সর্বজনীন পেনশন স্কিম: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম।।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে, বস্তুত এটি একটি প্রসংশনীয় উদ্যোগ। অন্যান্য দেশেও এমন উদ্যোগ আছে। এতে জীবন সায়াহ্নে মানুষের আর্থিক ঝুঁকি কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের যে অবকাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে তাতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা ইসলাম সর্মথন করে না। সংক্ষেপে তা হল—

এক. রিবা। স্কিমে চাঁদাদানকারী নির্ধারিত পরিমাণ টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ করবে। শর্ত হল, তাকে মূল টাকাসহ অতিরিক্ত ফেরৎ দিতে হবে। চাঁদাদাতা মাসিক পেনশন প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জনের পূর্বেই মারা গেলে তার নমিনী পুরো জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ পাবে। সেই মুনাফার হার কী হবে-তা বিধিমালায় বলা হয়নি। তবে বোঝা যায়, সেটি প্রচলিত সুদী সঞ্চয়ের হার-ই হবে। আর পেনশন চলাকালীন তার বয়স ৭৫ হওয়ার পূর্বে ইন্তেকাল হয়ে গেলে তার বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত তার নমিনীকে পেনশন দেয়া হবে। (বিধিমালা, ধারা: ০৫,০৬) টাকার উপর অতিরিক্ত আদান-প্রদান—এটিই রিবা বা সুদ। যা এখানে বিদ্যমান।

দুই. গারার। ইসলামের বাণিজ্য আইন অনুসারে কোনও লেনদেন অবৈধ (Invalid Contract) হওয়ার অন্যতম কারণ-তাতে ‘গারার’ (Uncertainty) বিদ্যমান থাকা। ইসলামী আইন বা ফিকহের পরিভাষায় ‘গারার’ এমন লেনদেনকে বলা হয়, শরীয়ত বর্ণিত পন্থায় যার পরিণতি অজ্ঞাত। অথবা বলুন-যে কারবারের মূল চুক্তি বা পণ্যে কিংবা মূল্যে শরীয়ত বর্ণিত পন্থায় অনিশ্চয়তা থাকে সেটাই গারারযুক্ত লেনদেন। সহীহ হাদীসে একে নিষেধ করা হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কংকর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় করতে ও গারারযুক্ত লেনদেন থেকে নিষেধ করেছেন।’(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৬৯১)

আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যদিও প্রদেয় সঞ্চয় সব সময় ফেরৎ পাওয়া নিশ্চিত। তবে এতে গারার (Uncertainty) আছে। তা এভাবে যে, একজন চাঁদাদাতা এতে অংশগ্রহণের পর সে জানেনা তার প্রাপ্তি কী পরিমাণ দাঁড়াবে। পেনশন শুরু হওয়ার পর মারা গেলে এক ধরনের প্রাপ্তি। এর আগে মারা গেলে অন্য ধরনে প্রাপ্তি। দুই প্রাপ্তি সমান নয়। পূর্বে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রথম প্রাপ্তি তার জন্য তুলনামূলক দ্বিতীয় প্রাপ্তির তুলনায় অধিক ও বেশি লাভজনক। যদিও সর্বাবস্থায় তার প্রদেয় সঞ্চয় সব সময় ফেরৎ পাবে।

প্রকাশ থাকে যে, এক ধরনের অনিশ্চয়তা বা (Uncertainty) সব ব্যবসাতেই থাকে। তাই বলে ব্যবসা হারাম নয়। এখানে যে অনিশ্চয়তা বা (Uncertainty) এর কথা বলা হয়েছে, তা একটি বিশেষ অনিশ্চয়তা বা (Uncertainty) যা শরিয়তে ‘গারার’ নামে পরিচিত। এর প্রয়োগ ও সীমানা নির্ধারিত। সুতরাং সবকিছুকে একভাবে চিন্তা করলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

তিন. আল-আকলু বিল বাতিল (অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা)। কুরআনুল কারীমে অর্থনৈতিক যেসব কারবার নিষেধ করা হয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম একটি হল-‘আল-আকলু বিল বাতিল’ বা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টিক্রমে কোনো ব্যবসা করা হলে তা জায়েয।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ২৯)

