মুখ ও মুখোশ : মুক্তিযুদ্ধে সেকুলার এলিটদের ভূমিকা

মাহদি হাসান :

বিশ্বজুড়ে যে কয়টি শব্দ মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শব্দ হচ্ছে ‘এলিট’। এলিট আসলে কারা? এলিট বলতে আসলে কী বুঝায়? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই বিভিন্ন গোষ্ঠী, গোত্র ও সমাজে তাদের অগ্রণী, উদ্যমী, কৌশলী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। কালক্রমে সমাজে তারা বিশেষ শ্রেণীতে পরিণত হয়, যাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতাবান এবং প্রবল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক যুগে দেশকাল নির্বিশেষে এই শ্রেণীকে এলিট হিসেবে অভিহিত করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই ‘এলিট’ শ্রেণীর একদল লোকের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের মধ্যে অনেককেই আমরা বুদ্ধিজীবী বলে জানি। আবার অনেকেই ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হর্তাকর্তা। বুদ্ধিজীবী হলেন তারাই, যারা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা, সংস্কৃতি দিয়ে সমাজে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন। পূর্বেও আমরা এমনটি দেখেছি। পৃথিবীতে যত বিপ্লবী এবং সংস্কারধর্মী আন্দোলন হয়েছিল তার পিছনের মূল কারিগর ছিলেন বুদ্ধিজীবীগণ। রুশোকে বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের মূল কারিগর। তিনি তার লেখার মাধ্যমে ফরাসি সমাজে পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভলতেয়ারও যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। এভাবে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতিটি পরিবর্তন, সংস্কার, বা বিপ্লবে বুদ্ধিজীবী ও এলিট শ্রেণীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মুহূর্ত হচ্ছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এই ঐতিহাসিক সময়ে এদেশের ‘এলিট’ শ্রেণীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। এদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। কেউ সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। আবার কারো অবস্থান ছিল দ্বিমুখী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, যাদের উদ্দেশ্যে আমরা ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অধিকাংশের ভূমিকাই ছিল নিষ্ক্রিয়। কেউ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। আফসোস! যেখানে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের যোগ্য সম্মানটুকু পান না, সেখানে আমরা এ জাতীয় ভেজা বিড়ালদের দিয়েছি মহানায়কের মর্যাদা।

এইসব বুদ্ধিজীবীরা সবসময়েই ক্ষমতাশীল সরকারের চাটুকারিতা করে এসেছে। যাদের সংখ্যা এখনো কম নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা বেশ সক্রিয় ছিল। এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে প্রাণের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। কী লজ্জার কথা! নিজ দেশে যেখানে চলছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যেখানে জনমানুষের জীবন সংকটাপন্ন, সেখানে তারা দেশের সহযোগিতার কথা চিন্তা না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এমনকি অনেকে সেখানে গিয়ে বিদেশ থেকে আসা ত্রাণে নির্লজ্জভাবে ভাগ বসাতে চেয়েছিলেন।

আরেক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেই অবস্থান করেছিলেন। তবে তাদের অন্তরে বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ কিছুতেই স্বাধীন হবে না। এসকল বুদ্ধিজীবীদের কাউকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অথচ লেনিন, কাল-মার্কস, মাও সে তুং প্রমুখ ব্যক্তি তাদের বুদ্ধি দিয়ে যেমন অবদান রেখেছিলেন, তেমনি রেখেছিলেন সশস্ত্র অবদানও। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ যাবৎ যত গ্রন্থ রচিত হয়েছে, এদের রচয়িতাদের মধ্য হতে কেউই প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বস্তুনিষ্ঠ আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থের অভাব সুস্পষ্ট। অনেক গ্রন্থে তথ্যগত বেশ গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে।

এমনকি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনেও বুদ্ধিজীবী ও ‘এলিট’ শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য কোনো কন্ট্রিবিউশন ছিল না। খুব অল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে আমরা এ সময় সক্রিয় হতে দেখেছি। এই মহান আন্দোলনে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তাদের অধিকাংশের পরিচয় ছিল ছাত্র। এমনিভাবে ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে যে স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলন হয়েছিল সেখানেও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল ন্যাক্কারজনক। ১৯৬২ সালের রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনেও বুদ্ধিজীবীরা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এমন অনেক প্রয়োজনীয় সময়েই হতাশাজনকভাবে আমরা কাছে পাইনি আমাদের বুদ্ধিজীবী ও ‘এলিট’ শ্রেণীর লোকদেরকে।

১৯৭১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া যে সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে আমরা শহীদ উপাধি দিয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, দুঃখজনকভাবে তাদের অনেকেই ছিল পাকিস্তানি চাটুকার। তারা তাদের চাটুকারিতার নির্মম পরিণতি ভোগ করেছে। কিন্তু ভ্রমের শিকার হয়ে আমরা তাদেরকে মহানায়ক ভেবে যাচ্ছি। এ সকল চাটুকারদের মধ্য হতে যারা জীবিত আছেন তাদের অনেকেই এখন দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়ক হিসেবে পেশ করেছেন। অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণের অনেকেই পাচ্ছেন না তাদের যোগ্য সম্মানটুকু। এ ধরণের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আহমাদ ছফা বলেন, “বাংলাদেশের কিছু কিছু অধ্যাপক এবং সাহিত্যিকের কথা জানি যারা কোলকাতা গিয়ে রাতারাতি ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্য তাদের কোলকাতায় যেয়ে খুন করবে সেরকম কোন সম্ভাবনা ছিল না। তবু তারা ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এর প্রয়োজনটা কী ছিল? প্রয়োজন ছিল বৈকি। তা দু’ধরণের। এক. তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে বাংলাদেশ সত্যি স্বাধীন হবে। যদি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকেই যায় আর তাঁদের যদি দেশে ফিরে আসতে হয়, বলতে পারবেন তাঁরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করেননি। দুই. ছদ্মনামে সত্যি-মিথ্যা গল্প ফেঁদে ভারতীয় জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণ করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার। যেহেতু ছদ্মনামে লিখেছেন তাই দেশের কেউ তাঁদের কোন কার্যকলাপের প্রতি চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না।

যারা এরকম দূর্বলচিত্তের এবং যুদ্ধের সময়ে এই দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এসে মুক্তি-সংগ্রামী হিসেবে কিভাবে দাপট দেখান এবং সরকার কোন যুক্তিতে তাঁদের টেনে তুলে উঁচু পদে বসালেন? এ ধরণের অপকর্ম শুধু লেখক-সাংবাদিকরা করেছেন এবং অন্যরা একেবারে খাঁটি ছিলেন সে কথা কিছুতেই নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেরা যা করেছেন ঠিকমত প্রকাশ পেলে লোম দাঁড়িয়ে যাবে, তা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর।

বাংলাদেশ যে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দুই যুগ, এক যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোন বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তাঁর ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে। বাংলাদেশের জনগণই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ঘটনা ঘটেছে ঘটনার নিয়মে। বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তার কোনো তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া হয়নি। বাংলাদেশের নির্দেশনা ব্যতিরেকেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে একটা কথা আছে না, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের ক্ষেত্রে তা আরো একবার সত্যে পরিণত হয়েছে। সকল ঘটনা ঘটে যাবার পর সকলে আপনাপন গর্ত থেকে শেয়ালের মত বেরিয়ে সমস্বরে জয়ধ্বনি তুলছেন।

আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয় – প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন – সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেক আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম, পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুস্তম্ভের জয়ধনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবি রয়েছেন, যাঁরা সারাজীবন কোনকিছুতে যদি নির্দ্ধিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন – সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।” (আহমদ ছফা/বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। )

এবার শুনুন বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকীর বয়ানে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান- “ শুধু বেতন-ভাতার জন্য তারা পালিয়ে যাননি, বরং ঢাকায় অবস্থান করেছেন এবং এ কারণেই তারা মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এইটুকু বোঝার ক্ষমতা ওই বুদ্ধিজীবীদের ছিল না। ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হবে – বাংলাদেশের ওই বুদ্ধিজীবীরা যদি এটা বুঝতে পারতেন, এটি যদি তাদের বুদ্ধিতে কুলাতো, অতো বুদ্ধি যদি তাদের থাকতো, তাহলে তারা নভেম্বরের শেষদিকে ঢাকা থেকে পালাতেন। তারা মনে করেছেন, এই দেশ স্বাধীন-টাধিন হবে না, আর হলেও কতদিনে হবে (তার ঠিক নেই)। আমরা আরো দু’চার বছর বেতন-টেতন ঠিকমতো নিয়ে ঢাকা শহরে ঠিকই থাকতে পারবো। যে মানুষগুলো পাকিস্তান রক্ষার জন্য (ডিসেম্বরের) ১৩/১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজেদের সমস্ত মেধা পাকিস্তানকে দান করেছেন, তাদেরকে আমরা কি-যে সম্মান দিলাম।”
( কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম / জাতীয় প্রেস কাবের ভিআইপি লাউঞ্জে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) আয়োজিত ‘দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় / ৩০-০৭-২০১৩।)

এ সকল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুনীর চৌধুরী। চলুন শুনি তার কীর্তি।

“উইলিয়াম রাস ব্রুককে সঙ্গ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সনে সরকারের সহযোগী হিসেবে কবীর চৌধুরী-মুনীর চৌধুরী। উভয়েই ছিলেন ১৯৭১ সনে সরকার সমর্থক। মুনীর চৌধুরী আয়ুবের আমলে পাক জমহুরিয়ায় বেনামে লিখতেন এবং সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি প্রাপ্ত। মরে শহীদ হলেন। কবীর চৌধুরী ভাইয়ের শাহাদাতের ফল ভোগ-উপভোগ করলেন। তাদের রাজাকারী ঢাকা পড়ল।” (আহমদ শরীফ / আহমদ শরীফের ডায়েরি : ভাব-বুদ্বুদ । জাগৃতি প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ । পৃ: ১১৩)

” একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী আজিমপুর কবরস্থান ও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পর বাংলা একাডেমীতে আলোচনা সভার জন্য মানুষ জড়ো হতে লাগলো। আমাদের বাড়ী থেকে আব্বাসহ অন্যেরা গেলেন। বটতলায় জমায়েত বেশ বড় হলো। সভা আরম্ভ হওয়ার সময় নির্ধারিত সভাপতি বেগম সুফিয়া কামাল বললেন, ‘হাশেম সাহেব (আবুল হাশিম) যেহেতু সভায় উপস্থিত আছেন কাজেই আমার পরিবর্তে তিনিই এ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। তিনি থাকতে আমি সভাপতিত্ব করবো না। আমি এ সভায় সভাপতিত্বের জন্য হাশিম সাহেবের নাম প্রস্তাব করছি।’ বেগম সুফিয়া কামালের এই প্রস্তাবে আমি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। আব্বার সাথে আইউব খানের সম্পর্কের কথা সকলেরই জানা। আমার আশঙ্কা হলো, কেউ যদি এ কারণে আপত্তি করে তার প্রতি অপমানজনক আচরণ করে সেটা খুবই খারাপ হবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। পরে আব্বা বলেছিলেন সে সময় তারও সে রকম আশঙ্কা হয়েছিল। কিন্তু সে রকম কিছুই হলো না। আইউব খানের সাথে তার ভালো সম্পর্ক থাকলেও তিনি যে সেই সম্পর্ককে টাকা পয়সা সম্পত্তি বানানোর কাজে ব্যবহার করেননি এবং তার মতবাদ ও রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের সম্মানজনক অবস্থান বজায় রেখেছেন, এ কারণে সাধারণভাবে তার প্রতি মানুষের কোন বিরুদ্ধ মনোভাব ছিল না। তাছাড়া ভাষা অন্দোলনের সময়ে তার ভূমিকা, বিনা বিচারে ষোল মাস জেলে আটক থাকা, ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং আন্দোলনে অংশ গ্রহণ ইত্যাদিও মানূষ ভোলে নি। কাজেই একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা অন্দোলনের ওপর আলোচনা বৈঠকে তার প্রতি বিরুদ্ধ আচরণের চিন্তা সেখানে কারও ছিল না।

