মুসলিম সভ্যতায় ঈদ উৎসব

আবু সাঈদ:

ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মুসলমানরা এই দিনটি দারুণ আনন্দে উদযাপন করে। এর প্রবর্তন ঘটে মদীনায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাবাসীদের বছরে দুটি দিন উৎসব করতে দেখেন। জিজ্ঞেস করেন, এই দিনদুটিতে উৎসবের কারণ কী? সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম জানালেন, জাহেলী যুগে তারা দিনদুটিতে উৎসব করতেন। তার‌ই ধারাবাহিকতায় এই আনন্দ উদযাপন। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে উৎসবের জন্য এরচেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। একটি হলো, কুরবানীর দিন। অন্যটি হলো, ফিতর (রোজা ভাঙ্গার) দিন। (আবু দাউদ)

নববী যুগে ঈদ উদযাপন

তখন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম এই দুই দিনে আনন্দ উদযাপন করতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাতে অংশ নিতেন। ইমাম শাফেয়ি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘কিতাবুল উম্ম’ গ্ৰন্থে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনকে বেশ আয়োজন করে উদযাপন করতেন। ইমাম ওয়াকেদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাবশার বাদশা নাজাসী একবার যুবায়ের ইবনুল আওয়াম রাদিআল্লাহু আনহুকে একটি মূল্যবান বর্শা হাদিয়া দেন। তিনি সেটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাদিয়া দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্শাটি ঈদের সময় নিজের সঙ্গে রাখতেন (সামহুদি প্রণীত ওয়াফাউল ওয়াফা)।

ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন বর্শাটি সঙ্গে নেওয়ার জন্য বলতেন। ঈদগাহে যখন নামাজে দাঁড়াতেন, বর্শাটি (সুতরা হিসেবে) সামনে রাখতেন (বুখারী)।

এভাবে ঈদগাহে বর্শা নেওয়ার রীতি চালু হয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর খোলাফায়ে রাশেদীন‌ও তা সঙ্গে রাখতেন। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল পর্যন্ত খলীফাদের মাঝে এই রীতি চালু থাকে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলেন, হযরত সাআদ কুরাযী রাদিআল্লাহু আনহু নববী যুগে মসজিদে কুবার মুআজ্জিন ছিলেন। হযরত উমর রাদিআল্লাহু আনহু যখন খেলাফতের মসনদে সমাসীন হন, তিনি সাআদ কুরাযী রাদিআল্লাহু আনহুকে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই দায়িত্ব তার বংশের লোকজনের উপর‌ই ন্যাস্ত থাকে। তিনি হযরত আবু বকর, ওমর ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমের যুগে খলিফার জন্য ঈদগাহে বর্শা নিয়ে যেতেন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন সাহাবীদেরকে উত্তম পোষাক পরিধানের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতেন। ইমাম হাকেম রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুস্তাদরাক গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, হাসান ইবনে আলী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমাদেরকে উত্তম পোষাক পরিধানের জন্য বলতেন। বলতেন উত্তম সুগন্ধি ব্যবহারের জন্য। এবং মোটা পশু জবেহ করার জন্য।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে গিয়ে খুতবা দিতেন। ঈদ সংক্রান্ত নানা মাসায়েল বর্ণনা করতেন। এজন্য নারী-পুরুষ সকলেই ঈদগাহে যেতো। ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত উম্মে আতিয়া রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব ধরনের মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। তবে ঋতুবতী নারীরা ঈদগাহে প্রবেশ করতো না। তারা বাইরে অবস্থান করতো। দুআতে অংশ নিতো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের পর ঈদের খুতবা দিতেন। কিন্তু উমাইয়াদের শাসনামলে এর ব্যতিক্রম রীতি চালু হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নানা বিরূপ আলোচনার কারণে মানুষজন তাদের খুতবা শুনতে চাইতো না। সেজন্য তারা নামাজের আগে খুতবা দেওয়ার প্রচলন শুরু করে। ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ভাষ্যমতে, মার‌ওয়ান ইবনে হাকাম সর্বপ্রথম এর প্রচলন শুরু করেন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঈদের দিন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিনোদনও অনুষ্ঠিত হতো। ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একবার ঈদের দিন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার ঘরে এলেন। আমার কাছে দুজন আনসারী মেয়ে ছিলো। তারা দুজন বুআছ যুদ্ধের গান গাইছিলো। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এটা দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। বললেন, রাসূলের ঘরেই শয়তানের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এলে? তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু বকর, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের‌ই উৎসবের দিন আছে। আজ আমাদের উৎসবের দিন।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এক ঈদের দিন দুজন হাবশী ঢাল-তলোয়ারের খেলা প্রদর্শন করছিলো। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে খেলা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। ( কিংবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই প্রস্তাব দিলেন।) তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাঁধের উপর থুতনি রেখে খেলা দেখতে লাগলাম।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ঈদের দিনের পারস্পরিক অভিবাদন বিনিময়-বাক্য পাওয়া যায় না।

তবে সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুমের আমল থেকে জানা যায়, পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা বলা উচিত। ইমাম তাবরানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কিতাবুদ দুআ গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, ‘প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু উমামা বাহেলী ও হযরত ওয়াছিলা ইবনুল আছকা রাদিআল্লাহু আনহুমার এক ঈদের দিন সাক্ষাৎ ঘটে। তখন তারা একে অপরকে বলেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’

বিভিন্ন তাবেয়ীনের আমল থেকেও বিষয়টি প্রমাণিত।

মুক্ত পরিবেশে ঈদের নামাজ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকেই ঈদের নামাজ খোলা প্রান্তরে আদায় করা হয়ে থাকে। কোথাও এই প্রান্তরের আলাদা নাম রাখা হতো। কোথাও বিশেষ নাম ব্যবহৃত হতো না।

ইতিহাস শাস্ত্রের বরেণ্য ইমাম ইস্তাখরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আল মাসালিক ওয়াল মামালিক গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পশ্চিমে একটি খোলা প্রান্তরে ঈদের নামাজ আদায় করতেন।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম তানুখী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নিশ‌ওয়ারুল মুহাযারা গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, বাগদাদে ঈদের নামাজ শহরের পূর্ব প্রান্তে অনুষ্ঠিত হতো।

ইতিহাস শাস্ত্রের বরেণ্য ইমাম মাকরিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আল খুতাতু ওয়াল আছার গ্ৰন্থে বলেন, দামেস্কবাসী একটি খোলা প্রান্তরে ঈদের নামাজ আদায় করতো। সে জায়গাটা আল মায়দানুল আখযার নামে পরিচিত ছিলো। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে তাগরী বারদীও দামেস্কবাসীর ঈদগাহের আলোচনা করতে গিয়ে এই নামটি উল্লেখ করেছেন।

ঈদগাহের সজ্জা

ঈদ উপলক্ষে সুলতানদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হতো। ঈদগাহের খোলা প্রান্তরকে দারুণভাবে সজ্জিত করা হতো। খুশির আমেজ আর ভালোবাসার আবেশে ঈদগাহ মোহনীয় হয়ে উঠতো। এজন্যই হয়তো প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম তানুখী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ইসলামের সৌন্দর্য দেখতে হলে বাগদাদে যাও শুক্রবারে। মক্কায় যাও তারাবির সময়। আর তারাসুসে যাও ঈদের দিনে (নিশ‌ওয়ারুল মুহাযারা)।

তখন সুলতান ও খলিফাগণ‌ই ঈদের নামাজে ইমামতি করতেন। নামাজ শেষে খুতবা দিতেন। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ ইমাম মাকরিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইত্তেআযুল হুনাফা গ্ৰন্থে বলেন, ঈদের সময় ফাতেমী খলিফা আব্দুল আযিয ঈদগাহ ও খেলাফত ভবনের মাঝে ঈষৎ উচ্চ মিম্বার নির্মাণ করতেন.. এতে অবস্থান নিতেন ফুকাহায়ে কেরাম ও নামাজের মুকাব্বিরান। যেন তাদের সম্মান হয়। এবং প্রাসাদ পর্যন্ত তাকবির ধ্বনি শোনা যায়… অতপর খলীফা ঈদগাহে আসতেন। এবং ঈদের নামাজের ইমামতি করতেন। নামাজ শেষে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করতেন।

কখনো খলিফার আসতে দেরি হলে উলামায়ে কেরাম তার প্রতিবাদ করতেন। অনুচিতের সুযোগ দিতেন না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নাসেরি সালাবী আল ইস্তেকসা লি আখবারিদ দুয়ালিল মাগরিব গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, একবার সুলতান আবুল আব্বাস ওয়াতাসি এর ঈদগাহে যেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। খলিফার অপেক্ষায় সবাই অপেক্ষমাণ। মিষ্টি রোদ পেরিয়ে সূর্যের তখন কাঠফাটা মূর্তি। তাবুর বিপুল আয়োজন ভেদ করে যেন সবাইকে দগ্ধ করবে। অবশেষে সুলতান এলেন। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে গেছে। এখন কি আর ঈদের নামাজ পড়বার সময় আছে? শায়খ আবু মালেক বিনশারিসী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মিম্বারে আরোহণ করলেন। লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে লোক সকল, আল্লাহ তোমাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন। ঈদের নামাজের আর সময় নেই। সবাই জোহরের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। অতপর মুয়াজ্জিন আজান দিলে শায়খ নিজেই নামাজের ইমামতি করলেন। খলিফা এই বিলম্বের কারণে খুবই লজ্জিত হলেন।

কোনো কোনো শহরে একাধিক মাজহাব থাকার কারণে ঈদের নামাজ একাধিকবার অনুষ্ঠিত হতো। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম কাযবিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আছারুল বিলাদ গ্ৰন্থে বলেন, সাকসীন শহরের অধিবাসী সকলেই মুসলমান। তাতে দুই বার ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো। শহরের অধিকাংশ মানুষ হানাফী। কিছু সংখ্যক শাফেয়ি। প্রত্যেক মাযহাবের রয়েছে আলাদা জামে মসজিদ। ঈদের দিন‌ও তাদের মিম্বার হতো আলাদা। সবাই নিজ নিজ মাযহাবের ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করতো।

ঈদের বিশেষ ঐতিহ্য

ঈদের দিনের বিশেষ ঐতিহ্য ছিলো কাবা গৃহের গিলাফ পরিবর্তন। শায়খ ফাসী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শিফাউল গারাম গ্ৰন্থে বলেন, ‘আমাদের এই সময় ঈদুল আজহার দিন কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। তবে নতুন গিলাফে কেবল উপরের অংশই আবৃত করা হয়। নীচের অংশের আচ্ছাদন ঈদুল আজহার কয়েক দিন পর সম্পন্ন হয়।’

শায়খ ফাসি রাহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, এই রীতি সব যুগের নয়।

বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে জুবায়ের তার রিহলা গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, ‘কাবা শরীফের গিলাফ ঈদুল আজহার দিন পরিবর্তন করা হতো না। বরং ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন পরিবর্তন করা হতো।’

ঈদের দিনে সাজসজ্জার গুরুত্ব

ঈদের উৎসবমুখর পরিবেশে সাজসজ্জার প্রতি যত্নবান হতে ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ ব্যাপারে নানা হাদিস‌ও বর্ণিত হয়েছে। এজন্য ফুকাহায়ে কেরাম‌ বলেন, ঈদের দিন গোসল করা জুমার দিনের গোসল অপেক্ষা উত্তম। জুমার দিনের গোসল নামাজে অংশগ্ৰহণকারী মুসল্লিদের দুর্গন্ধজনিত দুর্ভোগ কমানোর জন্য। যে নামাজে অংশ নিবে না, তার জন্য গোসলের নির্দেশ নেই। কিন্তু ঈদের দিন গোসল করতে হয় সাজসজ্জার জন্য। ঈদগাহে না গেলেও তাই গোসল করা বিধিবদ্ধ। ঈদের দিনের গোসল তাই জুমার দিনের গোসল অপেক্ষা উত্তম (আল হাবীল কাবীর)।

তাছাড়া শরীয়তের চাহিদা হলো, ব্যক্তি যেন ঈদের দিন তার সাধ্যে থাকা সবচেয়ে দামী এবং সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটিই পরিধান করে। এটি ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নয়। সজ্জা গ্ৰহণের জন্য। কিন্তু জুমার গোসল তো কেবল নামাজে অংশগ্ৰহণকারীর জন্য (নিহায়াতুল মুহতাজ)।

ঈদের দিন ধনী-গরিব সকলেই নানাভাবে পরিপাটি হয়। কেউ মেহেদীর রঙে হাত রাঙিয়ে তোলে। কেউ উস্কোখুস্ক চুল কালি করে শোভা বর্ধন করে। এ ব্যাপারে একটি দারুণ ঘটনা আছে। ঘটনাটি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম ইবনে আযারী মারাকেশী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আল বয়ানুল মুগরিব গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন। তিনি স্পেনের মারদা অঞ্চল বিজয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, একদিন একদল রোমান দূত মুসা বিন নুসাইরের সাথে দেখা করার জন্য আসে। তারা লক্ষ্য করে, মুসা বিন নুসাইরের দাঁড়ি ও চুল ধবধবে সাদা। দ্বিতীয় বার এসে দেখে, তার চুল লাল। তিনি মেহেদী দিয়েছিলেন চুলে। তৃতীয় বার যখন আসে, বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, এবার চুল দাঁড়ি সব মিশমিশে কালো। চুল দাঁড়ির এই ‘অদ্ভুত’ পরিবর্তনে তারা যারপরনাই সন্ত্রস্ত হয়। কিছু না বলেই শহরে ফিরে যায়। অতঃপর নেতাদের বলে, তোমরা কার সাথে যুদ্ধ করছো জানো! তোমরা তো নবীদের সাথে যুদ্ধ করছো। তাদের আমীর তো পৌঢ়ত্বের পর আবার যুবক হতে চলেছে। আমরা প্রথম বার গিয়ে দেখি, তার চুল ও দাঁড়ি ধবধবে সাদা। পরের বার গিয়ে দেখি লাল। এবার গিয়ে দেখি, মিশমিশে কালো। তবে নবী ছাড়া কে আর হবেন তারা! এতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও ভয় পেয়ে যায়। এবং তৎক্ষণাৎ সন্ধির জন্য দূত পাঠায়।

ঈদের শোভাযাত্রা

ঈদের দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সৌর্যবীর্য ও শক্তিমত্তা প্রদর্শন করা হতো। এদিনে সুলতানগণ বড় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাইরে বের হতেন।

এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইমাম ইবনুল জাওযী রাহমতুল্লাহি আলাইহি আল মুনতাযাম গ্ৰন্থে বলেন, আব্বাসী খলীফা মুকতাফী ঈদুল ফিতরের দিন এমন জাঁকজমকপূর্ণভাবে বের হন যে, এত জাঁকজমক অন্য কোন বাদশাদের মধ্যে দেখা যায় না। তার সামনে পেছনে থাকে নানা ধরনের উন্নত সাজে সজ্জিত ঘোড়ার বহর। থাকে নানা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও আমত্যবর্গ। থাকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অনেক সৈন্যসামন্ত। খলিফার এক হাতে থাকে বর্শা। অন্য হাতে লাঠি। গায়ে অসাধারণ কালো জুব্বা। কাঁধে ডোরাকাটা চাদর। এটা প্রত্যেক খলীফা তার পূর্বের খলীফা থেকে পেয়ে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, এই বর্শা, লাঠি ও ডোরা কাটা চাদর বনু আব্বাস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন। খলীফা এসবে সজ্জিত হয়ে অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সহিত বের হন। এইদিনে খলীফার বাহনে কেউ আরোহন করতে পারতো না। কোন ব্যক্তি যদি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে খলীফার অত্যন্ত আস্থা অর্জনে সমর্থ হতো, তবে কখনো কখনো খলিফা তাকে পাশের আসনে বসিয়ে সম্মানিত করতেন।

ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী রাহমতুল্লাহি আলাইহি তারিখুল ইসলাম গ্ৰন্থে বলেন, ফাতেমী সালতানাতের কাজী আবদুল আজিজ ইবনে মুহাম্মাদ খলিফার অত্যন্ত আস্থা অর্জনে সমর্থ হন। তখন খলিফা তাকে ঈদের দিন নিজের পাশে বসিয়ে সম্মানিত করেন।

সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম ঈদের দিন অস্ত্র বহন করতেন না। বরং একে ঈদ-সৌন্দর্যের প্রতিবন্ধক জ্ঞান করতেন। ইমাম বুখারী রাহমতুল্লাহি আলাইহি তার সহীহ গ্ৰন্থে এ সম্পর্কিত একটি অধ্যায়‌ উল্লেখ করেন।

তবে পরবর্তীতে নানা কারণে সুলতান ও খলিফাগণ ঈদের দিন‌ই সামরিক কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেন। এক সময় তা ঈদসৌন্দর্যের‌ই অংশে পরিণত হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনুল আছির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উমাইয়া শাসক ইয়াযিদ ইবনুল ওয়ালিদ সর্বপ্রথম এর প্রচলন শুরু করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য খলিফাগণ‌ও তা আমলে নেন।

প্রখ্যাত ইমাম ইবরাহিম ইবনে মুহাম্মাদ আল বায়হাকি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আল মাহাসিন ওয়াল মুসাবী গ্ৰন্থে বলেন, একবার ঈদের সময় খলীফা মুতাসিম বিল্লাহ বিশাল এক সৈন্য সমাবেশ করেন। ইতোপূর্বে এত সৈন্য সমাবেশ আর কোন খলিফাকে করতে দেখা যায়নি। তিনি প্রথমে খেলাফত ভবন থেকে ঈদগাহের দূরত্ব পরিমাপ করেন। পরে সৈন্যদের বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করেন। প্রত্যেক ইউনিটের জন্য নির্ধারণ করেন আলাদা জায়গা। প্রদান করেন স্বতন্ত্র ইউনিফর্ম। ইউনিট প্রধানকে দেন বিশেষ পতাকা। দিকনির্দেশ করেন প্রদর্শনীর ধারাবাহিকতা। ঈদের একদিন আগেই সকল ইউনিট নিজ নিজ পজিশনে পৌঁছে যায়। বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয় খলিফা মুতাসিম। বেশ আড়ম্বরে আদায় করেন ঈদের নামাজ। নামাজের পর উচ্চ মিম্বরে উপবেসন করেন। শুরু হয় প্রদর্শনী। সুশৃঙ্খলভাবে আসতে থাকে বিভিন্ন বাহিনী। প্রথমেই অশ্বারোহী দল। অশ্ববহরের হ্রেসাধ্বনিতে দর্শকদের মন দারুণভাবে হিল্লোলিত হয়। চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে সবার। আসতে থাকে অন্যান্য বাহিনী। ইউনিফর্মের নতুনত্ব যেন দর্শকদের বাড়তি আনন্দ যোগায়। অশ্ববহর শেষ হলে পায়ে হেঁটে এগুতে থাকে পদাতিক বাহিনী। দৃপ্ত পদক্ষেপের সৈনিকী ভাব বেশ দেখায়। মানুষ মুগ্ধ নয়নে কেবল তাকিয়ে থাকে। পদাতিক বাহিনী শেষ হয়। আসতে শুরু করে তিরন্দায বাহিনী। তাদের‌ও বেশ মুগ্ধকর দেখায়। জনসাধারণকে মুগ্ধতার ঘোরে রেখে তাদের বহর‌ও শেষ হয়। শেষ হয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠান। মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে সবাই ফিরে যায় নিজ নিজ গৃহে।

ঈদের রকমারি খাবার

ঈদের সময় গৃহে গৃহে প্রস্তুত করা হতো হরেক রকমের খাবার। ঈদ আনন্দের বিরাট অংশ জুড়ে থাকতো এই শাহি খাবারের প্রভাব। খাদ্য বিষয়ে ছিলো তাদের দারুণ অভিজ্ঞতা। নিখুঁতভাবে জানা ছিলো উপকারী-অপকারী দিক।

প্রখ্যাত ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রাহমতুল্লাহি আলাইহি তারিখুল খুলাফা গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, খলিফা মামুনুর রশিদের এক বন্ধু বলেন, ঈদের দিন আমি খলিফা মামুনুর রশিদের সাথে ভোজসভায় অংশগ্রহণ করি। সেখানে তিন শতাধিক খাবার পরিবেশন করা হয়। যখন‌ই নতুন খাবার পরিবেশন করা হয়, খলিফা মামুনুর রশিদ পাশে উপবিষ্ট এক লোকের দিকে তাকান। তখন সে খাবারের উপকারী-অপকারী দিক তুলে ধরে। বলে, ঠান্ডা থাকলে যেন এই খাবার স্পর্শ না করে। সর্দি থাকলে যেন গ্ৰহণ করে। কফের সমস্যায়ও নিরাময় মিলবে। বমন সমস্যায় না খাওয়াই ভালো। এভাবেই লোকটি প্রতিটি খাবারের উপকার, অপকার ও উপযোগিতা তুলে ধরে। আর অতিথিরা সুবিধাজনক খাবার গ্ৰহণ করে। পুরোটা সময় জুড়ে আমি তার অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হ‌ই। অবাক হ‌ই তার বিস্তর জানাশোনায়।

ফাতেমি খলিফাদের আয়োজনে মিষ্টান্ন দ্রব্য‌ই বেশি থাকতো। তারা তরল ও মিষ্টি জাতীয় খাবার অধিক পছন্দ করতো। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম মাকরিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতেমী খলিফা আমিরের ভোজসভার বিবরণে বলেন, খলিফার জন্য ঈদপূর্ব রাতেই নানা ধরনের খাবার প্রস্তুত করে রাখা হতো। যখন ভোরের আলো ফুটতো, দস্তরখানা বিছানো হতো। খেলাফত ভবনের রীতি অনুযায়ী বড় বড় সোনালী পেয়ালায় খাবার পরিবেশন করা হতো। তাতে থাকতো হরেক রকমের খেজুর, বিখ্যাত জুয়ারেশী ও অন্যান্য মিষ্টান্ন দ্রব্য। তা সোনালী বর্ণের রুমালে ঢেকে রাখা হতো।

খেলাফত ভবনের ঈদ আয়োজনে সাধারণ মানুষজন‌ও অংশ নিতো। সবার জন্য দ্বার অবারিত থাকতো। ইচ্ছে মত আহার করতো। বাড়ি নিয়ে যেতেও বাধা থাকতো না। প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনে তাগরী বারদি রাহমতল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘ঈদের দিন ফাতেমী খলিফা আজিজ বিশাল ভোজসভার আয়োজন করেন। অতিথি ভবনের মাঝখানে বিছানো হয় এক বিশাল দস্তরখানা। দুই প্রান্তের মাঝে প্রায় আটশ গজের দূরত্ব। চ‌ওড়া প্রায় ছয় গজ। পরিবেশন করা হয় চিনি বাদাম ও গমের আটায় তৈরি ঐতিহ্যবাহী রুটি, গোস্তের তৈরি বিশেষ ধরনের পিজ্জা, গোস্ত‌ ডিমের মিশ্রণে তৈরি বিশেষ চাপাতি রুটি ও হরেক ধরনের সুস্বাদু খাবার। খাবারের প্রতুলতায় দূর থেকে ছোটখাটো পাহাড় বলে‌ই ভ্রম হয়। দস্তরখানা ছিলো সবার জন্য উন্মুক্ত। মানুষ দলে দলে আসে। তৃপ্তি ভরে খায়। বাড়িতেও নিয়ে যায়। কিছুতেই বাধা নেই।’ অতপর ইমাম ইবনে তাগরী বারদি রাহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, খেলাফতের পক্ষ থেকে এই আয়োজনের সূচনা খলিফা আজিজ‌ই প্রথম করেন।

ইমাম ইবনে তাগরি বারদি রাহমতুল্লাহি আলাইহি সরকারী আমত্যবর্গের জন্য আয়োজিত ভোজসভার বিবরণে বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন আমলাদের জন্য দুইবার ভোজসভার আয়োজন করা হতো। আর ঈদুল আজহার দিন আয়োজন করা হতো একবার। মন্ত্রীভবনে রাতেই বিছিয়ে রাখা হতো অনেক দস্তরখানা। দস্তরগুলো দৈর্ঘ্যে ১৩০ গজ। প্রস্থে সাত গজ। এর উপর পরিবেশন করা হতো নানা ধরনের খাবার। প্রতিটি দস্তরে রাখা হতো একুশটি বড় বড় প্লেট। প্লেটে থাকতো একুশটি দুম্বা, সাড়ে তিনশ মুরগি ও সাড়ে তিনশ কবুতরের বাচ্চা ভুনা। খানা শেষে থাকতো বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত নানা পদের মিষ্টান্ন। প্লেটগুলোর পাশে পাশে সাজিয়ে রাখা হতো পাঁচশ চীনা মাটির বাসন। ফজরের পরপর‌ই চলে আসতেন মন্ত্রী পরিষদ ও অন্যান্য আমত্যবর্গ। তৃপ্তিভরে খেতেন। অতপর দ্রুত ফিরে যেতেন নিজ নিজ গৃহে। তখন অবশিষ্ট খাবার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকতো সাধারণ মানুষদের। সবাই ইচ্ছে মত নিয়ে যেতো। কেউ জমা করে পরবর্তীতে বিক্রয়‌ও করতো।
নামাজের পূর্ব পর্যন্ত চলতো এই আয়োজন। ঈদের নামাজের পর আবার বিছানো হতো নতুন দস্তরখানা। তাতেও পরিবেশন করা হতো আগের মত খাদ্যদ্রব্য। মানুষজন তখনো সংগ্রহ করতো মনোহরি খাবার।

