মুনশী নাঈম:
আল্লামা রহমাতুল্লাহ কিরানবির লেখা ‘ইযহারুল হক’ প্রকাশের দেড়শ বছর পার হয়ে গেছে। বইটিকে বলা হয় ইসলাম সম্পর্কে খৃস্টান মিশনারীদের উত্থাপিত সন্দেহের অপনোদন বিষয়ক সবচে বিখ্যাত কিতাব। এটি সমসাময়িক খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক কার্ল গট্টলিয়েব ফেন্ডার কর্তৃক আরবি ভাষায় রচিত ‘মিজানুল হক’ নামক বইয়ের জবাব হিসেবে লেখা হয়। মূল বইটি আরবিতে লেখা হলেও ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে।
যে পরিস্থিতিতে ও প্রেক্ষাপটে বইটি লেখা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট এখনও আছে। খৃস্টান মিশনারীদের প্রচারণার জবাব হিসেবে বইটি আজও হতে পারে আলোকবর্তিকা। লেখক রহমাতুল্লাহ কিরানবি এই বইটির জন্যই বিখ্যাত। লেখকের জীবনের সংক্ষিপ্ত আলাপ এই লেখায় তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
মাওলানা মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বিন খলিল রহমান কিরানবি উসমানি হিন্দি ১৮১৮ সালে কিরানা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত। তাকে উসমানি বলা হয়। কারণ, তার বংশ ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান বিন আফফান রাজি.-এর কাছে গিয়ে শেষ হয়। উসমান রাজি. তার ৩৪ তম পুরুষ।
শায়খ কিরানবি বিশিষ্ট আলেম পরিবারে বেড়ে উঠেন। তিনি কুরআন হেফজ করেন ১২ বছর বয়সে। পরিবারের আলেমদের কাছেই পড়েন ফার্সি, আরবি, ফিকহ। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য দিল্লিতে যান।
দিল্লিতে পড়াশোনা শেষ করে যান লখনৌ। সেখানে তিনি মুফতি সাদুল্লাহ মুরাদাবাদির কাছে ইলম শিক্ষা করেন। এখানেই তিনি ফিকহ ও ইলমে শরিয়ায় বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন।
খ্রিস্টানাইজেশন প্রতিরোধ
শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি কিরানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ দখলদারিত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সুরক্ষায় খৃস্টান মিশনারীদের দৌরাত্ম তাকে ভাবিয়ে তুলে। তিনি খৃস্টবাদ প্রচারণার মোকাবিলায় নিজেকে দাওয়াতের ময়দানে সঁপে দেন। খৃস্টান ধর্মপ্রচারকদের দাবিকে বাতিল প্রমাণ করতে এবং তাদের সন্দেহের জবাব দিতে ছুটে যান এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। লিখেন বই, পাঠান চিঠিপত্র। এমনকি খৃস্টান ধর্মপ্রচারকদের বিতর্কে আহ্বানও জানান।
ইজহারুল হকের ভূমিকায় তিনি লিখেন, ব্রিটিশরা ভারতে অধিপত্য বিস্তার করার পর ৪৩ বছর পর্যন্ত তারা তাদের ধর্মের দিকে কাউকে আহ্বান করেনি। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার পাটি সন্তোষজনকভাবে বিস্তৃত করছিল। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে তারা তাদের ধর্মের দিকে আহ্বান করতে থাকে। ইসলামি বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। এ সম্বন্ধীয় বই তারা ছড়াতে থাকে বিনামূল্যে। বাজারে, পথেঘাটে, এমনকি মসজিদের সামনেও।
মুসলিমরা দীর্ঘদিন তাদের প্রচারণায় কান দেয়নি। কিন্তু একসময় দুর্বল ঈমানের লোকেরা কান দিতে শুরু করে। অনেকে কান না দিলেও আশঙ্কা তৈরী হয়। তখন আলেমরা ইসলামের স্বপক্ষে এবং খৃস্টান মিশনারীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে কথা বলতে শুরু করেন। আমি ছিলাম ঘরকুনো। বক্তৃতাতেও ছিলাম না পারদর্শী। কিন্তু আলেমদের বয়ান-বক্তৃতা শুনে, তাদের লেখালেখি দেখে আমার মনে হলো, এই ময়দানে আমারও কাজ করা দরকার।
তৎকালীন সময়ে খৃস্টানদের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে সক্রিয় ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে একজন ছিলেন জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজক কার্ল গটলিব ফান্ডার। তিনি ইংরেজ দখলদার সৈন্যদের সুরক্ষায় বাজারে, ফোরামে, এমনকি মসজিদের সামনে সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মের দিকে আহ্বান জানাতেন। ফেন্ডর তার বই ‘মিযানুল হক’-এর জন্য বিখ্যাতি ছিলেন। এই বইয়ে তিনি সন্দেহ ও আপাত্তি দেখিয়েছেন ইসলাম, কুরআন এবং মুহাম্মদ সা.-এর নবুওয়াত সম্পর্কে।
১৮৫৪ সালের বিখ্যাত বিতর্ক
যখন যাজক ফেন্ডার বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, কিরানবি তাকে বিতর্কের জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু যাজক এমন কিছু শর্ত দেন, যা অন্যায্য বলে মনে হলেও কিরানবি মেনে নেন। কারণ তিনি চাচ্ছিলেন, যারা ইসলাম ধর্মকে ছুরিকাঘাত ও আহত করার কাজে নিয়োজিত, তাদের মুখোমুখি হয়ে ইসলামের সত্যতা তুলে ধরতে। এই বতর্ক যেন কোনোভাবে ভেস্তে না যায়, সেজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। যেন মিশনারীরা বলতে না পারে, যাজকদের প্রশ্নের জবাব দেবার যোগ্যতা নেই বলে আলেমরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না।
সিদ্ধান্ত হয়—বিতর্কে ৫টি বিষয়ে প্রতিযোগিতা হবে। ১. তাহরিফ, ২. নাসখ, ৩. তাসলিস, ৪. কুরআনের হাকিকত, ৫. হজরত মুহাম্মদ সা.-এর নবুয়ত। বিতর্ক চলবে দুদিন। উত্তর প্রদেশের আগ্রায়। সেখানে আলেম, যাঝক, আমির-উমারা সবাই থাকবে।
নির্ধারিত দিনে বিতর্ক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো। আধুনিক ইতিহাসে এই বিতর্কটি বেশ প্রসিদ্ধ। এতে কিরানবি জয় লাভ করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর ফজল ও রহমতে আমরা তাহরিফ ও নাসখ বিষয়ে জয় লাভ করি। এই দুটি বিষয় ছিল মূল বিষয়। মূল বিষয়ে যেহেতু হেরে গেছে, তারা বাকি তিনটি বিষয়ে আর বিতর্ক করেনি।
ইংরেজদের ক্ষোভ
কিরানবি বিতর্কে জয়লাভের পর বেশ প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন। যেহেতু খ্রিস্টানাইজেশনের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ ইংরেজদের দখল প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টার সাথে মিলে যায়, এটিই তাকে দখলদার কর্তৃপক্ষের লক্ষ্যে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ইংরেজরা তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরষ্কারেরও ঘোষণা দেয়। তার বইগুলো বাজেয়াপ্ত এবং নিষিদ্ধ করে।
ফলশ্রুতিতে কিরানবি ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চলে যান মক্কায়। সেখানে তিনি মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়খ আহমদ বিন জাইন দাহলানের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে মসজিদুল হারামে দরস দেয়ার অনুমতি দেন।
ইজহারুল হক রচনা
খৃস্টান ধর্মযাজক ফেন্ডরের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তিনি তার আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে সফর করেছিলেন। এমনকি তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী আস্তানায় ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি সুলতান আব্দুল আজিজ প্রথমের সঙ্গে দেখা করে বলেন, বিখ্যাত সেই বিতর্কে তিনি কিরানবির উপর জয়লাভ করেছেন। আব্দুল আজিজ শুনে অসন্তুষ্ট হন। কনস্টান্টিনোপলে কিরানবিকে ডেকে পাঠান। পরে কিরানবির কাছে বিতর্কের সত্য ঘটনা শুনে তিনি স্বস্তি পান। পাশাপাশি তিনি কিরানবিকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন বিতর্কের পাঁচটি প্রশ্ন খোলাসা করে একটি বই লিখেন। যেন এই বইতে ফেন্ডরের সন্দেহ ও আপত্তির জবাব থাকে।
কিরানবি ১৯৬৪ সালে মাত্র ৫ মাসে বইটি লিখে শেষ করেন। আগে ফার্সি এবং উর্দুতে যা লিখেছিলেন তার উপর নির্ভর করে পুরো বইটি লিখেন আরবিতে।
যদিও উসমানীয় সুলতান তাকে কাজটি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু কিরানবি স্বীকার করেন, তাকে বই লেখার প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন মসজিদুল হারামের খতিব। ইজহারুল হকের ভূমিকায় তিনি বলেন, আমি মক্কায় যাবার পর মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়খ আহমদ বিন জাইন দাহলান আমাকে বিতর্কের পাঁচটি বিষয় নিয়ে আরবিতে একটি বই লেখার নির্দেশ দেন।
দাঈদের পাথেয়
বইটির খ্যাতি সর্বদা ব্যাপক ছিল না। তবে এটি সর্বদা দাঈ এবং বিতর্ককারীদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা ছিল। এর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন শেখ আহমেদ দীদাত, যিনি পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান পন্ডিতদের সাথে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং শক্তিশালী বিতর্ক করেছিলেন এবং এই ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তার ভাষ্যে, এই বইটি তার জীবন বদলে দিয়েছে।
শেখ দীদাত বলেন, ৯ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে ভারত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই আমার বাবার কাছে। তিনি ডারবানে এসে আগেই বাড়ি করেছিলেন। আমি অল্প সময় একটা স্কুলে পড়ি। কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক সঙ্কটে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বসে যাই মুদির দোকানে।
দোকানের ঠিক বিপরীতে ছিল খ্রিস্টান অ্যাডামস মিশনের সদর দফতর। এখানে ছাত্রদের খ্রিস্টানকরণের পদ্ধতি এবং সেই অঞ্চলের মুসলমানদের প্রভাবিত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ছাত্ররা যখন দোকানে কিছু কিনতে আসতো, তারা ইসলাম ও রাসুল সম্পর্কে সন্দেহ এবং প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত। কখনও বলতো, ইসলাম তরবারির মাধ্যমে ছড়িয়েছে। কখনও বলতো, রাসূলের অনেক স্ত্রী ছিল। তিনি ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বই থেকে কুরআন ধার করেছিলেন। আমি এবং আমার বন্ধুরা এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারতাম না। কোথায় উত্তর পাব খুঁজতাম।
একদিন দোকানের পুরোনো পত্রিকার স্তুপ ঘাটতে গিয়ে পেলাম পুরোনো একটি বই। প্রচ্ছদ নেই। কাগজের রং হলুদ। প্রথম পৃষ্ঠায় বইয়ের নাম: ইজহারুল হক। বইটি ইংরেজিতে লেখা। আমি বইটি পড়তে শুরু করলাম। এটি ছিল আমার জীবনের পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু। এই বইটি আমার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে আমার দাঈ জীবনে।
এই বইটি দ্বারা প্রভাবিত সমসাময়িকদের মধ্যে আরেকজন হলেন ডক্টর সামি আমেরি। তিনি তুলনামূলক ধর্ম এবং বাইবেল অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞ। তার ভাষ্যে—লাইব্রেরিতে গিয়ে একদিন তুলনামূলক ধর্ম সম্পর্কে পড়তে চাচ্ছিলাম। এ বিষয়ক বই ছিল খুবই কম। তখনই আমি ইজহারুল হক খুঁজে পাই। এর সমৃদ্ধ তথ্য, আকর্ষণীয় শৈলী, নবীর জীবনী থেকে কুরআনের অলৌকিক ঘটনা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে ডুবে যাই। আমি বিমোহিত হই। আমি মনে করি, বইটি সব মুসলমানদের পড়া উচিত। বই ও ও প্রিন্টিংয়ের এই উৎকর্ষতার যুগেও এটি এখন খ্রিস্টানদের সন্দেহ এবং ইসলাম এবং মুহাম্মদের নবুওয়াতের প্রতি তাদের আপত্তির জবাব দেওয়ার জন্য সর্বোত্তম বই।
ইন্তেকাল
কিরানবি মক্কাতেই বসবাস করতেন। তাকে বলা হতো দুই পবিত্র মসজিদের বাসিন্দা। সেখানে তিনি একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। অবশেষে তার কর্মময় জীবনের ইতি ঘটে ১৩০৮ হিজরির ২২ রমজান, শুক্রবার রাতে। ইংরেজি সাল ১৮৯১। তাকে মক্কার কবরস্থান আল মুআল্লায় দাফন করা হয়। আল্লাত তার কবরকে জান্নাতের চাদরে ঢেকে দিন।
সূত্র : আল জাজিরা