কিন্তু অসুবিধা হলো মুনীর চৌধুরীর ক্ষেত্রে। সভা শুরুর কিছু পর তিনি আলোচনার জন্য মাইকের সামনে দাঁড়াতেই ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী, যুব লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ভাসানী ন্যাপের নেতা মহম্মদ সুলতান উঠে দাঁড়িয়ে মুনীর চৌধুরীকে দালাল ইত্যাদি বলে গালাগালি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাইক ছেড়ে চলে যেতে বললেন। তার সাথে অন্য বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়ে একই কথা বলে চীৎকার করে তাঁকে শুধু মাইক ছাড়া নয়, সভাস্থল ত্যাগ করার জন্য বললেন। এই ঘটনার জন্য মুনীর ভাই একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় অল্পক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং তারপর সভাস্থল ত্যাগ করে একেবারে বাইরে চলে গেলেন। তার সেইভাবে চলে যাওয়ার দৃশ্য আমি এখনো ভুলতে পারি না।

মুনীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে এই প্রতিক্রিয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি পাকিস্তানের কুখ্যাত তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সরকারী Writers Guild এবং Bureau of National Reconstruction ইত্যাদি সরকারী সাংস্কৃতিক সংস্থার একজন সক্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন। এসব কারণে সরকারের দালাল হিসেবে তার একটা পরিচিতি হয়েছিল। এক সময় তিনি প্রগতিশীল কাজকর্মের সাথে জড়িত থাকা, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার এই পরিণতি ঘটায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের মাত্রা বেশী ছিল। সুলতান এজন্যই তাকে বেঈমান পর্যন্ত বলে গালাগালি দিয়েছিলেন।” (বদরুদ্দীন উমর / আমার জীবন (তৃতীয় খন্ড) । জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ – জুন, ২০০৯ । পৃ: ৩৩-৩৪)

বর্তমান সময়ে কথিত বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করা জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির গংদেরও ছিল না মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

“শাহরিয়ারকে আমি ছেলের মতো স্নেহ করি, আমরা একসঙ্গে বহুদিন কাজ করেছি, বিশেষ করে ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে। কিন্তু যখন জানতে চেয়েছি সে কোথায় যুদ্ধ করেছে, তখনই সে নিশ্চুপ থেকেছে, কোনো দিন সদুত্তর দেয়নি।” (কর্ণেল (অব:) কাজী নুর-উজ্জামান । ৭ নং সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ ‘১৯৭১ ও তারপর’-এর প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে। – ০৯/০২/২০০২)

স্রোতের বিপরীতে থাকা গুটি কয়েক বুদ্ধিজীবী ব্যতিত অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী এবং ‘এলিট’ শ্রেণীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধে এমন ঘৃণ্য অবস্থান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শ্লোগান দিয়ে মুখের ফেনা ছুটিয়ে ফেলা বাম রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল না। যদিও এ সকল বুদ্ধিজীবীদের রণাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন ছিল না। বরং তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, দিক নির্দেশনা এবং সুচিন্তিত মতামতই ছিল জনগণকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অধিকাংশই ছিল নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। মোটকথা, বাংলাদেরশের স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন বাংলাদেশের জনগণই। এতে বুদ্ধিজীবী এবং এলিট শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান ছিল না বললেই চলে। তারা তাদের বুদ্ধিকে ব্যয় করেছে নিজেদের প্রতিরক্ষায়। সাধারণ জনগণের দিকে তাদের কোনো নজর ছিল না। তারাই আজ শৃগালের পালের মতো আপনাপন গর্ত থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার চেতনার মুখোশ পরিধান করে সমস্বরে জয়ধ্বনি তুলছে।

 

আগের সংবাদজালেম বনাম মাজলুম, মুক্তিযুদ্ধ ব্যাখ্যায় তৃতীয় মত
পরবর্তি সংবাদমুখোমুখি সংঘাত : আলেম মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানে