মুনশি নাঈম:
মসজিদের বারান্দা পেরুলেই দফতর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে বসে আছেন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. এর খলিফা মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ এবং মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস মুফতি ফয়জুল্লাহ। দু’একজন খাদেম এদিক সেদিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। আগে থেকেই সময় নেয়া ছিলো। এ মাদরাসারই বিগত মুহাদ্দিস এবং শুরাপ্রধান মাওলানা আবদুর রব মদিনা হুজুরকে নিয়ে একটি সাময়িকী করবে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর। তার স্মৃতি ও কর্মের বয়ান পেশ করাই লক্ষ্য।
স্মৃতিচারণ শুরু করলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ। রেকর্ডার ওপেন হতেই তিনি বলতে শুরু করলেন, মাওলানা আবদুর রব মদিনা হুজুর রহ. চূড়ান্ত পর্যায়ের একজন আল্লাহভীরু আলেম ছিলেন। হাদিসের দরসে আল্লাহভীতি সম্পর্কিত কোনো হাদিস এলে তিনি অঝোর ধারায় কান্না করতেন। কান্না করতে করতে মনে হতো, তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। তার হৃদয়ে হুব্বে রাসূল এত প্রবল ও প্রখর ছিল যে, মদিনা এবং আল্লাহর রাসূলের নাম শুনলেই তার দুচোখ ছলছল করে উঠতো। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূলের একজন অকৃত্রিম আশেক ও প্রেমিক। এজন্যই লালবাগ মাদরাসায় তার নাম হয়ে গেছে মদিনা হুজুর। লালবাগে আসার আগে তার এই উপাধি ছিল না।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. এর খলিফা এবং লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ সাহেব বললেন, হজরত মাওলানা আবদুর রব রহ. অত্যন্ত নেক মানুষ ছিলেন। তার চলাফেরা এবং আচার-আচরণ ছিল আদব-মার্জিত। সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতেন।
সমর্থন দিয়ে মুফতি ফয়জুল্লাহ বললেন, তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন ঠিক, কিন্তু তিনি নিজেকে খাদেম বলে পরিচয় দিতে বেশি আনন্দিত হতেন। তিনি ছিলেন এক অতন্দ্র প্রহরী। বাবা যেমন নিবিড় তত্ত্বাবধানে তার ছেলেকে গড়ে তুলেন, তেমনি মদিনা হুজুর মাদরাসার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে এমনই সচেষ্ট ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি মাদরাসার মজলিসে শুরার সভাপতি ছিলেন। জামিয়া আরাবিয়া লালবাগের মতো এমন একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের তিনি শুরা প্রধান; তার কথায়, কাজে, আচরণে কখনো তেমন গরিমা ফুটে উঠতো না। মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. থাকাকালীন তিনি যেমন মুহাদ্দিস সুলভ বিনয়ে বিনীত থাকতেন, শুরা প্রধান হবার পরও তেমনই ছিলেন।
মুহতামিম সাহেব হুজুর তেমন কথা বলেন না। চুপচাপ বসে শুনছেন আর মাথা নাড়িয়ে সমর্থন দিচ্ছেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ খুলে বসেন স্মৃতির ঢালি। একের পর এক করে চলেন স্মৃতিচারণ। তিনি বলেন, তিনি ইবাদতকে তার অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছিলেন। যেনবা ইবাদতই তার কাজ। এই কাজ করতে না পারলে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। বিপদে কিংবা দুঃসময়ে তার কাছে গেলে তিনি দরদি মন নিয়ে বর্ণনা শুনতেন। তারপর এমন কিছু আনোখা দোয়া ও আমল শিখিয়ে দিতেন, মনে হতো, এসব দোয়া কখনো শুনিইনি। তিনি এসব আমল করতে বলতেন। স্বপ্নের তাবির করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আসাধারণ যোগ্যতার অধিকারী। যখনই স্বপ্ন দেখতাম নিজেকে নিয়ে কিংবা পরিবার নিয়ে, তাকে এসে জানাতাম। তিনি নিখুঁত তাবির করে দিতেন।
