‘শুহাদা-পরিসংখ্যান’: মুসলিম ইতিহাসে ভূমিকম্প

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় ধরনের এই ভূমিকম্পে কেবল তুরস্কেই নিহত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪১৮ জন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০০ জনের বেশি। ভবন ও অবকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বলা হচ্ছে, দশ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আবাসন সঙ্কটে পড়বে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই প্রথম নয়, তুরস্ক তার ইতিহাসে কয়েক ডজন ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের সাক্ষী হয়েছে।

মুসলমানদের ইতিহাসে জনসংখ্যা, সভ্যতা এবং নগরায়নকে প্রভাবিত করেছে ভূমিকম্প। শহরের পর শহর ধ্বংস করেছে। লাখ লাখ জনসংখ্যাকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং হত্যা করেছে। ভূমিকম্পের হাত থেকে বেঁচে থাকা লোকেরা তাদের ক্ষতগুলি সারিয়ে উঠেছে, পুনর্নির্মাণ করেছে তাদের বসতি। এই ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের কারণে মুসলিম ভূমিতে যে বিপর্যয় ঘটেছে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। ইসলামি ইতিহাসের সূত্রে আমাদের কাছে সেসব হাজির রয়েছে।

ইতিহাসের ভয়াবহ পরিসংখ্যান

ভূমিকম্পগুলো বিখ্যাত আলেম এবং কবিদের প্রাণ কেড়েছে। পাশাপাশি শহর ও গ্রামের বাসিন্দাদেরও। যারা ছিল কারিগর, বণিক এবং কৃষক-সহ সাধারণ জনগণ। কোনো উৎসগ্রন্থ তাদের সম্পর্কে বলেছে, ‘ভূমিকম্পে অগণিত লোক মারা গেছে।’

মধ্য এশিয়ার ফারগানা অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে ২২৩ হিজরিতে। ‘নুজুমুজ জাহেরা’ গ্রন্থকার উল্লেখ করেন, ‘এই ভূমিকম্পে ১৫ হাজার লোক মারা যায়।’ শামের উত্তর থেকে দক্ষিণে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ২৩৩ হিজরিতে। ঐতিহাসিকরা প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে উল্লেখ করেছেন, ‘দামেশকের কাছাকাছি শহরটি দুলছিল ভূমিকম্পের আঘাতে। তাতে শহরের অধিকাংশ লোক মারা পড়েছিল। নারীরা পালিয়ে গিয়েছিল। যারা শহরে ছিল, তারা ঈদগাহে গিয়ে দোয়া-কান্নায় রত থেকেছিল মাগরিব-ইশা পর্যন্ত। পরে পৃথিবী শান্ত হলে মৃতদেরকে বের করে দাফন করা হয়। এমনকি গৌতা গ্রামে বেঁচেছিল মাত্র একজন। ভূমিকম্পটি অ্যান্টিওক, মসুল এবং দক্ষিণ আনাতোলিয়া অঞ্চলেx আঘাত করেছিল। এতে মারা গিয়েছিল ৭০ হাজার লোক।’

আর্মেনিয়ার ইসলামিক অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর দুবাইলে একটি বিপর্যয়কর ভূমিকম্প হয়েছিল ২৮০ হিজরিতে। ইবনুল জাওজি লিখেন, ‘রাতে এক তৃতীয়াংশে এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। শহরের মাত্র একশটি ঘরের মতো টিকে ছিল। বাকি সব ধ্বসে গেছে। একে একে পাঁচবার আঘাত হানে ভূমিকম্প। এতে ত্রিশ হাজার লোককে ধ্বংস্তুপ থেকে বের করে দাফন করা হয়। কেউ কেউ বলেন, যাদেরকে বের করে দাফন করা হয়, তাদের সংখ্যা ৫৫ হাজার।’

উত্তর ইরানের তাবরিজে আরেকটি বিপর্যয়কর ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ৪৩৪ হিজরিতে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এটি হাজার হাজার বাসিন্দা এবং নগরায়নকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পুরো শহর পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। ভেঙে পড়েছিল সব দালানকোটা, বাড়িঘর। শহরের আমির রক্ষা পেয়েছিলেন বাগানে থাকার কারণে। ধ্বংস্তুপ থেকে যাদের বের করা হয়, তাদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। ইমাম জাহাবি লিখেছেন, ‘আলেপ্পো শহরে ৫৬৫ হিজরিতে একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। তাতে মারা যায় ৮০ হাজার লোক।’

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো আমাদেরকে বিভিন্ন সময়ে ইসলামিক বিশ্বের অনেক শহর ও অংশে ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যার পরিসংখ্যান প্রদান করেছে। এই পরিসংখ্যান বড্ড ভয়ংকর। দক্ষিণ আনাতোলিয়া এবং শামের উত্তরে ৩৯৩ হিজরির ভূমিকম্পে অনেক মানুষ মারা যায়।