খলিফার থেকে আমলারাও পিছিয়ে থাকতেন না। গৃহে ফিরে আয়োজন করতেন বিশাল ভোজসভার। নানা পদের খাবারে জমজমাট করে তুলতেন নিজ নিজ দস্তরখান। খেলাফত ভবনের মতো না হলেও প্রভেদ তেমন নয়। ফলে মহাসমারোহে কাটতো ঈদের সকাল বিকাল। পুরোটা দিনজুড়ে আলাদা খুশির আমেজ বিরাজ করতো।

আমির সুলতান ও রাজন্যবর্গ থেকে পিছিয়ে থাকতেন না অভিজাত শ্রেণীর লোকজন‌ও। ঈদের দিন তারাও নানান খাবারের আয়োজন করতেন। স্বার্থের পরিসরে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। এই প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরামের কিছু ঘটনা বলা যায়। প্রখ্যাত ইমাম বরণ্যে ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসাকির রাহমতুল্লাহি আলাইহি তারিখে দিমাস্ক গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আওন আল মুযানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যতবার‌ই আমরা ঈদের দিন প্রসিদ্ধ তাবেয়ি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সীরিনের বাড়ি গিয়েছি, তিনি আমাদের ফালুদা ও খাবিসা (খেজুর ও ঘিয়ের মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্ন) খেতে দিয়েছেন।

ইমাম ইবনে বাশকুয়াল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আস সিলাহ গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম হিশাম ইবনে সুলায়মান আল কাইসী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ঈদের দিন দুর্গবাসীর জন্য বিশাল ভোজসভার আয়োজন করতেন। তিনি দুর্গরক্ষীদের‌ও তাতে আমন্ত্রণ জানাতেন। দুর্গরক্ষীদের পেছনে ব্যয় করতেন অনেক অর্থকড়ি। নানা সময় তিনি নিজেও বিভিন্ন সীমান্তে পাহারাদারীর কাজে নিয়োজিত থাকতেন।

এভাবে নানা শ্রেণীর আয়োজনে মহাসমারোহে কাটতো দরিদ্রজনের ঈদের সকাল-বিকাল। পুরোটা দিনজুড়ে আলাদা খুশির আমেজ বিরাজ করতো।

ঈদের অপ্রকাশ্য দান

ঈদের দিন ধনবানরা পড়শিদের খোঁজখবর রাখতো। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য দানে সহযোগিতা করতো। প্রখ্যাত ইমাম ইবনে শাহিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নাইলুল আমাল গ্ৰন্থে এ প্রসঙ্গে একটি দারুণ ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একটি পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিলো না। কিন্তু সদস্য ছিলো অনেক। কর্তাব্যক্তির আত্মসম্মান ছিলো ঢের। তাই পড়শিদের কাছে তার অসচ্ছলতা ছিলো অজানা। ঈদের দিন মহল্লায় অনেক গরু জবেহ হয়। ঘরে ঘরে তাই গোস্ত ভুনার আয়োজন। সন্তানাদির মনে ভুনা গোস্তের আগ্ৰহ জাগে। কর্তাকে জানালে তিনি অপারগতা পেশ করেন। নানাভাবে তাদের নিবৃত রাখার চেষ্টা করেন। সন্তানরা নিরত হয় না। কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। আ‌ওয়াজ যায় পড়শিদের কানে। রাতের বেলা তারা শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর উঠোনে শুনা যায় কারো পদধ্বনি। ক্ষণিক বাদে আবার। কিছুক্ষণ পর আবার। এভাবে রাতভর পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। কর্তার ঘুম হয় না। উঠে দেখতেও ইচ্ছে করে না। ঘুম হয় না গৃহকর্ত্রীর‌ও। কিসের এত আনাগোনা। ভোর ভোর উভয়ে উঠে। দরজা খুলে তো অবাক। কে বা কাদের গোপন দানে দ্বোরগোড়া গোস্তে পরিপূর্ণ। তারা অনেক আনন্দিত হয়। তবে সব গোস্ত গ্ৰহণ করে না। প্রয়োজনের অতিরিক্তটুকু দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে দেয়।

খুশীর সংবাদ প্রকাশের দিন

মানুষ নানা সুখকর সংবাদ প্রকাশের জন্য ঈদের দিনেরই অপেক্ষায় থাকতো। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম মাকরিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইত্তেআযুল হুনাফা গ্ৰন্থে বলেন, তখন সময়টা ছিলো রবিউল আউয়াল মাস। ফাতেমী খলিফা মুঈজ পরপারে পাড়ি জমান। ঈদের বাকি এখনো সাত মাস। খেলাফতের রীতি হলো, বর্তমান খলিফার তিরোধানের পরপরই পরবর্তী খলিফার নাম ঘোষণা করা। খলিফা পরিবারের ইচ্ছা, নতুন খলিফার নাম ঈদের দিন ঘোষণা করা হোক। এর তো উপায় নেই। ঈদ এখনো অনেক দূর। ফলে খলিফার মৃত্যু সংবাদ তারা গোপন করে। বুকে পাথর চাপা দিয়ে বেদনাদের হজম করে। সময় তরতর বয়ে যায়। ঈদুল আজহা হাজির হয়। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে খলিফার মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী খলিফা হিসেবে খলিফা পুত্র আজিজের নাম ঘোষণা করা হয়।

ঈদের খেলাধুলা

ঈদের দিন নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন হতো। নববী যুগেও এর প্রমাণ মিলে। তবে যুগে যুগে তার গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সময় জনপ্রিয়তা লাভ করে নানা ধরনের খেলা। কাবাক খেলা তার অন্যতম। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে ওয়াসিল আল হামাবী রাহমতুল্লাহি আলাইহি মুফাররিজুল কুরুব গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, সুলতান নুরুদ্দীন জাঙ্গী রাহমতুল্লাহি আলাইহি এই খেলার প্রতি খুবই আসক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম মাকরিযী রাহমতুল্লাহি আলাইহি আল খুতাত ওয়াল আছার গ্ৰন্থে কাবাক খেলার চিত্র অঙ্কন করে বলেন, উন্মুক্ত প্রান্তরে উঁচু এক কাষ্ঠখণ্ড স্থাপন করা হতো। তার উপর থাকতো ছোট এক টুকরো কাঠ । মাঝবরাবর থাকতো সংকীর্ণ ছিদ্র। তিরন্দাজরা তীর ধনুক নিয়ে উপস্থিত হতো। সেই ছিদ্র লক্ষ্য করে তীর চালনা করতো। লক্ষ্য ছুঁয়ে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিতো।

ছোটরাও নানা ধরনের খেলা খেলতো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো বাদাম খেলা। ইমাম ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এক ঈদের দিন প্রসিদ্ধ দরবেশ সিররী সাকতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখেন মারুফ কারখি রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি ধুলোমলিন ছেলের সাথে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তার? মারুফ কারখি বললেন, ছেলেরা বাদাম খেলা খেলছে। আর এই ছেলেটি ভগ্ন হৃদয়ে তাদের খেলা দেখছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন খেলো না? ছেলেটা বললো, আমার বাবা নেই। বাদাম কেনার টাকা পাবো কোথায়? তখন সিররি সাকতি রহমতুল্লাহি আলাইহি ছেলেটিকে বাদাম কিনে দিলেন।

আরো নানা আয়োজনে ভালোলাগার আবেশ মাখিয়ে ঈদ বিদায় নিতো। রেখে যেতো নতুন আগমনীর তৃষ্ণা।

আগের সংবাদপাপ
পরবর্তি সংবাদকবি আবু নুওয়াস: রক্তে যার খেলা করতো কবিতা