যাদের হাতে গড়ে উঠেছিল দারুল উলুম দেওবন্দ

এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর:

দারুল উলুম দেওবন্দ। একটি চেতনা। আদর্শিক অবস্থানের প্রাসঙ্গিকতায় জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া একটি সম্ভবনা। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া একটি বিপ্লবের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একটি নীরব আন্দোলনের ঐতিহাসিক সূতিকাগার। মূলত দারুল উলুম দেওবন্দ নিছক একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়; বরং আবশ্যিক দায়িত্ব পালনের নিরলস চেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফর্ম। কর্মের গতি ও পন্থায় কৌশল অবলম্বনের একটি শক্তিশালী ইউটার্ন। দারুল উলুম দেওবন্দ—পিছনে অশ্বত্থ গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে অধ্যায়ের পর অধ্যায়। ইতিহাসের নিখাদ ত্যাগ ও ভালোবাসার সৌধ। স্বপ্ন ও সৃজনশীলতার এক প্রেমময় আখ্যান। এই গতি আর রুদ্ধ হয় না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তেই থাকে এর প্রাসঙ্গিকতা। এবং সময়ের দাবি পূরণে ছাপ রাখে সাহসিকতার। সম্ভাবনা ও দৃঢ়তার। ১৮৬৬ ঈসায়ী সালের ৩০শে মে মোতাবেক ১২৮৩ হিজরির ১৫ই মুহাররম রোজ বুধবার ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলায় দেওবন্দ নামক গ্রামের মহল্লায়ে দেওয়ানে সাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে গড়ে ওঠা একটি দারুল উলুম কি শুধুই একটি প্রতিষ্ঠান ছিল? কিংবা ছিল কি কেবল ধর্মীয় জ্ঞানের দীক্ষা নেওয়ার একটি দ্বীনী শিক্ষালয়? অথবা ছিল কি আরো বহু বছরের পথ ধরে চলে আসা বিচ্ছিন্ন পরম্পরার কোন গতানুগতিক মাদ্রাসা? আর কে বা কার চেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছিল এমন একটি নিষ্কলুষ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান? এবং কার এবং কোন চিন্তা ও চেতনার জোরালো ভূমিকা ছিল এটি অস্তিত্বে আসার? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু থামতে হবে! হাঁটতে হবে কিছুক্ষণ একটু পিছনের দিকে। ইতিহাসের ধুলোপড়া ধুসর খাতা ঝেড়েঝুড়ে পড়তে হবে আমাদের অতীতের পাতা। ইতিহাসের কিছু জীবন্ত অধ্যায়।

