সদর সাহেব: উত্তর-ঔপনিবেশিককালে বাঙালি মুসলমানের জাগরণের নকীব

তানভির সাকি:

ভূমিকা

মোঘল সালতানাতের গ্রেটেস্ট সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীরের মৃত্যু-পরবর্তীকালে পুরো ভারতবর্ষজুড়ে এবং বিশেষত বাঙালি মুসলিম সমাজে যে অবক্ষয়ের সূচনা হয়, আঠারো শতকের পলাশী-ট্রাজেডি সেই অবক্ষয়কে আরো ত্বরান্বিত করে। ১৭৫৭-র রাজনৈতিক পটভূমি বাঙালি মুসলমানের জন্য ছিলো সত্যিই একটি ট্রাজেডি, যা তাদের সহস্রাব্দের ঐতিহ্য ও সুদীর্ঘ ছয় শতাব্দীকালব্যাপী তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের সালতানাতকে মুহূর্তেই তছনছ করে দেয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় দুইশতকের শোষণ, পীড়ন ও ব্রিটিশ-ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের মুখে বাঙালি মুসলমানকে এক ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে কালানুপাত করতে হয়। এসময়ে তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়ে ধর্মীয় পশ্চাদপদতা , সাংস্কৃতিক দৈন্যদশা এবং আর্থ-সামাজিক বিপর্যস্ততার শিকার হয়।

বাঙালি মুসলমানের এরূপ ক্রান্তিকালে তাদেরকে উত্তোরণের লক্ষ্যে অনেক শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও সমাজসংস্কারক এগিয়ে আসেন এবং ঔপনিবেশিক-উত্তর বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণে নেতৃত্বদান করেন। তাঁদেরই একজন হলেন উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমেদ্বীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রদূত, দিশেহারা বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক কর্ণধার ও সাংস্কৃতিক নির্মাতা, সমাজসংস্কারক মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, ছদর সাহেব হুজুর রহিমাহুল্লাহ।

মাওলানার বাস্তবোচিত পদক্ষেপ, সুদূরপ্রসারী কর্মসূচী ও প্রাজ্ঞোচিত সংস্কারিক প্রকল্প ঔপনিবেশিকোত্তরকালে বাঙালি মুসলমানের যুগপৎ ঐতিহ্যমুখী ও ভবিষ্যৎ-অভিসারী সম্মুখযাত্রাকে গতিশীল করে তাদের বিকাশ ও নবজাগরণে একটি মজবুত ভিত্তি নির্মাণের কাজ করে।

এই নিবন্ধের শুরুতে আমরা ঔপনিবেশিক বাঙলার মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দুর্দশার সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র আঁকার চেষ্টা করবো। এরপর মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহর জীবন ও বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মানস-গঠনের উপাদান বিশ্লেষণপূর্বক মাওলানার চিন্তা ও কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করবো। তারপরে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখাবো উত্তর-ঔপনিবেশিককালে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণে তাঁর কর্মময় জীবন ও সংস্কারসাধনা কীভাবে একটি মজবুত ভিত্তি নির্মাণের কাজ করেছিলো।

ঔপনিবেশিক কালপর্বে বাঙলার মুসলিম-সমাজ

ঔপনিবেশিক শাসন ছিলো বাঙালি মুসলমানের জন্য এক ভয়াল দুঃস্বপ্নের ন্যায়, যা তাদের হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা স্বপ্নের সৌধকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ে মধ্য দিয়ে বাঙলার মুসলিমরা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই হারায়নি বরং আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিকভাবে এক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে তারা দুশো বছরের জন্য পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

সদ্য-ক্ষমতাহারানো স্বাধীনতাকামী এইসব মুসলমানরাই হয়ে পড়ে বৃটিশশাহীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ইংরেজদের একেকটি ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ মুসলমানদেরকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ ও নির্জীব করে তোলে। তাছাড়া ব্রিটিশ ও হিন্দুত্ববাদের ক্রমাগত সাংস্কৃতিক অভিঘাত বাঙলার মুসলমানদেরকে একটি শেকড়বিচ্ছিন্ন আত্মভোলা জাতিতে পরিণত করে। তারা ক্ষমতাগ্রহণের পর ক্রমান্বয়ে মুসলমানদেরকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক―সবদিক থেকেই কোনঠাসা করে ফেলে।

১৭৯৩ সালে তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এদেশের আবহমানকাল ধরে চলে আসা জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নিঃশর্ত জমিদারি অর্পণ করে একটি স্থায়ী অর্থনৈতিক শোষণের দ্বার উন্মোচন করে। এই ব্যবস্থায় তাঁরা এমন এক রাজস্বনীতি গ্রহণ করে যা ছিলো আদতে কৃষক-শোষণের এক নির্লজ্জ হাতিয়ার। যার মাধ্যমে সুপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভাটি বাঙলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজকাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ধনে ধান্য পুষ্পেভরা যে বসুন্ধরায় মুসলিম শাসনের ছয়শোবছরব্যাপী ছিলো ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক উন্নতি আর অভাবনীয় সমৃদ্ধি, যেখানকার ভূমিরাজস্ব ছিলো দিল্লিশাহীর কাছে পরম আরাধ্য, দুর্ভিক্ষের সাথে ছিলো না যাদের কোনোরূপ পূর্বপরিচয়, সেখানে বৃটিশশোষণের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় দেখা দিলো এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুবরণ করলো খাদ্যের অভাবে। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী লুটেরা বেনিয়ারা তখনও ব্যতিব্যস্ত কড়া রাজস্ব আদায়ে, কৃষকের রক্তশোষণে। তাদের শোষণ লুণ্ঠন ও নিপীড়নকে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী মেকলেও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে―

বাঙলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্ত একথা ঠিক, কিন্তু এধরণের ভয়ঙ্কর শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনদিন দেখেনি। [ সুপ্রকাশ রায় ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পৃষ্ঠা-১০]

এভাবে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়ে বাঙলার মুসলমানরা সামাজিকভাবে ভয়াবহ-রকম পিছিয়ে পড়ে। ১৮২৮ সালে প্রবর্তিত লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ আইন ছিলো মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। মুসলিমদের ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো নির্ভরশীল ছিলো এসকল নিষ্কর ভূমিকে কেন্দ্র করে। এইসকল প্রতিষ্ঠান ছিলো মুসলিম সভ্যতার রক্ষাকবচ। ইংরেজশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে এদেশে নিষ্কর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল মোট ভূমির এক-চতুর্থাংশ। এসব ভূমিকে কেন্দ্র করে বাঙলায় অসংখ্য মাদরাসা, মসজিদ, সুফি খানকাহ, দরগাহ, ইমামবাড়া, মুসাফিরখানাসহ অসংখ্য জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এসময় বাঙলায় শুধু মাদ্রাসাই ছিল আশি হাজার। যা তৎকালীন জনসংখ্যার ধর্মীয় প্রয়োজন ও শিক্ষা চাহিদা পূরণে ছিল যথেষ্ট।  গৌড়, পান্ডুয়া, দারসবাড়ি, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, সোনারগাঁও, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যাতে উপমহাদেশের বাইরে থেকেও অসংখ্য শিক্ষার্থী এসে ভিড় জমাতো।

ইতিহাস-গবেষক ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন―ইংরেজদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়। ইসলামী শিক্ষার মহতী কেন্দ্ররূপে বাঙলার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার অবসান ঘটে। শিক্ষা-সংস্কৃতির সেই বিস্মৃত কেন্দ্রগুলোর সন্ধান লাভও এখন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। [মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, সবুজপত্র, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ৬০-৬১]

নিষ্কর ভূমি বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমেই তাদের চক্রান্ত শেষ হয়নি, ১৮১৪ সালে তারা যে ইংরেজি শিক্ষার ধারা এদেশে চালু করেছিল, ১৮৩৫ সালে এসে তাকে আরো জোরদার করে এবং ইংরেজ-প্রবর্তিত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেয়। মুসলমানদের চিন্তা চেতনার পরিপন্থী তাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা যে এদেশে তাদের একদল কেরানী তৈরির লক্ষ্যে নিবেদিত ছিল, তা মেকলের উক্তি থেকেই স্পষ্ট। মেকলে বলেন―বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাষিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্তমাংসের গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবে বটে; কিন্তু রুচি, মতামত ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে খাঁটি ইংরেজ। [ড়িড়ফৎড়ি সরহঁঃবং ড়হ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ,১৮৬২]

১৭৩৭ সালে রাজভাষা ফারসী থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি ছিলো বাঙালি মুসলমানের সভ্যতা-সংস্কৃতির কফিনে শেষ পেরেকটি পুরে দেয়ার আয়োজন। ডক্টর আব্দুল মান্নান বলেন―
চাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত করা হয়েছিল অফিস-আদালতের ভাষারূপে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালু করার মাধ্যমে। [মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, সবুজপত্র, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ৬৬]

