মুসলিম সংস্কৃতিতে খেলাধুলার ইতিহাস

মুনশি নাঈম:

ইসলামি সভ্যতায় মুসলমানদের কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে চিরায়ত কিছু দৃশ্য। জিহাদের ময়দানে তারা অশ্বের খুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে; তাদের হাতে চিকচিক করছে তীর-তরবারি। দিকে দিকে তারা প্রতিষ্ঠা করছে মাদরাসা, নেতৃত্ব দিচ্ছে মসজিদে, কলমের কালিতে গড়ে তুলছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার। চোখে ভাসে দিগন্ত-বিস্তৃত তাদের ইসলামি সাম্রাজ্যের মোহনীয় সব দৃশ্য। কিন্তু এর বাইরেও তাদের আরেকটি রূপ আছে, আরেকটি অনুশীলন আছে। যেমন—অবসরে নির্মল বিনোদন গ্রহণ, মেধা ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী খেলাধুলা করা। মুসলমানদের এই রূপটি ইতিহাসের একটি অবহেলিত অংশ, অচর্চিত অনুশীলন। মুসলমানদের পূর্ণ রূপটি তুলে ধরতে গেলে খণ্ডিত এই অংশকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই।

মুসলমানরা খেলাধুলা করতেন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সুনির্মিত নিয়মে। রাসূল সা. ছিলেন আরবের সবচে বড় কুস্তিগীর, উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় তাঁর উট কখনো জিততো, কখনো হারতো। অনেক তাবেঈ ইমাম ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচে দক্ষ দাবাড়ু। আলেম-উলামা, উমারা-শাসকগণ সাঁতার কাটতেন, গলফ খেলতেন, শিকার করতেন। এই লেখায় ইতিহাসের অনালোচিত সেই বিষয়টি পাদপ্রদীপে আনার চেষ্টা করবো।

খেলাধুলার উত্তরাধিকার

জাহেলি যুগ থেকেই অনেক খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল আরবরা। আরবি অভিধানে এমন কয়েক ডজন খেলার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ভাষাবিদ ইবনে সিদা উন্দুলুসি ‘আল মুখাসসাস’ গ্রন্থে একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘খেলাধুলার নাম’ শিরোনামে। এই অধ্যায়ে তিনি ৪২টি খেলার নাম উল্লেখ করেছেন। তারপর ইবনে মানযুর ‘লিসানুল আরবে’ আরও কিছু খেলার নাম বৃদ্ধি করেছেন। তারমধ্যে কিছু খেলার বিবরণও দিয়েছেন।

ঐতিহাসিক ফাকিহি ‘আখবারু মাক্কা’ গ্রন্থে একটি অধ্যায় লিখেছেন ‘জাহেলি ও ইসলামি যুগে মক্কাবাসীদের খেলাধুলা, পরবর্তীতে বর্জন’ শিরোনামে। তাতে তিনি বলেছেন, মক্কায় এসে হজরত ওমর রাদি. দেখলেন, মক্কাবাসীরা কাঠের টুকরো দিয়ে এক ধরণের খেলা খেলছে। খেলনাটির নাম ‘কুররাক’। তিনি বললেন, ‘রাসূল সা. যদি এই খেলার অনুমতি না দিতেন, আমিও অনুমতি দিতাম না।’ কুররাক খেলাটি ছিল আরবের বহু পুরাতন একটি খেলা। ২৫২ হিজরি/৮৬৬খৃ. পর্যন্ত এই খেলার প্রচলন ছিল।

মেধার জোরে খেলতে হয়, আরবীয় এমন পুরাতন একটি খেলা হলো ‘কিরক’। ইরাকের ছেলেরা এখনো খেলাটি খেলে। খেলায় একটি চতুষ্কোণ ঘর আঁকতে হয়, তার ভেতরে আরো একটি চতুষ্কোণ ঘর, তার ভেতরে আরো একটি চতুষ্কোণ ঘর। এখন রেখা টেনে সবগুলো কোণ মিলিয়ে দিতে হয়। খেলাটি খেলতে হয় দুজনে। প্রত্যেকের হাতে থাকবে তিনটি গুটি। গুটি বসাতে হয় কোণে। প্রত্যেকেই চেষ্টা করবে, তার তিনটি গুটি যেন একই রেখায় সমান্তরালভাবে আনতে পারে। যে আনতে পারবে, জিত তারই।

‘কিতাবুল গরিবিন ফিল কুরআন ওয়াল হাদিস’ গ্রন্থে আবু উবায়েদ হারবি বলেছেন, এই কিরক খেলা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদি. বলেছেন, ‘রাসূল সা. এই গুটিখেলা দেখতেন। কিন্তু খেলতে না করতেন না।’

আরবদের প্রসিদ্ধ খেলা ছিল কুস্তি। ইয়াজিদ ইবনে রুকানার সঙ্গে রাসূল সা. এর কুস্তি খেলার ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে’ ইবনে কাসির রহ. ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে জায়্যিদ সনদে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার সারমর্ম হলো—রাসূল সা. ইবনে রুকানাকে কুস্তিতে টানা তিনবার পরাজিত করেন। তৃতীয়বার ইবনে রুকানা বললো, ‘মুহাম্মদ! আপনার পূর্বে আমার পিঠ কেউ কখনো মাটিতে লাগাতে পারেনি।’

খেলার প্রকার

রাসূল সা. যখন মদীনায় হিজরত করলেন, মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলামি রাষ্ট্র, তখনকার মদীনায় দু’ধরণের খেলার প্রচলন ছিলো। এক—আনুষ্ঠানিক খেলা। দুই—প্রতিযোগিতামূলক খেলা। কখনো এ দু’ধরণের খেলা একই সঙ্গে হতো।

আনুষ্ঠানিক খেলার প্রসিদ্ধ উদাহরণ বুখারী শরীফে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদি. এর একটি হাদীস—দেখি, একদিন রাসূল সা. আমার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। একজন হাবশিরা মসজিদে খেলছে। রাসূল সা. চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে রেখেছেন। আর আমি হাবশিদের খেলা দেখছিলাম।’ কোনো রেওয়ায়াতে এসেছে—তারা বর্শা দিয়ে খেলছিলো।

এর থেকে স্পষ্ট—এই খেলাটি মদীনার আনসারদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো। আবু দাউদ রহ. হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদি. থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হিজরত করে রাসূল সা. যখন মদীনায় আসেন, হাবশিরা আনন্দে বর্শা দিয়ে খেলছিলো। ‘মিরআতুয যামান’ গ্রন্থে সিবত ইবনুল জাওযি বলেন, ‘হিজরত করে রাসূল সা. যখন মদীনায় আসেন, হাবশিরা আনন্দে বর্শা দিয়ে খেলছিলো। সেদিনের মতো আনন্দিত তারা আর কখনো হয়নি।

এই বর্শা বর্শা খেলা ছিল মূলত যুদ্ধের প্রস্তুতি। সহিহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে কিরমানি ইবনুল মুনাইইর থেকে একটি বক্তব্য কোট করেছেন—এটাকে খেলা বলা হতো। মূলত এটা ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারা আঘাত করার ভঙ্গি করতো, কিন্তু আঘাত করতো না।’

এই হাদীস থেকে হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ খেলা দেখার ফিকহি হুকুম বের করেছেন। এই হাদীসের ভিত্তিতে সহিহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে ইবনে বাত্তাল কুরতুবি বলেছেন, ‘যে খেলা মুবাহ, সে খেলা দেখা জায়েয।’ তিনি মনে করেন, ‘বর্শা দিয়ে খেলা সুন্নাত। কারণ এটা যুদ্ধ-প্রস্তুতি।’

খেলা যখন পেশা

প্রতিযোগিতার খেলা নয়, বরং এই আনুষ্ঠানিক খেলাকে কেউ কেউ পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ইবনু আবি শায়বা ‘আল মুসান্নাফে’ বর্ণনা করেন, ‘ইবনে আব্বাস রাদি. যখন তার দুই ছেলের খতনা করান, খেলা দেখানোর জন্য কয়েকজন খেলোয়ার ডেকে এনেছিলেন। খোলশেষে তিনি তাদেরকে দিয়েছিলেন চার দিরহাম। কেউ বলেন তিন দিরহাম।

পরবর্তীতে খলিফা এবং সুলতানগণ এসব খেলোয়ারদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতেন। সপ্তম হিজরি শতাব্দী/১৩০০ খৃস্টাব্দের শুরুতে তাতার দূতের সামনে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিলেন আব্বাসি খলিফা। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে জুবাইর মক্কাবাসীদের এমনই এক খেলার কথা সফরনামায় উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখলেন—মক্কাবাসীরা দলে দলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বের হচ্ছে। কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ পায়ে হোঁটে। তারা একটি ময়দানে উপস্থিত হলো। শুরু হলো ভয়ংকর এক খেলা। বর্শাকে শূন্যে ছুঁড়ে মুহূর্তেই কেমন নিপুণ কুশলতায় হাতে নিচ্ছে। কেউ শুন্যে ছুঁড়ছে তরবারি ; আবার এমনভাবে তরবারির বাট ধরে ফেলছে, মনেই হচ্ছে না তরবারি হাত থেকে আলাদা হয়েছে।

কখনো কখনো যুদ্ধজয়ের খুশীতেও এই ধরণের খেলার আয়োজন করা হতো। ‘কানযুদ দুরারে’ ঐতিহাসিক ইবনুদ দাওয়াদারি লিখেন, ৬৪৭ হিজরি/১২৪৯ খৃস্টাব্দে আইয়ুবিরা যখন মিশরে বিজয়ী হলো, তারা শহরে প্রবেশ করছিলো ঘোড়ায় চড়ে বর্শা দিয়ে খেলতে খেলতে। ‘হাওয়াদিসু দিমাশক আল ইয়াওমিয়্যাহ’ গ্রন্থে হাল্লাক বুদাইরি লিখেন, ‘১১৫৬হিজরি/১৭৬২ খৃস্টাব্দে দামেশকের গভর্নর সুলাইমান পাশা তার ছেলের খতনা উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন শুরু করেন। সমস্ত খেলোয়াড় তাতে উপস্থিত হয়েছিলো। তাদের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল—তাদের ইচ্ছেমতো তারা খেলতে পারে। টানা সাতদিন-সাতরাত এই উদযাপন চলে।’

ব্যাপক অংশগ্রহণ

মুসলমানদের এসব খেলাধুলায় সবাই অংশগ্রহণ করতো। এমনকি ফকিহরাও। সুলতানগণ রাষ্ট্রে আবশ্যকীয় একটা অংশ হিসেবে নিতেন খেলাধুলাকে। জাহিয ‘আত তাজ’ কিতাবে তাই বলেছেন। ইবনে রজব হাম্বলি ‘যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা’ গ্রন্থে বলেন, হাম্বলি মাজহাবের একজন যাহেদ আবু মনসুর আবদুল আজিজ ইবনে সাবেত বাগদাদি। তার সংস্পর্শে থাকতে ভালো লাগতো। একদিন আমরা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর কবর যিয়ারত করতে বের হই। পথে একটি নদী পড়ে। আমাদের সঙ্গে থাকা ফকিহরা নদীতে নেমে সাঁতার কাটতে শুরু করেন। তারা শায়খ আবু মনসুরকে ডাকতে থাকেন, আপনিও আমাদের সঙ্গে নেমে আসুন। শায়খ কাপড় খুলে নেমে তাদের সঙ্গে সাঁতরাতে লাগলেন।’

বাচ্চাদের জন্যও আলাদা কিছু খেলা ছিলো। সহিহ মুসলিমে এসেছে, ‘রাসূল সা. এর প্রথম বক্ষ বিদীর্ণের ঘটনা ঘটে শৈশবে। তখন তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিলেন।’ ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে ইমাম যাহাবি লিখেন, ‘আবু হুরায়রা রাদি. বাচ্চাদের প্রতি কোমল ছিলেন। তিনি খেলারত বাচ্চাদের কাছে এমনভাবে এসে দাঁড়াতেন, তারা টের পেতো না। যতক্ষণ না তিনি নিজে বুঝতে দিতেন পায়ে শব্দ করে। তখন বাচ্চারা পালাতো।’ আর মেয়েরা খেলতো পুতুল খেলা।

রাসূলের যুগ থেকেই মুসলমানদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। তবে ইসলাম জুয়ার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছে। যেখানে অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু সমাজের কোনো উপকার হয় না। তবে ইসলাম কিছু খেলার প্রতিযোগিতা নিষেধ করেনি। যেমন—সাঁতার। এর মাধ্যমে মানুষের শারীরিক উপকার হয়। এছাড়াও রয়েছে তীরন্দাজি, দৌড় প্রতিযোগিতা, উট এবং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। রাসূল সা. এসব প্রতিযোগিতায় নিজে অংশগ্রহণ করতেন, অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহ দিতেন। তিনি হাফিয়া থেকে সানিয়াতুল বিদা পর্যন্ত ১০ কি.মি ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি একবার তীরন্দাজিতে রত একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি উৎসাহ দিয়ে তাদেরকে বললেন, ‘হে বনি ইসমাইল! তোমরা তিরন্দাজি চর্চা করো। তোমাদের পিতাও ছিলেন তীরন্দাজ।’

রাসূল সা. এর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হাদীস থেকে আহলে ইলমগণ বলেন, যে সমস্ত খেলাধুলায় মেধা উন্নত হয়, যুদ্ধের প্রস্তুতি হয়, কৌশল শেখা যায়, সেসব খেলা জায়েয। আল্লামা মাহমুদ শুকরি আলুসির ‘মুখতাসারুত তুহফাতিল ইসনা আশারিয়া’ গ্রন্থে এমনটাই বলেছেন।

খেলাধুলার নিয়ম-কানুন

রাসূল সা. যেসব খেলাধুলায় তত্ত্বাবধান করতেন, সেগুলো থেকে খেলাধুলার কিছু নিয়ম বেরিয়ে আসে। যে নিয়মগুলো বর্তমানের জন্যও প্রযোজ্য। আবু দাউদ, তিরমিজি এবং নাসাঈ বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. বলেছেন, ‘লা জালাবা, ওয়ালা জানাবা।’ ইমাম মালেক ইবনে আনাস ‘মুআত্তা’য় এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় এক ঘোড়া যদি আরেক ঘোড়ার পেছনে পড়ে যায়, তখন পেছনের অশ্বারোহী সামনে ঘোড়াকে নাড়া দেয়, ফলে সামনের ঘোড়া পিছিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে পেছনের ঘোড়া এগিয়ে যায়। এটাকে বলে জালাব। আর জানাব হলো—নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি ঘোড়া রেখে দেয়া। প্রতিযোগী ওই ঘোড়ার নিকট যেতে যেতে তার ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন সে ওখানে রাখা ঘোড়ায় চড়ে ক্লান্ত ঘোড়া রেখে দেয়। খেলায় কখনো এটা করা যাবে না।

ইমাম শাফেয়ি ‘আল উম্ম’ কিতাবে বলেন, ‘তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককেই জানতে হবে তার সঙ্গে কে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে এবং কার ওপর তীর নিক্ষেপ করছে। এটা প্রতিযোগিতা জায়েয হওয়ার শর্ত।’

জাহেয ‘আত তাজ’ কিতাবে লিখেছেন, ‘বাদশার জন্য কর্তব্য হলো—খেলোয়ারকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা। আর খেলোয়ারের কর্তব্য হলো—খেলার নিয়ম মেনে চলা।

গলফ খেলা

ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি খেলা—গলফ। খেলোয়াড় ঘোড়ায় চড়েন, তার হাতে থাকে একটি লাঠি। লাঠির মাথা একটু বাঁকানো। তিনি ঘোড়ার উপর থেকেই লাঠি দিয়ে মাটিতে থাকা বলকে আঘাত করেন। খলিফা বাদশা এবং আমিরদের নিকট এই খেলা প্রিয় ছিলো। ‘কুনুযুয যাহাব’ গ্রন্থে সিবত ইবনুল আজমি বলেন, ‘প্রথম যে খলিফা গলফ খেলেন, তিনি খলিফা হারুনুর রশীদ। তার থেকে এই খেলার উত্তরাধিকার পেয়েছে তার ছেলে মুহাম্মদ আমিন। তারিখুল খুলাফা গ্রন্থে ইমাম সুয়ুতি বলেন, ‘খেলাফতের বায়াত গ্রহণের পর আমিন মানসুর প্রসাদের পাশে গলফ খেলার মাঠ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলো।’

‘আন নুজুমুয যাহেরা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক ইবনে তাগরি বারদি বলেন, ‘মিশরের আমির আহমদ ইবনে তুলুন বড় একটি ভবন নির্মাণ করেছিলেন। এই ভবনেই ছিল তার গলফ খেলার মাঠ। পুরো ভবনটাকেই বলা হতো মাঠ।’ গলফ খেলার প্রতি দারুণ আসক্ত ছিলেন সুলতান নিরুদ্দিন মাহমুদ জেঙ্গি। তার রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক আবু শামা মুকাদ্দেসী ‘কিতাবু তারিখির রওজাতাইন’ গ্রন্থে বলেন, ‘ঘোড়ায় চড়ে তিনি যখন গলফ খেলতেন, তখন তিনি সবচে ভালো থাকতেন। মনে হতো—এই খেলাটা তার জন্মগত। কী প্রবল গতিতে বলকে শূন্যে মারছেন, ঘোড়া হাঁকিয়ে গিয়ে বলটা হাতেও নিচ্ছেন, তারপর আবার বলে আঘাত করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন মাঠের ওপ্রান্তে।’ তবে এই খেলার প্রতি আগ্রহ তার ইবাদত এবং জিহাদে কোনো বিঘ্ন ঘটায়নি। বরং সব করে শরীর চাঙ্গা করার জন্য তিনি গলফ খেলতেন। ‘তারিখুল ইসলামে’ যাহাবি রহ. বলেন, ‘তিনি প্রচুর রোজা রাখতেন। গলফ খেলতেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ তাকে বললো, ‘আপনি অযথাই ঘোড়াকে কষ্ট দিচ্ছেন।’ তিনি বললেন, ‘না, তেমন নয়। গলফ খেলে ঘোড়াকে আমি সতেজ রাখছি। যেন যুদ্ধের ডাক এলে তীব্র গতিতে ছুটতে পারে।’ আশ্চর্যজনক তথ্য হলো—নুরুদ্দিন জেঙ্গি সালাহুদ্দিন আউয়ুবিকে নিজের কাছাকাছি করেছেন, তার অন্যতম কারণ—আইয়ুবির গলফ খেলায় দক্ষতা। ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘জেঙ্গি সালহুদ্দিন আইয়ুবিকে প্রিয়দের কাতারে জায়গা দিয়েছেন, কারণ, তিনি ছিলেন সুদর্শন এবং গলফ খেলায় সুদক্ষ।’

ইবনে তাগরি বারদি বলেন, ‘সুলতান নাসির মুহাম্মদ ইবনে কালাউন গলফ খেলায় দক্ষ ছিলেন। তিনি একটি মাঠ বানালেন। মাঠের পাশে খনন করলেন সরোবর, চারপাশে লাগালেন বিভিন্ন গাছ-গাছালি। এই মাঠে প্রতিদিন তিনি গলফ খেলতেন।’