১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ। কালের পরিক্রমায় মুঘল সাম্রাজ্য অনেকটাই নেতিয়ে পড়েছে। এখন আর নেই বাদশা আলমগীরের সেই ঐশ্বর্য! স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে বাবরের সেই শক্তিসাহস। এখন হেরেমের দুনিয়াই তাদের কাবু করে রাখে। অদূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞাহীনতার ভারে সর্বত্রই উদার মনোবৃত্তি। সর্বদায় এই ভয় ও শঙ্কায় থাকে মুঘল সম্রাটরা—এই বুঝি গেল রাজত্ব! ঘুণে ধরা রাজত্ব আস্তে আস্তে ধ্বসে পড়ার উপক্রম হয়। এদিকে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন দেশের বণিকদের ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে অনেক বেশি আনাগোনা থাকলেও এবার ভিন্ন চরিত্রের একদল বণিকের আগমন ঘটে। প্রথমে ব্যবসার কথা বলে ইংল্যান্ডের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামক এই বণিকদল ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেও ক্রমশ তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। বণিক বেশী এই শ্বেত ভল্লুকেরা সপ্তদশ শতকের দিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী তৎপরতা শুরু করে। রাজনৈতিক পলিসি ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা তাদের স্বরূপ উন্মোচনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের বিভিন্ন অপতৎপরতা, আগ্ৰাসন ও দখল অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও তাদের দিতে থাকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। এদিকে তারা তাদের সামরিক বাহিনীও প্রস্তুত করে তোলে; এবং আস্তে আস্তে সেটা সুসংহতও করে তোলে। এদিকে বাণিজ্যিক সুবিধার পথ ধরে সর্বশেষ ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব পণ্যদ্রব্যের শতকরা দুই টাকা ছাড়া অতিরিক্ত দেড় টাকা জিযিয়া কর আদায় করার শর্তে গোটা রাজ্যে অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি দিয়ে দেন। এর ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের ওপর তাদের জুলুম, নির্যাতন ও বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রবণতা বাড়তেই থাকে। ১৭৫৬ ইং সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ক্ষমতা লাভ করেন। শুরু হয় ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন।‌ ইংরেজরা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিরোধের জের ধরে শেষে অবধারিত হয়ে পড়ে পলাশীর যুদ্ধ। যুদ্ধে মীর জাফরদের গাদ্দারির কারণে পরাজিত হন একজন চির স্বাধীনতাকামী নবাব। এরপর মীর কাশেম বিদ্রোহ করেন। এর জের ধরে বক্সারের যুদ্ধে ত্রিপক্ষীয় বাহিনী তথা মীর কাশেম, মুঘল সম্রাট শাহ আলম ও সুজাউদ্দৌলা—মুখোমুখি হয় ইংরেজদের। এই বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ পরাধীনতার মূল পর্বে প্রবেশ করে। এরপর তারা দমন করতে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী দলকে। এই পরিক্রমায় রোহিলা খণ্ডের পাঠান রাজন্যবর্গ, মারাঠিদের বিভিন্ন দল-উপদল ও মহিশুরের টিপু সুলতানকে স্বজাতির গাদ্দারির কারণে দমন করতে সক্ষম হয়। সর্বশেষ ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লি দখল করে তারা ঘোষণা করে, আজ থেকে প্রশাসনিক নীতি হবে এমন, “সৃষ্টি আল্লাহর, সাম্রাজ্য সম্রাটের, প্রশাসন নীতি চলবে কোম্পানির।”

এরপর প্রায় দুইশ বছর রাজত্ব করে এই শ্বেত ভল্লুকেরা। যখনই কোনো স্বাধীনতাকামী জেগে উঠেছে তখনই তারা যেকোনো মূল্যে তাকে দমন করে গেছে। এভাবেই শাসন এ শোষণের মাধ্যমে ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় রচনা করে। যেদিন দিল্লি হাতছাড়া হয়ে যায় সেদিন থেকেই ভারতবর্ষে নেমে আসে নৈরাশ্যের অমানিশা। মানুষ এখন স্বাধীনতার প্রশ্নেকে সুদূরপরাহত ভাবতে শুরু করে। স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাবে—এমন কোনো দল আর বাকি রইল না। কিন্তু একটি দল চির আপোষহীন। অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে তারা সাধারণের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা বিলিয়ে যায়। যারা ছিল মুসনাদুল হিন্দ শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভির(১৭০৩-১৭৬৫ ইং) বিশ্বাস ও চেতনায় উজ্জীবিত একটি দল। শাহপুত্র সিরাজুল হিন্দ শাহ আব্দুল আজিজ রহ.(১৭৪৬-১৮২৮ ইং) এর হাতেগড়া স্বাধীনতাকামী দলের মানসসন্তান। এদের দমন করা কখনোই সম্ভব হয়নি।

শাহ আব্দুল আজিজ রহ. যখন দেখলেন মুসলিমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে থাকতে ভুলে যাচ্ছে নিজের অস্তিত্বের স্বরূপ। হারিয়ে ফেলছে দ্বীন ও ধর্মের বাঁধন। জুলুম ও নির্যাতনকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে পিঠ পেতে সহ্য করছে সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার। আস্তে আস্তে মানুষ তাদের ঈমানি চেতনা হারিয়ে ফেলছে। এহেন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে এগিয়ে আসেন এই মহান আলেম। ঘোষণা দেন (১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দ) তার ঐতিহাসিক যুগান্তকারী ফতোয়া‌। তিনি বলেন, “ভারত এখন দারুল হারব (শত্রুকবলিত এলাকা)। সুতরাং প্রতিটি ভারতবাসীর কর্তব্য হল একে স্বাধীন করা।’’

