সমন্বয় ও সংস্কার : যেভাবে ওয়াজ মাহফিল সংস্কার করা সম্ভব

আশরাফুল হক:

হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী ওয়াজ নসীহত এবং পারস্পরিক কল্যাণকামিতা দ্বীনেরই একটি অংশ। এ দেশে দ্বীন ও ধর্মকে যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীনের গতিধারা অবাধ রেখে মৌলিক পৃষ্ঠপোষণ দেয়া হয় না, তাই এ দেশের প্রেক্ষাপটে দ্বীনের আলো আপন অনন্যতায় সমুজ্জ্বল রাখতে ওয়াজ নসীহতের গুরুত্ব খানিক বেশি। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত যেখানে মানুষের মাঝে অপরাধ কমাতে ব্যর্থ, দেশের জনগণকে সুনাগরিকে পরিণত করতে অক্ষম, তাই সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গঠনে এবং বাধাহীন পরকাল গঠনে মানুষের মাঝে অপরাধ কমিয়ে আনতে দ্বীনের চর্চা ও ওয়াজ নসীহতের গুরুত্ব আরো অপরিসীম।

উপরোক্ত সত্যসমূহের পাশাপাশি আরেকটি ধ্রুব সত্য হলো— পৃথিবীর কোন কিছুরই নীতিহীন চর্চা কল্যাণ বয়ে আনে না। নিয়ম ও তত্ত্বাবধানহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চর্চার ফলে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তার আবেদন হারায়, মাহাত্ম্য কমায়, মূল্য খোয়ায়। পারস্পরিক কল্যাণকামিতা এবং দ্বীনচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওয়াজ-উপদেশেরও আজ তাই হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে এ দেশে দ্বীনচর্চার ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম ওয়াজ-মাহফিলও আজ তার ঐতিহ্য ও আবেদন হারাতে বসেছে।

চিহ্নিত করতে গেলে মোটাদাগে কিছু শিরোনাম আমাদের সামনে আসে। তন্মধ্যে রয়েছে— পর্যাপ্ত যোগ্যতা ছাড়াই বিভিন্ন আকর্ষণ দেখিয়ে বক্তা হয়ে ওঠা, বক্তাদের বানোয়াট ও ইসরাঈলী বর্ণনা, মাধুর্যহীন আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার, অনর্থ অসংলগ্ন অসাযুজ্যপূর্ণ কথাবার্তা, অসমর্থনযোগ্য বিনোদন ও হাস্যরস, অপরিণামদর্শী হুঙ্কার, সময়ের অপচয় ইত্যাদি।

আয়োজকদেরও রয়েছে কিছু অসতর্কতা। যেমন, ওয়াজ-মাহফিলকে আয়ের উৎস বানানো এবং এ উদ্দেশে মাহফিলের আগে ও মাহফিলস্থলে শরীয়তগর্হিত পন্থায় কালেকশন, অযোগ্য ‘মাওলানা’দের বক্তা হিসেবে দাওয়াত দেয়া, মাহফিলের মঞ্চে দ্বীনী মানদণ্ডে অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্যদান, ফাসিক ও পাপাচারীদের অলীক প্রশংসা, আলেম নন— এমন ব্যক্তিদেরকে মঞ্চে আলোচনার জন্য সুযোগ দেয়া, কখনো আবার বক্তাদের বসিয়ে রেখে বা বয়ানের মাঝে ছেদ টেনে তাদের হাতে মাইক দেয়া, এমনকি বক্তার আসনে সাধারণ মানুষদের বসিয়ে দেয়া, চিহ্নিত রাজনীতির আশ্রয়ে মাহফিলের আয়োজন করা ইত্যাদি।

মোটাদাগের এ সমস্যাগুলোর পৃথক পৃথক বিশ্লেষণ এবং প্রতিকার সংক্ষিপ্ত এই পরিসরে সম্ভব নয়। কিছু সমস্যা এমনও আছে, যেগুলো সরাসরি দেশের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে জড়িত। তাই বক্তা ও আয়োজকদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণীয় বিষয় শুধু উল্লেখ করবো।

বক্তাদের জন্য অপরিহার্য

  •  বক্তাদের প্রথমেই সচেতন থাকা উচিৎ ইখলাস প্রসঙ্গে। দ্বীনী চিন্তার কোন কাজই ইখলাসবিহীন হতে পারে না। ইখলাসবিহীন কাজ খোদ দ্বীনের কাছেই গৃহীত নয়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা আদিষ্ট হয়েছিলো আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তার ইবাদাত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে। তা-ই সঠিক দ্বীন।’ (সূরা বাইয়িনা, ০৫)

পরন্তু ইখলাসহীন কাজের জন্য আল্লাহর আদালতে বিচারেরও মুখোমুখি হতে হবে। একটি বয়ান স্বার্থক ও কৃতকার্য হওয়ার জন্য, বয়ান দ্বারা মানুষ উপকৃত হওয়ার পূর্বশর্ত— মানুষের অন্তর উন্মুখ হওয়ার জন্য বক্তার ইখলাসের বিকল্প নেই। ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘আল্লাহর চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম হলো— আল্লাহ মানুষের অন্তরকে মুখলিসের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা ও নূর দ্বারা সজ্জিত করেন। মানুষের অন্তরকে মুখলিস বান্দার প্রতি ধাবিত করেন— আল্লাহর সাথে তার মোয়ামালা এবং তার ইখলাস ও নিয়ত পরিমাণ। বিপরীতে ইখলাসহীন লৌকিকতাপ্রবণদের প্রতি আল্লাহ মানুষের অন্তরে ঢেলে দেন ঘৃণা, অবজ্ঞা আর অস্বস্তি।’ (ই’লামুল মুয়াক্কিঈন আন রাব্বিল আলামীন)

  •  বক্তাদের জন্য দ্বিতীয় লক্ষণীয় হলো— বয়ানের কথা, আচরণ, উপস্থাপন দরদী সুন্দর ও যুৎসই হওয়া। কথাগুলো হবে প্রেমপূর্ণ, মসৃণ, কোমল। শ্রোতার প্রতি ঝরে পড়বে ঋজুতা, শিষ্টাচার ও সম্মান। বজায় থাকবে আত্মমর্যাদা ও মূল্যবোধ। এসব বৈশিষ্ট্য যে আলোচনা ও বয়ানে থাকে, সে আলোচনা মানুষের অন্তরকে প্রশান্ত করে, হৃদয়ের কানকে তৃপ্তি দেয় এবং মানুষের জীবনকে অন্তরের অতল থেকে পরিবর্তন করতে থাকে। আল্লাহ মুসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামকে ফেরাউনের কাছে পাঠানোকালে সতর্ক করেছিলেন— ‘তোমরা তার সঙ্গে নম্র কথা বলবে; হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সূরা ত্বহা, ৪৪)

আল্লাহ আরো বলেন, ‘(হে নবী!) তুমি তোমার রবের পথে লোকদেরকে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা। (প্রয়োজনে) তর্ক করো সবচে উৎকৃষ্ট পন্থায়। কে তার পথ থেকে বিপথগামী হয়েছে, তিনি তা ভালো জানেন। যে হেদায়াতের পথে রয়েছে, তিনি তাকেও ভালোভাবে জানেন।’ (সূরা নাহল, ১২৫)

সায়্যিদ কুতুব রহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এর অর্থ হলো— যাদের সামনে দাওয়াত পেশ করা হবে, তাদের অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কতটুকু বক্তব্য তাদের সামনে উপস্থাপন করলে তারা বিরক্ত হবে না, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মানসিক প্রস্তুতির পূর্বেই তাদেরকে যেন কোনো ধর্মীয় বিধান পালনে বাধ্য করা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোন পদ্ধতিতে বক্তব্য পেশ করলে অধিক ফলপ্রসূ হবে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি শ্রোতাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্যের ধরন-ধারনের বৈচিত্র আনতে হবে। সাথে সাথে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে— যেন বক্তব্যের মাধ্যমে অহেতুক উত্তেজনা, অনাকাক্সিক্ষত চাঞ্চল্য এবং উগ্রতা সৃষ্টি না হয়। অন্যথায় দাওয়াত ও তাবলীগের আসল উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে, যা হেকমত, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী।’