মুসলিম শাসনামলে সামরিক-বেসামরিক রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। দেওয়ানী, রাজস্ব আদায়সহ বাঙলার ১৬৬০টি পরগনার আমিন, আলিম, কারকুন, খাজাি , কানুনগো প্রভৃতি পদে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী কাজ করতো। এই সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইংরেজরা সুপরিকল্পিতভাবেই মুসলমানদেরকে চাকরীচ্যুত করে। ভেঙে দেয় তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৬৪]

ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার বলেন―সত্য হলো এই যে, এদেশের শাসন-কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরাই ছিল উন্নততর জাতি এবং শুধুমাত্র মনোবল ও বাহুবলের বেলাতেই উচ্চতর নয়, এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় দক্ষতা এবং সরকার পরিচালনায় বাস্তব জ্ঞানের দিক থেকেও তারা ছিল উন্নততর জাতি। এ সত্ত্বেও মুসলমানদের জন্য এখন সরকারি চাকরি এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্র এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। [ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা-১৪৮]

ইংরেজরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল এদেশের মুসলমানদের শক্তির অন্তর্নিহিত উৎস হল ইসলাম। তাই তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম ধর্মের সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক-চর্চাকে সমাজ থেকে বিলোপ সাধন করে। আবহমানকাল থেকেই এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন ইসলামের আলোকে পরিচালনা ও তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সমাজ-জীবনে গতিশীল করতে প্রত্যেক পল্লীতে মুফতী, কাজী, মুনতাসিব ও নায়েব নিযুক্ত করা হতো। তারা মুসলমানদেরকে শরীয়তের বিধিবিধান শিক্ষা দিতেন, ধর্মীয় সমস্যার সমাধান দিতেন, মুসলমানদের ইমান-আকিদা হেফাজত করতেন, বিয়ে-শাদী পড়াতেন, জুমুয়ার নামাজ, ঈদের নামাজ, জানাজার নামাজ প্রভৃতিতে ইমামতি করতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামলে মুসলিম সমাজ এইসকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-চর্চার অভাবে ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়েছিল এবং তাদের দৈনন্দিন ধর্মাচারের নানা শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কারের অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো। গবেষক ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন―

প্রতিবেশী হিন্দুদের প্রভাবে ও অনুকরণে বহু কুসংস্কার ও শরীআত পরিপন্থী রীতি-রেওয়াজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। মুসলিম সমাজে প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দু ধর্মীয় বহু অনুষ্ঠান ও সামাজিক আচার-আচরণ এ সময় ঢুকে পড়ে তাদের ধর্মীয় জীবনের অঙ্গীভূত হয়। অনেকে সেগুলোকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে জাতে তোলার ব্যবস্থা করেন। মুসলিম সমাজে মা বরকত, ওলা বিবি ও শীতলা দেবীর পূজা, কালোজিরা পড়া, কাঞ্জিপড়া, তাবীজ-কবজ ইত্যাদি বহু নতুন উপসর্গ বেশ শক্তিশালী হয়ে আসন গেড়ে বসে। হিন্দুদের মনসা পূজার অনুকরণে খোয়াজ খিজিরের পূজা, দুর্গাপূজা-দশোহারার অনুকরণে মহররমের দশ তারিখে হাসান-হুসাইনেরর তাজিয়া বিসর্জন, হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণের অনুকরণে মুসলিম সমাজের নানা পার্বণ চালু হয়। [মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, সবুজপত্র, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ৭১]

এভাবেই শিক্ষা-দীক্ষায় সমৃদ্ধ, অর্থনৈতিক সচ্ছল, সামাজিকভাবে সুসংহত―একটি জাতিকে নিরক্ষর, নির্জীব, চেতনাহীন একটি পশ্চাদপদ জাতিতে রূপান্তর করা হয়। বাঙলার মুসলমানদের এই দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে ডক্টর ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন―

বস্তুত ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের রাজক্ষমতা-চ্যুতি, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারির সংখ্যা হ্রাস, ১৮২৮ সালে বাজেয়াফত আইনে নিষ্কর ভূমির রায়তি স্বত্ব লোপ, ১৮৩৭ সালে ফারসির রাজভাষাচ্যুতি―পরপর এই চারটি বড় আঘাতে পূর্বের শাসকশ্রেণী নিঃস্ব-রিক্ত, নিরক্ষর, নিষ্ক্রিয়, নির্জীব জাতিতের পরিণত হয়। ইংরেজদের প্রশাসনিক আইন ও শিক্ষানীতির ফলেই এই রূপটি হয়েছে। [ডক্টর ওয়াকিল আহমদ : উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা, সাহিত্য অকাদেমি, নিউ দিল্লি, ১৯৮১, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৪১, পটভূমিকা।]

মোটকথা কলোনিয়াল শাসন ছিলো বাঙালি মুসলমানের জন্য এক কালবোশেখী ঝড়ের ন্যায় যা তাদের সবকিছুকে লন্ড-ভন্ড করে দেয়। বৃটিশরা খুবই সচেতন ও সুপরিকল্পিতভাবে দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পাশ্চাত্যমুখী করে এবং বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী : ব্যক্তি ও মানস

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছিলেন বিশ-শতকের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। ঔপনিবেশিক বাঙলায় যেসকল মনীষী ও মহান সংস্কারক বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত মুসলমানের মাঝে পুনরায় ধর্মীয় বোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনার আলো জ্বেলেছিলেন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী তাঁদের অন্যতম।

মাওলানা ১৮৯৮ সালে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়ার এক নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ আরব দেশ হতে এদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারাভিযানে এসেছিলেন। সর্বপ্রথম যিনি বাঙলায় এসেছিলেন তিনি বঙ্গবিজেতা ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাঙলা-অভিযানের সতেরো সৈনিকের একজন ছিলেন। এরপর ঐতিহ্যগতভাবেই এই পরিবারের সকল উত্তর-প্রজন্ম দ্বীনের একনিষ্ঠ দ্বায়ী ও প্রচারক হিসেবে নিজেদেরকে ইসলামের তরে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর পিতামহ ও প্রপিতামহ উভয়েই বালোকোটের খুনরাঙা প্রান্তরে সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ বেরেলভীর সাথে জিহাদে শামিল হয়েছিলেন। এবং উভয়ই ‘গাজী’ উপাধীতে ভূষিত হন। মাওলানার পিতা মুন্সী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহও ছিলেন বিচক্ষণ আলেমেদ্বীন ও ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবাপন্ন বিপ্লবী আলেম।

তাই জন্মসূত্রেই মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী নিজ কওম ও মিল্লাতের প্রতি দ্বায়িত্বানুভূতিসম্পন্ন, দ্বীনের প্রতি উৎসর্গপ্রাণ এক সংগ্রামী মানস নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় পারিবারিক পরিমÐলে। এসময় তিনি কায়দা, আম্মাপাড়া ও জরুরি মাসআলা মাসয়েল শিক্ষা করেন।

সেসময়ে শিক্ষা-দীক্ষার তেমন আনুক‚ল্য ছিলোনা। সামান্য যাকিছু ছিলো তাতেও ছিলো হিন্দুদের একক অধিকার, মুসলমানদের ছিলো নামমাত্র ‘প্রবেশাধিকার’। কিন্তু মাওলানার বাবা ছিলেন খুবই সচেতন ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। সন্তানের শিক্ষা-চাহিদা পূরণে তিনি মোটেও আপোস করেননি। তাই পিতার উদ্যোগে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় গ্রামের এক পূজামণ্ডপে জনৈক হিন্দু পন্ডিতের পাঠশালায়। মাওলানার জীবনীকার মন্তব্য করেন―
এভাবে একজন জগদ্বিখ্যাত যুগসংস্কারকের প্রাথমিক পাঠ একজন পাক্কা মুশরিক হিন্দু পন্ডিতের হাতে পরিপূর্ণ শিরকের উপকরণের মধ্যেই শুরু হলো। কে জানত যে, এই মানুষটিই একদিন সমস্ত শিরিক বিদআতকে ধুয়েমুছে তাওহীদের নূরানী তরিকা জগতের দিকে দিকে বিস্তার করবেন। [মাওলানা আবদুর রাজ্জাক: সমাজসংস্কারক মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী(রহ.) এর জীবনী, বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০১, পৃষ্ঠা-৩৩]

তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাধর ও তীক্ষè মেধার অধিকরী। মেধার সাথে নিয়মানুবর্তিতা ও অধ্যবসয় তাঁকে জীবনভর প্রতিটি বিদ্যালয়ের সকল স্তরেই প্রথমস্থান অধিকারের সৌভাগ্য যোগায়। এমনিভাবে গুরুমান্যতা, সচ্চরিত্র ও মার্জিত ব্যবহারের জন্য তিনি সবসময়ই ছাত্র-শিক্ষক সকলের প্রিয়পাত্র ছিলেন।

বালক শামছুল হক দেশেরই বিভিন্ন মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সাথে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষ করেন।
এরপরে শিক্ষাগ্রহণের জন্য পিতার পরামর্শ ও নির্দেশে তৎকালিন শিক্ষা-সংস্কৃতির পাদপীঠ কোলকাতায় পাড়ি জমান। ‘কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা’র এ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এখানেই অধ্যয়ন করেন। অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তিপরীক্ষায় সারাদেশে প্রথমস্থান অধিকার করেন এবং স্বর্ণপদক পান। মেট্রিক বা প্রবেশিকা পরীক্ষায়ও ফার্স্ট ডিভিশনে ফার্স্ট হন। মেট্রিকের ফাইনাল পরীক্ষার আগে মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর সাথে তার মোলাকাত হয়। এই সাক্ষাৎ তাঁর পরবর্তী জীবন ও মানস-গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

এরপর ইংরেজী শিক্ষার প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা সত্তে¡ও বাবার হুকুম পালনার্থে তিনি তখনকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে মানবিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হোন। সেখানে তিনি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর ছাত্রত্ব অর্জন করেন।

এবছর অর্থাৎ ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সারাদেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। কলেজও বন্ধ হয়ে যায়। ইলমের তৃষ্ণায় ব্যাকুল তরুণ শামছুল হক এটাকে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত বাসনা ‘মাদরাসায়’ ভর্তি হবার চিন্তা করলেন। সেলক্ষ্যে দেওবন্দ অভিমুখে যাত্রা করলেন। মাওলানার জীবনীকার তাঁর এই দেওবন্দ-যাত্রাকে অভিহিত করেছেন মনযিলে মকসুদে পদার্পণ রূপে। আসলেই এটি ছিলো মাওলানার জীবনের একটি রিটার্নিং পয়েন্ট।

এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা জরুরী মনে করছি। মাওলানার ইংরেজি-শিক্ষা গ্রহণ করাটা হয়ে উঠেছিল একান্তই তার বাবার উদ্যোগ ও নির্দেশে। তিনি নিজে সারাজীবনই কুরআন সুন্নাহর ইলমের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাছাড়া তিনি যদিও সেক্যুলার শিক্ষাকাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, সাফল্যের সাথে প্রতিটি স্তর অতিক্রম করেছেন কিন্তু এর চেতনাকে কখনোই নিজের মধ্যে ধারণ করেননি। তিনি বরাবরই এই শিক্ষার প্রতি ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। সর্বদা বিভোর থাকতেন ইলমেদ্বীন হাসিলের স্বপ্নে। কিন্তু পিতা তাকে জাগতিক শিক্ষা অর্জনে বাধ্য করেছিলেন। তিনি চাইতেন ইংরেজী শিক্ষার মধ্যে আরবী পড়তে গিয়ে যেন পুত্র শামছুল হকের মনোযোগ নষ্ট না হয়। তাই তিনি আরবী শিক্ষাগ্রহণের ব্যপারে কিছুটা কঠোর ছিলেন। বাহ্যত যদিও মনে হয় তিনি ইসলামী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু বস্তবতা এর পুরোপুরি বিপরীত। মাওলানাকে জাগতিক জ্ঞানার্জনে বাধ্য করার পিছনে পিতা মুন্সী আব্দুল্লাহর বিশেষ হিকমত ছিলো। মাওলানার জীবনীকার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তিনি লেখেন―

তিনি (ছদর সাহেবের পিতা) শুধু চিন্তা করতেন, আমরা ইসলামের মুজাহিদ, ইসলাম এবং কোরআন হাদীস আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে এবং এদেশে ইসলমী হুকুমত কায়েম করতে হবে। কিন্তু ইংরেজ এদেশে মজবুভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। কাজেই তাদের আঁখড়া সমূলে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে ইংরেজী বিদ্যা শিখে তাদের হাড়-নাড়ের সন্ধান নিয়ে তাদেরকে পারজিত করতে হবে। এই শিক্ষার ক্ষতি হলে জিহাদের যোগ্যতা কমে যাবে। এজন্য ইংরেজি পড়ার সময় তিনি পুত্রকে অন্য শিক্ষা দিতে নারাজ ছিলেন এবং পরে ঘরের দৌলত ইসলামী শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। ইসলামী শিক্ষার বিরোধী তিনি কখনোই ছিলেন না বরং তার এবং তার বংশের লোকদের জীবনইতো ইসলামী শিক্ষার জন্য উৎসর্গকৃত, শুধু আগে পরের ব্যবধান। অন্যদিকে হযরত ছদর সাহেব হুজুরের চিন্তাধারা ছিলো এই― সর্ব প্রথমেই আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও কুরআন হাদীসের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পরে প্রয়োজনীয় বিদ্যা যা দরকার শেখা যাবে। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৩]

মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী দ্বীনি ইলমের প্রতি অপরিসীম তৃষ্ণা লালন করতেন, ফলে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন উস্তাদের নিকট নিজ প্রচেষ্টায় কিছু কিছু দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষা শিখে ফেলেছিলেন। ইলমে তীব, জ্যামিতি শাস্ত্র, ফিকহ শাস্ত্রের কিতাব কুদুরী, শরহে বেকায়া এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছিলেন।

১৯২২ সালে তিনি দেওবন্দ যান, সময়টা ছিলো শিক্ষাবর্ষের শেষের দিকে। তাই নতুন শিক্ষাবর্ষের আগ পর্যন্ত দুমাস থানাভবনে হযরত থানবীর সোহবতে থাকেন। পরবর্তী বর্ষে হযরত থানবীর পরামর্শে সাহরানপুর মাদরাসায় কাফিয়া জামাতে ভর্তি হলেন। সাহরানপুরে দীর্ঘ চারবছর তাঁর ইলমী সফর অব্যাহত ছিলো। এসময়ে তিনি শরীয়তের যাহেরী ইলমে বুৎপত্তি অর্জনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ইলম অর্জনের জন্য থানাভবনের সাথে মযবুত যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং হাকীমুল উম্মতের নিকট নিজের আধ্যাত্মিক চিকিৎসা গ্রহণে নিরত ছিলেন। দীর্ঘ চার বছরের প্রতিটি বৃহস্পতিবার তিনি থানবীর খানকায় হাজিরা দিয়েছেন, একবারের জন্যেও এই রুটিনের ব্যত্যয় ঘটেনি।

এরপরে তিনি উপমাহাদেশে দ্বীনি শিক্ষার কেন্দ্র, মাদারে ইলমী, দারুল উলুম দেওবন্দে তাঁর অধ্যয়নজীবনের শেষ দুবছর কাটান। সেসময়েও থানবীর সাথে তার ইসলাহী তাআল্লুক অব্যাহত ছিলো। অধ্যায়নজীবনের এই দীর্ঘ সময়ে ছদর সাহেব হুজুর যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদেরকে উস্তাদ হিসেবে পেয়েছিলেন। ইমামুল আসর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, শাইখুল আদব ওয়াল ফিকহ আল্লামা এযায আলী, শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী, হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী― এসকল নক্ষত্রতুল্য মনীষা শুধু ছদর সাহেবের উস্তাদই ছিলেন না, বরং তার চিন্তা ও মানস-গঠনে ছিলো তাদের অসামান্য অবদান ও প্রভাব।
ছদর সাহেবের চিন্তাচেতনা ও মানস-গঠনে প্রধান ভূমিকা ছিলো তৎকালিন উপমহাদেশে ও পুরো মুসলিম জাহানের দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এবং শাইখুল আরব ওয়াল আজম, শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর। তিনি বলেন―

সারা রোয়ে যমীনের মধ্যে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শায়েখ হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) এবং সারা বিশ্বের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠতম উস্তাদ শাইখুল ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)। এই দুইজন আমার জীবনের পথের দিশারী, মাথার তাজ। দুজনকেই আমি একইরকম করে হৃদয় আসন দিয়েছি। এই দুইজনকে ছেড়ে আমি আমার জীবনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারিনা। সারাবিশ্ব খুঁজে আমার জীবনপথে চলার জন্য এ যুগের দিশারী আমার গর্বের সম্বল। আমার জীবনে যা কিছু লাভ হয়েছে, সেক্ষেত্রে এ দুজনেরই অবদান সর্বাধিক। তারা আমার পীর, আমার উস্তাদ। [মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী: অসিয়তনামা, জীবনীগ্রন্থের সাথে সংযোজিত, বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেসন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৮৩]

থনবী ও মাদানী-কেন্দ্রিক উপমহাদেশীয় ইসলামপন্থায় যে দুটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠেছিল মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর মাঝে উভয়টিরই সম্মিলন ঘটেছিল, যা তার ব্যক্তিত্বকে দিয়েছিল ভিন্ন মাত্রা।
সেসময়কার উপমহাদেশীয় পরিসরে তারা উভয়ই ছিলেন ইসলামী চিন্তা ও জ্ঞানজগতের নকীবতুল্য মনীষা। থানবী যেমন ছিলেন তাসাউফের ময়দানে একজন মুজাদ্দিদ ও সমাজসংস্কারক তেমনি হযরত শায়খুল ইসলামও ছিলেন আকাবিরীনে দেওবন্দের বিপ্লবী সিলসিলার একজন দক্ষ কর্মবীর ও সিয়াসি ময়দানের লড়াকু যোদ্ধা।
১৮৫৭র সিপাহি বিপ্লবে রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফলে বিপ্লবী ওলামাদের নেতৃত্বে মুসলমানদের ধর্মনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, হযরত থানবী এবং মাদানী উভয়ই ছিলেন সেই বিপ্লবগাহ দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র ও এর বিপ্লবী সিলসিলার সার্থক উত্তরসূরি। তারা ঔপনিবেশিক ভারতে বিপর্যস্ত, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক মুসলমানদের ভিতরে ইসলামের নৈতিকতার আলো জ্বালিয়ে এবং এর বিপ্লবী চরিত্রকে পুনর্জীবন দান করে একটি ব্যপক সংস্কার এনেছিলেন। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীও ছিলেন তাঁদের সকল চিন্তা-দর্শন ও সাংস্কৃতিক-সংস্কারিক প্রকল্পের যোগ্য উত্তরসূরি। বাঙালি মুসলমান সমাজে তিনি ছিলেন হযরত থানবীর আধ্যাত্মিক-সংস্কারিক মিশন ও মাদানীর উদারনৈতিক আযাদী চেতনার স্বার্থক প্রতিনিধি। মাদানী থানবীর রক্তের ধারায় মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর ধমনীতে প্রবাহিত হয় হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, সাইয়্যেদ ইসমাইল শহীদ, সাইয়্যেদ আহমা বেরেলবী, শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী, মুজাদ্দিদের আলফেসানীর মত উপমহাদেশীয় ইসলামপন্থার বরীত পুরুষদের রক্তের ধারা।

হযরত ছদর সাহেবের ব্যক্তিত্বের উচ্চতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইলমী মাকান বিবেচনা করলে তাঁকে মুফতী আযম শফী উসমানী, শিব্বির আহমাদ উসমানী, আবুল হাসান আলী নদবী, শহীদ হাসান আল বান্নাহ, শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী, যফর আহমাদ উসমানী, মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবের মত সমকালীন মনীষাদের সাথে তুলনা করা যায়।

আল্লামা ফরিদপুরীর সংস্কার ও কর্মধারা

ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রদূত মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী, ছদর সাহেব হুজুর রহ. ছিলেন একজন সত্যিকারের মুজাদ্দিদ ও জাতিগঠনের অদৃশ্য কারিগর। ঔপনিবেশিক বাঙলার বিপর্যস্ত আত্মবিস্মৃত অবক্ষয়িত ও অসচেতন জাতিকে তিনি জাগরণী বাণী শুনিয়েছিলেন। একদিকে তিনি ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছেন অন্যদিকে ধর্মতাত্তি¡ক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের মাধ্যমে সজীব করে তুলেছিলেন বাঙালির নির্জীব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে।

মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন ও সংস্কারসাধনার ব্যাপ্তি চলিশ বছরের। এই চল্লিশ বছরের প্রথম বিশ বছর বাঙালি মুসলমান রাজনৈতিকভাবে বৃটিশ কলোনিয়াল শাসনের অধীনে এবং পরবর্তী বিশ বছর ছিল স্বাধীন পাকিস্তান-রাষ্ট্রের অধীন। মাওলানার এই দীর্ঘ চার দশকের সংস্কারসাধনা উত্তর-ঔপনিবেশিককালে বাঙালি মুসলমানের ঘুরে দাঁড়ানোর পটভূমি তৈরিতে অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, মাওলানার চিন্তা ও সংস্কারের ক্ষেত্র যদিও ছিল পুরো মুসলিম উম্মাহ এবং তাঁর দাওয়াতের সম্বোধন ছিল গোটা বিশ্বমানবতা, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে তা ছিলো বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে।

দেওবন্দ মাদরাসায় যখন মাওলানার অধ্যায়ন-জীবনের সমাপ্তি ঘটে তখন হায়দারাবাদ সরকারের পক্ষ থেকে চীফ জাস্টিস পদে উচ্চবেতনে চাকরির অফার আসলে শিক্ষকরা যখন এই চাকরির জন্য তাঁকে যোগ্য মনে করে উক্ত পদে তাকে যোগদানের খোশখবর দিলেন, তখন এই সুসংবাদ শুনে তিনি উল্টো কেঁদে ফেললেন। বিষন্ন মনে শিক্ষকদেরকে বললেন― ‘হযরত, আপনাদের হুকুম আমার মাথার তাজ কিন্তু ‘দেলে চায় বাঙ্গাল পোর জঞ্জাল’ আমি বাংলাদেশে গিয়ে আমার ভাইদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনবো।’ [প্রাগুক্ত, পৃ ৮২]

তিনি বাঙালি মুসলমানের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হন। বাঙালি মুসলমানকে নিয়ে তাঁর হৃদয়ে ছিলো অপরিসীম দরদ ও উৎকন্ঠা। সংস্কারের ক্ষেত্র হিসেবে তিনি তাদেরকেই নির্বাচন করেছিলেন। এখানে আমরা তাঁর কর্মময় জীবনের নানা দিগন্তকে শ্রেণীবদ্ধ করে জাতিগঠন ও জাতীয় জাগরণের সেগুলির প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস পাবো, ইনশাআল্লাহ।

১. শিক্ষার প্রসার ও মুসলিম-মানস তৈরি

ব্রিটিশরা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্য ও জাতিগত চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শুধু তাই নয় আধুনিক শিক্ষার নামে এমন এক নতুন প্রজন্ম তৈরীর প্রকল্প গ্রহণ করে, যারা রক্তবর্ণে ভারতীয় হলেও চিন্তা-চেতনা ও মননে হবে ইউরোপীয়। এই শিক্ষাগত দুর্দশা ছদর সাহেব হুজুরকে পীড়িত করতো। তিনি বলতেন―

ইংরেজ কাফেররা, ইসলাম ও মুসলিম জাতির যত ক্ষতি করিয়াছে এবং করিতেছে তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বুনিয়াদি ক্ষতি এই করিয়াছে যে, তারা ‘ধর্মহীন শিক্ষার ধারা’ আমাদের দ্বারা গ্রহণ করাইতে পারিয়াছে। কারণ শিক্ষার দ্বারাই মানুষের মন-মস্তিষ্ক তৈরি হয় এবং মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ মন-মস্তিষ্কেরই অনুসারী হয়। ধর্মহীনতার পরিনাম ধর্মদ্রোহিতা। [প্রাগুক্ত, পৃ ১৯১]

শিক্ষা সংস্কারের মধ্য দিয়ে মুসলিম মানস তৈরি করার পক্ষপাতী ছিলেন আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী। কারণ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে সংস্কৃতি জাতীয় জীবনে গেঁড়ে বসে তা কস্মিনকালেও জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মচেতনার অনুক‚ল হয় না। এই চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা বরং নিজেদের আত্মপরিচয়ের জন্য হয় হুমকিস্বরূপ। আধুনিক শিক্ষা নামক শিক্ষানৈতিক উপনিবেশবাদ মুসলমানের মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। মুসলিম আত্মপরিচয় ও জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি তাওহীদি বিশ্বাসের বিপরীতে এই শিক্ষানৈতিক উপনিবেশবাদ তাদের মনোজগতে রোপন করে সেক্যুলার নামীয় এক বিষাক্ত ধর্মদ্রোহী বীজ। আল্লামা চেয়েছিলেন ঈমানবিধ্বংসী এই শিক্ষানৈতিক উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করে বাঙালি মুসলমানকে নিজস্ব জাতিসত্তা ও ধর্মবোধ-উৎসারিত একটি যুগোপযোগী সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে গড়ে তুলতে।

মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহর শিক্ষাকেন্দ্রীক সংস্কারের ধারা ও অবদানকে কয়েকটি মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়।

ক. গণমক্তব প্রতিষ্ঠা: নবপ্রজন্মের মাঝে ইসলামী শিক্ষার বীজ বপন করার অদ্বিতীয় মাধ্যম হলো মক্তব। বাঙালি মুসলমানের হারানো ঐতিহ্য মক্তবশিক্ষার পুনর্জাগরণে মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই মক্তব প্রতিষ্ঠা করতেন। সর্বত্র মক্তব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও বিস্তারে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন, যা একটি ভবিষ্যৎ জাতিসত্ত্বা তৈরীর বীজতলা প্রস্তুতে কাজ করছিলো। [প্রাগুক্ত, পৃ ১৯১]

