যন্ত্রণাতেও ভালো থাকুক সময় 

ইফতেখার জামিল:

এবার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে আমরা ঈদ উদযাপন করছি। মোটামুটি সবাই উৎকণ্ঠায় আছি ; করোনা মহামারী থেকে দ্রুতই মুক্তি মিলছে নাㅡবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এটা নিশ্চিত করেছে। অবস্থা স্বাভাবিক হতে হতে অনেকের কল্পনা-পরিকল্পনা উলট-পালট হয়ে যাবে। এই অনিশ্চয়তায় আনন্দের সাথে ঈদ উদযাপন করা সম্ভব নয়। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে : অপেক্ষা মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্করㅡ আমরা সেই মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ক্লান্তিতে আটকে আছি ; অপেক্ষায় আছি কবে স্বাভাবিক হবে সব।

সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী এবার খোলা মাঠে-ময়দানে ঈদের জামাত করা যাবে না। তাতে ঈদের আয়োজন থেকে যাবে অনেকাংশে অপূর্ণ। বাংলাদেশের ঈদ সংস্কৃতিতে খোলা মাঠে জামাত আদায়ের গুরুত্ব অনেক বেশী। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছেন, ‘আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে/যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ’ㅡ বস্তুত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে বড় কোন যুদ্ধ না হলেও সূফী-দরবেশরা খুব সহজে দ্বীন প্রচার করতে পারেননি। রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে ধর্মীয় অধিকার।

যে সূফী দরবেশরা সারা বিশ্ব জয় করে এসেছেন, ইরান-তুরান-ইয়ামান থেকে তারা বাংলার মাঠে-প্রান্তরে ইসলামের জন্য জান কোরবানি দিয়েছেন, নজরুলের আহ্বান তাই ঈদের দিনে তাদের স্মরণে শাহাদাতের ময়দানে আয়োজিত ঈদের জামাতে শরীক হোক সবাই। পাশাপাশি এর সাথে ইংরেজ-জমিদারি আমলের জনযুদ্ধের শহীদও আছেন অনেক। সেই আমলে জামাতে নামাজ ও প্রকাশ্যে কোরবানি আদায় ছিল অনেক কঠিন বিষয়ㅡএতে আরোপিত ছিল নানান রকম কর ও বিধিনিষেধ। করোনার যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো খোলা মাঠে ঈদের জামাত করার ফজিলত অনুধাবনের ফুরসত মিলত না।

নজরুল উল্লেখিত গানে  ঈদের আরও দুটি গুরুত্বের কথা বলেছেন। ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ’ ㅡএখানে নজরুল হাত মেলাতে বলছেন। এবারের ঈদে হয়তো কোলাকোলি ও হাত মেলানোর প্রবণতা অনেক সীমিত থাকবে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এর  নির্দেশনায় বজায় রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্ব। নজরুল এর সাথে যোগ করেছেন, ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী /সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ’ ㅡ করোনার প্রেক্ষিতে কবির এই আহ্বানের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।

করোনার প্রেক্ষাপটে দেশে লকডাউন ও ওপেনআপের অদ্ভুত অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। রাস্তা-ঘাট-বাস-ফেরীতে মানুষ গিজগিজ করছে। মানুষ পড়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ সঞ্চয়, নাগরিক সেবা ও বীমা, তাই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোন উপায় নেই। পাশাপাশি তারা জানেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নীল মৃত্যু। তবু সামাজিক সম্মান ও জীবিকার নিরাপত্তার খোঁজে তারা বেরিয়ে পড়ছেনㅡ করোনা মহামারীর চেয়ে আর্থ-রাজনৈতিক ঝুঁকি কোন অংশে কম নয়।

এই বিপর্যয়কর সময়ে পাঠকের কাছে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর বিশেষ ঈদসংখ্যার উপহার নিয়ে এসেছে। এতে নিশ্চিতভাবে করোনার অনিশ্চয়তা ও ক্লান্তি কাটানো সম্ভব নয়। তবে আমরা আছি পাশে ㅡসবাই হাতে হাত রেখে মোকাবেলা করতে হবে এই মহাবিপদ ; ঈদসংখ্যার মাধ্যমে অবসরে শিক্ষা ও বিনোদনে পাঠকের মনে সামান্য শান্তি ও শান্তনা জোগাতে পারলেই আমরা নিজেদেরকে ধন্য মনে করবো।

এই সংখ্যায় প্রায় চল্লিশ জনের মতো লেখক তাদের গল্প ও বক্তব্য পেশ করেছেন। বিষয় নির্বাচন, নির্দেশনা, সম্পাদনা ও বানান যাচাইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আরও কয়েকজন। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। পাশাপাশি সবার আগে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি পাঠকদের প্রতিㅡ যারা ফাতেহের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, যারা বিজ্ঞাপন ও অনুদান দিচ্ছেন, সবার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

এটা ফাতেহের তৃতীয় ঈদসংখ্যা। প্রতি সংকলনেই আমরা নতুন অনেক কিছু শিখছি, ভুল সংশোধনের চেষ্টা চালাচ্ছি। তবু মানুষ বলে কথা, ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতা থেকেই যাবে। পাঠক যদি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন, তাহলে আমরা আমাদের সাহস ও উৎসাহ ধরে রাখতে পারবো। অনেকের দিক থেকে চাপ আছে এবং আমরা বিষয়টা নিয়ে ভাবছি ㅡ আশা করছি আগামী বছর থেকে ঈদসংখ্যার প্রিন্টসংস্করণ বের করতে পারবো। দোয়ায় রাখবেন সবাই।

ভালো থাকুক সময় !

আগের সংবাদবাংলা ইসলামি গান ও জাতীয় কবির অবদান
পরবর্তি সংবাদঅস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