রাকিবুল হাসান:
১৯৪৮ সালে ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন আমেরিকান-আফ্রিকান যুবক জর্জ মা ক্লোইন। কালো কুচকুচে চেহারা। এই ইউনিভার্সিটিতে তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন সাদা-কালো একসাথে পড়ালেখা করার নিয়ম ছিল না। নিয়মটা হয়েছে পরে, ১৯৫৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু নিয়ম না থাকলেও জর্জ মা ক্লোইন প্রতিভার জোরে এখানে ভর্তি হয়েছেন, কেউ আটকাতে পারেনি। সাদা কালো একসাথে থাকার যেহেতু নিয়ম নেই, তাই পানি খাবার কল, খাবারের টেবিল, ক্লাসরুমে বসার তেপায়া—সবকিছুতেই জর্জকে আলাদা করে দেয়া হয়। ২০২০ সালে ওকলাহোমার ইউনিভার্সিটির কিছু দূরে ভয়ংকর বর্ণবৈষম্যের শিকার হয় আরেক যুবক। নিজ দেশের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড। করোনা মহামারীর তীব্র সময়েই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে আমেরিকার রাজপথ। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে তৈরী হয় আরেকটি চিৎকার।
এই চিৎকার আমাদের তাড়িত করে নিয়ে যায় হাজার বছর আগে, মক্কাতুল মুকাররমায়। তখন বনি উমাইয়াদের শাসনকাল। ‘আখবারু মাক্কা’ গ্রন্থে ফাকিহানি (মৃ:২৭২) লিখেছেন, হজের সময় এক ঘোষক ঘোষণা দেয়—মক্কায় ফতোয়া দিতে পারবেন একমাত্র আতা ইবনে আবি রাবাহ (মৃ:১১৫)। তিনি ছাড়া আর কেউ ফতোয়া দিতে পারবেন না।’
মক্কায় ফতোয়া দেবার মতো মহান কাজের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হলো যাকে, তিনি মক্কার এক মহিলার কালো দাস। তাকে উপাধি দেয়া হলো—’হিজাযবাসীদের ফকিহদের সর্দার।’ কেউ নাক সিঁটকালো না, কালো বলে কেউ ঠাট্টা করলো না। খতিব বাগদাদি (মৃ:৪৬৩) তার ‘আল ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ একজন কৃষ্ণাঙ্গ ফকিহ। উমাইয়া খলিফা সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক (মৃ:৯৫) তার দুই ছেলেকে নিয়ে এই ফকিহের কাছে এলেন। তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন হজের বিভিন্ন মাসায়েল। এরপর খলিফা তার দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, দাঁড়াও। ইলম অর্জন করতে কখনো অলসতা করো না। এই কালো দাসের সামনে আমাদের এই তুচ্ছতা আমি কখনোই ভুলি না।’
দুই অঞ্চলে দুই ঘটনার মাঝে কত তফাৎ। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের কারণে যুবক জ্ঞান শিখতে পারছে না, বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ ইসলামের জন্মভূমি মক্কায় বর্ণবৈষম্যহীন কী সুন্দর এক পৃথিবী। কালো এক দাস পাচ্ছেন শহরের সবচে বড় সম্মান; স্বয়ং খলিফা যাচ্ছেন তার কাছে মাসায়েল জানতে। গায়ের রংয়ের চেয়ে ভেতরের গুণকেই মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। যে গুণে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে। এই লেখায় ইসলামি ইতিহাসে কালোদের ভূমিকা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করবো। এতে ফুটে উঠবে ইতিহাসে কালোদের ভূমিকা কারো থেকে কম নয়।
বিদেশী বাদশার কাছে ইসলামি তরজুমান
