মাহফিলের স্টেজ: গাইরে আলেমদের ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ আলেমসমাজ

মুনশী নাঈম:

প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মুফতী আরিফ বিন হাবীবের গঠনমূলক বয়ানের অসম্মানজনকভাবে বিরোধিতা করে নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরী করলেন কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব) আক্তারুজ্জামান রঞ্জন। মাহফিলের স্টেজে দাঁড়িয়েই তিনি মাওলানার বক্তব্য নিয়ে মুসল্লিদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে উত্তেজিত মুসল্লিরা তাকে জুতা নিক্ষেপ করে । শনিবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের গচিহাটা কলেজ মাঠে এ ঘটনা ঘটে। ৪১ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যায় মুফতী আরিফ বিন হাবীব পবিত্র কুরআন ও সহিহ্ হাদিসের প্রমাণ দিয়ে কিছু জাল হাদিস এবং বহুল প্রসিদ্ধ কিছু ভুল তথ্য নিয়ে গঠনমূলক বয়ান করেন মাহফিলে। বয়ান শেষে সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান রঞ্জন মাইক হাতে নিয়ে অসম্মানজনকভাবে এই বয়ানের বিষয়ে আপত্তি তোলেন। একপর্যায়ে উপস্থিত জনতা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে জুতা নিক্ষেপ করা শুরু করেন।

দেশে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটেনি। প্রায়শই বিভিন্ন মাহফিলে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্তৃক বক্তাকে অপমান করার ঘটনা ঘটে। দেশের বক্তারা বলছেন, এমন ঘটনা দেশের জন্য শোভনীয় নয়। তারা বিষয়টিকে ক্ষমতাচর্চার নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।

কী বলেছিলেন বক্তা?

গতকাল মাহফিলের বয়ান পরিকল্পনা বিষয়ে মুফতি আরিফ বিন হাবীব বলেন, মঞ্চে উঠার আগে নিয়ত করেছিলাম কুরআন নিয়ে মোট ৪০ টি কথা বলব; কুরআন থেকে ১১ টি, হাদীস থেকে ২২ টি, উপসংহারে কুরআন ও হাদীস থেকে আরো ৭টি। এই মোট ৪০টি। মঞ্চে উঠার পর মানুষের উপস্থিতি দেখে ইস্তেগফার ও দরুদ পড়ছিলাম আর চিন্তা করছিলাম, বয়ান কি আগেরটাই ঠিক রাখব? হঠাৎ মাথায় এল, এতগুলো মানুষকে কিছু সঠিক বিষয়ের ধারণা দেই, আর কিছু ভুল সম্পর্কে অবহিত করি। ইতিমধ্যে শ্রদ্ধেয় মেজর সাহেব এসে বললেন, তিনি আমার বয়ান শুনে তারপর কথা বলবেন।

এরপর মুফতি সাহেব ‘সালাম দিলে ৯০ নেকি আর জবাব দিলে দশ নেকি’ কথাটি সঠিক কিনা, তা হাদিসের প্রমাণ দিয়ে সাব্যস্ত করেন। তিনি দেখান, কথাটি সঠিক না। এসময় তিনি সালামের পক্ষে দুটি আয়াত ও নয়টি হাদীস পেশ করেন। এরপর মেরাজের সঠিক তারিখ কোনটা, তা নিয়েও প্রমাণসাপেক্ষ আলোচনা করেন তিনি। আলোচনা করেন ‘সুদূর চীন দেশে গিয়ে বিদ্যা অর্জন কর’ শিরোনামের জাল হাদিস নিয়ে। এ সময় তিনি বিদ্যার্জনের স্বপক্ষে কয়েকটা হাদীস বর্ণনা করেন।

এরপরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, আলোচনা সমাপ্তি টানার পর শ্রদ্ধেয় মেজর সাহেব আমার সাথে হাসিমুখে মুসাফাহা করলেন, তারপর তিনি মাইক নিয়ে হাসিখুশি আলোচনা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ বসে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আমি আধা কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করার পর কেউ একজন ফোন করে বললেন যে, মাহফিলে গন্ডগোল হয়েছে ইত্যাদি, (যা আপনারা মিডিয়া তে দেখেছেন)।

উক্ত আলোচান স্বপক্ষে মুফতি আরিফ বলেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমার নিয়ত হলো, লা মাযহাবী, মাযহাবী, সুন্নি, কওমী, আলিয়া সবাই যেন কুরআন ও সুন্নাহর আলোচনা করে, আর ঘটনা বললে যেন সত্য ঘটনা বলেন। সব মাসলাকের ভাইদেরকে বলব, আমার সম্পুর্ণ ভিডিওগুলো দেখলে আমার হাজারো ভুলের মাঝে একটা সত্য পাবেন। সেটা হলো, সবাই যেন এই ‘মাঠকে ব্যবহার করে সঠিক কথাগুলো মানুষকে জানিয়ে দেয়। প্রয়োজনে মাহফিল কম হোক, কিন্ত আপনাদের( ওয়ায়েজদের) মাধ্যমে যেন কম হলেও জাতি সঠিক কথাগুলো জানতে পারে।

কমিটির দায় কতটুকু?

বক্তারা বলছেন, একজন দাওয়াতি মেহমানের যথাযথ কদর করা কমিটির দায়িত্ব। এমন ঘটনা ঘটে কমিটির অতিথী নির্বাচনের কারণে। কিন্তু এমনব ঘটনা ঘটার পর কমিটি কোনো ব্যবস্থা নেন না।

কিশোরগঞ্জের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মুফতি রেজাউল করিম আবরার বলেন, মুফতি আরিফ বিন হাবিব ভাইকে খুব কাছ থেকে আমি পর্যবেক্ষণ করি। ব্যক্তি হিসেবে তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং লাজুক। হিফজুন নুসুসের ক্ষেত্রে ঈর্ষা জাগানিয়া যোগ্যতার অধিকারী তিনি। দেখা হলেই সেটা আমি বলি ভাইজানকে। আজ কিশোরগঞ্জের ঘটনাটি দেখে মর্মাহত হলাম। এভাবে তাকে অপমান করা হলো, কিন্তু কমিটি কিছুই করল না। এটা আলেমদের জন্য চরম ধৃষ্টতামূলক। মাহফিলের আয়োজকদের অনুরোধ করব, আলেমদের নিরাপত্তা এবং সম্মান রক্ষার ব্যাপারে আপনারা পূর্ণ সচেষ্ট থাকবেন ‘

মাহফিলের মঞ্চে আলেমদের অসম্মান করা ট্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে মুফতি হাবিবুর রহমান মিসবাহ বলেন, একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা কোরআনের একটা ছোট্ট সূরাও শুদ্ধ করে পড়তে পারে না, কিন্তু বলে বেড়ায় কোরআন ও সহীহ হাদীস ছাড়া মানি না বা কেচ্ছাকাহিনী শুনি না। মূলত কোনটা কোরআন-সুন্নাহ আর কোনটা কেচ্ছা এটা তারা জানেই না। তারা একটা মুখস্ত বুলি শিখে নিয়েছে ব্যস। এজন্য সূরা ফাতিহার তাফসীরে এসেও তারা মন্তব্য করে ‘এসব কেচ্ছাকাহিনী শুনতে চাই না! মেজর আখতারকেও তাদেরই একজন মনে হয়েছে আমার কাছে।’

তিনি কমিটির দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘একজন আলেমকে কমিটি যদি যখাযথ সম্মান দিতে না পারে, তাদের উচিত ওই আলেমকে দাওয়াত না দেয়া। কিন্তু আলোচিত মাহফিলের কমিটি সেটা করতে পারেনি। তাই দেশের সকল ওয়ায়েজদের উচিত, আখতার ও মাহফিল কমিটির উপযুক্ত বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঐ এলাকায় কোনো দাওয়াত না নেওয়া।

করণীয় কী

এই ঘটনা সামনে আসার পর অনেকেই বলছেন, বক্তাদের উচিত কে অতিথী হবেন, সব দেখে তারপার দাওয়াত নেয়া। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আলেম লেখক মাওলানা সাইমুম সাদী বলেন, বক্তাদের উচিত মাহফিলে কে সভাপতি, কে প্রধান অতিথি, ওই সময় পাশের চেয়ারে কে বসা থাকবে ইত্যাদি দেখে মাহফিল কনফার্ম করা। সকল বক্তা হয়ত এটা করতে পারবেননা কিন্তু কেউ কেউ অবশ্যই পারবেন। আলেমদের মজলিসে সভাপতি আলেম হবেন, এটাই উচিত। ওখানে কোনও জাহেল ব্যাক্তি বসা উচিত না।

বক্তারা বলছেন, সবসময় এভাবে যাচাই করে দাওয়াত গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ভিন্ন পন্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন, মাহফিল যেহেতু ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তাই এখানের প্রধান থাকবেন আলেমগণ। তারাই মাহফিলের সবকিছু পরিচালনা করবেন। মাহফিলের মেহমান নিয়ে অন্য কেউ কথা বলতে পারবেন না।

বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আরেম মাওলানা গাজি সানাউল্লাহ রাহমানি বলেন, মাহফিলের স্টেইজকে কলুষমুক্ত করার উত্তম একটি পন্থা হচ্ছে, স্টেইজে একটা মাত্র চেয়ার রাখা। যিনি ওয়াজ করবেন, কেবল তিনিই সেখানে বসবেন। অন্য কেউ বসবে না। তাহলে পাশে বসে বয়ান থামিয়ে দেয়া, কিংবা মাইক কেড়ে নেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না।

 

 

আগের সংবাদওমরাহ ভিসার মেয়াদ মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছে সৌদি
পরবর্তি সংবাদইসলামি বইমেলা: পরিধি বাড়ানোর বিকল্প নেই