রাকিবুল হাসান নাঈম:
বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি এবং ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার আন্দোলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মুফতী ফজলুল হক আমিনীর ইন্তেকালের দশ বছর পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের এ দিনে অনেকটা হঠাৎ করেই তিনি পরপারের ঠিকানায় পাড়ি জমান। বিশ্লেষকরা বলছেনو তার চলে যাওয়ার দশ বছর পার হলেও তিনি এখনও এ দেশের ধর্মীয় পরিমণ্ডল এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
রাজনৈতিক জীবনের তিন ধাপ
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর হাত ধরে তিনি রাজনীতির ময়দানে আগমন করেন। তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার রাজনীতি ও আন্দোলন তিনটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপ ১৯৮১ থেকে ৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জীর ইন্তেকাল পর্যন্ত। এ সময়টায় তিনি তার পাওয়ারফুল কণ্ঠ ও স্বভাবসুলভ মেধায় দ্যুতি ছড়ালেও তিনি মূলত শিক্ষানবিশ ছিলেন। প্রচলিত রাজনীতির ধরন, চেনা-অচেনা ওলিগলি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসার মধ্য দিয়ে শিখেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।
আর দ্বিতীয় ধাপে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, কমিটি ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষকে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী রাজনীতির সাথে পরিচয় করাতে করাতে তিনি একজন যোগ্য ও অনন্য নেতায় পরিণত হয়েছেন। বাবরী মসজিদ অভিমুখে লংমার্চ, তসলিমাবিরোধী আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে উলামা কমিটি, জমিয়তুল আনসার, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, ইসলামী মোর্চার মতো বিভিন্ন কমিটি ও শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার অচিন্তনীয় সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে এবং তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশসেরা সংগঠক হিসেবে ।
তৃতীয় ধাপে ১৯৯৭ সালে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে তার পথচলা শুরু। এরপর কেবল এগিয়ে গিয়েছেন। নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ফতোয়াবিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং সর্বশেষ নারীনীতি ও শিক্ষানীতির প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবে নিজেকে পাহাড়সম উচ্চতায় উন্নীত করেছেন ।
তিনি কেন এখনও প্রাসঙ্গিক
এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও চিন্তাবিদ মাওলানা শরীফ মোহাম্মদের সঙ্গে। মুফতি ফজলুল হক আমিনী কেন এখনও প্রাসঙ্গিক জানতে চাইলে ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘মুফতি আমিনী রহ.-এর কথা ভাবলে আমার সমুদ্রের কথা মনে হয়। আমি আমার তাল হারিয়ে ফেলি, এলোমেলো হয়ে যাই। তবে একটি কথা বলতেই হবে, তিনি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সময় বদলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। তিনি যেভাবে কাজ করেছেন, ইসলামের স্বপক্ষে যেভাবে কথা বলেছেন, তা আজও আদর্শ হয়ে আছে। কিন্তু সত্য করে বললে বলতে হবে, তার মতো অবস্থানে এখন দ্বিতীয় আর কাউকে দেখি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুফতি আমিনীর অন্যতম একটি গুণ হলো, তিনি ছিলেন আপোষহীন। কখনও তিনি আপোষে যেতেন না। হয়ত নিজে থেকে পিছিয়ে আসতেন বা