রাকিবুল হাসান নাঈম:
ইন্তেকাল করেছেন দেওবন্দি সিলসিলার অন্যতম আলেম মুফতি রফি উসমানি। তার ইন্তেকালের মাধ্যমে কর্মবহুল একটি জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। তিনি পাকিস্তান তো বটেই, সমকালিন মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ আলেমদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার গ্রহণযোগ্যতার বিভিন্ন কারণ বলা যেতে পারে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো—তিনি ঘরানানির্বিশেষে ইসলামের খেদমতে মনোযোগী ছিলেন। তিনি তার চিন্তাগত অবস্থান পেশ করতেন বিনাদ্বিধায়, শক্ত পাটের বুননে।
দেওবন্দি সিলসিলা কি
তিনি ছিলেন দেওবন্দি সিলসিলার অন্যতম ধারক ও বাহক। দেওবন্দি সিলসিলার পরিচয় নিয়ে তার ছিল সুস্পষ্ট বক্তব্য। তিনি বলতেন, এই উপমহাদেশে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্যতম ধারক এবং বাহক উলামায়ে দেওবন্দ। তাদের কুরবানীর বদৌলতে এই অঞ্চলে দ্বীনের প্রচার ও হেফাজত হয়েছে সর্ববৃহৎ পরিসরে। সাধারণভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত যা, উলামায়ে দেওবন্দও তা। দেওবন্দিয়ত-এর মাঝে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বাইরের কিছু নেই।
তিনি বলতেন, আপনি ফিকহের কিতাব খুলে দেখেন, প্রাচীন ফতোয়ার কিতাব খুলে দেখেন, দেখবেন, তারা যা বলছেন, দেওবন্দের বুজুর্গরাও তা বলছেন। সুন্নতের অনুসরণই দেওবন্দিয়ত। দেওবন্দিয়ত নতুন কোনো ফেরকা নয়। দেশভাগের আগে বারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি দেওবন্দে পড়েছি। আমার বাবার কাছে বোগদাদি কায়দা পড়েছি দেওবন্দের ইফতা বিভাগে বসে। দেশভাগের পর যখন পাকিস্তান চলে এলাম, আমি আমার নামের সাথে দেওবন্দী যোগ করতাম। বাবা কিছু বলতেন না। কিন্তু যখন দাওরা ফারেগ হলাম, তিনি নামের শেষে দেওবন্দি যোগ করতে নিষেধ করে দিলেন। বললেন, ‘এর থেকে অন্ধ ফিরকাভক্তির গন্ধ আসে’।
আমাদের আকাবিরগণ কেউ নামের শেষে দেওবন্দী উপাধি যোগ করতেন না। যোগ করা পছন্দও করতেন না। কারণ, এই উপাধি ফেরকার দিকে ইঙ্গিত করে। এই উপাধি কেবল শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী ব্যবহার করেছেন। তিনি দেওবন্দে পড়েছেন এজন্য এই উপাধি ব্যবহার করেননি। বরং তার বাড়ি ছিল দেওবন্দ, থাকতেন দেওবন্দে, তাই এ উপধি ব্যবহার করতেন।
হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়্যব রহ. বলতেন, দ্বীন-ঈমানের মৌলিক বিষয় এবং শরীয়তের শাখাগত বিষয় ও তার রুচি-প্রকৃতির দিক থেকে উলামায়ে দেওবন্দ পরিপূর্ণভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী। তারা নতুন কোনো ফেরকা নয়, নতুন কোনো আকীদা-বিশ্বাসেরও ধারক নয়। তাই রফি উসমানি দেওবন্দে দেয়া এক ভাষণে বলেন, দেওবন্দ কী বুঝতে হলে কারী তায়্যিব রহ. রচিত ‘উলামায়ে দেওবন্দ কা দ্বীনি রুখ আওর মাসলাকী মেযাজ’ পড়তে হবে। এই বইটি সবার পড়া উচিত।
সিলসিলার সঙ্গে সংযুক্তি
মুফতি রফি উসমানি নিজেকে দেওবন্দি সিলসিলার একজন ধারক মনে করতেন। তিনি বলতেন, এই বরকতময় সিলসিলার সংস্পর্শ আমি পেয়েছি।
এক ভাষণে তিনি বলেন, দারুল উলুম দেওবন্দ সিলসিলা যাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত, তারা হলেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মাওলানা ইয়াকুব আলি এবং মাওলানা কাসেম নানুতবি। তারাই দেওবন্দের মূল আকাবির। তাদের আদর্শকেই বলা হয় দেওবন্দী আদর্শ। তাদের আদর্শ আহলে সুন্নতেরই আদর্শ। তারা তাদের কাজে ও আমলে তার প্রমাণ দিয়েছেন।