মুসলমানদের মধ্যে যারা অগ্রজ এবং প্রথম সারির, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং দাস। কারণ ইসলাম ধন-সম্পদ এবং সামাজিক অবস্থানের চেয়ে প্রাধান্য দেয় মানুষের গুণ এবং চরিত্র। এই গুণের বলেই অনেক দাস হয়ে উঠেছেন সর্দার, বিদেশী বাদশাহর দরবারে ইসলামের তরজুমান। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন বিখ্যাত সাহাবি হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ (মৃ:২০)। হজরত ওমর রাদি. বলতেন, ‘আবু বকর আমাদের সর্দার; তিনি আমাদের আরেক সর্দারকে মুক্ত করেছেন।’ অর্থাৎ আরেক সর্দার বলতে হজরত বেলাল রাদি.। ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’তে আবু নাঈম ইস্পাহানি (মৃ:৪৩০) বেলাল রাদি.কে বলেছেন—’বেলাল হলেন সর্দার, আবেদ, যাহেদ।’
কৃষ্ণদের জন্য বেলাল রাদি. তৈরী করেছেন অনন্য এক মর্যাদা। তার গায়ের রং কালো; কিন্তু রসূলের সোহবতে, সাহাবিদের সংস্পর্শে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইসলামের মুআযযিন। ১৩ হিজরিতে ফিলিস্তিনের সিজারিয়া যখন অবরোধ করা হয়, রোমের বাদশা ইবনে হিরাকলের সঙ্গে সমঝোতা করতে পাঠানো হয় হজরত বেলাল রাদি.কে।
ওয়াকিদি (মৃ:২০৭) ‘ফুতুহুশ শাম’ গ্রন্থে লিখেন, ১৩ হিজরিতে ফিলিস্তিনের সিজারিয়া যখন অবরোধ করা হয়, রোমের বাদশা ইবনে হিরাকল একজন বড় পুরোহিতকে ডাকলো। সিজারিয়ার সবচে বড় পুরোহিত সে। হিরাকল তাকে বললো, মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করতে যাও। তাদের সঙ্গে কথা বলো সবচে সুন্দর ভঙ্গিতে। তাদেরকে বলো, বাদশার পুত্র বলেছেন, তোমাদের সবচে বিশুদ্ধভাষী, সবচে সাহসী একজনকে যেন তার কাছে পাঠাও। তবে শর্ত হলো সে আরবের হতে পারবে না।
পুরোহিত এসে মুসলিম বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে হিরাকলের ঘোষণাটি শোনালো। হজরত বেলাল রাদি. এগিয়ে এসে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস (মৃ:৪৩) রাদি.কে বললেন, রোমের সেনাপ্রধানের সাথে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমি কথা বলতে চাই। আমর ইবনুল আস রাদি. বললেন, তুমিই যাও। আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। কথা বলতে ভয় পেয়ো না। সুস্পষ্ট জবাব দিবে, ইসলামের নিয়ম-কানুন সবার উর্ধ্বে রাখবে। বেলাল রাদি. বললেন, ইনশাআল্লাহ, আপনার কথামতোই আমি কাজ করবো।
মুসলিম সেনাবাহিনীর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সামনে এলেন হজরত বেলাল রাদি.। পুরোহিত তাকে দেখে বললো, হে গোলাম, তোমার সর্দারকে পাঠাও। তাকে বলো বাদশা তোমাদের আমিরের সঙ্গে ইচ্ছেমতো কথা বলতে চান। বেলাল রাদি. বললেন, হে পুরোহিত, আমি বেলাল; রাসূল সা. এর মুআযযিন; তোমার নেতার জবাব দিতে আমি অক্ষম নই। পুরোহিত বললো, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। বাদশাহকে জিজ্ঞেস করে আসি। পুরোহিত বাদশার সঙ্গে দেখা করে এসে বললো, হে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদশা বলেছেন, তিনি গোলামের সঙ্গে কথা বলবেন না। বরং তেমাদের সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলবেন। বেলাল রাদি. সেনাবাহিনীর বৃত্তে ফিরে গেলেন।
এখানে দেখার বিষয়—মুসলিমরা একজন কালো গোলামকে পাঠাচ্ছে বাদশার দরবারে ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। অথচ বাদশা পাঠিয়েছে তাদের কাছে সবচে সম্মানিত পুরোহিতকে। কালো হলেও বেলালের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কারো দ্বিমত ছিলো না। তাই মুসলিমরা বিদেশী বাদশার সামনে ইসলামের তরজুমান করে তাকে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করেনি।
সাহসিকতার ক্ষেত্রেও কালোরা এগিয়ে থেকেছে সবসময়। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে যাহাবি রহ. বলেন, হজরত ওমর রাদি. এর আজাদকৃত গোলাম মাহজা’ ইবনে সালেহ (মৃ:২) ছিলেন বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ।’ বদর যুদ্ধে মুসলিম দলের একমাত্র অশ্বারোহী ছিলেন মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাদি. (মৃ:৩৩)। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে যাহাবি রহ. লিখেন, মিকদাদ রাদি. ছিলেন গোলাম… কৃষ্ণবর্ণ…বদর যুদ্ধে তিনিই একমাত্র সাহাবি, যার সঙ্গে ঘোড়া ছিলো।’ যাহাবি আরও লিখেছেন, ‘হজরত আলী রাদি. বলেছেন, বদরে আমরা রাত কাটিয়েছি। আমাদের সঙ্গে অশ্বারোহী ছিল মাত্র একজন। তিনি হলেন হজরত মিকদাদ।’ মিকদাদ রাদি. সব গাযওয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন। তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে—’রাসূলের অশ্বারোহী’ বলে।
আরবেও কৃষ্ণাঙ্গ ছিল
সব কৃষ্ণাঙ্গ সাহবিগণই আফ্রিকান ছিলেন না। অনেকেই ছিলেন আরব মরুভূমির, যাদের গায়ের চামড়া ছিল কালো। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন উবাদা ইবনে সামেত খাযরাজি রাদি. (মৃ:৩৪)। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। মিসরে তিনি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বেলাল রাদি.কে যেমন হিরাকলের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছিল, তেমনি উবাদা রাদি.কে পাঠানো হয়েছিল মুকাওকিসের সঙ্গে আলোচনা করতে।
ইমাম ইবনু আবদিল হাকাম রহ. (মৃ:২৫৭) ‘ফুতুহু মিসর ওয়াল মাগরিব’ গ্রন্থে লিখেছেন, মিসর বিজয়ী সেনাপতি হজরত আমর ইবনুল আস রাদি. শামে মুকাওকিসের সঙ্গে আলোচনা করতে উবাদা ইবনে সামেতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠালেন। দরবারে যখন উবাদা রাদি. প্রবেশ করলেন, তার কুচকুচে কালো চেহারা দেখে ভড়কে গেলেন মুকাওকিস। তিনি বললেন, এই কৃষ্ণাঙ্গকে নিয়ে যাও। তার বদলে অন্য কাউকে আসতে বলো। প্রতিনিধি দল বললো, এই কৃষ্ণাঙ্গই আমাদের মধ্যে ইলমে এবং বুদ্ধিমত্তায় শ্রেষ্ঠ। তিনি আমাদের সর্দার, আমাদের নেতা। তার কথা আমরা বিনাপ্রশ্নে মেনে নেই। আমিরের যা বলার তাকেই বলে দিয়েছেন। আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, আমরা যেন তার বিরোধিতা না করি।’ মুকাওকিস বললেন, ‘এই কৃষ্ণাঙ্গকে কিভাবে তোমাদের সর্দার মেনে নিলে? তেমাদের সর্দার অন্য কেউ হওয়া উচিত।’ প্রতিনিধি দল বললো, কখনোই নয়। দেখতে যদিও তিনি কালো, কথা-বার্তায়, জ্ঞানে-গুণে তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ। আমাদের ধর্মে কালোকে ঘৃণা করা হয় না।’ মুকাওকিস তখন উবাদা রাদি.কে বললেন, হে কৃষ্ণাঙ্গ, এগিয়ে আসো। নরম ভাষায় কথা বলো।’
বর্ণবাদকে ইসলাম ‘না’ বলে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হজরত বেলাল এবং উবাদা রাদি. এর এই দুটো ঘটনা। মুসলমানদের হয়ে কথা বলতে রোমের বড় দুজন নেতার কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের। রোমক নেতাগণ কালো বলে নাক সিঁটকালেও মুসলিমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছে—আমাদের ধর্মে কৃষ্ণাঙ্গকে ঘৃণা করা হয় না।
ইসলামের শুরু থেকেই কৃষ্ণ বর্ণের সাহাবিগণ রাসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন রাসূল সা. এর আজাদকৃত গোলাম রাবাহ। হাফেজ ইবনু আবদিল বার (মৃ:৪৬৩) ‘আল ইসতিআব ফি মারিফাতিল আসহাব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাবাহ ছিলেন কালো। রাসূল সা. যখন একাকী থাকতেন, তার কাছে যাবার অনুমতি ছিল তার।’ এমন আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবি জুলাইবিব রাদি.। তিনি যেদিন শহীদ হন, রাসূল সা. তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘জুলাইবিব সাতজন কাফেরকে হত্যা করেছে। পরে তারা তাকে হত্যা করেছে। সে আমার অংশ, আমি তার অংশ। সে আমার অংশ, আমি তার অংশ।’ এমন আরেকজন সাহাবি আবু হুযায়ফার গোলাম সালেম রাদি.। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর তিনি মুহাজিরদের নামাজ পড়াতেন। কারণ, তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতকারী।
এদের মধ্যে মহিলা সাহাবির কথা বললে সবার আগেই আসবে উম্মে আয়মান হাবশি রাদি. এর কথা। তিনি ছিলেন রাসূল সা. এর প্রতিপালনকারী এবং উসামা ইবনে যায়েদের মা। উসামা তার কাছ থেকে কালো বর্ণ পেয়েছিল। রাসূল সা. এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর এবং ওমর রাদি.তাকে দেখতে যেতেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলতেন, আসমান থেকে ওহি আসা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমি কাঁদছি।
ইলমের মসনদে, ইলমের গুণে
ইসলামি সভ্যতার গভীরে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারা তাদের জ্ঞানের গুণে আলোকিত করেছে পৃথিবী। যারা তাদের জ্ঞানে-চিন্তায় সমৃদ্ধ করেছে ইসলামি সংস্কৃতি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবিব নুবি (মৃ:১২৮)। ‘তারিখুল ইসলামে’ যাহাবি রহ. লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ হাবশি। মিসরের মুফতি। ধৈর্যশীল এবং বুদ্ধিমান।’ মিসরের ইলমি চরিত্র বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, মিসরে যিনি ফিকহি মাসায়েল তথা হালাল-হারাম নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে সেখানে কেবল আমলের তারগিব, ফিতনার স্বরূপ ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো।
মিসরের একদল ইমাম তার নিকট ইলম শিক্ষা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়া রহ. (মৃ:১৭৪)। মিসরের বড় ইমাম এবং প্রসিদ্ধ মুফতি লাইস ইবনে সাদ রহ. (মৃ:১৭৫)। ইয়াজিদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইয়াজিদ আমাদের আলেম, আমাদের সর্দার।’
সত্য প্রকাশে ইয়াজিদ কখনো সংকোচ করতেন না। ইয়াজিদের ছাত্র ইবনে লাহিয়া বলেন, ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবিব যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মিসরের যুবরাজ হাথুর বিন সুহাইল তাকে দেখতে এলেন। তিনি বললেন, হে আবু রজা, কাপড়ে মাছির রক্ত নিয়ে নামাজ পড়ার হুকুম কি? ইয়াজিদ মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কথা বলতে চাইলেন না। যুবরাজ ইয়াজিদের মুখের দিকে ফিরে গেলেন। তখন ইয়াজিদ বললেন, প্রতিদিন কত মানুষকে আপনি হত্যা করছেন। অথচ আপনি এখন জিজ্ঞেস করতে আসছেন মাছির রক্তের কথা!
জাতির নেতৃত্বে
জাতির ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ছিল কৃষ্ণাঙ্গরা। শুরুতেই আতা ইবনে আবি রাবাহের কথা উল্লেখ করেছি। তিনি ছিলেন মক্কার নেতৃস্থানীয় আলেমদের একজন। ‘মারিফাতুস সিকাত’ গ্রন্থে ইমাম আবুল হাসান আজালি (মৃ:২৬১) বলেন, ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ মক্কাবাসীদের মুফতি ছিলেন।’ যাহাবি তাকে বলেছেন, ‘শাইখুল ইসলাম, হারামের মুফতি।’
আতা ইবনে রাবাহ কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যই আদর্শ নন, বরং তিনি প্রতিবন্ধীদের জন্যও আদর্শ। কারণ তিনি ছিলেন প্যারালাইজড, এক চোখ অন্ধ। পরবর্তীতে দুচোখই অন্ধ হয়ে যায়। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে কুনফুজ কুসানতিনি ‘আল ওফায়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন, চেহারার সৌন্দর্য এবং সম্পদের প্রাচুর্য দিয়ে কেউ ইলম অর্জন করতে পারে না। ইলম হলো নূর; আল্লাহ তায়ালা এই নূর যার বুকে ইচ্ছে, তার বুকে রাখেন।’
তাবেয়িদের ইমাম সাঈদ ইবনে জুবায়ের (মৃ:৯৪) বিরাট ইলমের অধিকারী ছিলেন। ‘তাজকিরাতুল হুফফাজে’ যাহাবি লিখেছেন, ‘বিদ্বান আলেম বলা হয় সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ইবনে আব্বাস রাদি. যখন হজে গেলেন, কুফাবাসী তাকে বিভিন্ন কিছু জিজ্ঞেস করছিলো। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে সাঈদ ইবনে জুবায়ের নাই?’
ইলমের এতবড় মসনদ দখল করার পরও কুফার বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ইরাকে উমাইয়া খলিফা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের (মৃ:৯৫) বিরুদ্ধে যখন ফকিহগণ বিদ্রোহ করলেন, সেই বিদ্রোহে সাঈদ ইবনে জুবায়ের যোগ দিয়েছিলেন। বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়, তিনি গ্রেফতার হন। পরে হাজ্জাজ তাকে হত্যা করেন।
কৃষ্ণাঙ্গ আলেমদের মাঝে কেরাতের ইমামও ছিলেন। তিনি হলেন মদীনার কারী আবু রুয়াইম নাফে ইবনে আবদির রহমান মাদানি (মৃ:১৭০)। ইবনু জাযারি (মৃঃ৮৩৩) ‘গায়াতুন নিহায়াহ ফি তাবাকাতিল কুররা’ গ্রন্থে লিখেন, ‘তিনি ছিলেন সাত কারীর একজন। গাত্রবর্ণ কালো, কথা বলেন হাসি রসাত্মক। মদীনার একদল তাবেয়ি থেকে কেরাত গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি সত্তরজন কারীর নিকট কেরাত পড়েছি।’
কাব্যে ও কবিতায়
কৃষ্ণাঙ্গরা কেবল কুরআন-হাদীস-ফিকহের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তারা কাব্য এবং কবিতায়ও অবদান রেখেছে। ভাষা ও সাহিত্যের ইমাম আসমাঈ (মৃ:২১৬) ‘ফুহুলাতুশ শুআরা’ গ্রন্থে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ কবি ও সাহিত্যিকের আলোচনা করেছেন। কবিদের মধ্যে কতজন হলেন—নুসাইব ইবনে রাবাহ আবু মিহজিন নুবি (মৃ:১০৮), রম্য কবি আবু দাল্লামা (মৃ:১৬১), আবু আতা সানাদি (মৃ:১৮০ এর পর)। সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবু উসমান জাহিয (মৃ:২৫৫)। ‘মুজামুল উদাবা’ গ্রন্থে ইয়াকুত হামাভি (মৃ:৬২৬) লিখেছেন, জাহিযের দাদাও কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন।
কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের মধ্যে খুব বেশি প্রসিদ্ধ সুহাইম, যিনি ‘আবদু বনি হাছহাছ’ বলে পরিচিত। ‘খাযানাতুল আদব’ গ্রন্থে আবদুল কাদের বাগদাদি (মৃ:১০৯৩) লিখেন, সুহাইম ছিলেন মুখাজরামিনদের একজন; ‘তিনি জাহেলি এবং ইসলাম দুটো সময়ই পেয়েছেন। তবে তিনি সাহাবি কিনা, তা জানা যায়নি। তিনি ছিলেন কুচকুচে কালো।’ সুহাইমের দু’একটা পঙক্তি—দেহ তোমার দাস, মন কিন্তু স্বাধীন/গায়ের বর্ণ কালো, কিন্তু চরিত্র শ্বেত পাথরের মতো সমুজ্জ্বল।
প্রসিদ্ধ এই কবিদের একজন আব্বাসী কবি আবু ফানান আহমদ ইবনে সালেহ (মৃ:২৭০)। আবু উবায়েদ আন্দলুসি (মৃ:৪৮৭) ‘সামতুল লাআলি’তে লিখেন, ‘আবু ফানান ছিলেন কালো; তিনি বাগদাদের ভালো কবিদের একজন ছিলেন। তিনি মুতাওয়াক্কিলের শাসনকালে কবিতায় প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।’ তার পঙক্তি—কান্না থামাতে অস্বীকার করেছে আমার চোখ/অশ্রুর প্লাবন থামাতে নারাজ/অশ্রুকে অস্বীকার করো না/ মুক্তোর মতো জ্বলছে অল্প কিছু অশ্রু।
প্রসিদ্ধ আরেকজন কবি নুসাইব ইবনে রাবাহ আবু মিহজিন। ইমাম মোবাররাদ ‘আল কামিল’ গ্রন্থে বলেছেন, নুসাইবা কবিতায় আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (মৃ: ৮০) এর প্রশংসা করেছেন। খুশি হয়ে জাফর তাকে ঘোড়া ও দিনার ও দিরহাম পুরস্কার দিলেন। লোকজন তাকে বললো, কৃষ্ণাঙ্গ কবি কে আপনি এতগুলো উপঢৌকন দিলেন! আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর বললেন, যদিও সে কালো কিন্তু তার কবিতা উজ্জ্বল ; আরবদের প্রশংসা করছে সে; শুধু এতোটুকুই নয় বরং সে এর চেয়ে বেশি উপহারের যোগ্য।’
আরেকজন কবি ছিলেন ছোট নুসাইব (মৃ:১৭৫)। তিনি আবুল হাজনা বলে পরিচিত। কবিতায় তিনি আব্বাসি খেলাফতের নিকট একটা রাজনৈতিক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছিলেন। ‘তাবাকাতুশ শুআরা’তে ইবনু মু’তাজ (মৃ:২৯৬) লিখেছেন, বাদশা হারুনুর রশীদ তাকে শামের কিছু এলাকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।’ তেমনি আরেকজন কবি ফজল ইবনে ইয়াহইয়া (মৃ:১৯২)। হেলালি বলেন, একদিন আমি ইমাম আসমাঈকে বললাম, এই কৃষ্ণাঙ্গের কবিতা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?’ তিনি বললেন, ‘আবদে হাছহাছ তার কালে যতটা প্রসিদ্ধ ছিলেন, এই কালে তারচে বেশি প্রসিদ্ধ ফজল ইবনে ইয়াহইয়া। হেলালি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বড় নুসাইবের কবিতা, কোথায় ফজলের কবিতা! আসমাঈ বললেন, তারা দুজন একই শতাব্দীর, তাদের প্যাটার্নও এক। তবে নুসাইব ছিলেন একটু আগের, ফজল সমকালীন।’
আরেকজন কবি আলি ইবনে জাবালাহ, তিনি আকাউওয়াক বলে পরিচিত (মৃ:২১৩)। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে যাহাবি লিখেছেন, ‘জাহিয বলেন, আকাউওয়াক জন্মগ্রহণ করেছিলেন অন্ধ। তার ওপর তিনি কালো এবং কুষ্ঠরোগী। কিন্তু তার কবিতা অনন্য।’ আরেক কবি কাফুর নববি (মৃ:৫০৩)। ঐতিহাসিক সাফাদি তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ কবি এবং দারুণ কবি।’
রাজনৈতিক তৎপরতায়
জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের বাইরে রাজনীতির ময়দানেও কীর্তি আছে কৃষ্ণাঙ্গদের। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন মিসরের আমির কাফুর ইখশিদি (মৃ: ৩৫৬)। ক্ষমতার কেন্দ্রে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যেরও কদর করতেন। ঐতিহাসিক সাফাদি লিখেছেন, ‘কাফুর ইখশিদি মিসরের প্রসিদ্ধ সুলতান…তিনি কৃষ্ণাঙ্গ…তিনি মেধাবি; আরবি, সাহিত্য এবং ইলমের প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন।’
