রোন ছাড়াও ৩৫ হাজারের বেশি অভিজ্ঞ উদ্ধার বিশেষজ্ঞ সহ এই অঞ্চলে আড়াই লাখের বেশি সরকারি কর্মচারি উদ্ধার কাজে লাগিয়েছেন। ঘোষণা করেন ৪ নং বিপদ সংকেত। আহ্বান করেন আন্তর্জাতিক সহায়তা। এরমধ্যে ১০০টি দেশ তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৪টি দেশ পাঠিয়েছে ১১ হাজার উদ্ধারকর্মী। ৬১টি দেশ ৪৪৪টি ফ্লাইটে নিয়ে এসেছে ত্রাণ। এরদোগান ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ দশটি প্রদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে শোক ও দুই সপ্তাহের জন্য সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন।
১১টি রাজ্যে আঘাত হানা ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া থেকে তুর্কি অর্থনীতি মুক্ত ছিল না। কারণ, আক্রান্ত অঞ্চলেই রয়েছে বৃহত্তম তুর্কি কারখানার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে গাজিয়ান্তেপ এবং কাহরামানমারাশে। ভূমিকম্পের পর মাত্র তিনদিনে ১৫ শতাংশ পতন হয়েছিল ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জ সূচকে। ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মান কমে গিয়েছিল এক শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় আঙ্কারার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ফলে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতির মোট ক্ষতি সীমিত থেকেছে।
আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে সরকার
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভূমিকম্পের পর প্রথম দিনই অনুসন্ধান, উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য ১০০ বিলিয়ন লিরার (৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি) একটি তহবিল ঘোষণা করেন।
আবাদ সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অর্থনৈতিক বিষয়ের গবেষক খালেদ তুর্কাউই আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তুর্কি প্রেসিডেন্টের এই তহবিল ঘোষণা ছিল বাজার সুরক্ষার জন্য সরকারের নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই তহবিল ঘোষণা মানুষকে ভরসা দিয়েছিল যে, সমস্ত সঙ্কটে রাষ্ট্র তাদের পাশে আছে।’
অর্থনীতিতে আরও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে তুর্কি সরকার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তার একটি প্যাকেজও ঘোষণা করেছে। পদক্ষেপ নিয়েছে আর্থিক ও পণ্যের বাজারকে স্থিতিশীল করার। ১৫ ফেব্রুয়ারী থেকে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অ্যাকাউন্টে ১০০০০ লিরা (৫৩০ ডলারের সমতুল্য) জমা করা শুরু করে। এর আগেই এরদোগান ঘোষণা করেছিলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে সরকার আবাসন প্রদান করবে।
আর্থিক ও পণ্যের বাজারকে স্থিতিশীল রাখার প্রচেষ্টা
আর্থিক ও পণ্যের বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে ১০ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে। দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম অত্যধিক বাড়িয়ে দেয়া ৩৫৩টি কোম্পানিকে ৮৫ মিলিয়ন লিরা জরিমানা করে।
মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, এটি অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি এবং একচেটিয়া চর্চা রোধ করতে সাহায্য করেছে। নাগরিকদের প্রতি অবিচার রোধ ও অন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে বাধা দিয়েছে।
জরুরী প্রয়োজনীয় ত্রাণ হিসেবে মন্ত্রণালয় দিয়েছে—গরম করার হিটার, তৈরি করা খাবারের পার্সেল, কম্বল, রেইনকোট, হাইজিন কিট, মহিলা এবং বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি কিট, স্লিপিং ব্যাগ, শিশুর খাবার, চার্জিং ব্যাটারি, শীতের জুতা এবং আরও অনেক কিছু।
স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ মাসের জন্য কন্টেইনার হোম এবং প্রিফেব্রিকেটেড বিল্ডিং রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে সম্পর্কিত উদ্যোগ ও সংস্থার জন্য কন্টেইনার এবং প্রিফেব্রিকেটেড বাড়ির উপর মূল্য সংযোজন কর বছরের শেষ নাগাদ ১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে।
তুর্কি সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজ (SITA) এর অর্থনৈতিক বিষয়ের গবেষক ডেনিজ ইস্তিকবাল আল জাজিরাকে বলেন, ‘পণ্য বিক্রেতাদের উপর ভূমিকম্পের পরে আরোপিত জরিমানা জনসাধারণের কাছে পণ্য সহজলভ্য করতে সহায়তা করেছে। সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপ ভূমিকম্পের পরে যে কোনও সংকট বা আতঙ্ক রোধ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের কারণে ভূমিকম্পের সময় মোকাবেলা করা সহজ হয়েছে।’
অভ্যন্তরীণ আঘাত প্রতিরোধ
অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা জালাল বক্করের মতে, ভূমিকম্পের পরে তুর্কি অর্থনীতি বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু তুর্কি সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জে কিছু স্টকের ব্যবসা বন্ধ করে এই ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করে। ফলে তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ ছাড়াই অভ্যন্তরীণভাবে সংকট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ভূমিকম্পের পর মাত্র তিনদিনে ১৫ শতাংশ পতন হয় ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জ সূচকে। ফলে সরকার ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জ আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়। এতে অর্থনীতি কিছুটা রক্ষা পায়। তবে তুরস্কের কিছু প্রধান শহর এবং রাজ্য, যেমন গাজিয়ান্তেপে কাজ স্থগিত করার কারণে, বিশেষত উৎপাদনের স্তরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
তুর্কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াদ ওকতে ভূমিকম্পের পরে যারা ভাড়া বাড়ায়, তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ‘জনগণের চাহিদা এবং ভূমিকম্পের এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুতদের সুবিধা নিয়ে যারা ভাড়া বাড়ায়, আমরা তাদের জবাবদিহি করব।’
গাজিয়ান্তেপে গভর্নর দাউদ গুল ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যের মধ্যে বাড়ি স্থানান্তরের ফি-তে একটি সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হবে। যাতে বাস্তুচ্যুতদের নির্দিষ্ট দিকে সরে যাওয়ার বিষয়টি দাম বাড়ানোর কারণ হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার একযোগে তুরস্ক, তুর্কি সাইপ্রাস এবং আজারবাইজানের সমস্ত মিডিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফান্ড রাইজিং করা হয়। এতে অনুদান সংগ্রহ করা হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। বিধ্বংসী ভূমিকম্পের দুই সপ্তাহ পর তুর্কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিসংখ্যানে বলেছে, এই বছরের শেষে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি হবে ৩৫. ৭৬ শতাংশ। ডলারের মান হবে ২২.৮৪ লিরা।
সূত্র: আলি জাজিরা