ফতোয়ার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। মুসলমানদের ভেতরে জেগে ওঠে ঘুমন্ত শক্তি। চেতনার সৌরভে উদ্বেলিত হয়ে জড়ো হতে থাকে স্বাধীনতাকামীদের দল। এদের আমীর সাইয়েদ আহমদ শহীদ। শির না নোয়ানো বীর। আদর্শিক চেতনা ও স্বপ্নীল উচ্ছ্বাসকে বুকে ধারণ করে তিনি এগিয়ে চললেন দুঃসাধ্য গতিতে। সঙ্গে আছেন শাহ ইসমাইল শহীদ, মাওঃ আব্দুল হাই, মাওলানা খাইরুদ্দীন, সাইয়েদ মুহাম্মদ জামান খানসহ অসংখ্য বীর সেনানী। শাহ আজিজ রহ. এর আধ্যাত্মিক ও জিহাদি প্রেরণা তার চলার পথের শক্তি। তিনি অল্পদিনের ব্যবধানে একটি বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেন। এগিয়ে চলেন দুরন্ত গতিতে। পাঞ্জাতার, পেশোয়ার, কাবুলসহ অসংখ্য অঞ্চল অল্পদিনেই জয় করে তাতে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদলে হুকুমত কায়েম করেন। কিন্তু স্বজাতির গাদ্দারির কারণে তিনি চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। বালাকোট ময়দানে তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন পথে। কখনো দেখা যায় হাজী শরীয়তুল্লাহর হাত ধরে এই আন্দোলন এগিয়ে যেতে। কখনো দেখা তিতুমীরের হাত ধরে চলতে। তবে বালাকোটের আন্দোলন মৌলিক দিক থেকে তিনটি কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মূল কেন্দ্র ছিল দিল্লিতে। এই কেন্দ্রের নেতৃত্বে ছিলেন শাহ ইসহাক রহ.। তিনি হিজরত করে মক্কায় চলে গেলে এই দায়িত্ব পালন করেন শাহ আব্দুল গণি রহ.। তার মৃত্যুর পর মাওলানা মামলুক আলী রহ.। এরপর দায়িত্ব অর্পিত হয় হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রহ. এর ওপর।

তিনটি কেন্দ্র থেকে ক্রমাগত প্রচার ও প্রসারের কারণে আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে স্বাধীনতাকামীদের বিশাল বাহিনী। এদিকে দেশীয় সৈনিক ও বৃটিশ সৈন্যদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দেশীয় সিপাহিদের মধ্যে ক্রোধের আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে। তাছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন, সামাজিক নিপীড়ন ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহী করে তোলে। একদিকে মুজাহিদের স্বাধীনতার জন্য প্রচার-প্রচারণা, অক্লান্ত ত্যাগে গড়ে উঠা বিশাল বাহিনী অন্যদিকে সেনাবাহিনীর চাপা ক্ষোভের প্রকাশই হল১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া হয় মূলত দুটো কেন্দ্র থেকে। একটি দিল্লির নিকটবর্তী থানাভবন থেকে। যার নেতৃত্বে ছিলেন হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও কাসেম নানুতবী রহ.। তারা একটি স্বাধীন সরকারের ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছিলেন। হাজী এমদাদুল্লাহকে আমীর; গাঙ্গুহী ছিলেন প্রধান বিচারপতি ও কাসেম নানুতবীকে প্রধান সেনাপতি করে এই সরকারের অবকাঠামো ঘোষণা করা হয়। অপর একটি কেন্দ্র ছিল আম্বালায়। জাফর থানেশ্বরী ও মাওলানা ইয়াহইয়া আলী ছিলেন এর নেতৃত্বে। এছাড়াও তখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু দেশীয় ঘাতক ও দালালদের হীন চক্রান্ত ও ইংরেজদের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কারণে এই বিপ্লবও সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। রক্তের বন্যার ওপর ইংরেজরা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে তাদের আধিপত্য।

কিন্তু কেন ছড়িয়ে পড়ল এই বিদ্রোহ? কে দিয়েছিল এর নেতৃত্বে? কারা যুগিয়েছে এর ইন্ধন?—এই প্রশ্নগুলো যখন ইংরেজরা সামনে আনতে চাইল তখন ডঃ উইলিয়াম লিওর রিপোর্ট দেন, “১৭৫৭ সালের গণবিদ্রোহ মূলত— এটা মুসলমানদের আন্দোলন। আর নেতৃত্ব দিয়েছিল আলেম সমাজ। সুতরাং এই বিদ্রোহ নির্মূল করতে চাইলে মুসলমানদের জিহাদি চেতনাকে দমন করতে হবে। আর সেই চেতনার মূলমন্ত্র আল কুরআন ও তার বাহক আলেমদের নির্মূল করে ফেলতে হবে।” এরপর শুরু হয় আলেম-উলামা নিধনের মহোৎসব। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক আলেমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আন্দামান, মাল্টা, সাইপ্রাস ও কালাপানিতে দ্বীপান্তর করা অসংখ্য আলেমকে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় অনেকের। ধর্মীয় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়— দাফন-কাফনের মতো সাধারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞাত কোন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে স্বাধীনতা-আন্দোলন ভিন্ন পথে পরিচালিত করা ছিল সময়ের দাবি। আন্দোলনের জন্য লোক তৈরি ও ধর্মীয় জ্ঞানের ধারাবাহিক সিলসিলা বহাল রাখার জন্য কর্মীর প্রয়োজন ছিল। আর এজন্য প্রয়োজন একাডেমিক ব্যবস্থা। আর এভাবেই শুরু হয় দারুল উলুম দেওবন্দের পথচলা।

সিপাহী বিদ্রোহের পর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি মক্কায় হিজরত করে চলে যান। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী হন গ্ৰেফতার। তবে কাসেম নানুতুবী নিজ দেশেই আত্মগোপনে থাকাকে কল্যাণকর মনে করেন। এরপর যখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয় তখন বেরিয়ে আসেন। এবার তিনি আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। আপাতত সশস্ত্র সংগ্রামের পথে না গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য বলিষ্ঠ চেতনায় উজ্জীবিত ও দ্বীনী আদর্শে অনুপ্রাণিত একদল আত্মত্যাগী নেতা গড়ে তোলার মহান প্রয়াসে কাজ করে যেতে চাইলেন। তাছাড়া ইংরেজরা বিচ্ছিন্ন পথে যেই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল তাও প্রতিহত করা জরুরি ছিল। তারা মূলত চারটি পয়েন্ট ধরে কাজ করে যাচ্ছিল।
১. ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন।
২. ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা।
৩. মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করা।
৪. পারস্পরিক আত্মকলহ এবং জিহাদে বিশ্বাসীদের অবদমিত করে রাখা।

প্রথম পয়েন্টকে বাস্তবায়ন করতে তারা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছিল। সেই সময় সমস্ত মাদ্রাসা ছিল রাষ্ট্রীয় অনুদানে। তারা সেগুলোর রাষ্ট্রীয় অনুদান বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া এগুলোর অধীনে ছিল অনেক জায়গীর। যেগুলোর টাকা দিয়ে এর খরচ যোগাত। ভূমি উন্নয়নের অজুহাতে তারা জায়গীরও বাতিল করে দেয়। এতে করে অর্থের অভাবে অসংখ্য মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া সাধারণের অনুদানে যেগুলো চলত সেগুলোতে বিভিন্ন অভিযোগে বন্ধ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ফলে দেখা যায় যেখানে শুধু দিল্লিতেই এক হাজার মাদ্রাসা ছিল সেখানে পুরো দেশেই মাদ্রাসা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও তারা জোরেশোরে চালিয়ে যায়। দরিদ্রদের টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে; যুবকদের যুবতী নারী দিয়ে; এছাড়াও বিভিন্ন ভাবে তারা এই চেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে কাদিয়ানিদেরকেও তারা রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে যায়। তৃতীয় পয়েন্টেও তারা কিছুটা সফল হয়। তবে চতুর্থ পয়েন্টে তাদের সফলতা ছিল আরও বেশি। রেজা খান বেরলভী ও কাদিয়ানীসহ অসংখ্য ভ্রান্ত দলের তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে। তাই দ্বীনী ইলম ও ইসলামী তাহযীব, তামাদ্দুনকে সংরক্ষণ, বাতিল মতবাদের উপযুক্ত জবাব, ধর্মীয় প্রেরণাকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং ইসলামের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রক্ষার উদ্যোগ নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমের মধ্যে যাওয়ার চিন্তাকে তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন।