সাফাদি আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতার কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে ছিলেন। তিনি হলেন কাফুর শিবেল দাওলা (মৃ:৬২৩)। তিনি কায়রোতে আইয়ুবি প্রাসাদের খাদেম ছিলেন। তিনি ছিলেন হানাফি; একসময় তিনি মাদরাসা এবং খানকা কায়েম করেছেন।
তারিখুল ইসলামে যাহাবি একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি আমির বদরুদ্দিন হাবশি আদিলি (মৃ:৬৯৮)। তিনি ছিলেন সাহসী, যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম। আমানত এবং দিয়ানতদারিতেও তিনি ছিলেন অনন্য। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও অধিক কাল তিনি আমির ছিলেন। তিনি অনেকবার হজ করেছেন।’ এরপর যাহাবি এমন একটি বাক্য বলেছেন, যা ইঙ্গিত করে, এই কৃষ্ণাঙ্গ আমির যাহাবির শায়েখদের মধ্যে একজন ছিলেন। যাহাবি বলেছেন, আমি তার নিকট একটা ‘জুয’ পড়েছি; এই জুয তিনি শুনেছিলেন ইবনু আবদিদ দায়েম থেকে।
রাজনৈতিক খেলায় কৃষ্ণাঙ্গরা বিদ্রোহও পরিচালিত করেছে। তারমধ্যে একটি হলো ১৪৫ হিজরির বিদ্রোহ। বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল মদীনায়। ‘আল বিদায়া অন নিহায়া’ গ্রন্থে ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘আব্বাসি সেনাদের হাতে যখন বিদ্রোহী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান নিহত হয়, তখন কৃষ্ণাঙ্গরা বিদ্রোহে নামে। খলিফা মানসুর (মৃ:১৫৮) আব্দুল্লাহ ইবনে রাবি হারিসিকে মদীনায় গভর্নর করে পাঠান। তার সৈন্যরা মদীনায় বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়। ফলে একদল কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সৈন্যরা যখন জুমার নামাজ পড়তে যাচ্ছিল, তখন কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ওপর হামলা চালায়। কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের মধ্যে ছিল—ওয়াসিক, ইয়াকিল, উনকুদ, আবু কায়েস এবং আবু নার প্রমূখ। আব্দুল্লাহ ইবনে রাবি সৈন্যদের নিয়ে লড়াইয়ে নামেন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের পরাজিত করেন।
এর এক শতাব্দী পর দক্ষিণ ইরাকে কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। বিদ্রোহটি ২৫৫ হিজরি থেকে ২৭০ হিজরি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই বিদ্রোহকে বলা হয় ‘যানজ বিদ্রোহ’। এর দুই শতাব্দী পর ফাতেমি সাম্রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। যখন বিখ্যাত সেনানায়ক সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (মৃ:৫৮৯) মিসরে আসেন। আইয়ুবি বিদ্রোহ দমন করেন।
কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লেখালেখি
ইসলামি সভ্যতায় কৃষ্ণঙ্গদের অবদান কেবল ধারণাগত ছিল না, বরং বাস্তবেই দৃশ্যমান ছিল। ইতিহাসের পাতায় কৃষ্ণাঙ্গদের সেসব অবদান লিপিবদ্ধ আছে। তবে বিশিষ্ট দার্শনিকদের লেখা প্রাচীন ইউরোপীয় লেখাগুলো বর্ণবাদী মানদণ্ডে মানুষকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল। জার্মান দার্শনিক এমানুয়েল ক্যান্ট (মৃ:১৮০৪ খৃ.) প্রতিভা সারণিতে প্রথমেই রেখেছেন শ্বেতাঙ্গদের। তারপর ইন্ডিয়ান। তৃতীয় সারণিতে রেখেছেন কৃষ্ণাঙ্গদের। এমনিভাবে দার্শনিক হেগেলের (মৃ:১৮৩০ খৃ.) বর্ণবাদী অবস্থানও ছিল ক্যান্টের মতো। কিন্তু ইসলামি লেখকদের লেখায় বর্ণবাদী মানদণ্ডে মানুষকে বিভিক্ত করা হয়নি। বরং তাদের লেখায় ফুটে উঠেছে সাম্য। তারা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান তুলে ধরেছেন ইনসাফের সাথে। কৃষ্ণাঙ্গদের ফেলে দেননি। সমাজ ও সভ্যতায় কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান তুলে ধরেছেন।
‘কাশফুয যুনুনে’ আরব সংস্কৃতিতে কৃষ্ণাঙ্গদের উপস্থিতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের নাম উল্লেখ করেছেন হাজি খলিফা (মৃ:১০৬৮)। তিনি লেখকদের মৃত্যুর ধারাবাহিকতা অনুযায়ী গ্রন্থগুলোর বিন্যাস করেছেন। গ্রন্থগুলো হলো—জাহিয (মৃ:২৫৫) রচিত ‘ফাখরুস সুদান আলাল বীদান’; আবুল আব্বাস নাশিঈ (মৃ:২৯৩) রচিত ‘ফি তাফজিলিস সূদ আলাল বিয়াজ’; ইবনুল মারজুবান (মৃ:৩০৯( রচিত ‘আস সুদান ওয়া ফাজলুহুম আলাল বীদান’; ইবনুস সাররাজ কারি (মৃ:৫০০) রচিত ‘যুহদুস সুদান’; সুয়ুতি রচিত ‘নুজহাতু উমর ফিত তাফজিলি বাইনাল বিয়াজ ওয়াস সূদ’।
শেষকথা
ইবনুল জাওযি লিখেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের স্বভাবে কিছু গুণ থাকে বিশেষ। যেমন—শারীরিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ়তা; এ দুটো সাহসের জন্ম দেয়। কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ হাবশার কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে আতিথিয়েতা, সুন্দর চরিত্র, দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়া, মিষ্টি ভাষী এবং হাসী।’
কালো যে আলো, প্রকৃতির কিছু জিনিস তার প্রমাণ। ইবনুল জাওযি লিখেছেন, কিছু গুণ এবং সৌন্দর্য কালোতেই নিহিত। এরমধ্যে রয়েছে ‘চোখের মণি’ এবং ‘কলিজার কালো রং’। এ দুটো জিনসই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। তারপর বলা যায় মানুষের সৌন্দর্যের মুকুট ‘মাথায় কালো চুল’। সবচে মহান যে পাথর, হাদীসে তাকে বলা হয়েছে ‘হাজরে আসওয়াদ’।
কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ হাবশার কিছু ভাষা কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন—মেশকাত, ত্বাহা, আওয়াহুন। হাবশার ভাষায় ত্বাহা অর্থ—হে লোক। আওয়াহুন অর্থ মুমিন। আল্লামা সুয়ুতি রহ. ‘আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআনে’ লিখেছেন, ‘সব আসমানি কিতাব যার যার কওমের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এক কওমের জন্য অন্য কওমের ভাষায় আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করা হয়নি। এইখানে কুরআনের বিশেষত্ব হলো—কুরআনে আরবের সবকটি ভাষার শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। এরমধ্যে রোম, পারস্য, হাবশার কথা বলা যায়।’
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়তো কুরআনের বাণী এবং ইসলামের ব্যাপকতাকে ভাষা কিংবা বর্ণের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়া। মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাঝে কেবল ভাষাগত বন্ধনই নেই, বরং সবধরণের বন্ধনই আছে। সবাই সমান, বর্ণের ভিত্তিতে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। ইবনুল জাওযি রাসূল সা. এর এই উক্তি তুলে ধরেছেন—’বাদশা কুরাইশদের মধ্য হতে; বিচারক আনসারদের মধ্য হতে; মুআযযিন হাবশার মধ্য হতে; এবং আমানতদারিতা আজদের মধ্য হতে।’
ইসলাম যে সাম্য উপহার দিয়েছে, তার মতো আর কেউ দিতে পারেনি। কৃষ্ণাঙ্গদের যে উচ্চতায় জায়গা দিয়েছে ইসলাম, তাও অন্য কেউ দিতে পারেনি।