
রাগিব রব্বানি
মুজাদ্দিদে আলফে সানী নামে ইতিহাসে মশহুর হলেও তাঁর মূলনাম আহমদ। আহমদ সেরহিন্দি নামেও প্রসিদ্ধি আছে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর আল-ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ২৮তম বংশধর। পাঞ্জাবের সমকালীন পাতিয়ালা রাজ্যের সেরহিন্দ শহরে ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম।
মুজাদ্দিদে আলফে সানীর যখন জন্ম, ভারত উপমহাদেশে তখন মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনকাল। সম্রাট আকবর মোঘল সাম্রাজ্যকে তাঁর দক্ষ পরিচালনার কল্যাণে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি ও পদ্ধতি দুনিয়া জুড়ে প্রসংশিত হচ্ছে। মোঘল সাম্রাজ্যের শত্রুরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল বাদশাহ আকবরের প্রভাবে।
বাদশাহ আকবর ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন। তাঁর বাদশাহিপূর্ব জীবন ও বাদশাহি জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ইসলামের আচার-অনুষ্ঠানের খুবই পাবন্দ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় থেকে নিয়ে ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকাম নিষ্ঠার সঙ্গে পালনে ছিলেন সচেষ্ট। কিন্তু রাজ দরবারে হিন্দু পুরোহিত, রাজপুত আর শিয়া মতবাদের লোকজনের অবাধ যাতায়াত এবং তাদের ক্রমাগত তোষামোদি বাদশাহ আকবরকে একসময় বিভ্রান্ত করে ফেলে।
ভারতবর্ষে যেহেতু বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাস, ধর্মের কারণে নানা বিভাজন ও বিপত্তি সবসময় লেগেই থাকে তাদের মধ্যে, এই বিভাজনটা কীভাবে দূর করা যায়, ভাবতে লাগলেন তিনি। আর তখনই দরবারি তোষামোদকারী ও সুযোগসন্ধানী হিন্দু ও শিয়া পণ্ডিতরা তাঁকে কুমন্ত্রণা দেয় দীনে এলাহি নামক নতুন একটি ধর্মের প্রচলন করতে। যে ধর্মের মাধ্যমে তিনি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-শিখ—সবাইকে এক করে নেবেন।
এই মন্ত্রণা খুবই মনপুত হয় বাদশাহ আকবরের। তিনি দীর্ঘ একটা সময় ধরে সকল ধর্মের ধর্মবেত্তাদের ডেকে সব ধর্মের সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করলেন। এবং ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই বুঝের আলোকে প্রবর্তন করলেন নতুন এক ধর্মের। দীনে এলাহি।
দীনে এলাহিতে এমন বিষয় সমূহের সংযোজন করা হলো, যা ইসলামের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। কিন্তু হিন্দু ধর্মের সঙ্গে দারুণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধারণার জন্য কয়েকটি নিম্নে পেশ করা হলো।
১. দীনে এলাহির কালিমা ছিল—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খালিফাতুল্লাহ।’
২. এই ধর্মে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে রাসুল হিসেবে স্বীকার করা রাষ্ট্রীয় বিধানে দন্ডনীয় অপরাধ বলে সাব্যস্ত হয়। তাঁর পরিবর্তে আকবরকে ‘আল্লাহর প্রতিনিধি’ স্বীকার করা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে নির্ধারিত হয়।
৩. ইসলামের পাঁচটি স্বম্ভকেই অস্বীকার করা হয় এই ধর্মে।
৪. আকবর তাঁর প্রত্যেক ‘চেলা’কে নিজের ক্ষুদ্র একখানা ফটো দিতেন। চেলাগণ তা সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ আপন আপন পাগড়ির সাথে মাথায় সংস্থাপন করত।
৫. এই ধর্মে হিন্দু ধর্মের মতো সূর্য পূজা, নক্ষত্র পূজা, অগ্নি, বৃক্ষ বা গরু পূজা বিধান ছিল। বাদশাহ আকবর প্রতিদিন চারবার—ভোরে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় ও মধ্যরাতে—বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করতেন। তার অনুসারীবর্গ বা চেলাদের প্রতিও সূর্য পূজার কঠোর নির্দেশ ছিল।
৬. বাদশাহর চেহারা দর্শন না করা পর্যন্ত দীনে এলাহির অনুসারীদের দাঁত মাজা বা কোনো কিছু পানাহার করা নিষিদ্ধ ছিল। ভোরের সূর্য পূজা শেষে বাদশাহ বাইরে আসলে, নর-নারী নির্বিশেষে সকলেই একসংগে তাকে সেজদা করত।
৭. নতুন ধর্মে ‘পুনর্জন্মবাদ’ বিশ্বাস করা হয়। মূর্খ বাদশাহ আকবর নিজেও বিশ্বাস করতেন যে, মৃত্যুর পর তিনি অন্য কোনো স্বর্ণ সিংহাসনের অধিকারী হয়ে একই রকম প্রভাব-প্রতিপত্তির সাথে পুনরায় আবির্ভূত হবেন।
এমনতর আরও নানা বিশ্বাস ও বিধান ছিল দীনে এলাহিতে, যা মুসলমানদের জন্য স্পষ্টত কুফরি আর হিন্দু ধর্মের সঙ্গে দারুণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই ধর্ম প্রবর্তনের পর এই ধর্মে দীক্ষা লাভের জন্য ভারতীয় অধিবাসীদের ওপর রাজকীয় ফরমান জারি করা হলো; চাই সে হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, কিংবা মুসলমান। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা এতে খুব একটা আপত্তি না করলেও মুসলমানদের জন্য ছিল তা আত্মঘাতের শামিল। বাদশাহ আকবর নিজের প্রবর্তিত ধর্মকে বিস্তৃত করতে সর্বপ্রথম মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নজর দিলেন। একে একে বন্ধ করে দিতে লাগলেন মাদরাসা ও মসজিদ সমূহ। ফলে সবার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন ভারতবর্ষের মুসলিম প্রজাসাধারণ। ধর্মের চর্চা না থাকায় বাদশাহ আকবরের দীনে এলাহি, বিদআত ও কুসংস্কারের কারণে বিকৃতি সাধিত হতে লাগল মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে। মানুষ গোমরাহির নিকষ আধারে নিমজ্জিত হতে লাগল খুব দ্রুততার সঙ্গে।
পাঞ্জাবের যুবক আহমাদ সেরহিন্দ, আজকের ইতিহাস যাঁকে মুজাদ্দিদে আলফে সানী নামে অভিহিত করে, তিনি তখন যুবক। বাদশাহ আকবরের এই গোমরাহি এবং মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ধর্মের ব্যাপারে অজ্ঞতা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। বিশাল এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাধ্যি তো তাঁর নাই, নেই পরাক্রমশালী বাদশাহ আকবরের সঙ্গে সামরিক মুকাবেলার শক্তি, তাহলে কীভাবে তিনি এই ধর্মদ্রোহী শাসককে উৎখাত করবেন? কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম প্রজাসাধারণকে কীভাবে ফিরিয়ে আনবেন ইসলামের প্রকৃত পথে?
আহমাদ সেরহিন্দ এর উত্তম সমাধান পেলেন ধর্মীয় শিক্ষা ও মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করার প্রচেষ্টার মধ্যে। তিনি শুরু করলেন তাঁর অভিযান। একাই তিনি লড়বেন, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই।
এই চিন্তা থেকেই তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বুঝেছিলেন মূল ইসলাম ধর্মে অন্যান্য বিষয় অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতায় ধর্মনেতাদের বেশির ভাগ অংশ বিপথগামী এবং সাধারণ জনগণ মাতৃভাষায় ইসলামকে না বুঝার কারণে গোমরাহিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তাঁর সমকালীন উপলব্ধি ছিল—শাসকগোষ্ঠীই সকল অনাচারের মূল। আরবিতে একটি প্রবচন আছে, যার অর্থ হলো—‘জনগণ শাসকদেরই অনুসারী হয়ে থাকে।’ এ প্রসঙ্গে আহমাদ সেরহিন্দ তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, ‘সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল—
ক. বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন।
খ. উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন।
.গ. বাদশাহর সংশোধন।
ঘ. দুনিয়াদার ও দরবারি আলেমদের সংশোধন।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তা নিম্নরূপ—
১. প্রথমত লোকদের সামনে দীনের সঠিক রূপটি তুলে ধরেন, যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন এবং তাদের চারিত্রিক দিক অর্থাৎ ঈমান, আকিদা ও আচার-আচরণ সংশোধন করতে সচেষ্ট হন।
২. বিদআতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় না গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিতেন তিনি। আর এটাকেই সফলতা ও সৌভাগ্যের একমাত্র পথ বলে ঘোষণা করতেন।
৩. আগ্রা, সারহিন্দ ও লাহোরের উচ্চ মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন আহমাদ সেরহিন্দ এবং ছাত্রদেরকে স্বীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অনুকূলে প্রস্তুত করেন।
৪. পাশাপাশি ভারতের বিশিষ্ট বেসরকারি ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনেককে স্বীয় মতে দীক্ষিত করেন।
৫. সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠ সুন্নি মতাবলম্বী সভাসদদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অনেককে স্বীয় মতাদর্শে দীক্ষিত করেন তিনি। কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা বলেন, এ সকল সভাসদের তৎপরতায় সম্রাট আকবর শেষ জীবনে তওবা করে ইসলাম ধর্মে ফিরে এসেছিলেন।
৬. আকবরের মৃত্যুর পর ১০১৪ হিজরিতে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনারোহণ করলে আহমাদ সেরহিন্দ চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এবং তাঁর স্বমতে দীক্ষিত দরবারের সভাসদদের দ্বারা জাহাঙ্গীরের মনোভাবকে ইসলামের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। অবশ্য এর আগে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদে আলফে সানিকে স্বীয় সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে কুখ্যাত গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন।
দুর্গাধিপতি একসময় সম্রাটের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট প্রেরণ করেন যে, আহমদ সারহিন্দের সংস্পর্শে থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের পশুসুলভ বন্দীরা মানুষে পরিণত হয়েছে এবং মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে। এরূপ রিপোর্ট পাওয়ার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মুজাদ্দেদকে মুক্তি দান করে তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাক্ষাতে মুজাদ্দিদে আলফে সানী সম্রাটের নিকট স্বীয় দাবিনামা পেশ করেন। তাঁর দাবিগুলো ছিল—
(ক) সম্রাটকে সেজদা করার রীতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে।
(খ) মুসলমানদের গরু জবেহ করার অনুমতি দিতে হবে।
(গ) বাদশাহ ও তাঁর দরবারিদের জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হবে।
(ঘ) কাজির পদ ও শরিয়াহ বিচার বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(ঙ) সমস্ত বিদআত ও ইসলামবিরোধী অনাচারকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
(চ) ইসলামবিরোধী যাবতীয় আইন রহিত করতে হবে।
(ছ) ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলোকে পুনরায় আবাদ করতে হবে। কেননা সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দুরা ভারতের অনেক মসজিদকে ধ্বংস করেছিল এবং অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছিল।
সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদে আলফে সানীর দাবিসমূহ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং শাহি ফরমান জারি করে তা কার্যকর করেন। আর এভাবেই একজন দরবেশ উপমহাদেশের মতো বিশাল একটি ভূখণ্ড থেকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, বিদআত ও ইসলাম-বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধে সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের পরতে পরতে বিশুদ্ধ ইসলামের সুবাতাস বইয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পরিবর্তন আনতে জনবল নয়, প্রথমে ইচ্ছাশক্তিই প্রয়োজন।