‘আল-আকলু বিল বাতিল’ বা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা দ্বারা বোঝানো হয়েছে-বিনিময় ছাড়া কারও সম্পদ গ্রহণ করা বা ভক্ষণ করা। (তাফসীরে কুরতুবী, ৫/১৫)

আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিধিমালায় আছে, (ধারা: ৫/৫) কোনও চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তি চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে, তার পেনশন হিসাবটি স্থগিত হয়ে যাবে। পুনরায় চালু করতে হলে নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে চালু করতে হবে। এখানে লক্ষ্যণীয়, কেউ এভাবে তিন কিস্তি দেয়ার পর টাকা আর না দিলে, তার প্রদেয় টাকা আর ফেরৎ পাওয়া যাবে না। এই ফেরৎ না দেয়াটাই বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ গ্রহণ করার নামান্তর। বস্তুত সাধারণ জীবন বীমা পলিসিতে পেইড আপ অপশনকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ওখানে নিয়ম হল, দুই বছর এর আগে প্রিমিয়াম প্রদান বন্ধ করলে প্রদত্ত টাকা আর ফেরৎ পাওয়া যায় না। সুতরাং উক্ত বিধিমালার এ অংশটি কুরআনুল কারীমের সাথে সাংঘর্ষিক।

চার. ইনভেস্টমেন্ট। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ সূত্রে জানা গেছে- এ তহবিলের অর্থের একটা অংশ দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে খাটানো হবে।

সূত্রগুলো জানায়, সরকার ঋণের একটা অংশ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এবং আরেকটা অংশ সঞ্চয় কর্মসূচি থেকে নিয়ে থাকে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা শুরু হলে এ ধরনের অর্থায়ন তথা ঋণের ঘাটতি হবে না। এখান থেকে স্পষ্ট, এ তহবিল মূলত সরকারের ট্রেজারী বন্ডে বিনিয়োগ হবে। যা সুদী বিনিয়োগ হিসাবে সুপরিচিত। সুতরাং সরাসরি না হলেও চাঁদাদাতার টাকা সরকারের ট্রেজারী বন্ডে বিনিয়োগ হচ্ছে, যা অবৈধ বিনিয়োগ। এ ধরনের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লাভ গ্রহণ বৈধ নয়।

এক কথায় যদি বলেন-সর্বজনীন পেনশন স্কিমের রূপরেখা অনেকটাই কনভেনশনাল বিমা বা লাইফ ইনন্সুরেন্সের মতো।

শুরুতেই বলেছি, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মূল চিন্তা ও লক্ষ্য সমর্থিত ও প্রসংশনীয়। এতে সন্দেহ নেই। এর মূল আবেদনের সাথে আমরা একমত। বরং একটি প্রশংসনীয় চিন্তা ও লক্ষ্য। তবে এর জন্য যে পথ নির্বাচন করা হয়েছে, সেটি গলদ। এক্ষেত্রে পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে শরিআহসম্মত নানা পেনশন স্কিম আছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শরিআহ কনসালটেন্সি ফার্ম ‘আইএফএ কনসালটেন্সি’ একটি শরিআহসম্মত হালাল পেনশন স্কিম অবকাঠামো অঙ্কন করেছে। এগুলো সামনে রেখে সরকার চাইলেই বাস্তব অর্থে একটি সর্বজনীন শরিআহসম্মত স্কিম চালু করা সম্ভব। আমরা আশা করবো-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম, সহকারী মুফতী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা এবং প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আই এফ এ কনসালটেন্সি লি.

শ্রুতিলিখন— আব্দুল্লাহ আফফান

আগের সংবাদশ্রীলঙ্কার ঋণের ৫ কোটি ডলার ফেরত পেল বাংলাদেশ
পরবর্তি সংবাদবাংলাদেশি ওমরাহযাত্রীদের জন্য নুসুক প্ল্যাটফর্ম চালু করছে সৌদি