বলে চলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ, মূলত প্রচার বিমুখ একজন নীরব সাধক এবং আল্লাহর ওলী ছিলেন মদিনা হুজুর। তিনি ছিলেন যুগ সচেতন এবং বিচক্ষণ একজন মানুষ। হক কথা বলতে দ্বিধা করতেন না। মজলিসে শুরায় আমার অভিজ্ঞতা হলো, কেউ কারো সম্পর্কে সমালোচনার পর্যায়ে গেলেই তাকে বাধা দিতেন। গিবতের ধারেকাছে তিনি যেতেন। হিংসা-বিদ্বেষ কাকে বলে চিনতেন না। সতত ও নিষ্ঠার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তার মতো শরীফ, বিনয়ী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন খুব কম মানুষকে দেখেছি। মানুষ হাদিয়ার জন্য লালায়িত থাকে। কিন্তু তিনি হাদিয়া ফেরত দিতে ভালোবাসতেন। আমরা হাদিয়া দিতে হলে খুব কষ্ট করে দিতে হতো। তিনি ছিলেন আমার সরাসরি উসতাদ। তিনি কথায় কথায় হজরত যাকারিয়া রহ.-এর স্মৃতিচারণ করতেন, সাহারানপুরের কথা বলতেন। হাদিসের দরসে যখন তিনি হজরত যাকারিয়া রহ.-এর স্মৃতিচারণ করতেন, মনে হতো তিনি জাকারিয়া রহ.কে সামনে দেখতে পাচ্ছেন। তাকে দেখে দেখে স্মৃতিচারণ করছেন। উসতাদদের প্রতি তার যেই ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য ছিল, তা এক কথায় বিরল।
জানতে চাইলাম, সমকালীন ইস্যু নিয়ে মদিনা হুজুরের কোনো বক্তব্য থাকতো কিনা। মুফতি ফয়জুল্লাহ বললেন, মুফতি আমিনি রহ.-এর প্রতিটি আন্দোলনে তার দোয়া, পরামর্শ এবং উদ্দীপনা প্রদান ছিল দেখার মতো। ছেলেদেরকে তিনি উদ্বোদ্ধ করতেন, যাও তোমরা। এখন তোমাদের এই কাজটাই করা দরকার। তিনি মাঝেমধ্যে এই বার্ধক্য উপেক্ষা করে মুফতি আমিনী রহ.-এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিত হতেন। যেকোনো বিষয়ে যতটুকু বলা প্রয়োজন, ততটুকু বলতেন। সাধারণ মানুষের মতো কথা বলতেন না। তিনি বলতেন কোরআন ও হাদিসের আলোকে।
একটি কথা সবাই স্বীকার করেছেন—মাদরাসার চেয়ে প্রিয় কোনো জায়গা তার ছিল না। মাদরাসাতেই তিনি সময় কাটাতেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘মাদরাসাই ছিল মদিনা হুজুরের বাড়ি। এখানে থাকলেই তিনি স্বস্তিবোধ করতেন। তাই গ্রামের বাড়ি গেলে তিনি অস্থির হয়ে থাকতেন, কখন মাদরাসায় ফিরবেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মাদরাসাতেই ছিলেন।’
শেষদিকে এসে একটু কথা বললেন মুহতামিম সাহেব হুজুর। তিনি বললেন, মদিনা হুজুর ছিলেন গভীর ইলমের অধিকারী; লালবাগ জামেয়ায় দীর্ঘদিন তিনি আবু দাউদ শরীফ পড়িয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবক পড়িয়ে গেছেন। মাদরাসাতেই তার ইন্তেকাল হয়েছে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি দ্বীনের খেদমতে যুক্ত ছিলেন। প্রায় নয় বছর তিনি মাদরাসার শুরা সভাপতি ছিলেন। এ সময়ে তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন। শেষদিকে যখন তিনি আর অফিশিয়াল কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে পারছিলেন না, দায়িত্ব অন্যের হাতে সোপর্দ করা হয়।
এ দুজনই ছিলেন মদিনা হুজুরের দীর্ঘকালীন সহকর্মী। তাদের স্মৃতিচারণে জীবন্ত হয়ে উঠলেন মদিনা হুজুর। কথা লতা ছড়ায়। বিভিন্ন দিকে সেই লতা প্রবাহিত হয়ে যখন এইপ্রান্তে, এশার নামাজের একামত শোনা যায় মসজিদে। আমরা উঠে পঠি স্মৃতির কুড়ানো ফুল নিয়ে। একটা মালা গাঁথতে হবে।