সন্তানের বয়ানে মদিনা হুজুর: পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন তিনি?

মাওলানা সালমান আহমদ:

আব্বাজান রহ.-এর স্মৃতিচারণ লিখতে বসে আজ কত স্মৃতি ভীড় করছে। পুরো জীবনই আব্বাজানের স্মৃতিতে স্মৃতিময়। ভাবলেই সেসব স্মৃতি চোখের তারায় ভেসে উঠে। আমি কাতর হয়ে পড়ি, অশ্রুসজল হয়ে পড়ে আঁখিপল্লব। অশ্রু মুছে তবুও আব্বাজান রহ.-এর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিষয়ক কিছু স্মৃতিচারণ তুলে ধরবো এই লেখায়। আমার বেড়ে ওঠা যার হাতের তালুতে, আদরে-সোহাগে, মাদরাসার বাইরে পরিবারেও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। তার স্বীকৃতি থাকবে লেখার প্রতিটি লাইনে।

আদর্শ পিতা

সব সন্তানের নিকটই তার পিতা শ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু সব পিতা তার সন্তানের জন্য আদর্শ পিতা হতে পারে না। কারণ, আদর্শ পিতা হতে হলে আদর্শ মানুষ হতে হয়, উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হয়। এদিক দিয়ে আমরা বড়ই সৌভাগ্যবান, আমাদের পিতা ছিলেন আমাদের জন্য আদর্শ। কারণ, জীবনে যাকে একটি অশ্লীল কথা, একটি মিথ্যা কথা বলতে শুনিনি, গুনাহ করতে দেখিনি, সুন্নাতের বরখেলাফ কোন আমল করতে দেখিনি। নিঃসন্দেহে এমন সৎচরিত্রবান আল্লাহভীরু মানুষ সন্তানের জন্য আদর্শ পিতা।

সন্তানদের শিক্ষাদান ভাবনা

আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে আব্বা-আম্মা দু’জনেই অসম্ভব সচেতন ছিলেন। তবে তারা পাষাণ ছিলেন না। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কখনো কঠোরতা করতেন না, শাসনের চেয়ে দুআ করতেন বেশী। ইলমের চেয়ে আমলের গুরুত্ব দিতেন বেশী। আল্লাহর রহমতে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আব্বা-আম্মা দু’জনই আমাদের উস্তাদ। ছোটবেলায় আম্মাজানের নিকটই আমরা কুরআন শিখেছি। আম্মাজান ছিল কুরআনের পাগল। সর্বদা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। যখন খুব অসুস্থ ছিলেন, তখনও কোনদিন তিলাওয়াত বন্ধ করতেন না।

একমাত্র ছোট ভাই হাস্সান ব্যতীত আমরা সকল ভাই-ই আব্বাজানের নিকট অনেক কিতাব পড়েছি। সহজ ও সুন্দর করে কিতাব বুঝিয়ে দিতেন, পড়া নিতেন। ঠিকমতো ছবক না পারলে কখনো বেত্রাঘাত করাতো দূরের কথা বকাও দিতেন না। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। আমাদের পড়া লেখার ব্যাপারে আব্বা-আম্মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দুআ করি আল্লাহ পাক যেন আমাদের আব্বা-আম্মাকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করেন।

সংসার পরিচালনা

জীবনের শুরুতে আমাদের ছিল অভাবের সংসার। ৫ ভাই ও ৩ বোনের এত বড় সংসারে উপার্জনকারী ছিলেন শুধু আব্বাজান রহ.। সংসার চালাতে তাঁকে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি আমাদের কোন চাওয়া অপুর্ণ রাখতেন না, আমাদের সকল প্রয়োজন মিটাতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। নিজে কষ্ট করতেন, কিন্তু ছেলে মেয়েদেরকে কোন প্রকার কষ্ট করতে দিতেন না।

মাথায় করে বাজার সদাই নিয়ে বাড়ী আসার ম্মৃতি এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আব্বাজান রহ. ছুটিতে বাড়ী গেলে সকল কাজ নিজেই করতেন। ঝাড়ু দিতেন, মাটি কাটতেন, গাছপালার পরিচর্যা করতেন। আমাদেরকে কখনো কোন কাজের কথা বলতেন না। আম্মা যখন বলতেন, ছেলেদেরকে দিয়ে কাজ করান না কেন? উত্তরে আব্বা তখন বলতেন, আমাদের ছেলেরা তো বাড়িতে মেহমান হিসেবে আসছে, মেহমান দ্বারা তো কাজ নেওয়া যায় না।

আব্বাজান রহ. সারা দিন কাজ করে খাওয়ার সময় আমাদের সকলকে ডেকে এক সাথে খানা খেতেন। আব্বাজান রহ. কখনো একা একা খানা খেতেন না। আমাদের সংসারটা ছিল এক টুকরা জান্নাতের মত। কারণ যতটুকুই ছিল ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাটা আমরা আব্বা আম্মার কাছ থেকে পেয়েছি।

স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ

হাদীস শরীফের আলোকে আব্বাজান রহ. ছিলেন একজন সর্বোত্তম মানুষ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি উত্তম যে স্ত্রীর নিকট উত্তম।’ আব্বাজান রহ. ছিলেন আম্মাজানের নিকট একজন উত্তম মানুষ। আমল আখলাক আর চরিত্র মাধুর্যের কারণে আম্মার নিকট আব্বাজান রহ. ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর আম্মার ব্যাপারেও আব্বাকে অসংখ্যবার এ উক্তি করতে শুনেছি , ‘তোমাদের মা একজন আবেদা ও আল্লাহর অলী।’ তাদের একে অপরের প্রতি সম্মানবোধটা ছিল ঈর্ষা করার মতো। কখনো আব্বাজানকে ঝগড়া করতে দেখিনি। জীবনে কখনো আব্বাজান রহ.-কে আম্মার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে দেখেনি।

লেনদেন

লেনদেন, মুয়ামালা, মুআশারার ও হক্কুল ইবাদের ব্যাপারে আব্বাজান রহ. এর মতো মানুষ অন্তত আমার চোখে পড়েনি। হক্কুল ইবাদের ব্যাপারে একজন মানুষ এতটা সচেতন হতে পারে যা কল্পনা করাও যায় না। লেন-দেন সবকিছুই তিনি তিলে তিলে লিখে রাখতেন।

আত্মীয়তার সম্পর্ক

আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আব্বাজান রহ. সম্পর্ক ছিল গভীর। তিনি সকল আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নিতেন। সাধ্যানুযায়ী সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এজন্য তিনি সকলের নিকট ছিলেন সর্বাধিক প্রিয় মানুষ।

পরিপাটি মানুষ

আব্বাজান রহ. এর মতো পরিপাটি মানুষ খুব কম দেখেছি। তার মেজাজ ছিল বড্ড সংবেদনশীন। মেসওয়াক উলটো করে রাখাও তার পছন্দ হতো না। পানির বোতল মাটিতে পড়ে থাকলে রাগ করতেন। তার কথা ছিল, যেটা যেভাবে রাখার , সেটা সেভাবেই রাখতে হবে।

স্থির-শান্ত

তার মধ্যে কখনো অস্থিরতা দেখিনি। সবসময় একটা স্থিরতা তার মধ্যে বিরাজ করতো। একরাতে ফোন দিয়ে মাওলানা আবু বকর বললেন, বাবার মাথা ফেটে গেসে। রক্ত পড়ছে। তখন প্রায় শেষরাত। ফজরের আজান হয়ে গেছে। আমি বাসা থেকে দৌড়ে অস্থির হয়ে মাদরাসায় এলাম। এসে দেখি আব্বাজান রহ. নিশ্চিন্তে মেসওয়াক করছেন। তার মাথায় ব্যান্ডেজ রক্তে ভেজা। কিন্তু তার মধ্যে রক্তাক্ত যখমের কারণে কোনো অস্থিরতা নেই।

এই পৃথিবীর তাবু গুটিয়ে আব্বাজান রহ. পরম প্রভুর সাক্ষাতে চলে গেছেন। রয়ে গেছে তার স্মৃতি, তার ছাত্র, তার আদর্শ। তাকে হারিয়ে মূলত আমরা একজন ছায়াদাতা বটবৃক্ষকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন মাথার ওপর প্রখর রোদ, তীব্র প্রতাপ; কিন্তু ছাতাটা এগিয়ে দেবার কেউ নেই। আব্বাজান রহ.-এর পরপারের সফর হোক সুখময়। জান্নাতের বাগানে তিনি উড়ে বেড়ান সবুজ পাখি হয়ে।

আগের সংবাদকরোনারোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৫ জরুরি নির্দেশনা
পরবর্তি সংবাদডব্লিউএইচও’কে আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাবে বাধা যুক্তরাষ্ট্রের