খ. প্রাথমিক শিক্ষার ইসলামীকরণ: ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও মানসগঠনে মক্তবের পর দ্বিতীয় ভিত্তি হিসেবে কাজ করে প্রাথমিক শিক্ষায়তন। তাই ছদর সাহেব হুজুর জাতির জন্য ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বিত প্রাথমিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এই স্তরের শিক্ষা-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ক্বারী বেলায়েত সাহেব প্রবর্তিত ‘নূরানী পদ্ধতি’ এদেশীয় পরিমন্ডলে প্রাথমিক শিক্ষায় যে বৈপ্লবিক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে তাঁর মূল স্বপ্নদ্রষ্টা এবং রূপকার হলেন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী। [প্রাগুক্ত, পৃ ১২৮]

তাছাড়া ক্বারী আব্দুল হক সাহেবের নূরানী পদ্ধতি, আব্দুল মালেক সাহেবের নূরানী নাদিয়া, জামিয়া নূরিয়ার ধারা, ক্বারী ইব্রাহিম সাহেব প্রণীত পদ্ধতি ইত্যাদি সকল ধারাই হযরত ছদর সাহেব হুজুরের নিজ উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়েছিলো।

গ. মাদরাসা প্রতিষ্ঠা: একসময় মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাই ছিলো এদেশের একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা। যা জাতির ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ধরনের চাহিদা পূরণে সক্ষম ছিলো। ব্রিটিশ-প্রণীত লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ আইনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পড়ে। মানুষের ধর্মীয় চাহিদা পূরণের প্রয়োজন প্রকট হয়ে ওঠে। হযরত ছদর সাহেব এই সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসেন এবং সর্বত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিপ্লব সাধন করেন। তিনি অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। একক ব্যক্তি হিসেবে এত বিপুল সংখ্যক মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সমকালীন দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ অবধি বাংলাদেশের যে এত হাজার হাজার মাদরাসা, এর সিংহভাগ অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহর। তিনি নিজ হাতে যেমন অসংখ্য মাদরাসা গড়ে তুলেছেন তেমনি তার অসংখ্য শিষ্য শাগরেদরা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

ঘ. জাতীয় মানের জামেয়া প্রতিষ্ঠা: জাতির ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক নেতৃত্বদানের জন্য প্রয়োজন একদল যুগোপযোগী আলেমেদ্বীন। জাতির এই চাহিদা পূরণকল্পে তিনি কতগুলি জাতীয় মানের জামেয়া বা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আশরাফুল উলূম বড় কাটারা, জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, খাদেমুল ইসলাম গওহরডাঙ্গা ইত্যাদি যুগশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ সময়ে দেশের ইলমী অঙ্গনের নেতৃত্বদানের পাশাপাশি জাতির ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নেতৃত্বদান ও যুগসমস্যা সমাধানে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। সংকটকালে এইসকল উদ্যোগ ছিলো জাতির জন্য আলোকবর্তিকাস্বরুপ। এইসকল প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটরাই ঔপনিবেশিকোত্তর কালে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণকে গতিশীল করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল শিক্ষা, সংস্কার, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ। লালবাগ মাদরাসার তৎকালীন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তুলে ধরে মাওলানার জীবনীকার বলেন―

অতি অল্প দিনের মধ্যে জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসা শুধু বাংলাদেশেরই নয় বরং মুসলিম বিশ্বের একটি আদর্শ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। লালবাগকে কেন্দ্র করে যেন সারাদেশে এক নতুন ইসলামী জাগরণ শুরু হলো। রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কার ও সমাজনীতি অর্থনীতি এবং হকের প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের প্রতিরোধের এক বিশালাকার ঘাঁটি রূপেই লালবাগের অস্তিত্ব মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। যে স্মৃতি আজ পর্যন্ত আপন গৌরবে অব্যাহত রয়েছে। [পৃ ১২৩]

ঙ. দরসে নিজামীর হাকীকতের তত্ত্বতালাশ ও বিজ্ঞানদর্শন: দরসে নেজামীর ব্যপারে তৎকালীন ইলমী মহলে এক ধরনের ভুলবোঝাবুঝি কাজ করছিল, মাওলানা অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে দরসে নেজামী সংক্রান্ত সেসব সংকীর্ণ চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করেন এবং এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃতি ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তাছাড়া মুসলিম সমাজে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষা সংক্রান্ত বিরাজমান ভুলবোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে তিনি বিজ্ঞানকে স্রষ্টামুখী করার প্রস্তাব পেশ করেন এবং এর কল্যাণমুখী-চর্চার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বাঙালী মুসলমানকে বিজ্ঞানচর্চার নেতৃত্বগ্রহণ ও তার হাল ধরার নির্দেশ দেন। এদেশীয় পরিমÐলে যা ছিল একটি নতুন ও সাহসী অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন―

দরসে নেজামীর হাকীকত আজকাল লোকেরা বুঝিতেছে না। পুরান জামানার একটি শখসিয়াতকে হাকীকত মনে করিতেছে। দরসে নেজামীর হাকীকত এই যে, শুধু ‘মাকুলাত’ অর্থাৎ যুক্তি ও তর্কশাস্ত্র বা জ্ঞান-বিজ্ঞান কিংবা ‘মানকুলাত’ অর্থাৎ কুরআন-হাদীস পড়ানো উচিত নয় বরং ‘মানকুলাত’ এবং ‘মাকুলাত’ একত্রে পড়ানো উচিত।

কারণ ‘মানকুলাতে’র উদ্দেশ্য, আল্লাহ যা বলিয়াছেন এবং রাসূল বলিয়া করিয়া দেখাইয়া দিয়া গিয়াছেন সেইটাকে ভালমত বুঝিয়া বিশ্বাস ও ভক্তিসহকারে শক্ত করিয়া আঁকড়াইয়া থাকিতে হইবে।

মাকুলাতের অর্থ―এমন সব বিদ্যা পড়িতে, পড়াইতে হইবে, যদ্বারা মানুষের আকল বাড়ে, নতুন নতুন আবিষ্কার করিতে পারে। মানকুলাত স্থিতিশীল এবং সত্যভক্তি ও অটল বিশ্বাসভিত্তিক। মাকুলাত প্রগতিশীল এবং যুক্তিভিত্তিক। সত্য-ভক্তি, অটল বিশ্বাস ব্যতিরেকে যেমন শুধু যুক্তিতে কোন একটি কাজও সাধিত হয় না বরং শুধু যুক্তি অনেক সময় মানুষকে বিপদে লইয়া যায় তদ্রæপ যুক্তি না থাকিলেও মানুষ অনেক সময় অন্ধবিশ্বাসে এবং অসত্য ভক্তিতে পতিত হইয়া গোমরাহ হয়। কাজেই যুক্তি এবং ভক্তি―মানকুলাত ও মাকুলাত একত্রেই দরকার। অবশ্য মনে রাখিতে হইবে মানকুলাতের অর্থ―আল্লাহর কুরআন রাসূলের হাদীসের সরাসরি অর্থ এবং সূ²তত্তে¡র বাইরে নয়। মাকুলাতের কোন সীমা নাই―যামানা যেমন বাড়িতে থাকিবে, মাকুলাতও তেমন বাড়িতে থাকিবে। তারিখ, ইতিহাস, জিওগ্রাফি, অংক, জ্যামিতি, এ্যালজ্যাবরা, বৃক্ষ-বিজ্ঞান, পশুবিজ্ঞান, শাসনপদ্ধতি, বিচারপদ্ধতি, রাজনৈতিক বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক বিজ্ঞান, সমাজনৈতিকবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞান, আরও না জানি কত বিজ্ঞান আবিষ্কার হয়―এইসব দ্বারাই আকল বাড়ে। যার দ্বারা যতটা সম্ভব শিক্ষা করা দরকার এবং এইসব বিজ্ঞান যেন আল্লাহর মারেফত বাড়ায়, আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটন করে এবং আল্লাহর অধীনতা স্বীকার করায়, সমস্ত বিজ্ঞানের মুখ সেই দিকেই ফিরাইতে হইবে। খোদামুখী বিজ্ঞানই বিজ্ঞান। নাস্তিকতার বিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়, তাহা ধৃষ্টতা ও অন্ধতার বৈ আর কিছুই নয়। কাজেই কুরআন ও হাদীসের আলোর দ্বারা সমস্ত মাকুলাতকে, সাধারণ বিজ্ঞানকে আলোকিত করিতে হইবে এবং হাল ধরিয়া রাখিতে হইবে। কাজেই দরসে নেজামীই একমাত্র ঔষধ। [মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী: অসিয়তনামা, জীবনীগ্রন্থের সাথে সংযোজিত, বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেসন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৯১-১৯২]

চ. সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রবক্তা ও রূপকার: মাওলানা নিজে যেমন ছিলেন ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিপালিত এক বিরল ব্যক্তিত্ব তেমনি আজীবন উভয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয়ের কথাই বলেছেন। ‘ধর্মহীন কর্মশিক্ষা এবং কর্মহীন ধর্মশিক্ষা উভয়টাই জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে’ এই বিপ্লবী শ্লোগানই ছিলো তাঁর শিক্ষাদর্শনের প্রাণ। তিনি বলতেন―
‘কর্মের মাঝেই ধর্মের পরীক্ষা, এটাই আমাদের আসল কাজ। ধর্মহীন কর্মশিক্ষা এবং কর্মহীন ধর্মশিক্ষা উভয়টাই বেকার।’

মাদরাসা কারিকুলামের সাথে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়ের কথা তিনি শুধু বলেই থেমে থাকেননি, নিজ প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ও এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গিয়েছেন। জীবনীকারের বয়ানে আশরাফুল উলুম মাদরাসার অবস্থা কেমন ছিলো দেখা যাক―

আশরাফুল উলুম মাদরাসার শিক্ষার বৈশিষ্ট্য এই ছিল, শুধু পুঁথিগত আলেমই সেখানে তৈরি হতো না, বরং জীবনের সর্বশাখায় একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মানবরূপেই প্রতিটি ছাত্রকে গড়ে তোলা হত। কুরআন, হাদীস, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতার সাথে সাথে সমাজ ও দেশের যোগ্য নেতৃত্বের উপযোগী করেই এক একজন ছাত্রকে গড়ে তোলা হত। কিরাত বিভাগ, হিফয বিভাগ, আইন গবেষণা বিভাগ, দর্শন ও ফালসাফাসহ যাবতীয় বিভাগের ট্রেনিংই এ মাদরাসায় দেয়া হতো। বক্তৃতা-বিবৃতি, বিচার, প্রশাসন পরিচালনাসহ সমাজ পরিচালনার সর্বদিকের শিক্ষা মাদরাসায় দান করা হতো। [পৃ. ১০৯]

ছ. মসজিদভিত্তিক কুরআন-শিক্ষার প্রসার: এছাড়া সর্বসাধারণের মাঝে কুরআনের হেদায়াত ও পথনির্দেশ পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজ উদ্যোগে সারাদেশে মসজিদকেন্দ্রিক কোরআন শিক্ষা এবং তাফসিরের ক্লাস চালু করে সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। [পৃ. ১০৫, ১০৭]

২. ধর্মতাত্ত্বিক সংস্কার

সবকিছু ছাপিয়ে মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহর প্রধান পরিচয় হলো তিনি একজন আলেমেদ্বীন বা নায়েবে নবী। অর্থাৎ রাসূলের অবর্তমানে তাঁর ঐশী জ্ঞান ও কর্মধারার ওয়ারিশ। একজন নায়েবে নবীর কর্তব্য হলো― ‘নিজের জান মাল ও সম্মানের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ-প্রদত্ত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম কর্তৃক বাস্তবায়িত, সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক সুপ্রতিষ্ঠিত, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কর্তৃক সুশৃঙ্খলিত এবং সত্যপন্থী উলামায়ে উম্মত কর্তৃক সংরক্ষিত মহান শরীয়াতের নির্ভুল আদর্শকে মানবজাতির মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।’

ইতিহাসের গতিধারায় বাঙালি মুসলমান সমাজ ইসলামের মৌলিক চেতনা থেকে থেকে খানিকটা সরে এসেছিলো। ধর্মের মুখোশে তাদের মধ্যে নানা অধর্ম আর কুসংস্কার চেপে বসেছিলো। বাঙালির সংস্কারকপুরুষ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহ ধর্মের উপর থেকে এসকল আবরণ ও জঞ্জাল ধুয়ে মুছে সাফ করে মানুষকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও চেতনামুখী করার প্রয়াসী হন। তার কতিপয় ধর্মীয় সংস্কার নীচে তুলে ধরা হলো।

ক. নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা: মুসলিম সমাজে ধর্মীয় কুসংস্কার আর বিকৃতির মধ্যদিয়ে নানা শিরক, বিদায়াতমূলক বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তিনি সেসব বিষয়ে জাতিকে সতর্ক করে নির্ভেজাল তাওহীদভিত্তিক বিশ্বাস এবং সুন্নাহসম্মত ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটান।

খ. ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বয়ান: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ধর্ম নিছক কিছু আচারসমষ্টির নাম। মানবজীবনের বৃহৎ ক্যনভাসে এর কোনো আবেদন বা বিপ্লবী অবদান নেই। ধর্মকেন্দ্রিক এই সংকীর্ণ চেতনা পাশ্চাত্যের অব্যাহত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর উপনিবেশায়নের ফলে মুসলিম দেশসমূহেও ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি মুসলমান সমাজও এর আওতামুক্ত ছিলো না। তাদের মাঝেও ধর্মকেন্দ্রিক এরকম আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব এক ধরনের সংকীর্ণ চিন্তা দানা বাঁধে। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী এই সংকীর্ণ চিন্তার ব্যাবচ্ছেদ করেন এবং ইসলামকে একটি জীবনমুখী পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ও বিপ্লবী আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি সমকালীন ভাষ্যে বয়ান-বিবৃতি ও লিখনীর সাহায্যে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠার সাথে ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দর্শন ও এর গ্রহণযোগ্যতা মানুষের মাঝে তুলে ধরেন।

গ. ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা: ইসলাম এসেছিল মানুষের মধ্যকার দ্ব›দ্ব এবং বিভেদকে ভুলিয়ে বহুধাবিভক্ত মানবসমাজকে সার্বজনীন কল্যাণ ও মানবতাভিত্তিক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মাঝে খোদ ইসলামকে কেন্দ্র করেই নানা দল, উপদল ও ফিরকার উদ্ভব হয়। অথচ উম্মাহর ঐক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী অনৈক্যগত এই সংকট দেখে ব্যথিত হন এবং তাফরিক বাইনাল মুসলিমিনের বিপরীতে তাওহীদকেন্দ্রিক সার্বজনীন ঐক্যের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি সকল ইখতিলাফ ও শাখাগত মতপার্থক্যের বিভেদরেখা তুলে দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মাঝে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন এক্য স্থাপন করার পক্ষপাতী ছিলেন।

তাছাড়া ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয়ে কে কেন্দ্র করে তর্ক-বাহাস তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। হানাফী-সালাফী কিয়াম-লাকিয়াম দেওবন্দী-গায়রেদেওবন্দী মধ্যকার মতপার্থক্যকে মিটিয়ে উম্মার সার্বজনীন ইত্তিহাদ প্রতিষ্ঠাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ফরয বা অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করতেন। তাঁর উদার ঐক্যচেতনা জীবনীকারের লেখায় সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে―

তিনি কিয়াম, লা-কিয়াম, দেওবন্দী, বেরেলবি, রায়পুরী, শর্ষিনা, ফুরফুরা, তাবলীগি, হাটহাজারী, জৈনপুরি, আহলে হাদীস ইত্যাদির মধ্যে মতভেদকে কোন গুরুত্বই দিতেন না এবং সবাই আল্লাহর বান্দা নবীর উম্মত হিসেবে এক মায়ের পেটের সন্তানের মতো মনে করতেন। কেউ ইখতিলাফ করতে চাইলে তা মাসআলা ও কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন। উম্মতের মধ্যে খুঁটিনাটি আলোচনা ছড়ানোর একেবারে পক্ষপাতি ছিলেন না। [পৃ. ১৩১]

ঘ. লোকজ ধর্মাচার-প্রশ্নে উদারনীতি গ্রহণ: তিনি যেমনিভাবে ধর্মের বিকৃতি ও তাতে নব-আবিস্কৃত বিষয়কে প্রশ্রয় দিতেন না তেমনি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন বিভিন্ন লোকজ ধর্মাচারের ব্যাপারে ছিলেন উদার ও ভারসাম্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে তিনি বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হন নি। শরীয়তসম্মত কাওয়ালী, মুর্শিদী ও মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে তিনি বলেন―

অবশ্যই এলাজের জন্য অর্থাৎ খোদা রাসূলের ইশকের জযবা পয়দা করিবার জন্য বাদ্যবিহীন ইসলামী গজল আমি নাজায়েজ মনে করিনা। এইরূপে রাসূলের ইশকে মত্ত হইয়া খাড়া হইয়া বা বসিয়া গজল বা কাছিদা পড়াকে, মওলুদ শরীফ পড়া-পড়ানোকে আমি শুধু জায়েয মনে করি না বরং অত্যন্ত জরুরী মনে করি। কেননা এই অসিলায়ই সাধারণ লোকে হযরতের জন্মবৃত্তান্ত, জীবনবৃত্তান্ত, সত্যধর্মের জন্য কষ্ট সহ্যের বৃত্তান্তএবং রাসূলের অন্যান্য গুণাবলী, কার্যাবলী, সানা-সিফাত, মুজিযাত জানিয়া রাসূলের পরিচয় পাইয়া রাসূলকে এবং রাসূলের তরিকাকে প্রাণাধিক ভালোবাসিতে শিখিবে। [পৃ. ১৮৯]

সকলকে সাথে নিয়ে চলার মত তাঁর এ উদার মনোভাব জীবনীকার তুলে ধরেন―জৈনপুরী, বাহাদুরপুরী, ফুরফুরা, শর্ষিনা সিলসিলার বুযুর্গদের দ্বীনি খেদমতের ধারা মাওলানা শাছুসুল হক ফরিদপুরী উদার ভাবধারায় আরও একধাপ সামনে এগিয়ে যায়। [পৃ. ১০৭]

৩. প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক কার্যক্রম

বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি কখনোই তাদের ধর্ম ইসলাম থেকে পৃথক হয়নি। ধর্মকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতির যে সংকীর্নায়তন চেহারা ইসলামের সাথে এবং বিশেষত বাঙালি মুসলমানের সাথে তা কখনোই খাপ খায়নি। ধর্ম হিসেবে ইসলাম এই জনগোষ্ঠীর চর্চিত সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে। ইসলামের ভিত্তির উপরেই তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির সুরম্য প্রাসাদ।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছেন―  পঁষঃঁৎব রং যিধঃ বি ধৎব অর্থাৎ আমরা যা, আমাদের বিশ্বাস ও চেতনা যা, আমাদের দৈনন্দিন চর্চা ও যাপন যাকিছুকে ঘিরে সেগুলোই সংস্কৃতি।

মোটকথা মানুষের রীতিনীতি, আচার-বিশ্বাস, ধর্মাচার, সামাজিক রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, মূল্যবোধ, শিল্পকলা, স্থাপত্য, অনুষ্ঠান, ভাষা, অভিন্ন জাতীয় লক্ষ্য ও চেতনা, পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি, জীবনদৃষ্টি, স্রষ্টাতত্ত¡ ইত্যাদির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। আর বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির এসকল বস্তুগত ও অবস্তুগত অপরিহার্য উপাদান গড়ে উঠেছে ইসলামের মিশেলে।

সারকথা হলো শাশ্বত জীবনবিধান ইসলাম বাঙালি মুসলমানের জীবনে এসে নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটিয়েছে। বাঙালিয়ানাকে ইসলামের আদলে ঢেলে সাজিয়েছে। ফলে বাঙালিয়ানা ও ইসলাম এখানে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতি তার স্থানিক বৈশিষ্ট্য সাপেক্ষে নিখাঁদ ইসালামী সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক কালপর্বে ব্রাহ্মণ্য ও পাশ্চাত্যবাদের যুগপৎ সাংস্কৃতিক অভিঘাত মোকাবেলায় বাঙালি মুসলমানকে নতুনভাবে তাদের ঐতিহ্যবাদী নিজস্ব সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনতে হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহর সংস্কারকার্যক্রমগুলো ভিত্তিশীল ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে।

মাওলানার প্রবর্তিত শিক্ষানৈতিক-সংস্কার, ধর্মতাত্তি¡ক-সংস্কার, আধ্যাত্বিক-সংস্কারের মত সংস্কৃতি-নির্মাণের নির্ণায়ক এইসকল অপ্রত্যক্ষ ভূমিকার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান তার সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের সুযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি কিছু প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও তাদের নতুন-সংস্কৃতি নির্মাণকে গতিশীল করেছে।

এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় মাওলানার গৃহীত সেইসকল প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক ভূমিকা।

ক. খাদেমুল ইসলাম জামাত: বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি পুনর্বিন্যাসের সূতিকাগার: স্রষ্টার ইবাদাত সৃষ্টির খেদমত শ্লোগানকে ধারণ করে, অনৈসলামিক সমাজ বিলুপ্ত করে ইসলামী সমাজগঠন ও পাশ্চাত্যের গোলামীর শেকল ভেঙে ইসলামী আদর্শভিত্তিক জনকল্যাণমুখী দেশগঠনের অভিযানকে এগিয়ে নিতে কল্যাণযুগের সমাজবিপ্লবের নববী ধারাকে কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের সংগঠন খাদেমুল ইসলাম জামাত।
সীরাতের দুটি অধ্যায় মাক্কী এবং মাদানী জীবনে ‘সমাজবিপ্লবে রাসূলুল্লাহর অনুসৃত নীতি’কে পাঠ করে মাওলামা শামছুল হক বিশটি উসূল আহরণ করেন এবং তাকে খাদেমুল ইসলাম জামায়াতের ফেনিফেস্টো নির্ধারণ করেন। এই সংগঠন মাওলানার গৃহীত সমাজবিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়নে একদল সংগঠক তৈরী ও আপামর মুসলমানদের মাঝে সাংগঠনিক জিন্দেগি গঠনে ভূমিকা রেখেছিলো। সংগঠনকে গতিশীল ও সার্বজনীন করতে এর চল্লিশটি কেন্দীয় শাখাসংগঠন ছিলো। যেমন খাদেমুল ইসলাম সাধারণ পরিষদ, ছাত্র পরিষদ, কৃষক পরিষদ, শ্রমিক পরিষদ, ব্যবসায়ী পরিষদ, আইনজীবী পরিষদ ইত্যাদী।
খাদিমুল ইসলাম জামাতের এসকল বিপ্লবী প্রয়াস তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজে নবজাগরণের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল। তাই ইতিহাসে এ সংগঠনকে তাদের সাংস্কৃতিক পুনর্বিন্যাসের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

খ. মসজিদ মাদরাসা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন: হযরত ছদর সাহেব হুজুর অসংখ্য মসজিদ মাদরাসা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করে আজও আমাদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই একটি মসজিদ এবং মাদরাসা স্থাপন করতে উদ্যোগী ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এসকল স্থাপনার সংখ্যা অগনিত। আজকের ঢাকা মসজিদের শহরে রূপান্তরিত হবার পেছনেও হযরত ছদর সাহেবের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

আশরাফুল উলুম বড় কাটারা, জামেয়া কোরআনিয়া লালবাগ, জামেয়া ফরিদাবাদ, গওহরডাঙ্গাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান যেমন তিনি নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তেমনি আজকের ঢাকার প্রায় সকল দ্বীনী শিক্ষালয় গড়ে ওঠার পেছনে তিনি কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। সারাদেশে তিনি কয়েক হাজার মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজকের বাঙালি মুসলমানের রাস্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছদর সাহেব হুজুর। ঢাকার লালবাগে সিনেমা হল স্থাপনার উদ্যোগকে তিনি রূপান্তর করলেন শায়েস্তা খাঁ কল্যাণ কেন্দ্রে, খুলনার একটি নাট্যশালাকে রূপান্তর করলেন মসজিদে, এমনিভাবে আজকের ফরিদাবাদ মাদরাসা যে জায়গা দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও বরাদ্দ ছিলো সিনেমা হলের জন্য।

সদর সাহেবের এইসকল ভূমিকা বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি বিজাতীয় সংস্কৃতির উপাদানকে নিজস্ব দেশীয় সংস্কৃতিতে রূপান্তর করেছেন। নাট্যশালা সিনেমাহল কে মানবসেবা কেন্দ্র, ধর্মীয় উপাসনালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া সাংস্কৃতিক রূপান্তরের একেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

গ. ইসলামী গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা: ইসলামের শাশ্বত মুক্তির বার্তা সমকালীন ভাষ্যে মানবজাতির নিকট পৌঁছে দিতে একদল যোগ্য আলেম, লেখক-গবেষক তৈরীর জন্য তিনি এদারাতুল মাআরিফ নামে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর দায়িত্ব দেন তৎকালীন বাঙলার একজন খ্যাতিমান গবেষক, লেখক, চিন্তক আল্লামা নূর মোহাম্মদ আযমীকে। আরেকজন মনীষী আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী ইদারাতুল মআরিফের সূচনাকালে সামনের কাতারে থেকে একে এগিয়ে নিয়েছিলেন এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সত্তরের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ঘ. আর্তমানবতার সেবা: মাওলানার কাজের মধ্যে খেদমতে খালক বা আর্তমানবতার সেবা একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় হয়ে আছে। তিনি সর্বদা নিজেকে মানবকল্যানে নিয়োজিত রাখতেন। ‘খেদমতে খলক’ নামক গ্রন্থ রচনা করে পুরো আলেম সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সামনে সৃষ্টিসেবার গুরুত্ব তুলে ধরেন। উলামদেরকে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন যে, ক্বিয়াদাতুল উলামা বা আলেমদের সামাজিক-নেতৃত্বায়নে সৃষ্টিসেবামূল কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত খাদিমুল ইসলাম জামাতের শ্লোগানও ছিলো― স্রষ্টার ইবাদাত ও সৃষ্টির সেবা।

ঙ. মিশনারী তৎপরতার মোকাবেলা: তৎকালীন মুসলমানদের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে খ্রিস্টান মিশনারীতৎপরতা মহামারী আকার ধারণ করেছিল। বিভিন্ন এনজিও ও মিশনারী সংস্থা সহজ-সরল মুসলমানদেরকে সেবার আড়ালে ধর্মান্তকরণ করে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করার নীল নকশা বাস্তবায়ন করছিলো। শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহ এদের মোকাবেলায় দৃঢ়প্রত্যয়ে অবতীর্ণ হন। খ্রীষ্টবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলায় রচনা করেন ‘আল্লাহর প্রেরিত ইঞ্জিল কোথায়? পাদ্রীদের গোমর ফাঁস’ নামক কিতাব। তাছাড়া ওয়াজ ও বক্তৃতায় খ্রিস্টান-মিশনারীদের মুখোশ উন্মোচন ও জনগনকে তাদের থেকে সতর্ক করে ময়দানী প্রতিরোধ করেন। পাশাপাশি আঞ্জুমানে তাবলীগুল ইসলাম নামে ইসলামী মিশনারী প্রতিষ্ঠান গঠন করে তিনি খ্রিস্টবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের বাস্তবানুগ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিলছড়িতে ষাট একর বিস্তৃত জমিতে এবং ময়মনসিংহের গারোঅধ্যুষিত এলাকা, দিনাজপুর, সুন্দরবনসহ বিভিন্ন জায়গায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

চ. গ্রন্থ রচনা: ছদর সাহেবের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিলো। তিনি বলতেন―
বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের থেকে আমি ভালো বাংলা জানি। কারন আমার ওস্তাদ তাদের ওস্তাদের থেকে বিজ্ঞ ছিলেন। [জীবনী গ্রন্থ, পৃ. ১৫০]

স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তার রচিত গ্রন্থের সাহিত্যমান বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনীয় নয় কেন?
এর উত্তর হলো, মাওলানা সাহিত্য রচনা করেননি। তাঁর রচিত কোন বইই সাহিত্যগ্রন্থ না বরং দাওয়াতি উপকরণ, সুতরাং তাঁর রচনায় সাহিত্য খুঁজতে যাওয়াটাই ভুল।

মনে রাখতে হবে, সাহিত্য-জ্ঞান ও ভাষিক যোগ্যতাকে তিনি সর্বদা ব্যবহার করতেন দাওয়াতের বাহন হিসেবে। আর তার দাওয়াতের ক্ষেত্রভূমি যেহেতু ছিলো শিক্ষাবি ত চাষাভুষা বাঙালি মুসলিম জনতা, তাই তিনি তাদের নিকট বোধগম্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, এক্ষেত্রে তিনি পাণ্ডিত্য দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আর এটাই দাওয়াতের প্রকৃত ফলপ্রসূ উসূল। মাওলানার জীবনীকার লেখেন―

পাঁচটি ভাষায় (আরবী, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি) অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও আজীবন তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে সাহিত্যসেবা করেছেন। তাও আবার নিজে পাÐিত্য দেখাননি কোনদিন। সবাই বুঝে এমন সহজ সরল প্রচলিত ভাষা তিনি ব্যবহার করতেন। কোন সময় মানুষের সহজবোধ্যের জন্য সাধু-চলতির মিশ্রণও ঘটিয়েছেন। অথচ তিনি বলতেন, পাঁচটি ভাষা আমি ভাষাভাষীদের চেয়েও ভালো জানি। আমার সামনে পাঁচ ভাষায় কেউ কলম ধরতে সাহস পায়নি। [পৃ ১৫০]

বাঙালি মুসলমানদের যুগচাহিদা, সমাজবাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তিনি মাতৃভাষায় দুই শত কিতাব এবং হাজার হাজার প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় তাফসীরে হক্কানী নামে সাড়ে ষোলো হাজার পৃষ্ঠার এক অনবদ্য তাফসীর-গ্রন্থ লিখেছেন, যা একইসাথে ইসলামী জ্ঞানের জগতে একজন বাঙালী আলেম বিরচিত অনন্য ইলমী সংযোজন। এছাড়াও তিনি মাতৃভাষাচর্চা এবং সাহিত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি নিজ প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় সপ্তাহিক জলসা, বক্তৃতা সেমিনার, মাসিক পত্রিকা, দেয়ালিকা প্রকাশসহ নানা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে শিক্ষার্থীদের মননচর্চা ও সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশের বর্তমানে যে কয়জন ইসলামী ভাবধারার লেখক জীবিত আছেন এবং গত হয়ে গেছেন প্রায় সবাই তাঁর উৎসাহ ও প্রেরণা লাভ করে ধন্য হয়েছেন।

৪. আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে অবদান

হযরত ছদর সাহেবের সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে তার আধ্যাত্মিক কার্যক্রম বা তাসাউফ-চর্চা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবিদার। নৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া বাঙালি মুসলমানের মাঝে ইসলামের নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার আলো জ্বালতে তিনি একজন প্রকৃত সুফী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাঙলায় জ্বেলেছিলেন আধ্যাত্মিকতার আলো, যে আলো তিনি পেয়েছিলেন থানাভবনে হযরত থানবীর দীর্ঘ সাহচর্যের বদৌলতে। তাঁর আধ্যাত্মিক আলোকধারা থেকে বাঙলার তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ শিষ্য-মুরীদ, কল্যাণার্থী, শুভাকাঙ্খী, ভক্ত-অনুরক্ত নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ ও আলোকিত করেছিলেন। যা সংখ্যার বিচারে অনেক।

৫. বাঙালি মুসলমানের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি ও স্বজাতির রাজনৈতিক দূতিয়ালি

তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমানের প্রকৃত রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও দাবি-দাওয়া আদায়ের সোচ্চার কণ্ঠস্বর। বাঙালি মুসলমানের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে তার অবদান অতুলনীয়। মাওলানার রাজনৈতিক জীবনও বড় বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য। অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শিমলায় মুসলিমলীগের কনফারেন্সে ঐতিহাসিক ভাষণ-প্রদান, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ে সিলেটকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিকরণ, স্বাধীন পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, মুসলিমলীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্যতা, ঐতিহাসিক ‘বাইশদফা ইসলামী শাসনতান্ত্রিক নীতিমালা’ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন, চার দফা আদর্শ-প্রস্তাব পাস, আইয়ুব শাহীর স্বৈরশাসনের মোকাবেলায় আন্দোলনসহ তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে রাজনীতিতে তার আদর্শিক ভিত্তি ছিল অত্যন্ত প্রকট। মাওলানার রাজনৈতিক দর্শন ছিল মৌলিকভাবে আদর্শকেন্দ্রীক। প্রচলিত দল, পার্টি এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।

তার রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও তিনি ক্ষমতার রাজনীতিতে অনাগ্রহী ছিলেন। রাজনীতিকে তিনি কখনোই ক্ষমতায় আরোহনের মাধ্যম মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন রাজনীতি হচ্ছে একটি জীবনদর্শনের সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্তি¡ক লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চলমান হাতিয়ার। এজন্যই পদ-পদবী কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতাস্বর্বস্ব রাজনীতিতে আমরা যেই ছদর সাহেবকে পাই, তারচেয়ে আরো বেশি সফল ও স্বার্থক ব্যক্তিত্বকে পাই সাংস্কৃতিক-রাজনীতি ও ধর্মীয়-সামাজিক জাগরণের মাধ্যমে মূলধারার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে।

উপসংহার

ঔপনিবেশিককালে বাঙালি মুসলমান নিজেদের আত্ম-পরিচয়ের পাটাতন থেকে বিচ্যুত হয়ে যখন দিশেহারা, দিগি¦দিকশূন্য তখন তাদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তাদের দুঃসময়ের দরদী অভিভাবক, মুজাহিদে আযম, আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহ। তিনি হলেন জাতিগঠনের সেই অদৃশ্য কারিগর যারা নিজেদের মেধা ও প্রতিভাকে কোরবান করেন জাতীয় স্বার্থে, কওম ও মিল্লাতের খেদমতে। নিজেদেরকে যারা লুকিয়ে রাখেন জাগতিক সকল যশ-খ্যাতি আর প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে যোজন যোজন দূরে।
জাতিগঠনের যতগুলি কার্যকরী ক্ষেত্র এবং ইতিহাস-বিনির্মাণের যেসকল চলমান ধারা তার সব গুলিতে সরব পদচারণা ছিল তাঁর। একজন মুজাদ্দিদের যাকিছু গুণাবলী ও যোগ্যতার প্রয়োজন মাওলানার মাঝে তার পূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল।

তিনি বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার জন্য সেই আদর্শিক পাটাতন নির্মাণ করেছিলেন যার উপর আজ দাঁড়িয়ে আছি আমরা, আজকের বাঙালি মুসলিম জাতিসত্ত¡া। কিন্তু আশ্চর্য, নিজেদের ভিত্তিপ্রস্তরসম সেই পরিচয়ের পাটাতন ও তার মহান কারিগরকেই যেন ভুলতে বসেছি আমরা।

আগের সংবাদসামর্থ্য থাকলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানো উচিত: উবায়দুর রহমান খান নদভী
পরবর্তি সংবাদপ্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা : শিক্ষামন্ত্রী