৪৩৪ হিজরিতে শামে সংঘটিত ভূমিকম্প সম্পর্কে ইবনে তাগরি বারদি লিখেন, ‘পালমিরা এবং বালবেকও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং পালমিরার বেশিরভাগ লোক মারা গিয়েছিল।’ ৫৫২ হিজরির ভূমিকম্পটি ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকম্প যা পুরো শামে আঘাত হেনেছিল। ইবনুল আসির লিখেছেন, ‘তাদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল হামা শহর এবং শাইজার দুর্গ। কতজন মারা গেছে এই ভূমিকম্পে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।’

৫৯৭ হিজরিতে শামে যে ভূমিকম্পে আঘাত হেনেছিল, তার প্রভাব মিশর এমনকি উচ্চ মিশরেও পড়েছিল। মিসরে বহু লোক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তারপর নাবলুস ধ্বংস হয়েছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সেই প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে মিশর ও শামে মৃতের সংখ্যা গণনা করে বলেছেন, নিহতের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন। মাগরেবেও ভূমিকম্প হয়েছে এবং ঐতিহাসিকরা সেখানকার মানুষের উপর যে বিপর্যয়, দুর্দশা ও মহামৃত্যু এসেছে, তারও উল্লেখ করেছেন। সালাবি ৪৭২ হিজরিতে আলমোরাভিডস রাজ্যে একটি বিশাল ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করেছেন। সালাবি লিখেন, মাগরেবে এমন ভয়ংকর ভূমিকম্প আগে কেউ দেখেনি। উক্ত বছর রবিউল আউয়াল থেকে জুমাদাল উখরা পর‌্যন্ত প্রতিদিন রাতে ও দিনে ভূমিকম্প হতো।

ভূমিকম্পে আহত-নিহত আলেম-সাহিত্যিক

এই ভূমিকম্পের ফলে সমগ্র ইসলামি বিশ্বে, পূর্ব ও পশ্চিমে কত লক্ষ সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তা কেবল তাদের স্রষ্টাই জানেন। এতে অনেক বড় বড় আলেম, কবি ও লেখকও মারা গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তাবেঈ ও তাবেয়ীনদের বড় একটি দলও রয়েছে।

নিহতদের মধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ হলেন মুফাসসির-মুহাদ্দিস-তাবেঈ মুহাম্মদ বিন কাব বিন হাইয়ান। ভূমিকম্পের সময় তিনি মসজিদে ছিলেন তার কিছু অনুসারীসহ। সবাই মারা যান। ইবনে আসাকিরের বর্ণনা সংক্ষিপ্ত করে ইবনে মানজুর মিসরি বলেন, ‘মুহাম্মদ ইবনে কাব ছিলেন বড় মুফাসসির। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারার নিকট মসজিদে রাবজায় বসে ছিলেন। তখনই ভূমিকম্প ঘটে। মসজিদটি তাদের উপর ভেঙে পড়লে তারা সবাই মারা যান।’

ভূমিকম্পে যে সকল হাদিস বিশারদদের মৃত্যু হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন আবু হুরায়রা নিশাপুরী আনাস বিন আবদুল খালেক বিন যাহির শাহামি। এটি ৫৫৭ হিজরির ঘটনা। ভূমিকম্পে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে বিখ্যাত হাদীসবিশারদ আহমদ বিন সাঈদ মারওয়াযীও আছেন। তিনি তুস ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিলেন।

১৩০হিজরিতে সংঘটিত শামের বড় ভূমিকম্পে আনসারদের অনেক ছেলে এবং তাবেঈদের অনেক বংশধরদের মৃত্যু হয়েছিল। জাহাবি লিখেছেন, ‘এই ভূমিকম্পের আঘাত সবচে বেশি ছিল বাইতুল মুকাদ্দাসে। অনসারসহ আরও যারা সেখানে ছিল, তাদের অধিকাংশই মারা যায়। সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস আনসারির ঘর ভেঙে পড়ে। মুহাম্মদ ইবনে শাদ্দাদ বেঁচে যান। ৫৫২ হিজরিতে শামে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে মারা গিয়েছিলেনর কবি আবু সাহল আবদুর রহমান বিন মুদরিক মাআররি। ইবনে আসাকির হামা শহরে শামের আরেক কবির মৃত্যুর কথা লিখেছেন। তার নাম আলি বিন মুরজি তানুখি। তবে সেই ভূমিকম্পের নির্দিষ্ট কোনো সময় জানা যায়নি।

ভূমিকম্পের ভয়ে মানুষ প্রশস্ত জায়গায় এবং কাঠের বাড়িতে বাস করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, ভারী দুর্গ হলে তা যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। ৫৫২ হিজরির ভূমিকম্পে আহত হন ইসমাইলি শিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান এবং শামের ফাতেমি নিজারি প্রধান আবুল হাসান সিনান বিন সালমান বাসরি। ভূমিকম্পের সময় তার উপর একটি পাথর পড়ায় তিনি খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলেন।

সূত্র: আল জাজিরা

আগের সংবাদ৩০ দেশের নির্বাচনে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ!
পরবর্তি সংবাদ‘ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব’: ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে