যুগশ্রেষ্ঠ স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী র.-এর জীবন ও অবদান

ড. মীর মনজুর মাহমুদ

ভূমিকা: আল্লামা ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল-কারযাভী র. সমকালীন বিশ্বে অতি পরিচিত এক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর পরিচয় বহুমাত্রিক। তাঁকে মূল্যায়ন করা, তাঁর বহুমাত্রিক অবদান এবং জ্ঞানের গভীরতা পরিমাপের সক্ষমতা আমার নেই। সরাসরি দেখা বা কথা শোনার সুযোগ না পেলেও তাঁর লেখনির খুব সামান্য অংশের সাথে আমার পরিচয়টা একটু পুরাতন। কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন, তথ্যপ্রবাহের যুগে এতো মশহুর এবং বহুল আলোচিত মানুষের জীবন নিয়ে কিইবা কথার সুযোগ আছে? এতো ছোট্ট পরিসরে কেন আজকের এই লেখা? আমার কাছে মনে হয়েছে, পৃথিবী মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য না হওয়ায় এখান থেকে চলে যাওয়াটা এক চিরায়ত রূপলাভ করেছে- যা পরম সত্য। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ক‘জন দাঈ এবং জ্ঞানবিদগ্ধ  মুসলিম ব্যক্তিত্বের বিদায় হয়েছে- যাঁরা নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে কমবেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ড. কারযাবী র-এর ইন্তেকাল গোটা দুনিয়াতে নতুন করে তাঁকে নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে- তিনি কেমন ছিলেন, তাঁর অবদানের ক্ষেত্রেসমূহ ইত্যাদি। ২০১৫ সাল থেকে নিজ দেশের আইন-আদালতে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ডের বোঝা বহনকারী একজন অকুতোভয় দাঈ। সে অবস্থান থেকেই আমাদের কথা বলার কিছু আছে বলে অনুমিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে অধীত বিষয়ের বাইরে জ্ঞানের বিস্তর শাখায় অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি বিচরণ করেছেন-দশকের পর দশক ধরে, উম্মাহর সমকালীন চড়াই-উৎরায়ে উটপাখি বা কেবলই জ্ঞানচর্চার সীমানায় আবদ্ধ না হয়ে সামর্থের মধ্যে ভূমিকা রেখেছেন সম্ভাব্য ক্ষেত্রে; যা আজ তাঁকে কালোত্তীর্ণ, নিজ দেশ তথা হিজরাতকৃত দেশের বাউন্ডারী অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। এতো কিছুর মধ্যেও জ্ঞান-গবেষণায় জীবনব্যাপি নিমগ্ন থেকে নিজের এক আপন ভূবন গড়েছেন। ব্যক্তি ও পরিবারিক জীবনেও সফল একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ হিসেবে চিন্তা-কর্মে সীমাবদ্ধতার বাইরে তিনিও ছিলেন না। সকল কিছুর পরেও তিনি উম্মাহকে দেখিয়েছেন সমকালীন বাস্তবতায় ভাবনা-চিন্তা ও চলার পথের দিশা। আজকের এ প্রবন্ধে সবিস্তার আলোচনার জন্য নয়; বরং সংক্ষিপ্তাকারে কিছু বলার প্রয়াসমাত্র।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়: আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী (১৯২৬ খ্রিঃ-২০২২ খ্রিঃ) ছিলেন একজন মিশরীয় ইসলামি সুপণ্ডিত। তিনি একজন স্বনামধন্য কবি। নিজস্ব কাব্য বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি আরব বিশ্বে সুপরিচিত। জন্ম ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। মৃত্যু ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিঃ। প্রায় শত বছরের জীবনলাভ করেছেন তিনি। জন্মস্থান মিসরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে। দুই বছর বয়সে বাবা ইন্তিকাল করলে চাচা তার লালন-পালন করেন। দশ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন আল-আজহার কারিকুলামে। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ১৯৭৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি মিশর ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড এর পরামর্শক ছিলেন। তাকে ব্রাদারহুডের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মনে করা হতো। তাঁকে দু‘বার দলটির মুর্শিদে আমের প্রস্তাব করা হলে তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি নিজেকে দলটির রূহানী শিক্ষক হয়ে ভূমিকা পালনকে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি ইসলামি পন্ডিতদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইত্তেহাদুল আলামীলি উলামাইল মুসলিমীন এর সভাপতি ছিলেন।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ইসলামের একজন সক্রিয় কর্মী। এর জন্য তাঁকে ১৯৪৯, ১৯৫৪-১৯৫৬ এবং ১৯৬৫ সালে কারাবরণ করতে হয়। আরব ও মুসলিম দেশ সমূহের প্রতি পাশ্চাত্য বিশ্বের বিশেষ করে আমেরিকা ও বৃটেনের পররাষ্ট্র নীতির জন্য তিনি তাদের একজন কঠোর সমালোচক। একই সাথে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ইসরাঈলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ, একপেশে ও নিঃশর্ত সমর্থনের তিনি তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করেন। ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগণের মতামতকে শাণিত করতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। তিনি একজন মানবাধিকারের প্রবক্তা। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের সপক্ষে তিনি সোচ্চার যা তার বিভিন্ন লেখনীতে প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি কাতারের আমীরের মহানুভবতায় সেখানে সম্মানজনক অবস্থানের অনুমতি এবং নাগরিকত্বলাভ করে যেমন ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হয়েছেন। তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি উপকৃত হয়েছে এই ক্ষুদ্র মরুদেশটি। এটির আজকের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের পেছনে এ মহান মনীষীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান আছে বলেই আমরা জানতে পেরেছি। একই সাথে মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা, জ্ঞান-গবেষণা, আধুনিক চিন্তা ও মনন সৃষ্টিতে তিনি যুগের নবীকের ভূমিকা পালনের সুযোগ লাভ করেছেন।

কর্ম জীবনের খন্ডচিত্র: মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে শুরু করেন। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘Board of Religious Affairs’ এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি কাতারে প্রথম পাড়ি জমান। ১৯৭৩ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডীন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’।

১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন। তিনি জর্ডানের রয়্যাল অ্যাকাডেমি ফর ইসলামিক কালচারাল অ্যান্ড রিচার্জ (Royal academy for Islamic culture and research), ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ড এর সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আল্লামা কারযাভী র. এর মূল্যায়ন: আমরা জীবিত মানুষের মূল্যায়ন করতে সাহস পাই না বা অভ্যস্তও নই। এটি আমাদের দেশে কেবল নয়; গোটা দুনিয়া বিশেষত মুসলিম সমাজের চিত্র প্রায় অভিন্ন। তাঁর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে দু‘একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করছি।

শায়খ প্রফেসর ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল কারযাভি (১৯২৬-) মিশরীয় বংশোদ্ভূত একজন প্রভাবশালী আধুনিক ইসলামি তাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ। তিনি সাধারণ মানুষ বা পৃথিবীর বিশেষ কোনো এলাকা যেমন, শুধু আরব বিশ্ব, ইউরোপ-আমেরিকা, এশিয়া-আফ্রিকা নয়; বরং দুনিয়াজোড়া স্বীকৃত আলিম হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। শায়খ বিন বায র., শায়খ আলবানী র., মুফতী তকী উসমানী সহ সমকালীন আরব-অনারব আলীমগণের কাছে তিনি অতি বড় মাপের একজন আলিম হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত ছিলেন।