সায়্যিদ কুতুব রহ. আরও বলেন, ‘নরম ও সুন্দর ভাষায় কথা বলতে হবে, যেন তা মানুষের মনের গভীরে রেখাপাত করে এবং তাদের অনুভূতিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। অহেতুক সুরে এবং চিৎকার করে বক্তব্য প্রদান উচিৎ নয়। তেমনই কারো দোষত্রুটি নিয়ে প্রকাশ্য মজলিসে আলোচনা করাও উচিৎ নয়। মনে রাখতে হবে— নরম ও মার্জিত ভাষায় উপদেশ দিলে তা অনেক সময় কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দেয়, ধর্মবিমুখ লোকদের মনেও সাড়া জাগায় এবং এসব লোকদের সত্যের পথে পরিচালিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। নরম ও সুন্দর উপদেশ যতটুকু মঙ্গল বয়ে আনে, ততটুকু অহেতুক ধমক, উত্তেজনাকর বক্তব্য এবং ভর্ৎসনা দ্বারা কখনোই সম্ভব হয় না।’ (যিলালুল কুরআন)

আয়াতে আরো লক্ষণীয় হলো— কারো সাথে তর্কে লিপ্ত হতে হলেও তা হতে হবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। কারণ, কে হেদায়াত পাবে আর কে পাবে না, তা আল্লাহই ভালো জানেন। সুতরাং আমি উৎকৃষ্ট পন্থায় থাকাই ভালো।

নম্রভাবে কথা বলা রাসূলেরও আদর্শ। তবে প্রয়োজনে ধমকের স্বরেও কথা বলতে হবে। বর্ণিত হয়েছে— রাসূল যখন ভাষণ দিতেন, তার চেহারা থেকে রাগ টপকে পড়তো। কণ্ঠ উচ্চ হয়ে যেতো। চেহারা লাল বর্ণ ধারন করতো। ঘাড়ের রগগুলো ফুলে উঠতো। (বুখারী, মুসলিম)

আল্লামা শেখ সাদী রহ. বলেন— ‘ওয়াকতে বলুতফে গো ওয়া মাদারা ও মরদুমী /বাশদ দর কামান্দে কবুল আওয়ারী দিলে /ওয়াকতে বাকাহরে গো কেহ সদকো যায়ে না বা /গাহে গাহে চুনা বাকার নায়ায়াদ হানযালে।’
‘কখনো নরমভাবে বলবে, তাতে অনেক পাষাণ হৃদয়কে গলিয়ে তোমার করে নিতে পারবে। কখনো কঠোরভাবে বলবে, কারণ অনেক মিষ্টি জিনিসেও সে আরোগ্য আসে না— যা একটি তেতো ফল হানযালের মাধ্যমে আসে।’

  •  তৃতীয় লক্ষণীয় বিষয় হলো—বক্তাগণ সমাজ সংশোধন ও সংস্কারের উদ্দেশে কথা বলবেন। এজন্য মঞ্চে বসে কারো দোষত্রুটি চর্চা করবেন না। এটি রাসূলের আদর্শও নয়। ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘সংশোধনকারী যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির দোষ দুর্বলতা বা মুর্খতা প্রকাশের উদ্দেশ্য রাখেন, তবে তা হারাম হবে। চাই উদ্দিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে হোক বা অনুপস্থিতিতে হোক, উদ্দিষ্ট ব্যক্তির জীবৎকালে হোক বা মৃত্যু পরবর্তী হোক। … … … তবে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যদি পথচ্যুত বিদয়াতলিপ্ত বা আলেমের ছদ্মাবরণকারী কেউ হয়, সে ক্ষেত্রে মানুষকে সতর্ক করার জন্য তার দোষ প্রকাশ এবং মুর্খতা প্রকাশ জায়েয আছে।’ (আল-ফারকু বাইনান নাসীহাহ ওয়াত তায়ঈর)

সর্বোপরি বক্তাগণ হবেন নির্মোহ, নির্লোভ। বক্তাদের থাকতে হবে উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা, বিপুল পড়াশোনা, উম্মাহর দরদ, সময় সচেতনতা। থাকতে হবে কোনো হক্কানী পীর ও মুহাক্কিক আলিমের সাথে নিয়মিত যাতায়াত, আত্মপর্যালোচনা, তত্ত্বাবধান এবং আক্ষরিক অর্থের সান্নিধ্য।

আয়োজকদের জন্য লক্ষণীয়

আয়োজকগণ যদি সাধারণ মানুষ হন, সে ক্ষেত্রে অসচেতনতাগুলো বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাই সাধারণ লোকদের প্রথমেই করণীয় হলো— শীর্ষ কোনো আলিম বা বুযুর্গের তত্ত্বাবধানে মাহফিলের আয়োজন করা। অনলাইনে নয়, বরং স্থানীয় শীর্ষ আলিম বা শীর্ষ মাদরাসার সাথে পরামর্শক্রমে আলোচক নির্বাচন করা। মাহফিলের উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, ব্যয় ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। মাহফিলের মঞ্চে কোন শীর্ষ ও মান্যবর আলিমের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে অসংখ্য সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সহজে।

মনে রাখতে হবে— ওয়াজ-মাহফিল একটি দ্বীনী কাজ। নিজের আমিত্ব প্রকাশ, অর্থের বাহুল্য থাকায় প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ইত্যাদি দ্বীনী এই কাজকে বিতর্কিত করে। দ্বীনী এই কাজের ঐতিহ্যকে ম্লান করে। আল্লাহর কাছে এর জন্য জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে।

মসজিদ-মাদরাসা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে রাখতে হবে— ওয়াজ-মাহফিল কোনো ব্যবসা নয়। ওয়াজ-মাহফিলকে মসজিদ-মাদরাসার আয়ের উৎস বানালে তা স্পষ্ট করা উচিৎ ‘এটি একটি কালেকশনের আয়োজন।’ সেখানে শ্লোগান হওয়া উচিৎ— ‘পকেট দুটি ভরিয়া, মাহফিলে যাবেন চলিয়া, মাহফিল থেকে ঘরে ফিরুন পকেট খালি করিয়া।’ সেখানে দ্বীনের দোহাই দিয়ে জান্নাত-জাহান্নামের অনুভূতি জাগিয়ে পকেট কেটে রাখার মতো দ্বীন বিক্রির কোন মানে হয় না। চার খলীফা, আশারায়ে মুবাশশারা, ত্রিশ পারা কোরআন, ৩১৩ বদরী সাহাবীর সাথে জান্নাতে যাওয়ার ফয়সালা দেয়ার মতো গর্হিত কাজ যদি একটি মাদরাসা-মসজিদের মাঠে বসেই সম্পন্ন হয়, তখন স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে না। আর মানুষকে লজ্জার মুখে ফেলে, বারবার চাপ প্রয়োগ করে টাকা উসুল করা কতটুকু জায়েয, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

অযোগ্য ‘মাওলানা’দের বক্তা হিসেবে দাওয়াত দেয়া, মাহফিলের মঞ্চে দ্বীনী মানদণ্ডে অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্যদান, ফাসিক ও পাপাচারীদের অলীক প্রশংসা, আলেম নন এমন ব্যক্তিদেরকে মঞ্চে আলোচনার জন্য সুযোগ দেয়া, কখনো আবার বক্তাদের বসিয়ে রেখে বা বয়ানের মাঝে ছেদ টেনে তাদের হাতে মাইক দেয়া, এমনকি বক্তার আসনে সাধারণ মানুষদের বসিয়ে দেয়া, চিহ্নিত রাজনীতির আশ্রয়ে মাহফিলের আয়োজন করা — ঘটনাগুলো যে শুধুই বিরক্তিকর তা নয়, বরং তা দৃষ্টিকটু এবং নিজেদের আত্মমর্যাদা বিলীন করে দেয়ার নামান্তর। হাজারে হাজার সাধারণ মানুষের সামনে একজন নেতার আগমনে যখন স্থানীয় শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম সমবেতভাবে লীন-রূপে দাঁড়িয়ে যান এবং একজন আলেমের দ্বীনি আলোচনা স্থগিত করে মন্ত্রীকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে ওলামায়ে কেরামের চেয়ে নেতার গুরুত্বই বৃদ্ধি পাবে। দ্বীনি আলোচনা স্থগিত করে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে শরিয়তগর্হিত এসব বেহুদা বকওয়াস পরিবেশনের কী হুকুম হতে পারে? উপস্থিত সমবেত লোকজন এখানে দ্বীনের আলোচনা শুনতে এসেছেন, দ্বীনি আলোচনা শোনার জন্য অর্থ শ্রম মেধা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, এসব খেলতামাশা দেখার জন্য নয়। তাছাড়া একজন বক্তার অনর্গল আলোচনা স্থগিত করে মাঝে কোন বেহুদা বকওয়াস পরিবেশন করা হয়, তবে সেই বক্তার আলোচনার ধারায় কেমন ধাক্কা লাগতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

যাদের চলন-বলনে ফিসক ও পাপাচারের চর্চা, যাদের নিরাপত্তা পেয়ে পাপের বিস্তার ঘটে, বরং দেশময় কোরআন-হাদিস বিরোধী সকল কাজ যাদের সমর্থনে এবং নির্দেশনায় আয়োজিত, তারা এক মুহুর্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেকে দ্বীনের সেবক দাবি করলে সাথে সাথে তা মেনে নেয়া, হৈ হুল্লোড়ে সুবহানাল্লাহ নারায়ে তাকবির বোকামি ছাড়া কিছু নয়। ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা নফল কাজ। একাজের আয়োজন না করলে কেউ আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবে না। কিন্তু একাজ করতে গিয়ে শরিয়তের সামান্য লঙ্ঘন করলে অবশ্যই আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।

নেতাকে নেতার মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে, তাই বলে কোরআন-হাদিসের আলোচনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নয়। কোরআন-হাদিসের ধারকবাহকদের বাহ্যত উপেক্ষা করে নয়। সত্য-মিথ্যা বাস্তব-অবাস্তব নানা গুণকীর্তনের চাপরাশি দিয়ে নয়। কোরআন-হাদিসকে কোনরূপ উপেক্ষা করার দায়ে আল্লাহর কাছে আমাদের কী অবস্থান তৈরি হতে পারে, তা আয়োজকদের একবার ভেবে দেখা দরকার। যে উপস্থাপক নেতাদের যতসব প্রশংসা করেন, তিনি কি নেতাকে অন্তর থেকেই এমন প্রশংসার যোগ্য এবং মান্যবর মনে করেন! শ্রদ্ধা বা সমীহ করেন! যদি তাই হয়, তবে আমাদের একটি হাদিস মনে রাখতে হবে, ‘ইযা মুদিহাল ফাসিক্বু, গাদ্বিবার রাব্বু তা’য়ালা, ওয়াহতায্যালাহুল ’আরশু।’ ‘যখন ফাসিকের প্রশংসা করা হয়, আল্লাহ রাগ হন, তাঁর আরশ কম্পিত হয়।’ আর যদি অন্তর থেকে এসব প্রশংসার যোগ্য, মান্যবর, শ্রদ্ধা বা সমীহের পাত্র মনে না করেন, তবে এই ধোঁকাবাজি এবং দ্বিমুখিতা কোন হেকমতের অযুহাতে?

নিবেদন

আমার নিবেদনটি দেশের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বি আলেমদের কাছে। প্রথমত— ওয়াজ করা সকলের কাজ নয়। সবাই বক্তা হওয়ার উপযুক্ত নয়। তবু যে যার মতো যেখান থেকে ইচ্ছা, বক্তা হওয়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এর অন্যতম কারণ— তরুণ আলেমদের আত্মপরিচয় ও কর্মসংস্থানের অভাব। ফারেগীন ছাত্রদের সাথে গল্প করার জন্য দুটি দিন ধার্য করুন। জীবনের একটি দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে করে যে ছাত্রগুলো আরেকটি দীর্ঘ পরিক্রমায় পা ফেলতে যাচ্ছে, তাকে একটু সময় দিন। প্রতিটি ছাত্রের সঙ্গে কথা বলুন। প্রতিজন ছাত্র কোন কাজের উপযুক্ত, কোন কাজের অনুপযুক্ত, তা ছাত্রদের ধরিয়ে দিন এবং নির্দেশনা দিন।

যে ছেলেগুলো পড়াশোনায় সমাপ্তি টানছে, তাদের মধ্যে কারা ইলমে-আমলে-আলোচনায় বক্তা হওয়ার যোগ্য, বছর শেষে প্রতিটি মাদরাসায় তাদেরকে নির্দিষ্ট করা অসম্ভব নয়। এমন তরুণ আলেমদেরকে প্রতিজন মুরব্বি আপন আপন স্থান থেকে হাতেকলমে তত্ত্বাবধান করে সামনে নিয়ে আসতে পারেন।

যে ছেলেগুলো বকোয়াস বক্তা হতে যাচ্ছে, তাদের উসতাযগণ শুরুতেই তাদের লাগাম ধরতে পারেন। যাদের আলোচনা, আচরণ, রঙঢঙ ইত্যাদির কারণে কিছুদিন পরপর বিতর্ক উঠতে দেখি, তাদেরকে শীর্ষ আলেমগণ তাৎক্ষণিক কাছে ডেকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। ব্যক্তিবিশেষ আঞ্চলিক বোর্ড বা জাতীয় বোর্ডের অধীনে তাদেরকে হয়তো সংশোধন, সম্ভব না হলে ওয়াজের ময়দানে তাদেরক নিষিদ্ধ করতে পারেন। তাদের ব্যাপারে মুরুব্বিদের সিদ্ধান্ত দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ক্ষেত্র বিশেষ আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের কাছে, ক্ষেত্র বিশেষ প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। যে কোনো অঞ্চলে কেউ তাদেরকে দাওয়াত করলে আয়োজকদের বুঝিয়ে তাদের বাদ দেয়াতে পারেন।

শীর্ষ আলেমগণ প্রতি বছর বোর্ডের অধীনে কিছু আলেমকে বয়ানের ক্ষেত্রে নববী ও সাহাবীদের আদর্শের আলোকে পরখ করে জাতির জন্য উপস্থাপন করতে পারেন।
ওলামায়ে কেরাম সাধারণ মানুষকে সময় দিন। তাদের কাছে ডাকুন, কথা বলুন। সাধারণ মানুষ যেমন মাদরাসার মাহফিলে সর্বাত্মক সহযোগিতার চেষ্টা করে, মাদরাসা কর্তৃপক্ষও সাধারণ মানুষের মাহফিলে মেধা ও সময় দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার মাধ্যমে এতটুকু কৃতজ্ঞতা অন্তত জানানো উচিৎ। যে সাধারণ লোকটি একটি মাহফিলের আয়োজন করতে যাচ্ছে, দ্বীনের বুঝ না থাকায় সে তার মতো করেই আয়োজন করবে।

অবস্থা যা দেখা যায়, এ কাজগুলো আজ ওলামায়ে কেরাম না করলে কাল সরকার-প্রশাসন শুরু করবে। তখন ওয়াজ-মাহফিলে সরকারের হস্তক্ষেপ মর্মে আমাদেরকেই হাহুতাশ করতে দেখা যাবে। দ্বীনের ধারকবাহক পরিচিতির কারণে এ কাজগুলো কষ্ট হলেও আমাদেরই করা উচিৎ। পরিবর্তন একদিনে আসে না। বৃহৎ পরিকল্পনায় কাজ করতে থাকলে বহুদিন পর পরিবর্তনের দেখা মিলে।

লেখক: শিক্ষক, লেখক, খতীব।

আগের সংবাদধর্মপ্রচার, অপপ্রচার ও অর্থলিপ্সা : মুসলিম সভ্যতায় ওয়াজের ইতিহাস
পরবর্তি সংবাদ১৪ নারী কয়েদিকে মুক্তি দিল তালেবান