মূল : বারা নিযার রাইয়ান (গাযা, ফিলিস্তিন)
রূপান্তর : মাহমুদ সিদ্দিকী:
“আমার দরবারে চারজন চরিত্রবান লোক প্রয়োজন। তারাই হলো রাষ্ট্রের মূল খুঁটি। তাদের ছাড়া কোনো রাষ্ট্র যথাযথভাবে গঠিত হতে পারে না। একজন হলো বিচারক। প্রচলিত পরিভাষায় যাকে বিচার বিভাগীয় প্রধান বলা যেতে পারে। যিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিচারের ক্ষেত্রে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবেন না। দ্বিতীয় জন হলো পুলিশ প্রধান। বর্তমানে একে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত বলা যেতে পারে। যিনি শক্তিশালীর হাত থেকে দুর্বলকে রক্ষা করবেন। তৃতীয় জন হলো খারাজ কর্মকর্তা। আধুনিক সময়ে তাকে বলা যেতে পারে অর্থমন্ত্রী। যিনি মানুষের খারাজ সংগ্রহ করবেন। তবে জনগণের প্রতি জুলুম করবেন না। চতুর্থ জন হলো গোয়েন্দা বিভাগীয় প্রধান। যিনি এদের সবার তথ্য যথাযথভাবে লিখে রাখবেন।”
তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ইমাম তাবারি রহ. (৩১০ হি./৯২২ খ্রি.) এই বক্তব্যটিকে আব্বাসি খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আবু জাফর মানসুরের দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁর ইতিহাসগ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। খলিফা মানসুরের এই বক্তব্য প্রমাণ করে—ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রচিন্তা কতটা সুগঠিত ছিল।
গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিষ্ঠার সূচনা
নববি যুগ
গোয়েন্দা তৎপরতা হলো জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র করতে হলে গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে এর খুঁত খুঁজে বের করতে হবে। শত্রুর শক্তিমত্তা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে তো গোয়েন্দা তৎপরতার কোনো বিকল্পই নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপ ছিল না। তবে শত্রুদের সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরি করা এবং তথ্য সংগ্রহ বিভিন্নভাবে প্রচলিত ছিল। শুধু যে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল—বিষয়টি তা নয়। বরং কাফেরদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত ছিল।
নবীজির মক্কি জীবনে আমরা দেখতে পাই হাকাম বিন আবুল আস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করত। নবীজির সকল খবরাখবর কাফেরদেরকে সরবরাহ করত। যেমনটা সিবত ইবনুল জাওযি (৬৫৪ হি./১২৫৬ খ্রি.) তার ‘মিরআতুয যামান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
মুসলমানরা যখন মদীনায় হিজরত করে তখন কুরাইশদের সাথে মিলে ইহুদিদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়—মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে তথ্য সরবরাহ করা। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই বালাজুরির (২৭৯ হি./৮৯২ খ্রি.) ‘আনসাবুল আশরাফ’ গ্রন্থে। মালিক ইবনে আবি কাউকাল নামক এক ব্যক্তি ইসলামের পোশাক ধারণ করে মুসলমানদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংবাদ ইহুদিদের কাছে সরবরাহ করত।
এই ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে মুসলমানদের কঠিন মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এই প্রসঙ্গে ইমাম বাইহাকি (৪৫৮ হি./১০৬৬ খ্রি.) ‘দালাইলুন নুবুওয়াহ’ গ্রন্থে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সপ্তম হিজরিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমরাতুল কাজা থেকে ফিরে আসেন তখন মদিনার নিকটবর্তী বনু সুলাইম গোত্রে একটি অভিযান পাঠান। সেই বাহিনীতে বনু সুলাইমের গুপ্তচর ছিল। বাহিনী মদিনা ত্যাগ করলে গুপ্তচর লুকিয়ে বনু সুলাইমের কাছে চলে যায় এবং তাদেরকে তথ্য দিয়ে সতর্ক করে দেয়। বনু সুলাইম যুদ্ধের জন্য বিপুল প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা তাদেরকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে দেখলে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা কথার জবাব দেয় বর্শা দিয়ে।
শত্রুবাহিনীর গুপ্তচরদের রুখে দেওয়ার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের প্রচুর ঘটনা রয়েছে। একটি ঘটনা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে। একবার এক মুশরিক গুপ্তচর নবী সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের কাছে আসে। তারপর যখন সে চুপিচুপি বেরিয়ে যায় তখন নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দেন—লোকটিকে আমার কাছে ধরে আনো এবং তাকে হত্যা করো। সাহাবিরা প্রতিযোগিতা করে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসেন এবং সালামা ইবনে আকওয়া তাকে হত্যা করেন।
অপরদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজেরও গোয়েন্দা বাহিনী ছিল। তারা শত্রুর কাতারে ঢুকে পড়ে তাদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। এ প্রসঙ্গে সহিহ বুখারির একটি হাদিস উদ্ধৃত করা যেতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার উমরা আদায়ের জন্য ইহরাম বাঁধেন। রাস্তার তথ্য সরবরাহের জন্য প্রেরণ করেন খুজাআ গোত্রের একজন গোয়েন্দাকে। নবীজি রওনা করলে পথিমধ্যে খুজাঈ গোয়েন্দা কুরাইশদের আয়োজন সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য নিয়ে ফিরে আসে। গোয়েন্দা লোকটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানায়—কুরাইশরা আপনার বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী জমা করেছে। তারা আপনার সাথে যুদ্ধ করবে এবং বাইতুল্লায় পৌঁছতে বাধা দিবে।
ইবনে আব্দুল বার (৪৬৩ হি./১০৭০ খ্রি.) রহ. তার ‘আল-ইস্তিয়াব’ গ্রন্থে লিখেছেন—আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (৩২ হি./৬৫২ খ্রি.) রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন বদর যুদ্ধের পূর্বে। তিনি মদীনায় অবস্থান করে মুশরিকদের তথ্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে লিখে জানাতেন। আব্বাস রাযিয়াল্লহু আনহু চাচ্ছিলেন—তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসবেন। কিন্তু ফিরতি পত্রে নবীজি তাকে লেখেন—আপনার মক্কায় অবস্থান করাই ভালো হবে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ
সিবত ইবনুল জাওযি ‘মিরআতুয যামান’ গ্রন্থে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর (১৩ হি./৬২৪ খ্রি.) একটি অসিয়তনামা উল্লেখ করেছেন। যা থেকে বোঝা যায়—খলিফা আবু বকরের নিকট জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেনাপতি ইয়াযিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (১৮ হি./৬২৯ খ্রি.) রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে করা অসিয়তে বলেন—”তোমার কাছে শত্রুপক্ষের দূত এলে তার থাকা-খাওয়ার উত্তম ব্যবস্থা করবে। কারণ, তার প্রতি ভালো আচরণ করার এটাই তোমার প্রথম সুযোগ। তবে শত্রুপক্ষের দূতকে তোমার নিকট বেশিক্ষণ থাকতে দিবে না। যাতে মুসলমানদের সংরক্ষিত তথ্য তারা জেনে ফেলতে না পারে। তোমার গোপনীয়তা তুমি সংরক্ষণ করবে। তোমার উদ্দেশ্য যেন কথার ফাঁকে বেরিয়ে না পড়ে। সেনাবাহিনীর তথ্যও গোপন রাখবে। সৈন্যদের মধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রাখবে।”
একইভাবে উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু (২৩ হি./৬৪৫ খ্রি.) মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমার (৬০ হি./৬৮০ খ্রি.) নিকট এই বিষয়ে পত্র পাঠান। শামের উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন। ইবনে আবি শাব্বার (২৬২ হি./৮৭৬ খ্রি.) ‘তারিখুল মাদিনা’র তথ্য অনুযায়ী—মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু রাত হলে নিজে জনগণের প্রহরায় নেমে যেতেন। এটা সর্বসিদ্ধ ও প্রসিদ্ধ ছিল।
ওয়াকিদি (২০৭ হি./৮২২ খ্রি.) তার ‘ফুতুহুশ শাম’ গ্রন্থে মুসলমান ও রোমকদের মধ্যে বহু গোয়েন্দা তৎপরতার বিবরণ দিয়েছেন। অথচ জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। ইবনে হাজার আসকালানি (৮৫২ হি./১৪৪৮ খ্রি.) রহ.-এর তথ্য অনুযায়ী—এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরি হয় উমাইয়া খেলাফতের আমলে। ফাতহুল বারিতে তিনি লেখেন—”নববি যুগের কোনো কর্মকর্তার আমলে পুলিশপ্রধান নামে কোনো পদের অস্তিত্ব ছিল না। এই পদ তৈরি হয় বনু উমাইয়ার শাসনামলে।”
উমাইয়া শাসনামল
জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-পদক্ষেপটির ওপর নির্ভর করেন, সেটি হলো ডাক ও পত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর পরিচালককে বলা হতো ‘সাহিবুল বারিদ’। আধুনিক যুগে যাকে বলা যেতে পারে—গোয়েন্দাবিভাগীয় প্রধান। এই ব্যবস্থাকে ইসলামি সভ্যতায় প্রাতিষ্ঠানিক গোয়েন্দা ব্যবস্থার প্রথম বীজ বলা যেতে পারে। উমাইয়াদের এই ডাক বিভাগীয় তৎপরতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক আসকারি (৩৯৫ হি./১০০৪ খ্রি.) তার ‘আল-আওয়াইল’ গ্রন্থে লেখেন—”ইসলামে সর্বপ্রথম ডাকব্যবস্থার সূচনা করেন মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু। এই ব্যবস্থাকে আরও সুগঠিত করেন আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান (৮৬ হি./৭১৬ খ্রি.)।”
আরও জানা যায়—কোনো-কোনো উমাইয়া খলিফার ব্যক্তিগত গোয়েন্দা বিভাগ ছিল। যেমনটা হাফেজ ইবনে হাজার তার ‘তাহযিবুত তাহযিব’ গ্রন্থে লিখেছেন—বিশিষ্ট মুহাদ্দিস খালিদ ইবনে আবিস সালত উত্তর ইরাকের ওয়াসিতে উমর ইবনে আব্দুল আজিজের (১০১ হি./৭২০ খ্রি.) গোয়েন্দা ছিলেন।
এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সেটি হলো—বর্তমানের ডাকব্যবস্থা উন্মুক্ত। সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ—সকলেই তা ব্যবহার করতে পারে। উমাইয়াদের প্রতিষ্ঠিত ডাকব্যবস্থা বর্তমানের ডাকব্যবস্থার মতো উন্মুক্ত ছিল না। বরং তখন ডাক মাধ্যমে শুধু সরকারি তথ্য ও কাগজপত্র আদান-প্রদান হতো। তাই ইসলামি শাসনের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ডাকবিভাগের প্রধানকে গোয়েন্দাপ্রধান বললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাজুদ্দিন সুবকিও (৭৭১ হি./১৩৬৯ খ্রি.) এই কথা স্বীকার করে ‘তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ’তে লিখেছেন—”ডাকবিভাগের প্রধান খলিফাকে শহরের সকল খবরাখবর সম্পর্কে অবহিত করতেন।” সম্ভবত এখান থেকেই আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থাকে গোয়েন্দা বিভাগ নাম দেওয়া হয়েছে।
উমাইয়াদের ডাকব্যবস্থায় নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর অফিস ছিল। এগুলোকে বলা হতো—’সিকাকুল বারিদ’ বা পোস্ট অফিস। খলিল ফারাহিদি (১৭০ হি./৭৮৬ খ্রি.) তার ‘আল-আইন’ গ্রন্থে লেখেন—”বারো মাইল পরপর পোস্ট অফিস ছিল। প্রতি পোস্ট অফিসে এসে সংবাদবাহক তার বাহন পরিবর্তন করত। অথবা সংবাদবাহী ব্যাগ অন্য দায়িত্বশীলের কাছে অর্পণ করত।” মুহাম্মাদ তাহের পাটনী (৯৮৬ হি./১৫৭৮ খ্রি.) তার ‘মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার’ গ্রন্থে লেখেন—”বিভিন্ন দেশ থেকে সংবাদ বহনের জন্য ডাক বিভাগের ঘোড়া রাস্তায় বাঁধা থাকত। প্রতিটি নির্দিষ্ট জায়গায় একটা করে ঘোড়া প্রস্তুত করে রাখা থাকত।”
ডাকবিভাগীয় প্রধানদের জন্য মূল শহরগুলোর কেন্দ্রস্থলে স্থায়ী আবাস ও কার্যালয় ছিল। সেখান থেকে তথ্যসংগ্রাহক ও গোয়েন্দাদের তৎপরতা পরিচালিত হতো। শহুরে কার্যালয় থেকে তথ্য জমা করে তারা পাঠাতেন রাজধানীতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধানের কাছে। মক্কার চারপাশ ঘিরে থাকা গোয়েন্দা কার্যালয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ আমাদেরকে জানাচ্ছেন ফাকিহি (২৭২ হি./৮৮৫ খ্রি.) তার ‘আখবারু মাক্কাহ’ গ্রন্থে। ফাকিহি লেখেন—”শামের দিক থেকে মসজিদুল হারামে আসতে গেলে হারামের বাইরে যে-বাড়িটি আপনাকে স্বাগত জানাবে, সেটি হলো—’দারু সাহিবিল বারিদ’; গোয়েন্দা প্রধানের কার্যালয়। এখানে মক্কার সকল তথ্যসংগ্রহকারী গোয়েন্দা সদস্যরা থাকেন।”
তবে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন—এই পদ্ধতিতে ডাক ব্যবহার মুসলমানদের পরপর পারস্য সাম্রাজ্য সবার আগে শুরু করেছে। ইবনুল জাওযি তার ‘আল-মুন্তাযাম’ গ্রন্থে এই বিষয়ে বেশকিছু উদাহরণ দিয়েছেন।
আব্বাসি যুগ
আব্বাসিরা ক্ষমতায় এসেছিল উমাইয়াদেরকে সশস্ত্র বিপ্লবে পরাজিত করে। উমাইয়াদের গোয়েন্দা তৎপরতার কাছে একাধিকবার তাদের বিপ্লবের চেষ্টা ধরাও পড়ে যায়। তাই আব্বাসিদের কাছে গোয়েন্দা তৎপরতার গুরুত্ব বেড়ে যায়। শুরু থেকেই তারা গোয়েন্দা ব্যবস্থার প্রতি জোর দেয়। ইতিপূর্বে এই বিষয়ে আমরা আব্বাসি খেলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আবু জাফর মানসুরের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।
চিন থেকে মাগরিব পর্যন্ত বিস্তৃত এই ইসলামি সাম্রাজ্যে পরিপূর্ণভাবে যেন গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়—এই লক্ষ্যে আব্বাসিরা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গোয়েন্দা বিভাগকে আরও গতিশীল ও সামর্থ্যবান করতে প্রচুর পরিমাণে শাখা অফিস নির্মাণ করে। খুওয়ারিজমির (৩৮৩ হি./৯৯৩ খ্রি.) বলে পরিচিত ‘মুফিদুল উলুম ওয়া মুবিদুল হুমুম’ গ্রন্থে এসেছে—”খলিফা মামুন (২১৮ হি./৮৩৩ খ্রি.) গোয়েন্দা বিভাগের নামে আনুষাঙ্গিক খরচ সহ চার হাজার উট বরাদ্দ দেন। যাতে করে রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে যথাযথভাবে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা করা যায়। খলিফা মামুনের সময় গোয়েন্দা ব্যবস্থা এত তৎপর ছিল যে, প্রতিদিন সারা বিশ্বের খবর মামুন ঘরে বসে পেতেন।”
এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। “কারণ, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা গোয়েন্দাদের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা যতটা উপকৃত হতেন, সেই তুলনায় এই অর্থকে খুব নগন্য মনে করতেন।” বলেছেন ইবনে মাসকুইয়াহ তার ‘তাজারিবুল উমাম’ গ্রন্থে।
জনস্বার্থের জন্য সুগঠিত গোয়েন্দা ব্যবস্থা কতটা জরুরি, গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যদের মধ্যে কোন-কোন গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক—এইসব নিয়ে মুসলিম বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেছেন। এই বিষয়ে কলকশান্দি (৮২১ হি./১৪১৮ খ্রি.) তার ‘সুবহুল আশা’ গ্রন্থে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। ইমাম মাওয়ারদি (৪৫০ হি./১০৫৮ খ্রি.) তার ‘তাজিলুন নাযার’ গ্রন্থে এই বিষয়ে সংক্ষেপে বেশকিছু জরুরি কথা বলেছেন। তিনি লেখেন—”একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ছোট-বড় সব ধরনের সংবাদ জানা জরুরি। প্রজা ও কর্মচারীদের তাৎক্ষণিক তথ্য হালনাগাদ থাকতে হবে। বিভিন্ন পদে তার প্রতিনিধি ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গতিবিধি সম্পর্কে সার্বক্ষণিক তথ্য জানা থাকতে হবে। প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের মাঝে গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিতে হবে। এই কাজের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানকে এমন ব্যক্তি বেছে নিতে হবে, যিনি আমানদতার এবং আস্থাবান। উপস্থিতি-অনুপস্থিতি—সর্বাবস্থায় যে রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করে। ঘুষ কিংবা প্রবৃত্তির চাহিদায় যে টলে যায় না। যাতে সর্বাবস্থায় সংবাদ সংগ্রহ এবং রহস্য উন্মোচনের জন্য তৎপর থাকতে পারে।”
এজন্য শাসকরা কেন্দ্রীয় বা জোন ভিত্তিক গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে নির্বাচন করতেন এমন লোকজনকে, যারা বিশ্বস্ত ও শিক্ষিত; এবং এই পদের গুরুতরতার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন। এজন্য খুওয়ারেজমি লেখেন—”শাসকদের খাস লোকদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে থাকেন বিভিন্ন জোনের গোয়েন্দা প্রধানরা। কারণ—একজন গোয়েন্দা প্রধান শাসকের শ্রবণযন্ত্রের মতো। শাসককে রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ অবস্থা তিনিই অবহিত করেন।” রাষ্ট্র টিকে থাকার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তা বোঝাতে খুওয়ারেজমি আরও যোগ করেন—”যুদ্ধের নিয়ম হলো, প্রচুর পরিমাণে গোয়েন্দা, গুপ্তচর এবং তথ্যসংগ্রাহক প্রেরণ করা। কারণ—গোয়েন্দারা খুব কৌশলী ও চতুর হয়ে থাকেন।”
এজন্য আমরা বিভিন্ন সময় দেখতে পাই—বিখ্যাত আলিম ও সাহিত্যিকগণ এই পদ অলঙ্কৃত করেছেন।
গোয়েন্দা ব্যবস্থায় আলিমগণ
১. হাফেজ ইবনে হাজার তার ‘তাহযিবুত তাহযিব’ গ্রন্থে লিখেছেন—বিশিষ্ট মুহাদ্দিস খালিদ ইবনে আবিস সালত উত্তর ইরাকের ওয়াসিতে উমর ইবনে আব্দুল আজিজের গোয়েন্দা ছিলেন।
২. আরবি সাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাকামাতে হারিরি’র লেখক হারিরি (৫১৬ হি./১১২২ খ্রি.) ছিলেন আব্বাসি খেলাফতের গোয়েন্দা প্রধান। ইমাদুদ্দিন আসবাহানি (৫৯৭ হি./১২০০ খ্রি.) তার ‘খারিদাতুল কাসর’ গ্রন্থে লেখেন—”হারিরি বসরায় আব্বাসি খেলাফতের গোয়েন্দাপ্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে তার সন্তানেরা ৫৬৬ হিজরির মুকতাফি বিল্লাহর শাসনামল পর্যন্ত এই পদে ছিল।”
৩. ইমাম যাহাবি (৭৪৮ হি.) ‘তারিখুল ইসলাম’ গ্রন্থে লেখেন—”আবু নসর আল-কুন্দারি (৪৫৬ হি./১০৬৪ খ্রি.) সেলজুক সুলতান তুগ্রিল বেকের (৪৫৫ হি./১০৬৩ খ্রি.) সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান তাকে নিজের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান বানিয়ে দেন। পরবর্তীতে তাকে মন্ত্রী পদে উন্নীত করেন। আবু নসরের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর।
সেলজুকদের শাসনামল
সেলজুকরা ছিল আব্বাসি খেলাফতের অধীনস্ত আলাদা একটি শাসনব্যবস্থা। তারা আব্বাসি খলিফাকে কেন্দ্রীয় খলিফা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যদিও আব্বাসিদের তখনকার খেলাফত ছিল নামমাত্র। তুগ্রিল বেক পর্যন্ত গোয়েন্দা ব্যবস্থা থাকলেও পরবর্তীতে সুলতান আলপ আরসালানের যুগে তা বাতিল করা হয়। সুলতান আলপ আরসালান তার মন্ত্রী নিযামুল মুলককে বলেন—”আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের প্রয়োজন নেই। কারণ, পৃথিবীর সব দেশেই আমাদের বন্ধু এবং শত্রু আছে। দেখা যাবে—গোয়েন্দা কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে সংবাদ নিয়ে আসবে। তখন বন্ধুকে বানিয়ে দিবে শত্রু এবং শত্রুকে বানিয়ে দিবে বন্ধু।” এই সন্দেহপ্রসূত ধারণার ওপর নির্ভর করে সুলতান গোয়েন্দা ব্যবস্থা বাতিল করে দেন। যার ফলে দেখা যায়—হাশাশিনরা আত্মপ্রকাশ করে শক্তিশালী হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সুলতান টেরই পাননি।
ইমাদুদ্দিন আসবাহানি তার ‘তারিখু দাওলাতি আলি সালজুক’ গ্রন্থে লেখেন—হাশাশিনরা ৪৮৫ হিজরিতে সেকজুক মন্ত্রী নিযামুল মুলককে হত্যা করে। নিযামুল মুলকের পরেই সেকজুকদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ লড়াই ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নিযামুল মুলকের এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন—সালতানাতের কোনো গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল না। যার কারণে এত বড় একটা পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে কোনো তথ্য হাতে ছিল না। অথচ অপরদিকে বুওয়াইহিরা কোনো দিকেই গোয়েন্দা নিয়োগ দিতে বাদ রাখেনি। যার ফলে সব ধরনের খবর তাদের কাছে পৌঁছে যেত।
পরবর্তীতে মুসলিম শাসকদের মধ্যে গোয়েন্দা বিভাগকে সবচেয়ে উত্তমভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রহ.। গোয়েন্দা তৎপরতা মুসলিম শাসনের সকল যুগেই ছিল। তবে, কেউ সেটাকে ব্যবহার করতে পেরেছেন উত্তমভাবে, কেউ সেভাবে পারেননি।
এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমরা অনুসন্ধান করতে চেয়েছি—মুসলিম শাসনামলে গোয়েন্দা তৎপরতার প্রাথমিক ধারণা নিয়ে। অনেক মুসলিম সাম্রাজ্যের কথা ও তাদের তথ্য এখানে আসেনি। এই বিষয়টি আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান এবং গবেষণার দাবি রাখে।