চুপ থাকতেন, কিন্তু আপোষ করতেন না। অনেকে বলবেন, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক না। সেটা মাথায় রেখেই বলছি। মুফতি আমিনীর ইন্তেকালের পর, হেফাজত পরবর্তী সময়ে আমাদের অঙ্গনে অনেক কিছু ঘটেছে। কিন্তু হেফাজত নেতৃত্বে আপোষহীনতা বাহ্যত পূর্ণ মাত্রায় দেখা যায়নি। শোকরানা মাহফিল সহ বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে হেফাজত নেতৃত্বের হাসিমুখে বসাটাও দেখা গেছে। বসাটা যদিও নমনীয়তার স্বাক্ষর না, তবুও যারা ৫মে ঘটালো, তাদের সঙ্গে হাসিমুখে বসাটাও বা কেমন।’
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, মুফতি আমিনী রহ. যে আন্দোলনই করতেন, তার পরিণতি সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকতেন। পরিণতি মাথায় রেখেই তিনি আন্দোলন পরিচালনা করতেন। আমরা হয়ত দেখেছি, তিনি গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন, আবেগী করে তুলছেন সবাইকে। কিন্তু তার মধ্যে তখনও পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। তার সময়ে যদিও এখনকার মতো পরিস্থিতি ছিল না, কিন্তু কিছু তো ছিল। ফতোয়া আন্দোলনে ৬ শহীদের ঘটনাও ঘটেছে। দেখা গেছে, বিভিন্ন আন্দোলন তিনি একটা জায়গায় এসে ছেড়ে দিতেন। সেটা নিয়ে আর কাজ করতেন না। আমরা বলতাম, এই আন্দোলনগুলো আরেকবার জাগিয়ে তুললেই তো বিষয়টির সমাধান হয়ে যায়, দাবিটি আদায় হয়ে যায়। কিন্তু তিনি চুপ থাকতেন। পরে ৫মের ঘটনার পর বুঝেছি, তিনি আসলে জানতেন, কোথায় থামতে হয়। এটা জানার কারণেই অনেক বিপর্যয় তখন ঘটেনি। কিছু আন্দোলন সফল বেশি হয়েছে, কোনো আন্দোলন সফল কম হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে আলেম কবি ও বিশ্লেষক মুসা আল হাফিজ ফাতেহকে বলেন, একটা জাতি বা গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে থাকা বা প্রতিষ্ঠিত থাকার মৌলিক উপাদানগুলোর একটি হচ্ছে ওই জাতি তাঁর জাতিগত শত্রু কারা এবং কারা তাদের মিত্র, তা চিনতে পারা। মুফতী আমিনী রহমতুল্লাহ আলায়হি ফ্যাসিবাদ এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার এই সময়ে তার জীবৎকালের মতোই সমান প্রাসঙ্গিক থাকবার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, তিনি জাতিগত শত্রু এবং মিত্রদের চিনতে পারতেন। জাতিগত শত্রুদের সঙ্গে কখনোই আপোস করতেন না। লক্ষ্য ঠিক রাখার জায়গাটায় আমরা যেখানে আরও সচেতন হবার কথা, সেখানে দিনদিন আমরা আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মুফতী আমিনী ছিলেন লক্ষ্যের প্রতি অবিচল। একজন আমিনীর প্রাসঙ্গিকতা এই কারণেও এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
মুফতি আমিনীর রাজনেতিকত দূরদর্শীতা সম্পর্কে গবেষক এই আলেম বলেন, রাজনীতির গতিপথ বুঝতেন মুফতী আমিনী, বুঝতেন সময়ের প্রয়োজন এবং চাহিদা। ‘হাওয়া বুঝে পাল খাটানো’র যে একটা প্রবণতা আছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকের মধ্যে, মুফতী আমিনী তেমন ছিলেন না। তিনি বাস্তবতার আলোকে এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। অনেকে বলেন, তিনি ‘গরম গরম বক্তব্য’ দিতেন। হ্যাঁ, তিনি দিতেন। কিন্তু সেটা অবাস্তব কোনো বক্তব্য হতো না। তিনি যখনই কোনো হুংকার দিয়েছেন, এই হুংকারকে যথাযথভাবে কাজেও লাগিয়েছেন। অবাস্তব কোনো হুংকার তিনি দেননি। আমি বলছি না রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় তিনি কখনো ভুল করেননি। মানুষ হিসেবে ভুল করতেই পারেন। কিন্তু জেনে বুঝে কখনো ভুলের পথে পা বাড়াননি। ভুল করেছেন ভুলক্রমে।