
আব্দুর রহমান বারি:
ভূমিকা
বাংলাদেশে ইতিহাস পঠন – পাঠনে বিদ্যায়তনিক এবং বিদ্যায়তনের বাইরেও যে কাঠামো, বয়ান তার ছকে, ভাষায় তরিকা-ই মহম্মদীয়া, তিতুমীরকে ওয়াহাবি, তিতুমীর তথা হিদায়েতিদের মনকে আরব- ইরান- তুরানি বলে অভিহিত করে কিংবা বড়জোর প্রলেতারিয়াত কৃষক সম্প্রদায়ের নেতা হিসাবে হাজির করে৷ ফরাসি মনোচিকিৎসক জাক লাকঁ তার ওস্তাদ ফ্রয়েডকৃত অবচেতন মনের সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে ভাষা তথা বয়ানকে গুরুত্ব দিলেন যার বদৌলতে আমরা ধরতে পারি যে অবচেতনে যা বলতে চাই বা বয়ান হাজির করি তার প্রকাশ ঘটে শব্দের আড়ালে। তদ্রুপ আরবি – ইরানি- তুরানি মনের বক্তাদের মনের সুলুকসন্ধান করে আমরা কিছুটা হইলেও বলতে পারি মুসলিম কর্তাসত্তার আলাপে তাদের অবচেতন মনের বাসনায় যে ছেদ হয় তার ই প্রকাশ উপরিক্ত বিদ্যায়তনিক কিংবা বিদ্যায়তনের বাইরে বয়ানের পসরাতে৷ তরিকা- ই মহম্মদীয়ার প্রচার – প্রসার -প্রভাবে হিদায়েতি তিতুমীর যার সাথে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আন্দোলন,রাষ্ট্রগঠন, ছেদ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এবং ৫ই মের শাপলা চত্বর সিলসিলাগত ভাবে সংযুক্ত৷ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ধরা পড়ে আত্ম চৈতন্য, তথা মুসলিম কর্তাসত্তা, ঐতিহ্য এবং ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবাদ।
১. হিদায়েতির সুলুকসন্ধান : তরিকা- ঈ মহম্মদীয়া, পথচলা ও প্রভাব
মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের যুগে উপনিবেশিক আমলে হিন্দুস্তানে ইসলামের ভূমিকা, আলেম সমাজে মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবনা দেখা দেয়৷ তন্মধ্য, প্রসিদ্ধ আলেম,হিন্দুস্তানি সংস্কারক এবং দিল্লির নক্সাবন্দিয়া সিলসিলার প্রধান শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ:)প্রস্তাব করেন যে শরিয়ত চর্চা( কোরআন – হাদীস তথা মহম্মদ (সঃ) এর পথ ই আকড়ে ধরার) দাওয়াত এবং অনুবাদ তথা এলেমকে গুরুত্ব দেওয়া যা বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠ হয় মাদ্রাসা- ই – রহিমিয়া৷ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহঃ) তত্ত্ব আলোচনার সাফল্যের ফলে- ই হিন্দুস্তানি মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে দুশো বছরের অধিক সময় নিয়ে চলা ওয়াদাতুল শুহুদ এবং ওয়াদাতুল ওজুদ তথা দুই সুফি মতবাদের সাম্যঞ্জস্য আনার চেষ্টা এবং বিরোধ নিরসন ঘটে৷শাহ ওয়ালিউল্লাহের পুত্র আব্দুল আজিজের শিক্ষাবিস্তারের সাফল্যের ফলে মাদ্রাসা -ই – রহিমিয়ায় হিন্দুস্তানের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌলভি, আলিমরা এলেম তালাশে ভিড় জমাতে আরম্ভ করলো।যার- ই ধারাবাহিকতায় কোরআনের উর্দু অনুবাদ, জনমানুষের বুলির সাপেক্ষে বোধগম্য করে ইসলামি ধর্মশাস্ত্রের ব্যখ্যা – নসিহত এবং দাওয়াত ( প্রচার) হতে শুরু হলো৷ মানুষের ধর্মীয় জীবনের নানা প্রশ্ন, অস্থিরতা এবং তার সাথে সমাজের আন্তঃসম্পর্ক বুঝাপড়ায় ফতোয়ার সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিকটা প্রকট আকারে হাজির হতে থাকলো৷ শাহী ফরমানের স্থান নিল আলিমি ফতোয়া যার প্রভাব শুধু নিছক সম্ভ্রান্ত আশরাফ শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ ছিল না, শহরের গন্ডি ছাড়িয়ে গ্রাম গঞ্জের আতরাফদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়লো।
“Shah Abdul al – Aziz ” issued the famous Fatwa in reply to a question asking whether India was Dar- Ul- Harab ( land of war) or Dar- Ul – Islam ( land of Islam) under the British ”
শাহ আব্দুল আজিজ হিন্দুস্তানকে দার- উল – হরব বলে ঘোষণা করার কিছুকাল পরেই তার ছাত্র সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি এবং পুত্র শাহ ঈসমাঈল দেহলভি দার- উল – হরবে জেহাদের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও বাংলায় দাওয়াতের সফরে বের হলেন,তরিকায়ে মহুম্মদীয়ার আঞ্চলিক খলিফা নির্বাচনের মাধ্যমে দাওয়াতী মেহনত জারি রাখলো। শরা কবুল করনেওয়ালারা ঈমান, তৌহিদ, শিরক, সুন্নাহ তথা মহম্মদের পথ এবং বেদাত সমন্ধে স্থানীয় পরিসরে দাওয়াত, মসজিদ তৈরী করতে শুরু করলো যার ফলে শিখদের বিরুদ্ধে যখন বালাকোটের জেহাদ শুরু হলো বাংলা -বিহার থেকে অনেক শরাওয়ালা মুহম্মদ সঃ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জেহাদে শরিক হয়।বাংলায় তরিকা- ঈ মহম্মদীয়া প্রচার-প্রসারে বিস্তার লাভ করায় মানুষের কাছে দ্রুত পৌছায়তে থাকে। যেখানে শ্রেণীপ্রশ্ন, জাত- পাত সবকিছুকে ছাড়িয়ে ইসলাম মানুষের ভাব জগৎ এ ছিল।তরিকা- ঈ মুহম্মদীয়ার সাথে আরবে বিকশিত ওয়াবি আন্দোলনের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না৷ ওয়াহাবি আন্দোলন বলে জনমানুষের ভাবজগৎ তথা তাদের চৈতন্য বুঝা তো যাবে ই না বরং তা সংকোচিত করার কুপ্রয়াস চালান বৈকি। গৌতম ভদ্র দেখাচ্ছেন
“ভারতের অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতক ইসলাম ভাবজগতের আলোড়নের যুগ আর সেই আলোড়ন থেকে মুসলিম আতরাফরা একাবারে পিছিয়ে ছিল না। উনবিংশ শতকের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় এই ধারা সবেমাত্র স্কীকৃত হতে চলেছে তাকে এক বাক্যে ওয়াহাবি বলা অসংগত। ”
বাজারে ওয়াহাবি মিথ ব্যবসা কিংবা আরব- ইরান – তুরান তথা বহিরাগত ধারক বাহক আকারে নিজভূমিতে মুসলমানকে এলিয়েন আকারে হাজির করার সাথে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামোর রিশতা আছে যার সিলসিলা এখনো চলমান। ইংরাজ বিরোধী মুসলিমকে ওয়াহাবি বলা হতো যা এখনকার শব্দে ব্যাড মুসলিম ৷ হান্টারের বইতে আমরা দেখতে পায় যে তিতুমিয়া ওরফে তিতুমীর কেও একই ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে৷ কিন্তু সরকারি দলিলে,আমরা দেখি যে এই তিতুমিয়া কলকাতায় কুস্তিগির ছিল,পালোয়ান তিতুমিয়া জমিদারদের লাঠিয়াল ছিল যার কাজ ছিল জমিদারের হয়ে কর আদায়৷ ভাড়াকরা লাঠিয়াল তিতুমিয়া হজ্জে গেলেন এবং এসেই তরিকায়ে – ঈ মহম্মদীয়ায় দীক্ষিত হয়ে পুরো যাপিত জীবন বদলে ফেললো। এইযে, হজ্জে যাওয়া এবং লাঠিয়াল তিতুমিয়া থেকে তিতুমির হওয়া এই অবস্থা হইলো হিদায়েত। তিতুমিয়া এবং তার অনুগামীরা নিজেদের হিদায়েতি বলে পরিচয় দিত৷ তরিকা- ই মহম্মদীয়া এবংহিদায়েতিরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
তিতুমীরের অনুগামীরা ছিল কৃষক এবং শ্রেণী বিবেচনায় যাকে কারিগর তথা প্রলেতারিয়াত শ্রেণী হিসাবেও অভিহিত করা যায়৷ তরিকা-ই মহম্মদীয়ার অনুসারী এইসকল কৃষক, জোলা, কারিগর শ্রেণী তাদের নয়া পরিচয় নির্মান করলেন তা হইলো হিদায়েতি এবং সকলেই একই সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে মহম্মদের পথ অনুসরন করতে বদ্ধপরিকর৷
২. নাড়কেলবেড় হইতে শাপলা: মুসলিম কর্তাসত্তা বাসনার বিকাশ, ছেদ এবং পৌনপুনিক্তা
শাহবাগ উত্তর বাংলাদেশের ঘটনাবলি খেয়াল করলে ঔপনিবেশিক সময়ের হিদায়েতিদের ঈমানের রাজনীতি তথা আত্ম চৈতন্য ধরা পড়ে৷ ইতিহাসে কোথায় যেন দেখেছিলাম এখন আবার দেখছি এমন অনুভূতিকে ফরাসি ভাষায় দেজ্যা ভ্যূ বলে বুঝানো হয়৷আত্ম চৈতন্য যে ইতিহাসের সিলসিলাগত তা বলা – ই – বাহুল্য। সেই ধারাবাহিকতায় উত্তর উপনিবেশিক সময়ে পাকিস্তান হয়ে ওঠে মুসলিম কর্তাসত্তা বিকাশের ভূমি৷ আবুল মনসুর আহমদ তার আমার রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে উল্লেখ করেন,
“এতকাল পরে পিছন দিক তাকাইয়া একজন রাজনৈতিক কর্মী লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে আমার যা মনে পড়ে, তার সারমর্ম এই যে ভারতের( ঔপনিবেশিক) মুসলমানরা আগা- গোড়াই একটা রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য সত্তা হিসাবেই চিন্তা এবং কাজ করিয়াছে ”
বিলাতের লিড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটোরিক এন্ড ডিকলোনিয়াল থট এবং স্কুল অফ সোশিওলজি এন্ড সোশ্যাল পলিসির প্রধান ড. সালমান স্যায়িদ পাকিস্তানের মানে বুঝবার কোশেশ করতে গিয়ে বলতেছেন যে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল নয়া মদিনা হিসাবে।সায়্যিদের কোশেশকে শক্তিশালী করে ভ্যানকাত ধুলিপালার ক্রিয়েটিং এ নিউ মদিনা কিতাব৷ স্যায়িদ ইতিহাসের একটু পিছনে ফিরে খিলাফত উত্তর নয়া তুরস্কের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শের কুলুজি ধরার কোশেশ করতেছেন।স্যায়িদ তুরস্কের জাতীয়তাবাদী, আধুনিক প্রগতিশীলতাকে শুধু তুরস্কের ফেনোমেনা আকারে না দেখে মুসলিম প্রধান ভুখন্ডের সাপেক্ষে এক ইডিওলজি আকারে দেখছেন যাকে উনি কেমালিইজম বা কামালবাদ বলে চিহ্নিত করছেন৷ সেই কামালবাদের প্রভাব মুসলিম প্রধান দেশগুলোর শাসক শ্রেণীকে প্রভাবিত করেছিল যার – ই ধারাবাহিকতায় ইরানের পাহলভী শাহ, আফগানিস্তানের আমানউল্লাহ, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন মিশরের নাসের এবং প্রাক আজাদী বাংলায় আধুনিক শিক্ষিত আরবান মুসলমানদের। ঔপনিবেশিক বাংলায় বামুন- কায়েত তথা ভদ্রলোকীয় তথাকথিত রেনেসাঁসের পদাঙ্ক অনুসরন করে আধুনিক প্রগতিশীল হয়ে ওঠতে এগিয়ে আসা মুসলিম অংশ নিয়ে বুলবুলের একটা লেখাতে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন,
“প্রসঙ্গত বলা আব্যশক যে, আলোচ্যকালে মুসলিম সমাজে জাগরণের সূচনা হয় অসহযোগ – খিলাফত আন্দোলনের পরে তুরস্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র এ খিলাফত ধারণার জায়গায় গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীলতার লক্ষ্যে যে বিপ্লব সাধিত হয়, তার প্রভাবে। হিন্দুসমাজের দেখাদেখি মুসলমান সমাজে যে প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছিল তা, ধর্মভীরু, অশিক্ষিত মুসলমানের ভারে ন্যুজ, উগ্র ধর্মীয় চেতনার প্রভাবে প্রভাবিত সমাজে প্রান প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলো না। ”
কিন্তু স্যায়িদ দেখাচ্ছেন পাকিস্তান ছিল কামালবাদের এন্টি থিসিস। পাকিস্তানে মুসলিম সাবজেক্টিভিটি তথা কর্তাসত্তার বিকাশ হবার জন্য উপযুক্ত ভূমি ছিল। স্যায়িদ বলতেছেন,
Kemalism was a set of overlapping positions regarding the belief that only a national identity could be the vehicle of a hegemonic political subjectivity throughout the Islamosphere. The formation of Pakistan was a challenge to Kemalism. The movement for Pakistan is not based on ethnicity or language but rather a politicized Muslim subjectivity.”
মুসলিম কর্তাসত্তার বিকাশের ধাপ এবং বিঔপনিবেশকরন হিসাবে ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান আত্মপ্রকাশ করে যেখানে সাংবিধানিক সভ্রেন পাওয়ার (হাকিমিয়্যা) আল্লাহর বলে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সাংবিধানিক কাঠামোয় কলোনিয়াল লিগ্যাসি দূর করতে প্রস্তাবনা হাজির করেন ইসলামপন্থী এবং ঐতিহ্যবাদী আলেম – উলেমারা যার মধ্য অন্যতম উলামায়ে দেওবন্দ শাব্বির আহমদ উসমানী, মুহাম্মদ শফি রহঃ জাফর আহমদ উসমানি রহঃ সহ প্রমুখ এবং ইসলামপন্থী দল গুলোর মাঝে অন্যতম মাওলানা মাওদুদি রহঃ। উলামায়ে দেওবন্দের এই ধারা “খিলাফত আলামিনহাজিন নবুওয়াত” এর আদলে পাকিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়াস চালান ৷বহু সংস্কৃতি এবং ভাষার মুসলিমদের আবাস পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা কাঠামোতে কলোনিয়াল ব্রাউন স্লেভ দের আধিপত্য দেখা দেয়, উলেমা সমাজ খানিকটা হতাশ হয়ে পড়েন নয়া মদিনার বাস্তবায়ন না হওয়াতে এবং পাকিস্তান জুড়ে চলা কমিউনিস্ট পার্টির ভায়োলেন্স, কলোনিয়াল উত্তরসূরী কেমালিস্ট শাসক এবং দীর্ঘ দিনের সেনা শাসন ফলে অস্থিরতা চলছিল। তিরিশের দশকের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন এবং কলকাতার জমিদার পরিবারের সন্তানদের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন, পরিচালনা, এবং তা দিয়ে সামাজিক নৈরাজ্য তৈরি যা মুসলিম কর্তাসত্তা বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।ঔপনিবেশিক আমলে বিকশিত কলকাতাকেন্দ্রিক বাহ্মণ্যবাদী ভদ্রলোক সমাজের চিন্তায়, সংস্কৃতিতে , সাহিত্যে প্রভাবিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান নির্মান হয় ৬০ এর দশকে। মুসলিম কর্তাসত্তার বাসনায় ছেদ ঘটে ৭১ এ। কেমালিস্ট আরবান বাঙালি এলিটের নিয়ন্ত্রণে যায় দেশ, একই সাথে যুদ্ধে বাঙালি – বিহারির রক্ত ঝরে। যুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্র এর উদয় এবং তার কাঠামোগত ত্রুটি যা আজও বিদ্যমান তা মুসলিম কর্তাসত্তার বাসনাকে অবদমিত করতে বাধ্য করে৷ কামালবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে গিয়ে মুসলিম কর্তাকে অবদমিত অবস্থায় ফেলে দেয়৷ প্রাতিষ্ঠানিক বি- ইসলামিকরন, মুসলিম তমদ্দুন – তহযিবকে এলিয়েন আকারে, ধর্মীয় বিশ্বাস – চিহ্ন এবং ইসলামি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, পশ্চিমা- কোলকেতে সংস্কৃতি আমদানি সহ মুসলিমদের অপরায়ন করে কামালবাদীরা।ফলে, মুসলিম কর্তাসত্তার বাসনায় ছেদ ঘটে এবং তা অবদমিত অবস্থায় রয়ে যায়৷ মুসলিম কর্তাসত্তার বাসনায় ছেদ এবং তার অবদমন বুঝতে আমরা স্যায়িদের নিচের লেখাতে চোখ বুলাতে পারি।
“This transformation of Islam, from the master signifier of political order into just another element, is what allows me to describe these regime as being kemalist. In other words, kemalism describes a hegemonic political discourse in the Muslim world, within which Islam was no longer as a master signifier of the political order.”
কামালবাদীদের হাত ধরে রাষ্ট্র এবং সমাজে বি-ইসলামিকরন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হবার পিছনে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী লিব্রেল- লেফট সেক্যুলার দের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বয়ান আছে তার সমান্তারালে চলতে থাকে অপরায়নের শিকার হওয়া অবদমিত মুসলিম কর্তাসত্তা৷ আরব – ইরান – তুরান, ওয়াহাবি, শিবির, জঙি ইত্যাদি শব্দবন্দী করে নিজ ভূমিতে বহিরাগত এলিয়েন এবং ডি-হিউম্যানাইজ( উন-মানুষ) হিসাবে হাজির করে৷ইসলাম এবং মুসলিমদের এইভাবে হাজির করার শানে নুযূল বুঝতে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসের সেই হিদায়েতিদের কাছে,শাহবাগ উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক – রাজনৈতিক বাস্তবতার সাপেক্ষে সেই ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে৷
হেদায়েতি তিতুমীরের সামাজিক আবেদন ছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত কৃষক, তাঁতি সহ কারিগর শ্রেণী সাথে যারা সামন্তব্যবস্থায় গরিব প্রজা এবং ক্ষমতা সম্পর্কের দিক থেকে প্রান্তিক ৷কৃষক, তাঁতি সহ এই কারিগর শ্রেণি মুখে দাঁড়ি রেখে, গরু কোরবানি দিয়ে জেয়াফত, সম্প্রদায়ের সবাই মিলে একসাথে ভোজ, মসজিদ নির্মান করে সমাজে তাদের সাংস্কৃতিক কর্তাসত্তার জানান দিতে থাকে৷ সাজন গাজির পুঁথিতে আমরা তার ই চিত্র দেখি৷ লাঠিয়াল তিতুমিয়া থেকে হিদায়েতি তিতুমীর হবার সময়টাকে পুঁথিতে বেঁধে সাজন গাজী বলে:
“হদরপুর ঘর তার নাম তিতুমীর।
মক্কা মদিনায় গিয়ে হইলো হাজির
নামাজ রোজা শেখাত, রাখতে বলতো দাঁড়ি
দিনের তরিখ শেখায়েই ফিরে বাড়ি বাড়ি ”
সমাজে এই সাংস্কৃতিক চিহ্ন ক্ষমতার রুপ হিসাবে প্রকাশ ঘটে এবং ক্ষমতা কাঠামোর উপরের মহলের জন্য এই রুপ ই যেন ভয় উদ্রেক করে৷ এইযে উপরের মহলে তথা মনিবের কপালে ভয়ের রেখাচিত্র ফুটে উঠে তার সাথে দাস চৈতন্যের সম্পর্ক নিয়ে হেগেল আলোচনা করেছেন তার বই”Phenomenology of Spirit ” এর ‘Independence and Dependence of Self consciousness : Lordship and Bondage ” অধ্যায়ে যেখানে হেগেল দাসের চৈতন্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে “ভয়”কে একটি মুহূর্ত বলছেন।
“The fear of the lord is beginning of wisdom”
দাসের চৈতন্য নিজকে চিনতে পারে তথা প্রভুসত্তা থেকে নিজকে আলাদা করতে পারে প্রভুর ভয়ের সাপেক্ষে। তারপর ভয় উত্তরিত হয় ত্রাসে, বিদ্রোহের মাধ্যমে দাস প্রভুর মনে সন্ত্রাস তৈরি করে যার ফলে সাবজেক্ট এবং অবজেক্ট এর সম্পর্ক বদলে যায়।দাস হয়ে যায় প্রভু৷ ফলে, প্রভুর আইডেন্টিটি নাকচ করে দাস যার সাপেক্ষে প্রভুর দাপট বদলে যায় আতঙ্কে কেননা যে বেখেয়াল দাসকে এতোদিন ভোগ করেছিলতা প্রথমে খন্ডিত হয়, পরে তা বিপর্যস্ত হয়। দাস নিজের সত্তাকে করে তোলে প্রধান যার ফলে নিজ ভূমিতে সে অধিষ্ঠিত হয় যা তার নিজস্ব মন আর জগৎ কে প্রতিষ্ঠ করতে চায়৷ হেগেলীয় এই রিশতা ই ফুটে উঠে হিদায়েতি এবং ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কেন্দ্রের মাঝে৷
সরফরাজপুরে জোলাদের চালা মসজিদ ভেঙে ফেলা,জোলাদের ধর্মীয় জীবন নিয়ে জমিদার দুলালের তাচ্ছিল্য, পাইক – পেয়াদার দাঁড়ি কেটে ফেলা, দারোগাদের বদমাইসি, জমিদারের হুকুমে কুখ্যাত দাঁড়ি কর তথা ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার পালন, প্রচার স্থানীয় ক্ষমতার রোষানলে পড়ে।যার সূত্র ধরে বাজারে প্রকাশ্য গরু কোরবানি, জমিদারকে হত্যা, যুদ্ধবন্দীদের দাঁড়ি রাখানো, সহ নানা ক্রিয়া, এবং ক্ষমতার ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো হেদায়েতিরা। এই ভাষা বিদ্যমান আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোকে আতঙ্কে ফেলে দেয়।
এজেন, ছোয়াছে রোগের মতোন যা ছড়িয়ে পরে এবং আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলে যা বিদ্রোহের প্রথম পরিচয়৷ বাহ্যিকভাবে দেখে রক্ত, পরিবার, সম্প্রদায় তাদের শক্তির উৎস মনে হলেও নিক্তিতে উক্ত হিদায়েতিদের শক্তি মাপবার জো নেই, তাই তাদের শক্তির উৎস খুজতে হবে তাদের ঈমানে এবং আত্ম চৈতন্যের ফলে তৈরি হওয়া তাদের নয়া ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায়।আঞ্চলিক এবং তার অধীনস্থ জমিদারি, নীলকর ছাড়িয়ে সামগ্রিক রুপে পরিনত হয় অল্প সময়ে।ধর্মীয় যাপিত জীবনে বাধার ফলে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোর মুখোমুখি হয়ে এই হেদায়েতিরা আঞ্চলিক জমিদারি অস্কীকার, তিতুমীরের বাদশাহির পয়গাম ঘোষণা , ফরমান জারি, খাজনা আদায়, খোলা চিঠি, মিসকিন শাহ ওরফে ( কুরবান শাহ সহ আরও ফকিরদের সাথে মিত্রতা) ফৌজ গঠন, করে সরকার বাহাদুর তথা ক্ষমতার কেন্দ্রে বার্তা পাঠালো৷ বাশের কেল্লা নির্মান এবং খোলা চিঠিতে ফরমান জারি নয়া রাজত্বের যার উৎস দীন এবং মহম্মদের তরিকায় পরিচালিত।
আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষের সমাগম, তাদের জমিদারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করা, এবং হেদায়েতিদের কর আদায় ছিল নয়া রাজত্বের প্রকাশের চিহ্ন যেখানে বাশের কেল্লার লড়াই কৃষক, জোলা, কারিগরের কাছে দীনের লড়াই।
” দাঁড়ির কর, দারোগার বদমাইসি, কুঠিয়ালের দাপট এইসব টুকরো টুকরো দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে হিদায়েতিরা মুক্তি পায় এক রাজ্যে , যেখানে দীন মহম্মদ আদর্শ”
উসুল এবং কাঠামোগত দিক থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুসলমানের কর্তাসত্তাকে অবদমন করতে বাধ্য করে। কেমালিস্ট,আরবান মিডল ক্লাস এলিট দের সাথে অপরায়নের শিকার হওয়া মুসলমানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক লড়াই দীর্ঘদিনের৷ দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রকাশ হিসাবেই ৭১ এর বাঙালি জাতীয়তাবাদ,প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামোফোবিয়া, রেসিইজম, এবং পশ্চিমা- কোলকেতে মিশ্র সেক্যুলার ডিস্কোর্স এর নগ্নরুপ আমরা শাহবাগে দেখি৷নবীর শানে গোস্তাখি করে ব্লগার কমিউনিটি যার আশ্রয়স্থল ছিল আবার শাহবাগ৷ রাসুল (সঃ) ইশক তথা ঈমানের বুনিয়াদে মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার শাপলায় অবস্থান নেওয়া, ১৩ দফার প্রস্তাবনা প্রদান, এবং তার বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব রাখা। শাহবাগ ছিল ক্ষমতা কাঠামোর সাথে যুক্ত যেমনটা হিদায়েতিদের সময় জমিদারেরা ছিল।ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সাপেক্ষে যে তৌহিদি জনতার জোয়ার শাপলায় সমাগম হয়েছিল এবং জনতার জোয়ারের প্রস্তাবনা ক্ষমতাকেন্দ্র যে উপায়ে মোকাবিলা করেছে সেখানে হেগেলীয় সেই দাসের আত্ম চৈতন্য হাজির হয়,গন জোয়ার প্রভুকে আতঙ্কে ফেলে দেয়,প্রভুর অনুমোদন খারিজ করে, প্রভুর আইডেন্টিটি নাকচ করে নিজকে কর্তা হিসাবে জাহির করে। শাপলায় উত্থাপিত প্রস্তাবনা একইসাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এর কাঠামোগত বিঔপনিবেশিকরণ, মুসলিম কর্তাসত্তা, এবং সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাবনাও বটেও।শাপলা পরবর্তী বাংলাদেশে গন-মানুষের বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বড় একটা অংশের বোধোদয় মুসলমানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্তাসত্তার অবদমিত বাসনা জাগ্রত হয় যার ফলে সামাজিক পরিসরে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য এখনো চলমান৷ ৭১ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে নতুন বোঝাপড়া, তার সংস্কার এবং জমিন এবং জনগনের ভবিষ্যৎ কল্যান কামনার লক্ষ্যে ন্যাশনাল রিকন্সিলিশন তথা জাতীয় মীমাংসায় আগ্রহী শাহবাগ উত্তর বাংলাদেশের হিদায়েতিরা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে সাংবিধানিক সংস্কার, মাল্টিপল জুডিশিয়ারি গঠন, সামাজিক – সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক পরিসরে গন মানুষের চৈতন্যর বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব করেন শাহবাগ উত্তর বাংলাদেশের নয়া হিদায়েতিরা৷
৩. ইতিহাসের আয়নাঘর : সংকোচন নাকি গুম?
তিতুমীর এবং তার অনুগামী হিদায়েতিদের মতো শাপলার বাসনাকে চিহ্নিত করতে না পারা কিংবা চিহ্নিত করে গুম করে দেওয়ার প্রয়াস নেহাত কম নয়৷ ঔপনিবেশিক সরকার বাহাদুরের প্রতিবেদন থেকে শুরু করে উদারপন্থী, মার্কসবাদী নানান ধারার চোখে হিদায়েতির বাশের কেল্লা কিংবা শাপলা ধরা পড়ে কিছু ছক বাধা শব্দে৷ হয়তো তা কখনো দ্রারিদ্রতা, ধান্দাবাজি, শ্রেনী সংগ্রামে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভূমিকা অথবা সাম্প্রদায়িক – ইসলামো-ফ্যাসিবাদী, কট্টর মৌলবাদী ওয়াহাবি আকারে। মোদ্দাকথা, যুক্তিবাদী সেক্যুলার,ও তথাকথিত বিপ্লবীদের কাছে ধর্মভাব হইলো প্রলেপ যা গৌন বিষয়। বাংলাদেশের লিব্রেল- লেফট তথা মুলধারার সেক্যুলার সমাজের এক অংশ শাপলাকে বুঝতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী বলে অভিহিত করেছে এবং একই সমাজের আরেক ধারা শ্রেণী সংগ্রাম, তথা প্রলেতারিয়াত সমাজ হিসাবে, ক্ষমতা কাঠামোর সাপেক্ষে, এবং শ্রেণী সংগ্রামে ধর্মের ভূমিকার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করছে৷ উপরিক্ত বুঝাপড়ায় দেদারছে হিদায়েতি চৈতন্যের প্রতি, আত্মত্যাগের প্রতি হক আদায় হয় না বরং সংকুচিত অনেকাংশে গুম হয়৷ ঈমান, হিদায়েতির চৈতন্য, মুসলিম আত্ম পরিচয় তথা মুসলিম কর্তাসত্তা মোদ্দাকথা, ঐতিহ্য, অন্টোলজি তথা ইসলামিক স্বাতন্ত্র্যবাদের সাপেক্ষে ইতিহাসের পঠন- পাঠন জারি থাকুক৷ঈমানের নিশান থাকুক এই জমিনে৷
Pearson, H.(2008).Islamic Reform and Revival in Nineteenth – Century India, The Tariqah-i Muhammadiyah.
Mumbai:Yoda Press
Ahamed khan, Muin-ud- Din (1965).History of the Faraidi Movement in Bengal,( 1818-1906).
Karachi:The University of Dacca Press
Ahamed khan, Muin-ud- Din, Titumir and His Followers
Hegel, G.W.F(1979).Phenomenology of Spirit, Translated by A. v Miller.
Oxford University Press
Sayyid, B(1997). A Fundamental Fear: Eurocentrism and the emergence of Islamism
London : Bogazici University Library
Sayyid, B. The Meaning of Pakistan ( Re- orient blog)
Maqtabkhana Webinar on, 1971 Bangladesh war of Independence :The Failure of the Secular Pakistani Nation – Building Project.
Link : https://youtu.be/4L0dFTg-8mA
ভদ্র, গৌতম (১৯৯৩). ঈমান ও নিশান, উনিশ শতকে বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায় ( ১৮০০-১৮৫০)
কলকাতা : সুবর্নরেখা পাবলিশার্স৷
আহমদ, আবুল মনসুর (২০০২). আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউজ।
মজহার, ফরহাদ ( ২০০৬). মোকাবিলা, ঢাকা :আগামী প্রকাশনী।
খান, ইসরাঈল (২০০৫) মুসলিম সম্পাদিত এবং প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা (১৯৩১-৪৭) ঢাকা : বাংলা একাডেমী৷
হুদা, তরিকুল( দেজ্যা ভ্যূ: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মতাদর্শিক পরিগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব) শিহান বিন ওমর সম্পাদিত, বাঙলানামা, অক্টোবর, ২০২১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা৷
খান, সলিমুল্লাহ। ওয়েবিনার :জাক লাকার বাসনা।
ইউটিউব লিংক :https://youtu.be/uw11GaSahxk