গলফ খেলতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে মারা যাবার ঘটনাও ইতিহাসের কিতাবে সংরক্ষিত আছে। যেমন— ‘আল মুখতাসার ফি তারিখিল বাশার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, বাদশা সাঈদ বারাকা গলফ খেলতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান। ফলে তার প্রচণ্ড জ্বর আসে। কিছুদিন জ্বরে ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেন। ‘নায়লুল আমাল’ গ্রন্থে ইবনে শাহিন বলেন, গলফ খেলতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে ইন্তেকাল করেন ইয়ালবুগা সালেহি। তিনি ছিলেন কামিল শাবান ইবনে নাসের কালাউনের শাসক।

দাবা খেলা

ইসলামি সভ্যতায় কেবল গায়ের জোরের খেলাই প্রচলিত ছিল না, বরং মেধার খেলাও প্রচলিত ছিল। এরমধ্যে অন্যতম দাবা খেলা। এই খেলাটি ভারতীয় উপমহাদেশের আবিষ্কৃত। জাহিয ‘আর রসায়েল’ গ্রন্থে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘দাবা খেলা অভিজাত খেলা। এর মূল চালিকা শক্তি মেধা ও কৌশল।’ ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান বলেন, ‘দাবা খেলা ভরতীয় উপমহাদেশের আবিষ্কার। খেলাটির আবিষ্কারক সাসা ইবনে দাহের হিন্দি। তিনি খেলাটি বাদশা শেহরামের জন্য আবিষ্কার করেন।’

হিজরি প্রথম শতাব্দী থেকে মুসলমানরা দাবা খেলার প্রতি আগ্রহী। আলেম, ফকিহ, সাধারণ মানুষ সবাই।  হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষদিকে মক্কার হারাম সংলগ্ন যে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিলো, তাতে দাবা খেলার সরঞ্জাম ছিলো। কোরেশীয় ঐতিহাসিক জুবায়ের বিন বাক্কার জামহারাতু নাসাবি কুরাইশ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জুমাহী মক্কার নিকটে একটি গৃহ নির্মাণ করেন। এতে দাবা ও পাশা খেলার ব্যবস্থা ছিলো। শিশুদের জন্য ছিল বিভিন্ন খেলার আয়োজন। কিতাবাদির‌ও ছিল বিশাল সম্ভার। গৃহটির দেয়ালে কীলক লাগানো ছিল। অবসর যাপনের জন্য মানুষ সেখানে যেতো। জামা খুলে কীলকে ঝুলিয়ে রাখতো। এরপর নিজ পছন্দের খেলায় মেতে উঠতো। কেউ কেউ মন দিত বই পড়ায়।

তাবেঈদের কেউ কেউ দাবা খেলায় এতটাই দক্ষ ছিলেন, না দেখেও গুটি চালতে পারতেন। ইমাম বায়হাকি রহ. ‘মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার’ গ্রন্থে বলেন, ‘আমি শাফেয়ি রহ.কে বলতে শুনেছি, সাঈদ ইবনে জুবাইর না দেখে দাবা খেলতে পারতেন। তিনি বলতেন, ‘কোন গুটি চালা হয়েছে? যখন বলা হতো ওটা, তিনি বলতেন, তাহলে এটা চালো।’ শাফেয়ি রহ. বলেন, ‘মুহাম্মদ ইবনে সিরিন এবং হিশাম ইবনে উরওয়া দাবা খেলতেন না তাকিয়ে। শাবি রহ. সম্পর্কেও এমন বক্তব্য আছে।

প্রথম যুগের পর কোনো কোনো মুসলমান দাবা খেলায় এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলো, তাকে দিয়ে উদাহরণ দেয়া হতো। সেই উদাহরণের কারণে লোকজন ভাবতো, তিনিই বুঝি দাবা খেলার আবিষ্কারক! ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান বলেন, ‘সাহিত্যিক আবু বকর ইবনে সুলি ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। তার সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। কেউ এখন ভালো খেললে, মানুষ এখনো তাকে উদাহরণ হিসেবে বলে, ‘সে সুলির মতো দাবা খেলেছে।’

উয়ুনুল আম্বা গ্রন্থে আছে, উন্দুলুসের চিকিৎসক আবু বকর ইবনে আবিল হাসান যুহরি দাবা খেলায় এতটাই দক্ষতা অর্জন করোছিলেন, তাকে বলা হতো, আবু বকর যুহরি শতরঞ্জি। এই উপাধিতে রাগ হয়ে তিনি দাবা খেলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই উপাধি দূর করতে এই খেলা ছাড়া ব্যাতীত উপায় ছিল না।’

আহলে ইলমগণ তাদের বাড়িতে দাবাঘর রাখতেন আগত মেহমান এবং ছাত্রদের জন্য। অবসর সময়ে তারা যেন খেলতে পারে। ‘আল কামিল’ গ্রন্থে ইবনুল আসির বলেন, ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ফারসি এবং আরবিতে ভালো কবিতা পারতেন। তার একটা মেহমানখানা ছিলো। তাতে ছিল বিভিন্ন কিতাব এবং দাবাঘর। আলেমরা কিতাব পড়তেন, মূর্খরা দাবা খেলতেন।’

‘মাসালিকুল আবসার’ গ্রন্থে ইবনে ফজলুল্লাহ উমরি বলেন, ‘বাহাউদ্দিন হালাবির বাড়িতে তালেবুল ইলমরা আসতো। দেখা যেতো তারা একদল পড়ছে, একদল দাবা খেলছে। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না।’

তবে দাবা খেলার বৈধতা নিয়ে মতপার্থক্য আছে।

উপসংহার

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সত্য ও ন্যায়ের পাশাপাশি ইসলাম বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহ দেয়। বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। সুস্থ শরীর ও সুন্দর মন পরস্পর পরিপূরক। তাই ইসলাম এ বিষয়টির প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ইসলাম নিথর-নির্জীব জীবনবোধের বদলে ইবাদতের মাধুর্যে শরীর-স্বাস্থ্যের বিকাশে উৎসাহ দেয়।

খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক বিষয়াবলিকে ইসলাম ধর্মে খুব সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়েছে। খেলা ও বিনোদন যখন সীমার ভেতর থাকে, তখন ইসলাম এতে বাধা দেয় না। কারণ খেলাধুলা পৃথিবীর আদিকাল থেকে শিশু-কিশোরদের স্বভাবজাত। কিন্তু যখন এটাকে ব্যবসায়িক রূপ দেওয়া হয়, খেলার নামে অশ্লীলতা ছড়ায়, মানুষ এতে আসক্ত হয়ে জুয়া ইত্যাদিতে জড়িয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে, তখন এটা হারাম।

যেসব শর্তে খেলাধুলার বৈধতা দেওয়া হয়, বর্তমানে প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন খুবই কম লক্ষণীয়। এসব খেলার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি, নামাজের প্রতি অবহেলা, ইসলামবহির্ভূত অন্য কিছুর অনুসরণ, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজি ধরা, রংখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উলকি আঁকা ইত্যাদির বাহুল্য থাকে। তাই এসব খেলাধুলা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। কারণ আধুনিককালে খেলাধুলার নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটেছে। খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনুষঙ্গিক বহু বিষয়। খেলার বৈধতা-অবৈধতার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচ্য। যেমন এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব খেলার প্রাণ দর্শক-শ্রোতা। দর্শকরাই খেলাধুলার মাধ্যমে আয়ের প্রধান উৎস। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম খেলাধুলার ক্ষেত্রে বল্গাহীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আর সুস্থ সুন্দর ও শরিয়তের সীমায় থেকে খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করেছে ইসলাম।

আগের সংবাদইসলামী সভ্যতায় লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা
পরবর্তি সংবাদনবীজি ও সাহাবিদের ঈদ