দেওবন্দ ছিল কাসেম নানুতুবীর শ্বশুরালয়। সেখানে গেলে তিনি সাত্তা মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। সাত্তা মসজিদের ইমাম ছিলেন হাজী আবেদ হুসাইন। মাওলানা জুলফিকার আলী ও মাওলানা ফজলুর রহমানও এই এলাকারই বাসিন্দা। এই ব্যক্তিবর্গ নামাজান্তে প্রায়শই হাজী আবেদ হুসাইনের কামরায় একত্রিত হতেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের সবসময়ই ভাবিয়ে তোলত। মানুষ গোমরাহির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। সবদিকে দ্বীনবিমুখতা। বিশেষত তারা ইসলামী শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

একদিন হাজী আবেদ হুসাইন ফজরের নামাজ পড়ে ইশরাকের নামাজের অপেক্ষায় মুরাকাবারত ছিলেন। হঠাৎ তিনি ধ্যানমগ্নতা ভেঙে নিজের কাঁধের রুমাল নিয়ে চার মাথা এক করে একটি থলে বানালেন। এবং সেখানে নিজের পকেট থেকে তিন টাকা রাখলেন। এরপর তা নিয়ে তিনি চলে গেলেন মাওলানা মাহতাব আলীর কাছে। তিনি খুশি হয়ে ছয় টাকা দেন। হাজী ফজলুল হকও দিলেন ছয় টাকা। মাওলানা ফজলুর রহমান দিলেন ১২ টাকা। এরপর গেলেন মাওলানা জুলফিকার আলীর কাছে। তিনিও সোৎসাহে দিলেন ১২ টাকা। সেখান থেকে গেলেন দরবেশ সম্রাট ‘আবুল বারাকাত’ মহল্লার দিকে। এভাবেই সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পর তার ঝুলিতে জমা হয়ে গেল তিনশ’ টাকা। বিষয়টি লোকমুখে প্রচার হতে হতে বেশ সর্বত্র চাউর হয়ে গেল। দ্বীনি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ উদ্দীপনা-দেখে মিরাঠে কর্মরত কাসেম নানুতুবীর কাছে এই মর্মে পত্র পাঠান—“আমরা মাদ্রাসার কাজ শুরু করে দিয়েছি। আপনি অনতিবিলম্বে চলে আসুন”। চিঠি পেয়ে হযরত নানুতুবী মোল্লা মাহমুদকে শিক্ষক নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দেন। প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবেও পড়তে আসেন মাহমুদ হাসান। পরবর্তীতে যিনি শায়খুল হিন্দ নামে গোটা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। এভাবেই গণচাঁদার ওপর ভিত্তি করে সরকারি অনুদান ছাড়াই গড়ে উঠে একটি মাহমুদীয় তথা প্রশংসিত প্রতিষ্ঠান। ইসলামী আন্দোলনকে পুনরায় বেগবান করতে, ধর্মীয় চেতনা ও ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুনকে টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হাঁটি হাঁটি পা করে এগিয়ে যায় ‘উম্মুল মাদারিস’ দারুল উলুম দেওবন্দ। আকাবিরে সিত্তার ইখলাস, ত্যাগ ও নিষ্ঠার কারণে একটি দারুল উলুম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। গোটা বিশ্বে ইসলামী চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং ইসলামের সঠিক মর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে দারুল উলুম দেওবন্দ মূলত বেনজির।

সহায়িকা

১. দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান; আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া
২.সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস; সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী
৩. আমরা যাদের উত্তরসূরী; হাফেজ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
৪. দারুল উলুম দেওবন্দ উলামায়ে দেওবন্দ কর্ম ও অবদান; মুফতি মনসুরুল হক সম্পাদিত
৫. জিয়াউর রহমান ফারুকীর বক্তৃতা
৬. দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন অনলাইন প্রবন্ধ-নিবন্ধ

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন