শায়খ ইউসুফ আল কারদাভি এবং মুসলিম বিশ্বের সংকট-সমস্যা

রচনা : ইশতিয়াক আলম ফালাহি

তর্জমা : কাজী একরাম

আল্লামা ইউসুফ আল কারদাভি একজন সাহসী ও নির্ভীক  আলিম, ফকিহ, মুজাহিদ, মুজতাহিদ, কবি এবং লেখক। কারদাভির ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন কামালাত এবং বহুগুণের আধার। সত্যবাদিতা, নিপীড়িতের সমর্থন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাঁর ব্যক্তিত্বের মৌলিক উপাদান। আল্লামা কারদাভি একদিকে কুরআন ও সুন্নাহর খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছেন, জ্ঞান ও চিন্তার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন এবং ফিকহ ও ইজতিহাদের ক্ষেত্রে উম্মাহর সেবা করেছেন, অন্যদিকে তিনি ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটপূর্ণ ইস্যুতে সাহসিকতার সঙ্গে আপন মতামত প্রকাশ করেছেন, পালন করেছেন আপন ভূমিকা।

আল্লামা কারদাভি তার সমগ্র জীবন ইলমের খেদমতে এবং ইসলামের সমুন্নতির সংগ্রামে অতিবাহিত করেন। তার প্রচেষ্টার পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত। আল্লামার জ্ঞানগত এবং জাতিগত কার্যক্রমের একটি অংশ উম্মাহর সমস্যায় দিকনির্দেশনা এবং ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন সংকটময় ইস্যুতে তাঁর ইজতিহাদি এবং মুজাহিদসূলভ ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত।

ফিলিস্তিন ইস্যু এবং আল— আকসা মসজিদের সুরক্ষা

উম্মাহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর ইস্যু হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং আল আকসা মসজিদের সুরক্ষা। ফিলিস্তিন ইস্যু সবসময়ই শায়খ কারদাভির আগ্রহ ও মনোযোগের বিষয় থেকেছে। তিনি তাঁর ‘সীরাতুন ওয়া মাসীরাতুন” গ্রন্থে লিখেছেন: ‘আমার হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে যে ইস্যুগুলি ছেয়ে রয়েছে, তার মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যুটি শুরু থেকেই প্রধান ইস্যু। ১৯৪০ সালে, যখন আমি তান্তায় ‘আল— মা’হাদুদ— দ্বীনী’তে ভর্তি হই, তখন থেকে, প্রতি বছর ২ নভেম্বর, আমি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের ‘বেলফোর ঘোষণা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করি। এটা সেই ঘোষণা যা বিশ্বের ইহুদিদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনে তাদের জন্য একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’

শায়খ কারদাভি তার বেশ কয়েকটি বইয়ে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, আমাদের আসল লড়াই হলো ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে এবং যতক্ষণ না ইহুদিরা আমাদের জমির দখলদার থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের লড়াই জারি থাকবে। ইহুদিদের পক্ষে ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে অব্যাহতি গ্রহণের অধিকার কারো নেই। শায়খ কারদাভি আরো বলেন, ইহুদিরা যদি ফিলিস্তিনে ধর্মের নামে যুদ্ধ করে, তাহলে আমাদের জন্যও তাদের ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েজ হবে। তাদের যুদ্ধের অস্ত্র যদি তাওরাত হয়, তাহলে আমরা কুরআনকে অস্ত্র বানাবো। যদি তারা মূসা আ. এর নামে একটি বাহিনী প্রস্তুত করে তবে আমরা মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মদ (দ.) এর নামে একটি বাহিনী প্রস্তুত করব, কারণ আমরা তাদের চেয়ে মুসা আ.— এর বেশি নিকটবর্তী। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন: ইহুদিরা দাবী করে যে, ফিলিস্তিনের ভূমিতে তাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় অধিকার আছে, কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে, তারা যখন ভূমিতে প্রবেশ করেছিল, তখন এটি কোনো জনবসতিহীন ভূমি ছিল না এবং তারা যখন এখান থেকে চলে গিয়েছিল, তখন তারা এটিকে খালি রেখে যায় নি, বরং এখানে মানুষের জনসংখ্যা ছিল। এখানে বসবাসরত ছিল ফিলিস্তিনের লোকেরা যাদের কথা স্বয়ং তাওরাতে উল্লেখ আছে। তারা সেখানে ইহুদিদের আগমনের আগেও ছিল, তাদের আগমনের পরেও ছিল এবং ইহুদিদের চলে যাওয়ার পরেও ছিল। অতএব, তারা যে ঐতিহাসিক অধিকারের কথা বলে, তার কোনো সত্যতা নেই, নিছক একটি ফেরেব— প্রতারণা।’ এক উপলক্ষ্যে তিনি বলেন, ‘আল— কুদসের মুক্তির লক্ষ্যে একটি দীর্ঘ জিহাদের প্রস্তুতি নেওয়া আরবদের উপর ফরজ। কারণ, ইসরাইল আমাদের অধিকারকে কখনোও স্বীকার করবে না।

আল্লামা কারদাভি ফিলিস্তিনকে সাহায্য করার জন্য ভরপুর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বৈষয়িকভাবে সাহায্য করার জন্য, জনসেবার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন, উদাহরণস্বরূপ, মুআসসাসাতু ইতিলাফ আল— খাইর এবং মুআসসাসাতু আল— কুদস আল— দাউলিয়াহ।  ফিলিস্তিনের আর্থিক সহায়তার জন্য অনেক দেশে প্রচারাভিযান করেন। এইভাবে, তিনি রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি অনেক শাসক ও রাজা— বাদশাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে ফিলিস্তিন ও আল— আকসা মসজিদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার দাওয়াত দেন। তিনি ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে চলমান ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে শাসকদের নীরবতার সমালোচনা করেন এবং ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোকে সাহায্য করতে তাদেরকে রাজি করাবার চেষ্টা করেন।

আল্লামা কারদাভি উম্মাহর কাছে ফিলিস্তিনের ভূমিতে চলমান যুদ্ধের প্রকৃতি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।  তিনি বলেন, ভূমিকে রক্ষা করার জন্য সেই ভূমির মানুষের উপর জিহাদ ফরজ এবং এই জিহাদের পরিধি সমগ্র উম্মাহ পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। আর যখন প্রথম কিবলা ও তৃতীয় হারামের মুক্তির কথা আসে, তখন এই পথে জিহাদের দায়িত্ব ও সম্মান আরও বেড়ে যায়। শায়খ সন্ত্রাস ও প্রতিরোধের পার্থক্যও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার ‘ফিকহু জিহাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইসরায়েল প্রথম দিন থেকেই সন্ত্রাসবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র। এটি Haganah (ইহুদি সামরিক সংগঠন) গুন্ডাদের সন্ত্রাস এবং তাদের মাধ্যমে দারিয়াসিন এবং অন্যান্য স্থানে ফিলিস্তিনিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি রাষ্ট্র। তাই ফিলিস্তিনের জনগণ যা কিছু করছে, তা হলো জিহাদ এবং প্রতিরোধ, তারা তাদের ভূমি ও অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিরোধ করছে। এই প্রতিরোধের নাম যদি সন্ত্রাস হয়, তবে তারা আমাদের সন্ত্রাসী বলতে থাকুক।’

ফিলিস্তিন ইস্যুটির প্রকৃতি স্পষ্ট করার জন্য শায়খ কারদাভি সাহিত্য ও শিল্পেরও ব্যবহার করেছেন। ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন কবিতা— কাসীদা, খুতবা, আর্টিকেল এবং অডিও এবং ভিডিও মাধ্যমের ব্যবহার করেছেন তিনি। দরবারি আলেম ও খতিবদের ফতোয়া থেকে সরে গিয়ে শায়খ সাহসিকতার সাথে তার মতামত প্রকাশ করেছেন। ফিলিস্তিনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে তিনি ফিদায়ী বা আত্মঘাতী আক্রমণকে জায়েজ ঘোষণা দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনে ফিদায়ী হামলার ইসলামি অবস্থান সম্পর্কে অনেকেই জানতে চান। প্রকৃতপক্ষে, এটি জিহাদের অন্যতম উত্তুঙ্গ একটি রূপ। এটি শত্রুকে ভয় দেখানোর এমন একটি পদ্ধতি, যার দিকে কুরআনে সূরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে ঈশারা করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এই আত্মঘাতী অভিযান তখনই অনুমোদিত, যখন প্রতিরক্ষার অন্য কোনও উপায় বাকী নেই। পরবর্তীতে তিনি স্পষ্ট করেন যে, ফিলিস্তিনিরা যখন আত্মরক্ষার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য অস্ত্র পায়, তখন আর ফিদায়ী হামলার প্রয়োজন বাকী থাকে না। তিনি জায়নবাদী সরকারের সাথে বন্ধুত্বকে হারাম ঘোষণা করেন। আমেরিকান ও ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান।  ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের মূল্য গ্রহণ করাকে হারাম ঘোষণা করেন। অনুরূপভাবে, তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, আল— কুদস থেকে অব্যাহতিগ্রহণ আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং সমগ্র উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। কাতার যখন ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেসকে স্বাগত জানায় এবং কাতারের আমির তার সাথে করমর্দন করেন, তখন শায়খ তার জুমার খুতবায় (যা সর্বদা কাতার টিভি এবং রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়) বলেন যে, যে লোকেরা শিমন পেরেসকে করমর্দন করেছে, তাদের উচিত সাতবার নিজের হাত ধোয়া এবং একবার মাটি দিয়ে ধোয়া। একইভাবে, আন্তঃধর্মীয় সংলাপে কাতার যখন কট্টরপন্থী ইহুদিদের আমন্ত্রণ জানায়, তখন শায়খ এর সমালোচনা করেন এবং কনফারেন্সের বয়কটও করেন। তবে, ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের জন্য অনেক মধ্যপন্থী ইহুদির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল।

আর রাবীউল আরাবী বা আরব বসন্ত

সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব শাসক, চাই তারা তথাকথিত ধার্মিক হোক বা ধর্মহীন, ইনসানি ও ইসলামি মূল্যবোধের বিপর্যয় সাধনে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। জুলুম ও নিপীড়নকে রেওয়াজ দিয়ে তরবারির জোরে শাসন করা এবং দেশ ও জাতির সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে নির্দ্বিধায় হস্তক্ষেপ করা– তাদের অধিকাংশেরই পরিচয় হয়ে উঠেছে। শায়খ কারদাভি সব সময় এই জালিম ও নিষ্ঠুর শাসকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। তিনি মিশরে দু’বার কারারুদ্ধ ও নির্যাতিত হন। তার মিশরীয় পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। সিরিয়ার শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তাকে সিরিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইরাকে সংঘটিত নৃশংসতার উপর সাহসী মতপ্রকাশ এবং সেখানকার শাসকদের মনোভাবের কারণে বছরের পর বছর তিনি ইরাকে প্রবেশ এড়িয়ে যান।

২০১১ সালে, যখন তিউনিসিয়া থেকে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে আরব বসন্তের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রভাব অনেক আরব দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন বিপুল সংখ্যক সুলতানপন্থী এবং দরবারী উলামা জন— সংগ্রামকে নিরুৎসাহিত করে এবং অত্যাচারী শাসকদের সমর্থন দেয়। কিন্তু, আল্লামা কারদাভি সে সময় তার সর্বশক্তি দিয়ে বিপ্লবী জনতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আরব বসন্তের মূল বার্তা ছিল ইসলাম যেসব মৌলিক মূল্যবোধের উপর জোর দিয়েছে তার প্রচার— প্রতিষ্ঠা। শায়খ কারদাভি বলেন, আরব বসন্তের সংগ্রাম একটি ইসলামি সংগ্রাম, এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্বাধীনতা, মানবতার প্রতি সম্মান, মানবজাতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শান্তি— শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা। আর এই বিষয়গুলোর দিকে ইসলাম অত্যন্ত তীব্রতা ও গুরুত্বের সাথে দাওয়াত দিয়েছে। আল্লামা কারদাভি তার খুতবাত, প্রবন্ধ— নিবন্ধ এবং আলোচনা— বক্তৃতায় এটা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, উম্মাহর আলেমদের দায়িত্ব হলো তাঁরা উম্মাহর পুনরুজ্জীবনের জন্য কাজ করবেন এবং উম্মাহকে বর্বর শাসকদের করুণার উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকবেন না। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আলেমরা উম্মাহর অংশ, এবং এটা জায়েজ নয় যে আলেমরা এক উপত্যকায় বাস করবে এবং উম্মত অন্য উপত্যকায়। এটা আলেমদের দায়িত্ব যে তারা উম্মতকে জাগ্রত করবে এবং বর্বর আগ্রাসী শাসকদের হাতে উম্মতকে বিসর্জন দেবে না। এই উপলব্ধির অপরিহার্য ফল হওয়া উচিত ছিল আমরা আরব বসন্তের শুরু থেকেই উম্মতের সাথে সমকণ্ঠ হয়ে থাকবো ।’

লিবিয়ায় যখন গাদ্দাফি অত্যন্ত বর্বরতার সাথে নিরপরাধ মানুষের রক্ত ​​ঝরানো শুরু করে, তখন শায়খ কারদাভি পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ফতোয়া দেন যে, গাদ্দাফির মতো একজন শাসককে হত্যা করা জায়েজ। শায়খ কারদাভি ও তার মতো অন্যান্য সাহসী আলেমদের পৃষ্ঠপোষকতা আরব বসন্তের সংগ্রামকে তিউনিসিয়া, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়ায় শক্তি সরবরাহ করে এবং এসব প্রচেষ্টা সফলতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এটা হওয়া উচিত ছিল যে উপসাগরীয় দেশসহ অন্যান্য দেশের শাসকরা রাজপথের আওয়াজে কর্ণপাত করবে, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই তাদের শাহী— তখতের পদস্খলন অনুভব করল! তথাকথিত শেখ এবং পেট্রোডলারের সুর— ঝংকারে শ্বাস— প্রশ্বাস নেওয়া উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকরা দিনরাত ষড়যন্ত্র করে এই সংগ্রামকে দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। আশা করি, এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন আরব বসন্ত নতুন শক্তি নিয়ে আবার দাঁড়াবে।

আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে আমেরিকান মুসলিম সৈন্যদের অংশগ্রহণ

শায়খ কারদাভি ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ক্রুসেডীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, মুসলিম দেশগুলোর জন্য আফগানিস্তান হামলায় আমেরিকাকে সমর্থন দেওয়া বৈধ নয়। ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম খুতবা প্রদান করেছেন তিনি। আমেরিকান হুমকির জবাবে তিনি এতদূর পর্যন্ত বলেছিলেন যে, ‘আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, আমার হৃদয়ে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।’

অবশ্য, ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকান যুদ্ধের বিষয়ে শায়খের একটি ফতোয়ায় অনেক মহলে বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালায়, তখন কিছু আমেরিকান মুসলিম সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের বৈধতা বা অবৈধতা সম্পর্কে শরয়ী হুকুম জানতে চেয়েছিল, তাই মুহাম্মদ শায়খ সালিম আল— আওয়া এর জবাবে একটি ফতোয়া লেখেন, এতে শায়খ কারদাভিও স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়েছিল যে, শান্তি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মার্কিন সেনাবাহিনীতে আমাদের মুসলিম ভাইদের উচিত এই শর’য়ী নীতি বজায় রাখা। আমেরিকায় যা ঘটেছে তার প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করা এবং বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমেরিকান মুসলিম সৈন্যের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো যে যুদ্ধটি সংঘটিত হবে, সেখানে কে প্রকৃতপক্ষে দোষী এবং কতজন নিরপরাধ মানুষ লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে তার মধ্যে পার্থক্য করা অসম্ভব। আমেরিকান মুসলিম সৈন্যদের যুদ্ধের এই পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে, অস্থায়ী সামরিক অন্যবিধ সেবার আবেদন করা উচিত। এবং যদি এটি করা না যায়, তবে সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই, যাতে অংশগ্রহণের জন্য তাদের দেশ সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, তারা সিদ্ধান্তকারী নয়, বরং দেশের জন্য জারি করা সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নকারী।

এই ফতোয়ায় শায়খের স্বাক্ষর থাকায় নানা মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শায়খের শিষ্য ড. সালাহুদ্দিন আবদুল হালিম সুলতান (যিনি মিশরে কারাভোগ করছেন, আল্লাহ তাকে মুক্তি দিন) শায়খের এই ফতোয়ার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এবং লিখেন: ‘আফগানিস্তানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমেরিকান যুদ্ধে অংশগ্রহণ শরীয়তের দৃষ্টিকোণ একেবারেই জায়েজ নয়। যুদ্ধ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব না হলে, মুসলিম সৈনিককে যুদ্ধের পরিবর্তে অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরিষেবাগুলিতে কাজ করার জন্য আবেদন করা উচিত। শায়খ সালাহ সুলতানও তার যুক্তি— প্রমাণগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। এতে, শায়খ আরও বলেন যে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরপরই, তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের (আল জামিয়াহ আল— ইসলামিয়াহ আল— আমিরিকিয়া, ডেট্রয়েট) শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করার পরে একটি বিবৃতি জারি করেন। বলেন, না কোনো ধর্ম, না কোনো মানব ঐতিহ্য এই অনুমোদন দেয় যে, স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই কাউকে এই অপরাধের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হবে।

শায়খ সালাহ সুলতান আরো উল্লেখ করেন যে, যারা শায়খ কারদাভির নিকট আমেরিকার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উল্লেখ করেছেন, তারা শায়খের সামনে সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরেননি এবং সেখানকার মুসলিম সৈন্যদের অবস্থাকে বয়ান করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করেছেন। যখন ড. সালাহ সুলতান শায়খের সাথে আলাপ করেন এবং  সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন, তখন তিনি ড. সালাহ সুলতানের অবস্থানকে সমর্থন করেন।

মুসলিম দেশে স্বৈরাচার বা গণতন্ত্র

গণতন্ত্র সম্পর্কে মুসলিম আলিমগণের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কারো কারো মতে, কিছু বাহ্যিক গুণ— বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইসলামি ব্যবস্থা ও চিন্তাধারার সাথে মেলে না। গণতন্ত্র মানে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে শাসন জনগণের জন্য মানানসই নয়, এটি কেবলমাত্র আল্লাহর অধিকার : اِن الحُکم اِلّا لِلّہِ অর্থাৎ, ‘সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর’, (আল— আনআম : ৫৭)। পক্ষান্তরে অন্যান্য আলিমগণ মনে করেন যে, আধুনিক যুগে ভালো শাসক নির্বাচন করার এটি একটি উপযুক্ত উপায়। আমরা যদি ইসলামি বিশ্বের দিকে তাকাই, তবে এই সত্যটি সামনে আসে যে, মুসলিম দেশগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামপ্রাণ এবং ইসলামি সরকার ব্যবস্থা চায়। কিন্তু এটাও একটি বাস্তবতা যে, অধিকাংশ মুসলিম দেশে শাসক নির্বাচিত হয় না, বরং শাসকরা শক্তি ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করে এবং কখনও কখনও অন্য উপায়ে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতাই তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে।

জাতীয় উন্নয়ন, দ্বীনের সেবা, জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে তাদের মূল লক্ষ্য হয় ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং তারপর শুরু হয় অত্যাচার ও দমন— পীড়নের এক সীমাহীন ধারা। এই ধারার সমাপ্তি ঘটিয়ে, ধর্মপ্রাণ মানুষের আশা— আকাঙ্খার প্রতিনিধিত্বশীল শাসনের জন্য বর্তমান যুগে কী পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। অনেক আলেম এ প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করেছেন। অনেকের কাছে এর একটি সমাধান হলো ইসলামি বিশ্বে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। গণতন্ত্রের বহাল হওয়ার ফলস্বরূপ এটা এবং অন্যান্য অনুরূপ সিদ্ধান্তগুলিতে জনগণের ইচ্ছা ও গণ— আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটতে পারে এবং এই প্রক্রিয়াটি সত্তাগতভাবে শরীয়তের চেতনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।

শায়খ কারদাভি ইসলাম এবং গণতন্ত্র (الإسلام والدیمقراطیۃ) নামে একটি বই লিখেছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন  উপলক্ষে তার লেখা— লেখিতে এটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ফিকহ এবং ইসলামি ঐতিহ্যের ভাষায় যাকে শূরা বলি, তার সমসাময়িক অভিব্যক্তি হলো গণতন্ত্রের ব্যবস্থা। হিকমত মুমিনের হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকার, যেখানেই সে এটি খুঁজে পায়, সে এর অধিক হকদার।’

কারদাভি বলেন, ‘কিছু লোক গণতন্ত্রকে স্পষ্ট মুনকার এবং কুফর বলে। এটি সঠিক নয়। জ্ঞানগত পরিভাষার বাইরে গিয়ে, গণতন্ত্র জনগণের উপর কে শাসন করবে, তাদের উপর কোনো অবাঞ্ছিত শাসক চাপিয়ে দেওয়া হয় না, যদি সে ভুল করে তবে তাকে জবাবদিহি করা হয় এবং যদি সে অন্যায় করে, তবে তাকে পদচ্যুত করা হয়, তার জন্য বিচারিক সিদ্ধান্তের একটা উপায় আছে… গণতন্ত্রে যদি এই সারসত্তা বিদ্যমান থাকে, তবে তা কি ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থী? আসল কথা হলো, যে ব্যক্তি ভালোভাবে চিন্তা— ভাবনা করবে সে বুঝতে পারবে যে এটা ইসলামি পদ্ধতির কাছাকাছি। ইসলামে এটা অবাঞ্ছিত যে, যার ইমামতি মানুষ অপছন্দ করে, তাকে তাদের নামাজের ইমাম বানিয়ে দেওয়া।’

