যেভাবে ধ্বংস করা হলো চামড়াশিল্প

|| তাসনিফ আবীদ ||

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ‘চামড়শিল্প’। এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানিখাতেও। কমছে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের পরিমাণ। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের চামড় ব্যবসায়ী, দেশের এতিমখানা, কওমি মাদরাসা ও অসহায় মানুষজন। ২০১৬ সালের পর থেকে এই শিল্পের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

সঠিক দাম পান না কোরবানিদাতারা-

কোরবানির চামড়ার বর্তমান বাজার দর নিয়ে কী ভাবছেন সাধারণ মানুষরা? এ বিষয়ে আমাদের কথা হয় রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা হামিম শাহের সঙ্গে। তিনি বলেন, বছর দশেক আগেও প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম গড়ে ১৫০০ টাকা থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে এটি গড়ে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে।

‘সরকারের পক্ষ থেকে যে দাম নির্ধারণ করা হয়, সঠিক তদারকি না থাকার কারণে সেই দামও আমরা পাই না। এর ফলে আমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজের অসহায় মানুষরা। কেননা চামড়া বিক্রি করার পর আমরা তো সেই টাকা তাদেরকেই দিয়ে দিই।’ –বলেন তিনি

ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন বলেন, ১০ বছর আগে একটা গরুর চামড়া তিন হাজার থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যেতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং বর্তমানে বলা যায় চামড়ার কোন মূল্যই নাই। গত ১০ বছরে দেশের সবকিছুর দাম বেড়েছে। কমেছে শুধু চামড়ার দাম।

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কওমি মাদরাসাগুলো-

একটা সময় দেখা যেত অনেকটা উৎসবের মতো করে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে চামড়া কালেকশন হতো। ছাত্রদেরকে ছুটি না দিয়ে ঈদে মাদরাসায় রেখে দেওয়া হতো। ঈদের এক দুই দিন পরে ছাত্র-শিক্ষকরা বাড়ি যেত। তাদের পরিশ্রমে মাদরাসায় ফান্ডে জমা হতো মোটা অংকের। যা দিয়ে মাদরাসাগুলো বেশ ভালোভাবেই বছর পার করতে পারতো। কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই।

রাজধানীর ভাটারার জামিয়া ইসলামিয়ার মুহতামিম মুফতি মিসবাহ উদ্দীন বলেন, চামড়ার সঠিক দাম না পাওয়ার কারণে কওমি মাদরাসাগুলো চামড়া কালেকশনের পথ থেকে ক্রমেই সরে আসছে। এখন দেখা যায় অধিকাংশ ছাত্রদেরকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অল্পকিছু ছাত্র ও শিক্ষকরা মিলে এই কালেকশন করে। অনেক মাদরাসা তো চামড়া কালেকশন একেবারেই বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়ের অন্যকোনো উৎসের দিকে মনোযোগী হচ্ছে।

লাভে আছে কারা-

মৌসুমী ব্যবসায়ী, কোরবানিদাতা ও বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতি বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা শত শত কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং এখন কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নিচ্ছে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা। সব মিলিয়ে প্রত্যেক সিজনে হাজার কোটি টাকা ঢুকছে তাদের পকেটে।

জটিলতা যেখানে-

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক জিয়া হাসান দেশের চামড়াশিল্পের বিপর্যয়ের কারণে দেশের মাদরাসাগুলো চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে চামড়াশিল্পের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেন।

তার গবেষণা মতে, সরকার চামড়াশিল্পকে পরিবেশসম্মত ও বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ঢাকার অদূরে সাভারে চামড়া শিল্প নগরী স্থানান্তর করেছে। লম্বা একটা সময় পেরিয়ে গেলেও সেখানে সেন্ট্রাল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পরিপূর্ণভাবে চালু করা হয়নি। চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ কারখানারই কমপ্লায়েন্স নেই। কমপ্লায়েন্স না থাকায় এসব কারখানার বৈশ্বিক মান (এলডব্লিউজি) লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ নেই। এই সনদ প্রাপ্তির পূর্ব শর্ত হলো ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন, যা কারখানার দূষিত বর্জ্যকে পরিবেশ উপযোগী করে তোলে। সনদ না থাকার কারণে ইউরোপ আমেরিকার মতো ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ওইসব দেশে ঢুকতে পারছে না। যদি ২০-৩০টি ট্যানারিও এলডাব্লিউডি সার্টিফায়েড হতো, তাহলেও এরকম পরিস্থিতি থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসা যেতো।

তাছাড়া চামড়াশিল্পকেন্দ্রিক আমাদের দেশে বেশকিছু সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট যদি ভাঙা যায় তাহলে এই শিল্প আশার আলো দেখবে। আর এর জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

চামড়াশিল্পে ধ্বংসের নেপথ্যে ২৯টি কারণ-

দীর্ঘ গবেষণা থেকে এই শিল্প ধ্বংসের ২৯টি কারণ বের করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণগুলো হচ্ছে- ১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ২. সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ শেষ না করে কারখানা স্থানান্তর করা, ৩. সাভারে ট্যানারিপল্লীতে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করা, ৪. নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও সময়মত গ্যাস সংযোগ দিতে না পারা, ৫. লোডশেডিং, ৬. জেনারেটর ব্যবস্থা ভালো না হওয়া, ৭. সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা, ৮. চামড়া কাটার পর বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে সেটি নির্ধারণ করতে না পারা, ৯. জমির দলিল হস্তান্তরসহ নানা বিষয় নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব, ১০. তিন বছরেও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা, ১১. কারখানা স্থানান্তরের পরও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে না পারায় রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়া, ১২. হাজারীবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে মাত্র ১৫০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া, ১৩. প্লট না পাওয়া ৫৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় এসব কারখানার শ্রমিকদের বেকার হয়ে যাওয়া, ১৪. অবৈধ পথে চামড়া পাচার, ১৫. বিশ্ব বাজারের দরপতনে দেশের চামড়া শিল্পের অবস্থান আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হয়ে যাওয়া, ১৬. টানা কয়েক বছর ধরে চামড়া রফতানি আয় কমে যাওয়া, ১৭. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের আধুনিকায়নে সামঞ্জস্যতা না থাকা, ১৮. চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, ১৯. বিশ্ববাজারে চামড়ার জুতার পরিবর্তে সিনথেটিক বা কাপড় জাতীয় জুতার আগ্রহ বৃদ্ধি, ২০. চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়া, ২১. চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে না তোলা, ২২. ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কারখানার পরিবেশ উন্নত না করা, ২৩. চাহিদার তুলনায় ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, ২৪. পুঁজি সংকট, ২৫. দক্ষ শ্রমিকের সংকট, ২৬. গতবারের চামড়া এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে না পারা, ২৭. আগের বছরের সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাওয়া, ২৮. নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট এবং ২৯. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।

চামড়াশিল্পে গতি ফেরাতে বাড়াতে হবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি-

বিশ্লেষেক ও গবেষক প্রফেসর মমতাজ উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, চামড়াশিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো। এর জন্য যা যা প্রয়োজন তা সরকারকে করতে হবে। রপ্তানি বাড়লে বাজার দর বাড়বে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আমাদের সম্ভাবনা কম নয়। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বিদেশে বাংলাদেশী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের খুব ভাল চাহিদা রয়েছে। আমরা সেই চাহিদা কাজে লাগিয়ে আমেরিকা, ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য, স্পেন, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানের বাজার ধরতে পারি।

‘গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে গিয়েছিলেন। জাপান বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াশিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের আগ্রহে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এখন প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে সেই চাহিদা কাজে লাগিয়ে দেশের চামড়াশিল্পকে সচল করা। সেটি করলে বাংলাদেশ এই বিশাল চামড়া ব্যবসায় ও শিল্প খাতে লাভবান হতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার এবং চামড়াশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করে সঠিকভাবে যদি এই শিল্পকে যত্ন নেওয়া না হয়, তাহলে দেশের হারিয়ে যাওয়া শিল্পগুলোর তালিকায় যুক্ত হবে ‘চামড়াশিল্প।’ কেননা সিন্ডিকেট, অনিয়ম আর কালো প্রভাবের কারণে অনেকেই এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া দিন দিন মাদরাসাগুলোও তাদের ভিন্ন আয়ের খাত খুঁজে নিচ্ছে।

আগের সংবাদএবার কেমন যাবে চামড়ার মূল্য
পরবর্তি সংবাদগাজা যুদ্ধ সত্ত্বেও ইসরাইলে রপ্তানি বাড়িয়েছে মিশর, আরব আমিরাত ও জর্দান