ভূমিকম্প: তুরস্কের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে?

মুনশী নাঈম:

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে ঘটে গেল শক্তিশালী ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের এ প্রভাব পড়তে পারে দেশটির আসন্ন এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। কারণ, উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতির অভিযোগ ও ভবন নির্মাণে কঠোর আইন প্রণয়নে ব্যর্থতার আঙুল উঠেছে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ানের দিকে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেও স্বীকার করেছেন, এ ধরনের দুর্যোগে যত তাড়াতাড়ি এবং যতটা বিস্তৃত পরিসরে সাড়া দেওয়া দরকার, সেটা করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই ধরনের দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়।

৬ ফেব্রুয়ারি, ভোররাতে তুরস্কের মানুষ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন দেশটির অন্তত ১০টি প্রদেশে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প। ১৯৩৯ সালের পর দেশটির মানুষ এমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মুখোমুখি হয়নি। তুর্কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তার দেশে ৩৯ হাজার ৬৭২ জন মারা গেছে। এদিকে সিরিয়া সরকার এবং জাতিসংঘ বলছে, সিরিয়ায় ৫ হাজার ৮০০ এর বেশি প্রাণহানি হয়েছে।

১৯৯৯ সালের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হবে?

এরদোয়ান ২০০৩ সাল থেকে তুরস্কের ক্ষমতায় আছেন। তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। ভূমিকম্পের আগে তুরস্কে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, আসন্ন নির্বাচন এরদোয়ানের জন্য সহজ হবে না। নির্বাচনে তাকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে। ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে থেকেই এরদোয়ানকে একের পর এক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক বিষয়ে তার নীতি দেশটিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে ফেলেছে। গত বছর দেশটিতে ভোগ্যপণ্যের দাম প্রায় ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে এরদোয়ানকে দাবানলসহ পরিবেশগত অন্যান্য বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হয়েছে। নানামুখী চ্যালেঞ্জ আছে—তা এরদোয়ান নিজেও জানেন। সে অনুযায়ী, তিনি কাজ করে আসছিলেন। ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পরই এরদোয়ান রাজধানী আঙ্কারায় একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন। পরবর্তী সময়েও তাকে তৎপর থাকতে দেখা গেছে।

এরদোগানের ভাষ্যমতে, ১৯ হাজারের বেশি ভবন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। ৪৭ হজাার ২১১টি ভবন গুরুতর ক্ষতির কারণে আবাসনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আতএব, এগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলতে হবে। তিনি ১২ হাজার ২৩৫টি যান, ৭৬টি বিমান, ১২১টি হেলিকপ্টার, ২৬টি জাহাজ এবং ৪৫টি ড্রোন ছাড়াও ৩৫ হাজারের বেশি অভিজ্ঞ উদ্ধার বিশেষজ্ঞ সহ এই অঞ্চলে আড়াই লাখের বেশি সরকারি কর্মচারি উদ্ধার কাজে লাগিয়েছেন। তুরস্ক ঘোষণা করেছিল ৪ নং বিপদ সংকেত। আহ্বান করেছিল আন্তর্জাতিক সহায়তা। এরমধ্যে ১০০টি দেশ তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৪টি দেশ পাঠিয়েছে ১১ হাজার উদ্ধারকর্মী। ৬১টি দেশ ৪৪৪টি ফ্লাইটে নিয়ে এসেছে ত্রাণ। এরদোগান ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ দশটি প্রদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে শোক ও দুই সপ্তাহের জন্য সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন।

তুরস্কে আগে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। সেই ভূমিকম্পের পর উদ্ধার-ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে তুমুলভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ট ইসেভিট। সে সময় ভালোভাবে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেয় এরদোয়ানের দল। ২০০২ সালের নির্বাচনে তার দল জয়ী হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরদোয়ান যদি বর্তমান সংকট ভালোভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন, তাহলে রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলে তাঁকে ইসেভিটের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।

রাজনৈতিক প্রভাব

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এতবড় একটি ঘটনা তুরস্কের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। সরকারকে এর মাশুল দিতে হবে। ভূমিকম্পের রাজনৈতিক পরিণতির প্রথম লক্ষণ হল ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে মেরুকরণ। যা ঘটেছে তার জন্য সরকারকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেছে বিরোধী দল। রাষ্ট্রপতি এবং সরকারকে বয়কট ঘোষণা করেছে। ভূমিকম্পের কয়েকদিন পর পিপলস পার্টির সাবেক প্রধান ডেনিজ বেকালের জানাজা নামাজের সময় বিরোধী দলের প্রধান কামাল কিলিচদারোগ্লু, ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামো’লু এবং আহমেত দাভুতোগ্লুর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে যান এরদোগান।

নির্মাণ আইন এবং ভূমিকম্পের প্রস্তুতির আলোচনায় তুরস্কের ক্ষমতাসীন সরকার দায় এড়াতে পারবে না বলে উল্লেখ করেছে আল জাজিরা।

গার্ডিয়ান ও আর জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির তোয়াক্কা না করেই বিশালাকায় অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রকল্পে মনোযোগ দিয়েছে তুরস্কের সরকার। এটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান খাতে পরিণত করা হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার নির্মাণ ও আবাসন খাত, স্থানীয় সরকার ও গৃহনির্মাণে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নতুন আইন পাসের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থায় কাঠামোগত সংস্কারও করেছে। এর মধ্য দিয়ে নগর প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকে নগরায়ণ ও নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নগর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভবনগুলো ভূমিকম্প আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম কি না, সে বিবেচনা একেবারে করা হয়নি।

এ ছাড়া এরদোয়ান সরকারের আবাসন খাতে কথিত দায়মুক্তি নিয়েও সমালোচনা চলছে। ১৯৯৪ সালে তুরস্কে প্রথম ব্যাপকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ভবনের ক্ষেত্রে এ ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি নাগরিকদের জন্য সরকারি ‘উপহার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে অবৈধভাবে ও বিকল্প কাঠোমোয় নির্মিত ভবন সরকারকে কিছু ফি দেওয়ার বিনিময়ে বৈধ করার অনুমতি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে অবকাঠামো খাতে সর্বশেষ দায়মুক্তি দেওয়া হয়। অবৈধ ভবনের ক্ষেত্রে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দায়মুক্তি দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় একেপি। একবারে ৭৪ লাখ অবৈধ ভবন বৈধ করা হয়। এর বিনিময়ে ২৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন লিরা রাজস্ব আয় করে সরকার। পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই অর্থ তুরস্কের ভবনগুলো আরও বেশি ভূমিকম্প–সহনীয় করার কাজে ব্যয় করা হয়েছে। ভূমিকম্পের আগের সপ্তাহে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ২ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি ভবনকে দায়মুক্তি আইনের আওতায় বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্প যখন আঘাত হানে সে সময়ে আরেকটি বড় দায়মুক্তি আইনের খসড়া আইনসভায় অনুমোদনের জন্য অপেক্ষাধীন ছিল।

তবে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা, যেমন আশ্রয়, ক্ষতিপূরণ, পুনর্গঠন এবং কোনো গাফিলতি, অবহেলা বা দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না করে সরকারের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন সম্পূর্ণ বা সঠিক নয়। অতএব, এক বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার ক্ষমতা এবং কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা সরকারের কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের মৌলিক মানদণ্ডের মধ্যে থাকবে। তবে এটি যৌক্তিক যে, ভূমিকম্প এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলো আসন্ন নির্বাচনের এজেন্ডায় প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হবে। এখানে দুটি পক্ষ প্রতিযোগিতা করবে। বিরোধীরা বলবে, সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তাদের অবহেলার কারণে বিপর্যয় ঘটেছে। সরকার বলবে, ভূমিকম্প যেকোনো সরকার বা দেশের মোকাবিলা করার ক্ষমতার চেয়ে বড় এবং বিরোধীরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দুর্যোগকে কাজে লাগাতে চাইছে। ফলে তুর্কি বৈদেশিক নীতির উপর প্রভাব ছাড়াও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জীবনকে খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্থির করে রাখবে। আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলে এই ভূমিকম্পের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়বে এটা নিশ্চিত। তবে তা কতটুকু, এখনই বলা মুশকিল।

নির্বাচন কি পেছাবে?

এছাড়াও ভূমিকম্পকে রাজনীতিকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নির্বাচন স্থগিত করার সম্ভাবনা, যা একটি জটিল আইনি এবং রাজনৈতিক বিষয়। অনেকেই বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা এবং ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেখানে কোনও ভবন, প্রতিষ্ঠান বা সরকারী আমলাতন্ত্র নেই, সাধারণ পরিবেশও এর জন্য অনুপযুক্ত। অবার অনেকেই মনে করছেন, ভোটাররা অন্য শহরে চলে গেছে। সুতরাং তারা যেখনে আছে, সেখান থেকেই ভোট দিবে। তাহলে তাদের সংকটের জন্য দায়ী কে, তা তাদের ভোটে ফুটে উঠবে।

আইনত সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে ‘যুদ্ধের কারণে তাদের সংগঠিত করা সম্ভব না হলে নির্বাচন স্থগিত করার সম্ভাবনার বিধান’। এবং এই স্থগিত করার ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে তুর্কি গ্র্যান্ড পিপলস অ্যাসেম্বলির (সংসদ)। এর অর্থ, ভূমিকম্পের কারণে নির্বাচন স্থগিত করা যাবে না। তবে ‘সংগঠিত করার অক্ষমত’ এই কারণকে আমলে নিলে এই ভূমিকম্প বিধ্বংসী যুদ্ধের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। বলা হচ্ছে, ৫০০ পারমাণবিক বোমার আঘাতের মতো ছিল এই ভূমিকম্প। এরপর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন ও স্থগিতাদেশ কার্যকর করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে উভয় উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন জোটকে বিরোধী দল বা তার কয়েকটি দলের সঙ্গে একমত হতে হবে। সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষমতার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারের নেই।

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদী স্থগিতকরণ না হলেও অন্তত অল্প সময়ের জন্য স্থগিত করার সম্ভাবনা আছে। কারণ, সবাই চায় মানুষকে এই বার্তা দিতে—দুর্যোগের সময় মানুষ আগে, রাজনীতি ও ভোট আগে না।

আগের সংবাদআমিরাতে একই কমপ্লেক্সে মসজিদ, গির্জা ও সিনাগগ
পরবর্তি সংবাদঅবৈধ ভবন বৈধ করার সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