শায়খ বলেন, আধুনিক যুগে ইসলাম, ইসলামের দাওয়াত ও মুসলিম উম্মাহ যে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তার প্রধান কারণ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা। ইসলামি দুনিয়ায় শরিয়া ব্যবস্থার লঙ্ঘন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাশ্চাত্যবাদের প্রচার ঘটানোই হয়েছে উৎপীড়ন ও জবরদস্তির মাধ্যমে, আগুন আর খুনের খেলা খেলে। স্বৈরাচারী শাসকরাই ইসলামি দা’ওয়াহ, ইসলামি আন্দোলন এবং দ্বীনের দাঈদের নিশ্চিহ্ন করার কাজ করেছে।’

কারদাভি এটাও বলেছেন যে, অনেক অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসক গণতন্ত্রের নামে তাদের স্বৈরাচারী নখর বিস্তার করেছে। যেখানে এটি ঘটেছে সেখানে সত্তাগতভাবে গণতন্ত্রের অস্তিত্বই ছিল না। অতঃপর তিনি বলেন যে, শাসন করার অধিকার নীতিগতভাবে একমাত্র আল্লাহর। সৃষ্টিতাত্ত্বিক (তাকভীনী) দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহই শাসক, তিনিই মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক, তিনিই ব্যবস্থাপক ও তাকদিরের মালিক। তিনি তাঁর সুন্নাহ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। আর তাশরী’য়ী শাসন বাস্তবায়নের জন্য মহান আল্লাহ রাসুলদের পাঠিয়েছেন, কিতাব নাজিল করেছেন, হালাল— হারামের পরিধি নির্দেশ করেছেন। মুসলিমরা যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, তারা এটিকে শাসনের এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার আহ্বান জানায়, যাতে শাসক নির্বাচনের জন্য ইসলামের রাজনৈতিক শিক্ষা অনুসরণ করা হয়, যা শুরা এবং কল্যাণের পরিবেশকে প্রচার করে। ইজতিহাদি বিষয়াবলী, যেখানে কোনো নস বা টেক্সট বর্তমান নেই, বা এমন নস আছে যেখানে একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব বিষয়ে মতানৈক্য নিরসনের কোন না কোন উপায় থাকা উচিত এবং এধরণের বিষয়ে মানুষ ভোটিং এর পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। শরীয়া এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধা দেয় না।’

ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য সমস্যা

শায়খ কারদাভির জীবন একজন সক্রিয় দাঈর জীবন। তিনি ইসলামি বিশ্বের সকল সমস্যা নিয়ে তার মতামত দিয়েছেন এবং সময়ে সময়ে তার ভূমিকা পালন করেছেন– সেটা আরব বসন্তই হোক বা সিরিয়ায় চলমান রক্তপাত, কিছু আরব শাসকের সহায়তায় তুরস্কের অভ্যন্তরে বিপ্লবের চেষ্টা হোক বা কাতারকে কূটনৈতিক বয়কট বা ঘেরাও করে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হোক। সেটা ইসলামের শত্রুদের এবং স্বৈরাচারীদের দ্বারা ইসলামি আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা হোক কিংবা হোক ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র, শায়খ কারদাভি তাঁর সাহসিকতাপূর্ণ অবস্থান ও ভূমিকা রেখেছেন। এই সাহসিকতার ফলস্বরূপ, শায়খকে কারাবাস, নির্যাতন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং প্রাণনাশের হুমকিও ভোগ করতে হয়েছিল। পরের চেয়ে বেশি আপনরাই তাঁর প্রচেষ্টাকে রোধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের রক্ষাকারী এবং যারা দ্বীনের জন্য সংগ্রাম করে, তাদের প্রতিদানদাতা।

আগের সংবাদশরীফুজ্জামান নোমানি থেকে আবরার ফাহাদ: রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রকারভেদ ও বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের স্বকীয়তা
পরবর্তি সংবাদযুগশ্রেষ্ঠ স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী র.-এর জীবন ও অবদান