  • আল্লামা তকী উসমানী বলেন, “প্রকৃতপক্ষে, সংক্ষিপ্ত এবং দীর্ঘ কলেবরের শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা ড. কারযাবী র. তাঁর লেখনির মাধ্যমে ইসলামী সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে সমসাময়িক মুসলিম জীবনের এমন কোনো অংশ নেই যে বিষয়ে তিনি তাঁর লেখায়, খুতবায় এবং লেকচারে আলোচনা করেননি। কেবল অল্পসংখ্যক লেখক এবং দাঈ-এর ক্ষেত্রে এমন দাবী করা চলে।”[1]
  • অনেকের দৃষ্টিতেই তিনি সমকালীন মুজাদ্দিদ ছিলেন। প্রখ্যাত দাঈ ড. ইয়াসীর কাদীরের ভাষায় তিনি মুজাদ্দিদগণের মুজাদ্দিদ ছিলেন।
  • আল্লামা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ জাফরী-এর ভাষায়, তিনি ছিলেন যুগের ইমাম, আলেমে রব্বানী, আকলান ও নাকলান পন্ডিত, উম্মাহর সংস্কারক ছিলেন।
  • তাঁর অবদান নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম আলজাজিরার ভাষ্যমতে, Al-Qaradawi was one of the world’s most influential Muslim scholars, and a vocal advocate for Palestinian liberation as well as for the Arab revolutions of 2011. His passing at the age of 96 brings to a close the career of one of the most important Muslim scholars of the last century. Al-Qaradawi’s written style was highly accessible – he steered away from the relatively obscure language of pre-modern Islamic legal manuals to write a book that could be read and understood by the lay reader. In addition to his lucid prose, al-Qaradawi would show himself to be unusually prolific, authoring more than 100 works over the course of his career. [2]

তাঁর তিন পুত্র ও চার কন্যা রয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তার কন্যা ইলহাম ইউসুফ আল কারযাবী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী। তার পুত্র আব্দুর রহমান ইউসুফ আর কারযাবী  মিশরের একজন কবি ও রাজনৈতিক কর্মী।

জ্ঞানসাধনার জগতে প্রভাবিত ছিলেন যাঁদের দ্বারা: ইমাম ইবনে তাইমিয়া র., ইমাম ইবনুল কাইয়িম র., আল্লামা সৈয়দ রশিদ রিদা র., হাসান আল-বান্না র., ড. গাজালী র., সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী র., সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী র. এবং নাঈম সিদ্দিকী এর চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভের কিছু অন্যতম মাধ্যম: আল্লামা কারাযাভী র. একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান, একজন বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী (Polymathic Knowledge) যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস। ধারণা করা হয়, আল জাজিরা টেলিভিশনে ‘শরীয়াহ এবং জীবন’ নামক তার অনুষ্ঠান তাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলেন, যেটির আনুমানিক দর্শক ছিল ৪০-৬০ মিলিয়ন। তিনি Islam Online নামক একটি ওয়েবসাইটের জন্যও পরিচিত, যা তিনি ১৯৯৭ সালে খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিলেন এবং তিনি এটির প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে কাজ করেন। ড. কারাযাভী  পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, আরব ও মুসলিম দেশসমূহ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার এসেছেন।

আমি মনে করি, বিশ্বব্যাপী তাঁর পরিচিতির জন্য উল্লিখিত কারণের সাথে আরও কয়েকটি জিনিস যোগ হতে পারে। যেমন, যুগজিজ্ঞাসার জবাবমূলক গুরুত্বপূর্ণ লেখনি, দুনিয়াব্যাপি দাওয়াহ কাজের সাথে সম্পৃক্তি, উম্মাহর জীবনের নেমে আসা সমকালীন সমস্যার সাথে নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্পৃক্তকরণ, সুদীর্ঘ হায়াতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার অসীম দয়া ও করম এর পিছনে কাজ করেছে।

পুরস্কার ও সম্মাননা: আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী র. জ্ঞানসাধনার জীবন যাপন করেছেন। নিজ দেশ মিসর থেকে হিজরাতের আগে ও পরে তাঁর স্পষ্টবাদিতা এবং প্রবল সম্ভাবনাময় মনীষা স্বতন্ত্র এক বিশেষ উচ্চতা স্পর্শ করেছিল। ফলে জীবনে সব সময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। তারপরও তাঁর অবদানকে স্বীকার করেছেন অনেকেই। সে অবস্থার মধ্যে কেউ তাঁর অনন্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং কেউ আবার তাঁকে সম্মানিত করার মধ্যদিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানকে ধন্য করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  • ১৯৯০ (১৪১১ হিজরীতে) সালে ইসলামি অর্থনীতিতে অবদানের জন্য তিনি আইডিবি পুরস্কার লাভ করেন
  • ১৯৯২ (১৪১৩ হিজেরীতে) সালে ইসলামি শিক্ষায় অবদানের জন্য মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
  • ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে হাসান বাকলি পুরস্কারে সম্মানিত করেন।

গবেষণা ও প্রকাশনা: আল্লামা কারযাভী র.’র রচনার ভাষা মূলত আরবি। তাঁর রচিত মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ১৫০ এর কাছাকাছি। আর অন্যান্য মিলে ২ শতাধিক। ইসলামে দারিদ্র বিমোচন, ইসলামের যাকাত বিধান, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইসলামের হালাল হারামের বিধান অন্যতম। তবে ইসলামের হালাল হারামের বিধান এই বইটি তাঁর বিশেষ রচনা হিসেবে স্বীকৃত।  তন্মধ্যে অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ যেমন,

বাংলা ভাষায় অনূদিত উল্লেখযোগ্য বইসমূহ:

সুন্নাহর সান্নিধ্যেজেরুজালেম বিশ্ব মুসলিম সমস্যা
ইসলামি পুনর্জাগরণ : সমস্যা ও সম্ভাবনাইসলাম ও মানবিক মূল্যবোধ
ইসলামে হালাল হারামের বিধানআমাদের দাওয়াত: জীবনবিধান ও ইসলাম
ঈমান ও সুখমানুষ মর্যাদা ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য
বুদ্ধিদীপ্ত জাগরণের প্রত্যাশায়উমর ইবনে আবদুল আজিজ
ইসলামের বিজয় অবশ্যম্ভাবীআলিম ও স্বৈরশাসক
আধুনিক যুগ ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচীইমাম হাসান আল বান্না
ইসলাম ও চরমপন্থাইসলামের ব্যাপকতা
ইসলাম ও শিল্পকলাতাকফির: কাফির ঘোষণায় বাড়াবাড়ি ও মূলনীতি
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগইমাম বান্নার পাঠশালা
ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাঅর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে যাকাতের ভূমিকা অন্যতম।
ইসলামে দারিদ্র বিমোচনইসলামে এবাদতের পরিধি
ইসলামের যাকাতের বিধান ১ম ও ২য় খণ্ডমমিন জীবনে সময়
দাঈদের জ্ঞান চর্চামমিন জীবনে পরিবার
মধ্যমপন্থামুসলিম যুবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

 

আল্লামা কারযাভী র.-এর জীবনদর্শন ও অবদানের কয়েকটি মৌলিক দিক: এ বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা করার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি। কারণ তাঁর কাজ চলমান ছিল ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত অনেক পান্ডুলিপি, সমাপ্ত-অসমাপ্ত কাজের হিসাব পেতে সেজন্য কিছু সময় প্রয়োজন হবে সঙ্গত কারণেই। তবে তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে নিম্নের বিষয়গুলো শিক্ষা হিসেবে নেয়া যেতে পারে:

১. দু‘বছর বয়সে ইয়াতীম হয়েও জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে থাকেননি। মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছেন জীবনব্যাপী জ্ঞানসাধনার মধ্যদিয়ে।

২. শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে সত্যের পথে অবিচল থেকেছেন।

৩. সত্যপ্রকাশে কখনও দ্বিধান্বিত হননি।

৪. জ্ঞানচর্চা ও সমাজ সচেতনতা ক্ষেত্রে উটপাখির চরিত্র অনুসরণ করেননি।

৫. চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে উদারতার নীতি অবলম্বন করেছেন; অত্যন্ত নিখুঁত ও জ্ঞাতসারেই অন্ধ তাকলিদ, মাজহাবি গণ্ডি এবং প্রাচ্য প্রতিচ্যের ভাব দর্শনের ছায়া থেকে নিজকে সরিয়ে রেখেছেন।

৬. উম্মাহর জ্ঞানচর্চার জগতে অতীত ও বর্তমানের সার্থক সেতুবন্ধকের ভূমিকা পালন করেছেন।

৭. তিনি তার লেখনীর তথ্য উপাত্ত নিতে ইসলামের মৌলিক গ্রন্থাবলির কাছেই গেছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরত সালাফে-সালেহিনের কর্মপন্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল বিষয়ের আলোচনা  ও অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

৮. তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই চিন্তা দর্শনে মধ্যপন্থা, প্রায়োগিক পর্যায়ে সহজতা ও দাওয়তি ক্ষেত্রে ইনসাফ এবং কোমলতা অনুসরণ করেছেন। ফলে তার সিদ্ধান্তগুলো কোনো রকম বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির রোগমুক্ত হয়ে উঠেছে।

৯. তার লেখনী, বক্তৃতা, ডিবেট, আলোচনা সবটাতে একজন দাঈ ইলাল্লাহের ভাষা, একজন মুরব্বির আদর এবং একজন একনিষ্ঠ ইসলামপ্রেমীর ভালোবাসার বন্যা বয়ে যায়।

১০. ইসলামী ফিকহের যে ডাইমেনশন তিনি রচনা করেছেন তাতে মৌলিকত্ব, আধুনিকতা, ইজতিহাদ ও যুক্তির প্রাচুর্য যুগপৎভাবে ফুটে উঠেছে।

১১.  ড. কারযাভী আধুনিক ফিকহ ও ফাতওয়ার মিছিলকে একটি নতুন মহাসড়কে প্রতিস্থাপন করেছেন। তিনি ফিকহের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘আলমাইসিরুল ফিকহ’ অথবা ‘তাইসিরুল ফিকহ’ তথা ইসলামী ফিকহকে সহজীকরণ করা ও ইসলামী ফাতওয়াগুলোতে কোমলতার ছায়া দেয়া।

১২. তিনি সময়ের সেরা দাঈদের একজন। পৃথিবীময় চষে বেড়িয়েছেন, সেরা মসজিদগুলোতে খুতবা দিয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে অংশ নিয়েছেন, নানান পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, অনলাইনে ইসলাম প্রচার শুরু করেছেন, মিডিয়ার সবগুলো আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েছেন এবং পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলতে নিরন্তর কাজ করেছেন।

পরিশেষে দ্বিধাহীনচিত্তে বলতে হয়, তিনি প্রখর মেধাশক্তি সম্পন্ন একজন নিরলস জ্ঞানতাপস মানুষ ছিলেন। মানবীয় সীমাবদ্ধতার উপরে তিনিও ছিলেন না। তাঁর বিশাল কর্মপরিসরের সকল ক্ষেত্রে কেউ একমত নাও হতে পারেন। তবে তাঁর বিরাট মনীষাকে খাটো করে দেখার সুযোগ কোনোভাবেই নেই। আমরা উদ্দীপ্ত হতে চাই, কর্মস্পৃহা পেতে চাই- তাঁর জীবনকর্ম থেকে। সত্যই যেন তাঁর মহান রবের কাছে তিনি এই দুআ-ই যেন করেছিলেন, “তোমার কাজের মাঝে আমায় ভোলা সহজ হবে স্বামী”। হ্যাঁ, তিনি কপালে কর্মব্যস্ততার ঘাম নিয়েই মহান রবের সাথে সাক্ষাত করলেন, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ খ্রিঃ। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল অবদানকে কবুল করুন। আমীন।

[1] . তকী উসমানী, শাইখ আল কারযাভীকে যেমন দেখেছি, সঞ্চারণ, ঢাকা; মুসলিম বিশ্বের সমসাময়িক ৭০ আলিমের লেখা ইউসুফ আল কারযাভীর মূল্যায়নের উপর ১০৪০ পৃষ্ঠার একটি আরবী সংকলন থেকে অনূদিত।

[2] . Yusuf al-Qaradawi, the Muslim scholar who influenced millions, https://www.aljazeera.com/news /2022/9/27/ yusuf-al-qaradawi-the-muslim-scholar-who-influenced-millions.

লেখক – নির্বাহী পরিচালক, সিএডিটি

আগের সংবাদইউসুফ কারজাবীর বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা : ইয়াসির কাদীর পর্যালোচনা
পরবর্তি সংবাদকেমন হলো ময়মনসিংহের ইসলামি বইমেলা?