শিবলি নোমানির শিক্ষাভাবনা

আবদুল্লাহিল বাকি

ইংরেজদের উপনিবেশিক রাজনীতির উত্থানের পর ভারতবর্ষে মুসলমানদের গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থার পতন ঘটে। ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে হিন্দু সমাজের পাশাপাশি মুসলিম সমাজেও। আর প্রাচীন প্রাচ্য শিক্ষাধারা সরকারি তত্ত্বাবধানের অভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়ে।

এই দুঃসময়ে কাসেম নানুতুবি রহমতুল্লাহি আলায়হি প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে দারুল উলুম দেওবন্দের গোড়াপত্তন করেন। এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তিনি মুসলমানদের বর্তমান অবস্থায় শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকেই তাদের মর্যাদার পথে উত্তরণের সোপান মনে করলেন।

কিন্তু কিছু চিন্তাবিদ এই অবস্থায় ছিলেন খানিকটা ভিন্ন। তাঁরা দুই প্রান্তিক ধারার কোনোটিতেই স্থান নেননি। বিষয়টাকে তাঁরা ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে, মধ্যপন্থায়। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য আল্লামা শিবলি নোমানি। আধুনিক প্রাচীন দুই শিক্ষাব্যবস্থাকেই তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এজন্য দুটিই তাঁর আগ্রহের স্থান দখল করে রেখেছিল। সম্মিলন চেয়েছিলেন তিনি উপযোগী প্রাচীন উপকারী আধুনিকের মাঝে। এটাই তাঁর শিক্ষাচিন্তার মূলকথা। মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানি বলেছেন, ‘আল্লামা শিবলি নোমানি ছিলেন প্রাচীন আধুনিক দুই শিক্ষার মাঝে সেতুবন্ধন।’ (আলআদিব ম্যাগাজিন, শিবলি নোমানিকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা, ২০)

শিবলি নোমানি নিজে ছিলেন প্রাচীন শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তিত্ব। তা আবার গতানুগতিক কোনো মাদরাসাভিত্তিক ছিল না। একেকটা বিষয় একেকজন যোগ্য উস্তাদের নিকট গিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। সর্বশেষ হাদিসের উচ্চ সনদ নিয়েছেন মাওলানা আহমদ আলি সাহারানপুরি রহমতুল্লাহি আলায়হির কাছ থেকে। আধুনিক শিক্ষা তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু তিনি গতানুগতিক শিক্ষার্থী হতে নারাজ ছিলেন, যারা দরসের দরসের পড়ালেখায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে। তিনি ছিলেন ছাত্র হিসেবে উদারমনা। অজানা সকল কিছুই তাঁর আয়ত্তাধীন আনার ইচ্ছে ছিল। এজন্যই তিনি বিস্তৃত অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ছোটবেলা হতেই। তাঁর এই বিস্তৃত অধ্যয়নই তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিল, গতানুগতিক চিন্তার বাইরে একটা নতুন পথের দিকে। কিন্তু পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠেন তিনি আলিগড় এসে।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান যখন নতুন একটা শিক্ষাদর্শন সামনে রেখে মুসলমানদের জাগতিক উন্নতির পথে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই শিক্ষাভাবনায় শিবলি নোমানি, এমকি তাঁর পিতা শায়খ হাবিবুল্লাহ সাহেবও অত্যন্ত প্রভাবিত হন। এজন্যই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মাহদি হাসানকে ১৮৭৬ সালে আলিগড় মোহামেডান কলেজের স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৮৮১ সালে পিতা তাঁর পুত্র শিবলি নোমানিকে নিয়ে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সাথে দেখা করতে যান। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত শিবলি নোমানি খালি হাতে স্যারের সাথে দেখা করতে যাননি। কাব্যপ্রতিভা নিংড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা স্বরচিত আরবি প্রশংসাগীতিকা। তাঁর এই কাব্যপ্রতিভা তাঁর সাথে কথা বলে যে মেধা বিস্তৃত ভাবনার দেখা পেলেন, তা স্যার সৈয়দ আহমদকে প্রভাবিত করে।

এর দুবছর পর ১৮৮৩ সালে আলিগড় কলেজে প্রাচ্যদেশীয় ভাষা বিভাগে একজন অধ্যাপকের প্রয়োজন দেখা দেয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের দৃষ্টি এক্ষেত্রে নিবদ্ধ ছিল শিবলি নোমানির প্রতি। ফলে এই পদে তাঁকে নিযুক্ত করে আপন কাজের সাথি বানিয়ে নেন। আলিগড়ে আসার পর শিবলির চিন্তায় সামগ্রিক জীবনধারায় বিপ্লব সাধিত হয়। পূর্বে শিবলি নোমানি কাব্যসাধনা করতেন। কিন্তু তা ছিল উর্দুর প্রাচীন কবিতার ধারায়। কিন্তু এখানে এসে তাঁর এদিকটায় পরিবর্তন আসে। পাশ্চাত্যের আধুনিক কবিতা কাব্যসমালোচনা দ্বারা তাঁর কবিতা নতুন মুখ গতি পায়। আগে তিনি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করতেন। কিন্তু তা ছিল নিছকই প্রাচীন ফিকহি কালামি অনুষঙ্গে সীমাবদ্ধ। আগে তিনি গায়রে মুকাল্লিদদেরও বিরুদ্ধে লেখাজোকা করতেন। লিখেছিলেনজিল্লুল গামাম ফি মাসআলাতিল কিরাআতি খালফাল ইমাম

আবদুল হাই ফিরিঙ্গিমহল্লিরইমাম ওয়াল কালামগ্রন্থের জবাবিগ্রন্থ হিসেবে রচনা করেছিলেনইসকাতুল মুতাদি আলা ইনসাতিল মুক্তাদি কিন্তু আলিগড়ে এসে এসব বিষয়ে আরবি ভাষার রচনা ছেড়ে দেন। শুরু করেন মাতৃভাষা উর্দুতে লেখালেখি। সাথে যুক্ত হয় নতুন বিপ্লবী চিন্তার প্রভাব, যা তিনি পেয়েছেন স্যার সৈয়দ আহমদ প্রফেসর আর্নল্ডের সাথে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে। তিনি মুসলমানদের শিক্ষা নিয়ে ভাবেন। ইতিহাসে মুসলমানদের শিক্ষাগত উৎকর্ষ বর্তমানে সেই শিক্ষার পতন বিচ্ছিন্নতায় তিনি ব্যথিত হন। পূর্বের শিক্ষাব্যবস্থাগুলো তুলে ধরে মুসলমানদেরকে এদিকে তিনি আগ্রহী করতে চান। এজন্য সর্বপ্রথম রচনা করেনমুসলমানুঁ কি গুদাশতা তালিম

তিনি যে এই পরিবেশ, সৈয়দ আহমদ আর্নল্ডের দ্বারা নিজেই শুধু প্রভাবিত হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। এই পরিবেশের সংকটও তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সংকট দূর করার জন্য প্রয়াসরতও ছিলেন। প্রফেসর আর্নল্ড সৈয়দ আহমদ খানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, এমনকি তর্কবিতর্কও হতো। সেই আলোচনার শুভ প্রভাবও পড়েছিল তাদের উপর। আর্নল্ড একজন প্রাচ্যবিদ গবেষক ছিলেন। কিন্তু শিবলি নোমানির আলোচনায় তাঁর সামনে ইসলাম এর ঐতিহ্যগত সঠিক অবস্থান স্পষ্ট হয়েছিল। এজন্যই তাঁর লেখায় ইসলামের কালচারবিরোধী বিষয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা তাঁকেসহানুভূতিশীলবলে অগ্রাহ্য করতে চায়।

শিবলি নোমানি স্যার সৈয়দ আহমদ খান দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁকে গ্রহণ করে নেননি পুরোপুরি। এজন্যই শিবলি নোমানি একপেশেভাবে শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষার মাঝে মুসলমানদের শিক্ষামুক্তির পথ দেখতে পাননি। তাছাড়া সৈয়দ আহমদ খানের মতো তিনি ইংরেজতোষণ নীতির পক্ষপাতী ছিলেন না। ছিলেন স্বাধীনচেতা। প্রাচীন আধুনিকউভয়ের সমন্বয়ের কথা তিনি ভেবেছেন। সেই কলেজের পরিবেশেও ছাত্রদের মাঝে তিনি আরবি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। মাঝে মাঝে ছাত্রদের নিয়ে তিনি সিরাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এমনকি ছাত্রদের জন্যবাদউল ইসলামনামক একটি সিরাতগ্রন্থ লিখেছিলেন। আলিগড়ের ছাত্র শিক্ষকদের শুধুমাত্র মুসলমান নয়, ছিল হিন্দু ইংরেজও। এই পরিবেশেও শিবলি নোমানি একটি ইসলামি পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আলিগড় কলেজে আসার পর তিনি আপন শহর আজমগড়েও আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার ইচ্ছে করলেন। এজন্য সেখানে একটা ন্যশনাল স্কুল স্থাপন করেন। প্রথমে সেটা প্রাইমারি স্কুল থাকলেও পরবর্তী সময়ে হাই স্কুলে রূপান্তরিত হয়। সেসময় তাঁর অনুজ অথবা সমবয়সী বন্ধু কোনো আলেমকে চিঠি লিখলে গুরুত্বের সাথে ইংরেজি শিক্ষার তাগিদ দিতেন।

শুধুমাত্র স্বদেশ নয় বরং বহির্বিশ্বের মুসলমানদের শিক্ষাগত অবস্থাও তাঁকে পেরেশান করে রাখত।হিন্দুস্তানের মুসলমানদের শিক্ষাগত অধঃপতন তো তাঁকে ব্যথিত করতই, উপরন্তু তিনি যখন ১৮৯২ সালে ইসলামি শহরগুলো, যেমন ইস্তাম্বুল, কায়রো, বৈরুতের সফরে গেলেন তখন সেখানে হিন্দুস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে উন্নত আর কিছুই দেখতে পেলেন না। (আলামুল মুসলিমিন৮৩, শিবলি নোমানি, পৃষ্ঠা, ৫১)

তিনি ১৮৯২ সালে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এসে তাঁর সফরনামায় লিখেন, ‘আলআজহারকে দেখে মুসলমানদের দুর্দশার যে চিত্র আমার সামনে এসেছে তা অন্য কিছুতেই এতটা প্রকটভাবে ফুটে ওঠেনি। এটা একটা বৈশ্বিক শিক্ষানিকেতন। পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ছাত্ররা পড়তে আসে। এখানকার বার্ষিক ব্যয় ভারতীয় রুপি হিসেবে তিন লাখেরও বেশি। এখানের ছাত্রসংখ্যা বারো হাজারের মতো, যারা পুরো মুসলিম জাতির আশাভরসার কেন্দ্র। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই আজহার আমাদের হাজার হাজার সন্তানকে অচল, কর্মহীন করে গড়ে তুলছে। এর যেই শিক্ষাব্যবস্থা সেটা শুধুমাত্র ছাত্রদের স্বপ্ন, উচ্চাশা, উদ্দীপনা, ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য মানবিক ভালো গুণাবলির মৃত্যু ঘটাতে পারে। আমি এখানে অনেক ছাত্রকে দেখেছি, যাদের আত্মীয়স্বজন বড় বড় চাকরিতে লেগে আছে। নিজ হাতে টাকা উপার্জন করছে।

কিন্তু সেই ছাত্ররা ক্লাস শেষ হলে ঘাটে বাজারে গিয়ে রুটির দুটো টুকরো ভিক্ষা চাইতে মোটেও লজ্জাবোধ করে না। এদের মতো নিম্ন সংস্কৃতির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কি ইসলামের শানশওকত বৃদ্ধি করা সম্ভব? এরচেয়েও দুঃখজনক বিষয় হলো, আজহারের শিক্ষাপদ্ধতি। এই পদ্ধতি গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে নাহু আর ফিকহকে। এই দুটি শিক্ষার সময়সীমা আট আটটি বছর। এখানে তর্কবিদ্যা, দর্শন, গণিতসহ অন্যান্য বুদ্ধিকেন্দ্রিক শাস্ত্রের কোনো পাঠ নেই। অবশ্য উসুলে ফিকহ, তাফসির, হাদিস, বালাগাতের কিছু ক্লাস সেখানে হয়, কিন্তু এর পরিমাণও অত্যন্ত নগন্য। বুঝলাম পদ্ধতিটা নাহু ফিকহ কেন্দ্রিক। কিন্তু সেটাও আবার নতুনত্ব গবেষণা হতে যোজন যোজন দূরে।

এখানে ছাত্র একাধারে মুখস্থ করতে থাকে কাফিয়া, এর সকল শরাহ, সকল হাশিয়া। এই অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাপদ্ধতির দরুণই আজহার দীর্ঘদিন যাবত জাতিকে কোনো লেখক, সাহিত্যিক, গবেষক, কিংবা একজন বড় আলেমও অন্তত উপহার দিতে পারেনি। দুঃখজনক বিষয় হলো, যদ্দূরই শিক্ষা দেয়া হয়, এরও কোনো শৃংখলাবদ্ধতা নেই। কোনো শ্রেণি নেই, স্তর নেই, সিলেবাস নেই, পরীক্ষা নেই। এমনকি এই ভঙ্গুর অবস্থা সংশোধনের চিন্তাও কারও নেই।’ (রিহলাতু শিবলি, পৃষ্ঠা, ২৭২৮)

যখন আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হলো ১৮৯৯ সালে, তখন আল্লামা রশিদ রেজা তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাআলমানার‘ (সংখ্যা: ৩০ জুমাদাস সানি ১৩১৭ হি.)- তিনজন শিক্ষাসংস্কারকের নাম প্রস্তাবনা হিসেবে পেশ করেন। . শায়খ আহমদ জান রুশি, . শায়খ আহমদ শানকিতি মাগরিবি, . শায়খ শিবলি নোমানি আলহিন্দি। (হায়াতে শিবলি, ১২)

এই সময়ের মধ্যে শিবলি নোমানির একটা নির্দিষ্ট চিন্তাধারা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে। তার শিক্ষাচিন্তার মূলনীতিগুলো ছিল

* মুসলমানদের শিক্ষার সমস্যাটা কোনো ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ নয়, বরং এটা তাদের জাতীয় সামাজিক জীবনের সাথে উতপ্রোত একটা বিষয়। এজন্যই শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা উচিত।

* প্রাচীন আধুনিক, উভয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপযোগিতা আপন ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বীকৃত। কিন্তু বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে দুটোরই সংস্কারের প্রয়োজন।

* আধুনিক শিক্ষার পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। এতে করে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

* প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সেখানে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের কিছু অংশ ঢোকাতে হবে। আর আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতেইসলামিয়াত‘-এর ক্লাস গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

* ধর্মীয় শিক্ষার সাথে আধুনিক বিষয়াবলির মধ্যে ইংরেজি ভাষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা শেখা ছাড়া পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ গবেষকগণ ইসলাম নিয়ে যেসব আপত্তি করে থাকেন, সেগুলো জানাও যাবে না। সেগুলোর উত্তর দেয়া তো দূরের কথা। তাছাড়া ইংরেজিতে বিশুদ্ধ ইসলামী লেটারেচর তৈরির জন্যও ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়া উচিত। আধুনিক শিক্ষিত সমাজ ইসলাম নিয়ে জানার আগ্রহ রাখে। তারা হাতের কাছে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ না পেলে অন্যদের তৈরিকৃত লেটারেচরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, যেসবে ইসলাম ইসলামি শরিয়ার সঠিক প্রতিনিধিত্ব হয়নি।

* মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর বিশেষ কোন জ্ঞানে তাখাসসুসের জন্য অনেক ফ্যাকাল্টি খুলতে হবে। যাতে ছাত্রের রুচি প্রকৃতি অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করতে পারে।

* ছাত্রের মেধার উৎকর্ষ তর্কে পটু করে তোলার জন্য মুনাযারা বিতর্কঅনুষ্ঠানের আয়োজন করা দরকার। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় যার বহুল প্রচলন ছিল।

* প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার তো, কোনো সন্দেহ নেই প্রয়োজনীয়, কিন্তু সংস্কার ছাড়াও এক দিক থেকে এই শিক্ষা উপকারী। কারণ, এই শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিগণও অনেক জাতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করছেন। (জিহাতুল ইসলাম ম্যাগাজিন, জুলাইডিসেম্বর ২০১২ই সংখ্যা, সংখ্যা:)

আলিগড় কলেজে দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল যাপন করার ফলে কলেজের  শিক্ষা নিয়েও তাঁর কিছু প্রস্তাবনা ছিল। কলেজ ভার্সিটির ছাত্রদের জন্য, তাঁর মতে, শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দীক্ষাই যথেষ্ট নয়, বরং সাথে সাথে বাস্তবিক জীবনেও ধর্মীয় আচার পালন করা প্রয়োজন। এজন্য কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়।

* আধুনিক শিক্ষানিকেতনের পরিবেশে ধর্মীয় একটা আবহ তৈরি করতে হবে। যাতে ধর্মের চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

* ধর্মীয় বিষয়াবলির পরীক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া। অর্থাৎ ইংরেজি পরীক্ষার পাশমার্কের মতোই আরবি পরীক্ষার মার্ককে আবশ্যকীয় করে দিতে হবে।

* কলেজের দীনিয়াত বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত দেয়া উচিত জ্ঞানী যোগ্য আলেমদেরকে।

* কলেজে বিভিন্ন দীনি বিষয়ের ওপর মাঝে মাঝে আউটটাইমে লেকচারের আয়োজন করা যায়।

* ধার্মিক ছাত্রদেরকে অগ্রগণ্য রাখা।

* এগুলোর চেয়েও বেশি যেই কাজটা করা উচিত, তা হলো কিছু ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রকে চাকরির পাশাপাশি মাদরাসার জ্ঞানগুলো শেখার উন্মুক্ত পরিবেশ করে দেয়া। (মাকালাতে শিবলি : /১৪১১৪২)

আলিগড় কলেজের পরিবেশে তাঁর মন বসছিল না। তাছাড়া মৌলিক ক্ষেত্রে সৈয়দ আহমদ খানের সাথে তাঁর মতভিন্নতা প্রকট হয়ে ওঠে। এই মৌলিক মতভিন্নতা তিনটি ক্ষেত্রে বড় হয়ে দেখা দেয়।

১. সৈয়দ আহমদ খানের মত ছিল, ছাত্ররা একমাত্র ধর্ম ছাড়া সকল ক্ষেত্রে ইংরেজদের অনুসরণ করবে। কিন্তু শিবলি নোমানি এই কথা মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, বিশুদ্ধ ইসলামি আকিদা বিশ্বাস এইরূপ মতামত সমর্থন করে না।

. তখন মাত্র নতুন নদওয়াতুল উলামা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। মাওলানা শিবলি নোমানি সেখানকার প্রতিটি মজলিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উপস্থিত থাকতেন। সেখানের এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির উত্থানের পথ হলো তারা যত সামনে বাড়বে, এগিয়ে যাবে, ততটা উন্নতি সাধন করতে পারবে। কিন্তু মুসলমানদের উত্থান উন্নতির পথ একেবারে ভিন্ন। তারা যতটা পেছনের দিকে তাকাবে, যতটা ঐতিহ্যের পথে ফিরে যাবে, সাহাবিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে ততই উন্নত মর্যাদাবান হতে পারবে।কিন্তু এই কথাকে সৈয়দ আহমদ খান মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল বিপরীত কথাটা। এজন্য শিবলির এই কথাটির বিরুদ্ধে একটা প্রবন্ধ লিখে ছাপিয়েছিলেন।

