যেমন ছিলেন অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ চৌধুরী

যুবাইর ইসহাক

অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সাবেক মহাপরিচালক। লেখাপড়া করেছেন কওমি ও জেনারেল ধারায়। শিক্ষকতাও করেছেন উভয় ধারাতেই। এক বর্ণাট্য জীবন শেষে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ গত শুক্রবার সাত এপ্রিল ইফতারের মুহূর্তে ইন্তেকাল করেন।

জন্ম

অধ্যাপক জোবায়ের আহমদ চৌধুরী ১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহরের শাহ মোস্তফা রোডস্থ বাসায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আবদুর নূর। তিনি প্রখ্যাত আলেম ও শায়খে কৌড়িয়ার বিশিষ্ট খলিফা ছিলেন।
তার মাতা কারী রুহেলা খানম চৌধুরী।

শিক্ষা

অধ্যাপক জোবায়ের আহমদ পিতার কাছে ১৯৬৬ সালে মৌলভীবাজারের আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন।
পরবর্তীতে ঢাকার আশরাফুল উলূম মাদরাসা, জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসা ও জামিয়া হোসাইনিয়া আরাবিয়া গহরপুর মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। ১৯৭২ সালে জামেয়া আনোয়ারুল উলুম বরুণা মাদরাসা থেকে ১ম স্থান অধিকার করে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি সোনামুড়ি আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল সমাপ্ত করেন।

কর্মজীবন

অধ্যাপক জোবায়ের আহমদ কর্মজীবনে বহু মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। লেখাপড়া সমাপ্ত করে, ১৯৭৩ সালে নেত্রকোনার মৌ মাদরাসার মধ্য দিয়ে তার শিক্ষকতা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজার ডিগ্রী কলেজে ইসলামিয়াত ও ইসলামিক হিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৯০ সালে মৌলভীবাজার জামেয়া দ্বীনিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন। তিনি সেখানে সদরুল মুহাদ্দীস ছিলেন। ১৯৯৫ সালে বর্ষিজোড়ায় হাফিজিয়া মদীনাতুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯৯৭ সাল থেকে এই মাদরাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি কমলগঞ্জের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হাদিস মুন্সিবাজারের শায়খুল হাদিস হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।

২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহকারি মহাপরিচলকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৬ সালে বেফাকের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ হন, ২০২২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনীতি

অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ ছাত্রজীবনে জমিয়তে তোলাবায়ে আরাবিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত খেলাফত মজলিসের মৌলভীবাজার জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের দিকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২১-২২ সেশনে দলের সিনিয়র আমির হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ২০২৩ সালে খেলাফত মজলিসের আমির নির্বাচিত হন, আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করেন।

পরিবার

অধ্যাপক জোবায়ের আহমদ চৌধুরী ১৯৭৬ সালে বর্ষিজোড়া টিলাবাড়ির ডা: মাওলানা আ.ফ.ম আবদুল বারীর কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ফুফাতো বোনের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সাংসারিক জীবনে তিনি চার ছেলে-তিন মেয়ের বাবা।

রচনা

মাওলানা জোবায়ের আহমদ ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে তাফসীর গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইফা থেকে প্রকাশিত তারযুমানুস সুন্নাহ ২য় খণ্ডের অনুবাদ করেন। তাছাড়া তিনি ইসলামী বিশ্বকোষের একজন অনুবাদ ও নিবন্ধকার ছিলেন।

কেমন ছিলেন তিনি

বেফাকের সহকারী মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের ফাতেহকে জানান, ‘অধ্যাপক জোবায়ের আহমদ পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। অফিসের সবগুলো শাখায় তার জানাশোনা ছিল। আমি তাকে অল্প দিন পেয়েছি। অফিসিয়াল কাজে তার মধ্যে দক্ষতার কোন ঘাটতি ছিল না।’

খেলাফত মজলিস মৌলভীবাজার জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা জিয়া উদ্দীন ফাতেহকে বলেন, ‘মাওলানা জোবায়ের আহমদ ছিলেন বিচক্ষণ,শিক্ষাবিদ, নীতিতে অটল। কোনো অনিয়ম মেনে নিতে পারতেন না। তার জীবন যাপন ছিল খুব সহজ, স্বাভাবিক। সহজে তার সঙ্গে মেশা যেত। কোনো বিষয়ে আলোচনা করা যেত।সাংগঠনিক হিসেবে কর্মঠ, কর্মীবান্ধব ও আন্তরিক ছিলেন।

মাওলানা জোবায়ের আহমদ চৌধুরীর ছাত্র মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ জানান, ‘আমাদের উস্তাদ সদালাপী ও আন্তরিক ছিলেন। সহজে আপন করে নিতেন যে কাউকে। শিক্ষক হিসেবে দক্ষ ও যোগ্য ছিলেন। তার প্রতিভা ছিল বহুমূখী, সফল সংগঠক, দক্ষ রাজনৈতিক ও যোগ্য শিক্ষক। তার আচরণে বংশীয় আভিজাত্য প্রকাশ পেত।’

মাওলানা জোবায়ের চৌধুরীর ছেলে ইমতিয়াজ আহমদ চৌধুরী মুরাদ ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের বাবা সদাসর্বদা দ্বীনের প্রতি উৎসর্গিত ছিলেন। হাদীস কীভাবে সহজে মানুষ বুঝতে পারে, এ চেষ্টা করেতেন। হাদীসের উপর একটি গবেষণাগ্রন্থ তৈরি করেছিলেন, যা প্রকাশ করে যেতে পারেন নি।

‘পিতা হিসেবে আমরা তাকে আদর্শবান পেয়েছি। তিনি আমাদেরকে ন্যায়পরায়ণতা, সত্যের উপর অটলতার শিক্ষা দিতেন। ব্যক্তিজীবনে প্রচারবিমুখ ছিলেন। বাসায় এলে আমাদের সময় দিতেন। দূরে থাকলেও নিয়মিত খোঁজ নিতেন।’

জানাজা ও দাফন

৮ এপ্রিল বিকেল তিনটায় মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ চৌধুরীর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তাকে বর্ষিজোড়া টিলাবাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আগের সংবাদকেমন ছিলেন মুফতি নূর আহমদ
পরবর্তি সংবাদচার শতাব্দী পুরোনো মসজিদ : বরুণা বড়ো জামে মসজিদ