এই আদর্শের ব্যাখ্যাতা হলেন শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবি, হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলনা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ.। তারা দেওবন্দ মাসলাকের ব্যাখ্যাতা। তারা সরাসরি দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাতাদের সংস্রব পেয়েছেন। তাদের ব্যাখাতা হলেন শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানি, কারী তৈয়্যব সাহেব রহ.। তারা দেওবন্দ মাসলাকের ব্যাখ্যাতাদের ব্যাখ্যাতা। আলহামদুলিল্লাহ, আমারা এই ব্যাখ্যাতাদের সংস্রব পেয়েছি।
দেওবন্দি সিলসিলার বৈশিষ্ট্য
এক ভাষণে রফি উসমানি বলেন, দেওবন্দি সিলসিলার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো সবকিছুতে ‘ইতেদালে শরঈ’ অবলম্বন করা। বিনয়-যুহদ, আবদিয়্যাত ও সাদেগির মধ্যে ইতিদাল, কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহর মধ্যে ইতিদাল।
তিনি বলেন, দেওবন্দি সিলসিলার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো ইলমে গভীরতা। তবে শুধু ইলমে গভীরতা আল আজহারেও আছে। তাহলে দেওবন্দের মধ্যে বিশেষত্ব কী। বিশেষত্ব হলো, এখানে ইলমের গভীরতার সঙ্গে আছে আমলও। ইলম বা আমল দেওবন্দি সিলসিলার বড় একটি বৈশিষ্ট্য। দেওবন্দি সিলসিলার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সুন্নতের অনুসরণ। দেওবন্দি সিলসিলা মূলত সুন্নতেরই অনুসরণ করে। তারা আলাদা কোনো ফেরকা না।
থানভি-মাদানি দ্বন্দ্ব
থানভি-মাদানি দ্বন্দ্ব অপছন্দ করতেন মুফতি রফি উসমানি। তিনি দেওবন্দে দেয়া এক ভাষণে বলেন, থানভি-মাদানি যদি এই গ্রুপিং দেখতেন, বড্ড বেজার হতেন। তারা কখনও এটা সমর্থন করতেন না। দেশভাগ নিয়ে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি এবং আশরাফ আলী থানভি রহ.-এর মাঝে বিরোধ ছিল। কিন্তু তারা একে অপরকে শ্রদ্ধা করতেন। ভালোবাসতেন। কেউ কখনও কাউকে অশ্রদ্ধা করেননি।
তিনি বলেন, থানভি-মাদানি নামটা খারাপ না। বড্ড মর্যাদাশীল নাম। কিন্তু গ্রুপিংয়ে ব্যবহার হবার কারণে এটা খারাপ। যেমন একবার আনসার-মুহাজিরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছিল। আনসাররা তাদের গোত্রদের ডেকেছিল ‘ইয়া লাল আনসার’ বলে। মুহাজিররা ডেকেছিল ‘ইয়া লাল মুহাজির’ বলে। রাসুল জানতে পেরে বলেছিলেন, এটা আর বলবে না। অথচ আনসার-মুহাজির নামটা কিন্তু খারাপ না, বরং মর্যাদাশীল। কিন্তু গ্রুপিং করার কারণে রাসুল নিষেধ করেছেন।
তিনি বলেন, এই বিষয়ে শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ.-এর বই ‘আল্ এ’তেদাল ফী মারাতিবির রিজাল’ পড়া উচিত সবার। তাহলে বুঝা যাবে, কিভাবে আকাবিরদের মতভেদে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা যাবে।
তিনি বলেন, আকাবিরদের মধ্যে এমন গ্রুপিং ছিল না। মাদানি সাহেব ছিলেন অখণ্ড ভারতের পক্ষে। শিব্বির আহমদ উসমানি ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। আমার বাবাও ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। মাদানি রহ. যখনি ইংরেজ আমলে জেল থেকে ছাড়া পেলেন, আমার বাবা গিয়েছিলেন তাকে দেখতে। সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। মাদানি সাহেবের সঙ্গে মুসাফাহা করেছিলাম। সেটাই ছিল তার সঙ্গে শেষ দেখা। আমার বাবা এবং তিনি দুই মতের দাবিদার হলেও শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন। দেওবন্দের শাইখুল আদব আল্লামা ইজাজ আলী রাজনীতি না করলেও তিনি মাদানি সাহেবের পক্ষে ছিলেন। একদিন আমাদের ঘরে পাকিস্তানপন্থী উলামায়ে কেরাম এলেন। আমার বাবার কাছে পরামর্শ চাইতে কোনো একটা বিষয়ে। আমার বাবা তাদেরকে বললেন, বিষয়টি নিয়ে আল্লামা ইজাজ আলীর সঙ্গে কথা বলা দরকার। অথচ তারা ছিলেন দুই মতবাদের। কিন্তু তাই বলে তাকে অশ্রদ্ধা করেননি। তার কাছে গিয়েছেন। এই যে মধ্যপন্থা, এটাও দেওবন্দি সিলসিলার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।