. শিবলি নোমানির কথা ছিল, ছাত্রদের জন্য ইংরেজি ভাষার শিক্ষা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনিভাবে আরবি ভাষার শিক্ষাও অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই মতকে সৈয়দ আহমদ খান পছন্দ করেননি। তাঁর মত ছিল, আরবি ভাষা শিক্ষা ছাত্রের জন্য ইংরেজি চর্চার পথে অন্তরায়। শিবলি নোমানি নিয়ে তো মাসুদ আলম নদভিকে একটা পত্রে বলেছেন, ‘বড় দুঃখজনক বিষয় হলো, আমার সাথে স্যার আহমদ খান সাহেবের মৌলিক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বিদ্যমান। আমি ত্রিশ বছর যাবত মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবছি, গভীরভাবে চিন্তা করছি, তাই আমি খুব ভালো করেই জানি, মুসলমানদের উন্নতির পথে অন্তরায় বিষয়টাই যে বিষয়ের শিক্ষা দিয়ে থাকেন সৈয়দ সাহেব।

(হায়াতে শিবলি, পৃষ্ঠা: ২৪১)

আলিগড় থেকে বের হয়ে যাবেন যাবেন অবস্থায় এই চিঠিটা লেখার বারো/তের দিনের মাথায় সৈয়দ সাহেবের ইন্তেকালের খবর আসে। আলিগড়ে এরপর শিবলি নোমানি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন। যুক্ত হয়ে পড়েন নদওয়াতুল উলামার আন্দোলনের সাথে। কারণ এই নদওয়াই ছিল আত্মার গভীর আকুতি, এই আন্দোলন ছিল তাঁর দগ্ধ হৃদয়ের অনুবাদ। এরপর আলিগড় থেকে শিবলি নোমানির প্রতি অনুরোধ আসে স্যার সৈয়দ সাহেবের ধর্মচিন্তা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখার। এটার ক্ষেত্রে শিবলি নোমানি অস্বীকৃতি জানান। মাওলানা হালি শেষমেশ এই কাজ আঞ্জাম দেন। আর অধিক পীড়াপীড়িতে শিবলি নোমানি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেনস্যার সৈয়দ আওর উর্দু লেটারেচরনামে।

(হায়াতে শিবলি, পৃষ্ঠা: ২৪২)

১৮৯৪ সালে নদওয়া প্রতিষ্ঠার পর এটার সাথে শিবলি নোমানি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৯৮ সালের মার্চ মাসে সৈয়দ সাহেব মারা যাবার পর নদওয়াকেই নিজের লক্ষ্যউদ্দেশ্য শেষ গন্তব্য হিসেবে স্থির করেন। এখানকার শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পান তিনি। এখানেই তিনি তাঁর শিক্ষাভাবনাগুলো প্রয়োগ করার প্রয়াস চালান। তিনি এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারবার এই কথা জোর দিয়ে বলে থাকি যে, মুসলমানদের জন্য ইংরেজি বিদ্যানিকেতনের বিদ্যা শুধুমাত্র যেমন যথেষ্ট না, তেমনিভাবে যথেষ্ট না প্রাচীন আরবি মাদরাসাগুলোর তালিমও। আমাদের সমস্যার সমাধান প্রাচ্য পাশ্চাত্য দুটির মাঝে একত্রে নিহিত।’ (মাকালাতে শিবলি, /১৬১)

শিবলি নোমানির প্রস্তাবনার কারণেই প্রথমবার না হলেও পরেরবার নদওয়াতুল উলামায় ইংরেজিকে নেসাবের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় কুরআন শিক্ষার ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ। এমনকি কোরানের মূল মতন সেই শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত নেই। আছে তাফসিরের দুটি মাত্র কিতাব, . তাফসিরে জালালাইন। সেটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। গুণলে দেখা যাবে এই তাফসিরের শব্দসংখ্যা খোদ কুরআনের শব্দসংখ্যা হতে বেশি হবে না। . তাফসিরে বায়জাবি। এটা বিস্তারিত তাফসির হলেও দুই পারার অধিক এই তাফসির থেকে পড়ানো হয় না।’ (মাকালাতে শিবলি, /১৫৮)

এজন্যই নদওয়ায় প্রাচীন মানতেক, ফালসাফার পরিমাণ কমিয়ে কুরআনের মতনকে ক্লাসের অন্তর্গত করা হয়। তাফসির পাঠদানের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তন ঘটে।

এসব পরিবর্তন সাধন করার পাঁচ বছর পর অন্তর্গত ইখতেলাফের দরুণ নদওয়া থেকেও একপর্যায়ে তাকে চলে আসতে হয়। এরপর মাতৃভূমি আজমগড়ে তিনি থিতু হয়ে পড়েন। এখানে দুটি কাজ হাতে নেন। এক. গবেষণাগার স্থাপন। দুই. একটা মাদরাসার গোড়াপত্তন।

উদ্দেশ্যেই তিনি গবেষণার জন্যদারুল মুসান্নিফিনকায়েম করেন। বর্তমানে যাশিবলি অ্যাকাডেমিনামে পরিচিত। এবংমাদরাসাতুল ইসলাহনামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। দায়িত্ব তুলে দেন আপন ভাগ্নে মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহির হাতে। তখন আর্যসমাজিদের ধর্মপ্রচার খুব জোরেশোরে চলছিল পুরো ভারতজুড়ে। এর বিরোধিতা শিবলি নোমানি অনেকদিন যাবত করে আসছিলেন। কিন্তু তারা ধর্মের জন্য ছিল উৎসর্গপ্রাণ। ধূতি পড়ে, পানসুপারির সম্বল নিয়ে ভারতের মাথা থেকে মাথা ঘুরে ঘুরে ধর্মপ্রচার করত। তাদের এই কৃচ্ছতা, ত্যাগস্বীকারের মানসিকতা শিবলি নোমানিকে প্রভাবিত করে। তাই ফারাহিকে বিভিন্ন চিঠিপত্রে তিনি বলেছেন ছাত্রদেরকে কষ্টসহিষ্ণু ত্যাগী হিসেবে গড়ে তোলার কথা।

জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই দুটি কাজ নিয়েই সময় অতিবাহিত করেন। এই আজমগড়েই তিনি ১৯১৪ সালে জান্নাতবাসী হন। শিবলি নোমানি অবশ্যই একজন প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন, বহুমুখী যোগ্যতা চিন্তার সরোবরে অবগাহন করা ব্যক্তিত্ব, যাঁর চিন্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা চলছে, এবং চলতেই থাকবে।

তথ্যসূত্র

. হায়াতে শিবলি, সৈয়দ সোলায়মান নদভি, প্রকাশ : শিবলি অ্যাকাডেমি আজমগড়, ২০০৮ ইং

. মাকালাতে শিবলি : তৃতীয় খণ্ড, শিবলি নোমালি, প্রকাশ: শিবলি অ্যাকাডেমি আজমগড় ২০০৯ ইং,

. আলামুল মুসলিমিন৮৩, শিবলি আননোমানি আল্লামাতুল হিন্দিল আদিব ওয়াল মুআর্রিখুল নাকিদুল আরিব, মুহাম্মদ আকরাম নদভি, প্রকাশ : দারুল কলম দেমাশক, ২০০১ইং,

. জিহাতুল ইসলাম ম্যাগাজিন, সংখ্যা , জুলাইডিসেম্বর ২০১২ ইং, প্রবন্ধ : আল্লামা শিবলি কে তালিমি আফকার আওর আসরে হাজির ম্যেঁ উন কি মানাবিয়াত, জফরুল ইসলাম ইসলাহি,

. রিহলাতু শিবলি, মূল : শিবলি নোমানি, আরবি অনুবাদ: মুহাম্মদ আকরাম নদভি,

লেখক  : তরুণ চিন্তক ও অনুবাদক

আগের সংবাদসমুদ্র শিরোনামে কোলাহলের কথা
পরবর্তি সংবাদপ্রেম, পাখি ও রুহের শূন্যতা