মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি

মূল: আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবী রহ.

অনুবাদ. যুবাইর আহমাদ:

উনবিংশ শতাব্দীর কথা। তখন ইসলামী দেশগুলোর মানুষের অবস্থা সুখের নয়, দুঃখের ছিলো। তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা, নিজেদের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত তার যৌবনকাল অতিক্রম করছিলো। ভারতবর্ষ ছিলো এসব মন্দ চর্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র—এখানে একই সময়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতা, পুরোনো ও আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণা চলছিলো। সর্বোপরি তা ছিলো ইসলাম ও খৃস্টবাদের উর্বর ভূমি। দ্বিপাক্ষিক শক্তি পারস্পরিক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেয়। ১৮৫৭ইং সনে আযাদী আন্দোলনে ব্যর্থ হলে ভারতবর্ষের মুসলিমদের হৃদয় বেদনায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা রাজনীতি ও সভ্যতাগত দুই গোলামির শিকার হয়ে পড়েন।

একদিকে যেমন ইংরেজ শাসকরা নিত্য নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে, অন্যদিকে ভারতের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খৃস্টান পাদ্রীগণ খৃস্টবাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করে। তারা ইসলামী আকিদা ও শরীয়তের উৎস মূলের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ে ফেলে দেওয়াকে নিজেদের বড় সফলতা মনে করছিলো। মুসলিম নতুন প্রজন্ম, এখনো পর্যন্ত যাদের উপর ইসলামী শিক্ষার যথাযথ ছোঁয়া লাগেনি, তারা এই প্রচারণার লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। খৃস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ঘটনাও ঘটতে থাকে সময়ে সময়ে।

কিন্তু এসময় মুরতাদ হওয়ার বিষয়টি যত না জটিল ছিলো,তার চেয়ে বড় ভয়ংকর সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নাস্তিকতা, ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি করা ইত্যাদি বিষয়াদি। খৃস্টান পাদ্রী এবং মুসলিম আলেমদের মাঝে জায়গায় জায়গায় মুনাযারা-বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্যাপকহারে মুসলিম আলেমদের যেমন বিজয় লাভ হয়, তেমনি খৃস্টবাদের মুখোমুখি ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং সুদৃঢ়তাও প্রমাণিত হয়। তবে এসবের ফলে স্বভাবতই এক চিন্তাগ্রস্ততা ও আকিদাগত সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হতে থাকে।

ঐদিকে মুসলিমদের পারস্পরিক মতানৈক্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একদল অপর দলের খণ্ডনে কোমড় বেঁধে নামে। মাযহাবী মুনাযারা-বিতর্ক ছিলো তখন তুঙ্গে। ফলে পারস্পরিক দন্দ্ব- সংঘাত, লড়াই-ঝগড়ার কারণে ভারতবর্ষজুড়ে এক ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই অবস্থা মুসলিম আলেমদের আত্মমর্যাদা ও দ্বীন-ধর্মের সম্মানের উপর বড় আঘাত হানে।

অপরদিকে আনাড়ী সূফী-সাধকগণ তরীকত ও বেলায়েতকে খেলার বস্তু বানিয়ে রাখে। তারা নিজেদের শরীয়ত পরিপন্থী কথাবার্তা, নানা ধরণের ইলহাম প্রচার করতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় মানুষ ইলহামের দাবিসহ আশ্চর্য ধরণের দুর্লভ সুসংবাদ বর্ণনা করতে থাকে। যার ফলে জনসাধারণের মাঝে গোপন ভেদ, কারামত, গায়েবী বিষয়ক স্বপ্ন ও ভবিষ্যদ্বাণী শোনার অস্বাভাবিক আগ্রহের জন্ম নেয়। যে যত বেশী এ জাতীয় বিষয় জনসম্মুখে পেশ করতে পারতো, সে ততই জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতো। সে সমাজের ভক্তি-শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। আর এ সুযোগে নির্লজ্জ, প্রতারক, চতুর দরবেশগণ জনগণের এই মানসিকতাকে নিজেদের ফায়েদা লুটার মাধ্যম মনে করে। তাছাড়া মুসলিম সম্প্রদায় তাদের পরাজয়, হতাশা ও ব্যর্থতার ফল দেখে মধ্যপন্থা ও সাধারণ রীতিতে অবস্থার পরিবর্তন এবং সংশোধনে নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের বৃহত্তম একটি অংশ এমন একজন অদৃশ্য পুরুষের বহির্প্রকাশের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ ছিলো যিনি অদৃশ্য ইলহাম ও আল্লাহর সাহয্যপ্রাপ্ত হয়ে আগমন করবেন। কোথাও কোথাও এ অমূলক ধারণাও শুরু হয় যে, ১৩তম শতাব্দীর শেষ লগ্নে মাসীহে মাওউদের বা প্রতিশ্রুত মাসীহের প্রকাশ ঘটবেই। বিভিন্ন মজলিসে কেয়ামতপূর্ব ফেতনার ঘটনাবলী চর্চিত হতে থাকে।

সেই সময় পাঞ্জাব এলাকা ছিলো চিন্তার বিক্ষিপ্ততা, দুর্বল ও মন্দ বিশ্বাস এবং ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার কেন্দ্র। এ এলাকাটি ৮০ বৎসর যাবৎ শিখ শাসনের বিপজ্জনক ভয়াবহতা বরদাশত করে আসছিলো। যা এক ধরণের সেনা শাসিত এলাকায় পর্যবসিত হয়। একশত বছরের কম সময়েই পাঞ্জাবের মুসলিমদের আকীদা-বিশ্বাসে চরম দুর্বলতা দেখা দেয়। সঠিক ইসলামী শিক্ষার চর্চা দীর্ঘ সময় ধরে অনুপস্থিত থাকার ফলে ইসলামী জীবনাচার নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

এই সুরতহাল পাঞ্জাববাসীদের চিন্তাগত বৈরিতা ও নব্য আন্দোলন-সংগ্রামের সাড়া দানের সবুজ-শ্যামল ভূমিতে রুপান্তরিত করে। যার মূলে ছিলো নানা অপব্যাখ্যা, ইলহাম ইত্যাদি। দেশের অধিকাংশ মানুষের মেযাজ এরকমই ছিলো।

এমন নাজুক পরিস্থিতিতে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানি তার নতুন দাওয়াত, নতুন আন্দোলন নিয়ে জনসম্মুখে উপস্থিত হন। তার এই মিশন বাস্তবায়নের জন্য এটাই ছিলো উপযুক্ত স্থান ও কাল। পূর্বোক্ত পরিস্থিতি যেমন জনসাধারণকে মির্যার এই দাওয়াতের সঙ্গদানে সহায়তা করে, তদ্রুপ তৎকালীন ইংরেজ সরকারও মুজাহিদদের সংগ্রাম এবং মুসলমানদের জিহাদী জযবার ভয়ে এই আন্দোলন দাঁড় করায়, যে আন্দোলনের মৌলিক আকিদা এবং উদ্দেশ্যই ছিলো ব্রিটিশদের গোলামী। এভাবেই খুব সহজে সম্ভবপর হয়ে উঠে কাদিয়ানি মতবাদের উত্থান এবং একটি ভিন্ন দলের ভিত্তিস্থাপন।

(আলী নদবী রহ.কৃত القادياني والقاديانية এবং  قادیانیت  مطالعہ وجائزہথেকে ঈষৎ পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত )

 

আগের সংবাদসম্পাদকীয়
পরবর্তি সংবাদপশ্চিমা কল্পনায় জালালুদ্দিন রুমি : বিকার ও বিকৃতি