তাসনীম জান্নাত:
চলছে বিবাহের আয়োজন। আয়োজনটি পরিচালনা করছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৩ জন স্ত্রী । বহু সংখ্যক সাহাবী উপস্হিত হয়েছেন। ১৮ জন বদরী সাহাবীও আছেন । উবাই বিন কাব রাদি. তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করছেন । আচ্ছা, এত সৌভাগ্য কাদের ? কারা এই সৌভাগ্যবান দম্পতি ? তারা হলেন আনাস রাদি. -এর মুক্ত দাস সীরীন রাদি. এবং আবু বকর সিদ্দীক রাদি. -এর আজাদকৃতা দাসী সাফিয়াহ রাদি.।
তখন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রাদি. -এর যামানা চলছে । ৩১ হিজরীতে বসরায় এই দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন হযরত হাফসা রাদি.। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সাহাবাদের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকেন । শৈশবেই মাত্র বার বছর বয়সে পুরো কুরআন হিফজ করেন । শুধু তাই নয় কিরাআতের ক্ষেত্রেও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । তাঁর ভাই ছিলেন বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ বিন সীরীন রাদি.। তাঁর কাছে কুরআনের কোন অংশ কঠিন মনে হলে তিনি বলতেন, তোমরা হাফসাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, দেখো সে কিভাবে পড়ে।
এরপর তিনি সাহাবাদের কাছে ইলম শেখা শুরু করেন। ইলমের প্রতি তাঁর ছিল প্রচুর আগ্রহ । তিনি ইলম অর্জনের জন্য ঠিকমত ঘুমানোর সুযোগ পেতেন না । তিনি ইলমের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি পৌঁছে যান ফিকহ এবং হাদীসের অতি উচ্চ স্তরে। মুহাদ্দিসদের নিকট হয়ে যান র্নিভরযোগ্য রাবীদের একজন । ইবনে হিব্বান তাকে ছিকাহদের মধ্যে গণ্য করেছেন। ইয়াহইয়া বিন মাঈন তার সম্পর্কে বলেছেন, ছিকাহ এবং হুজ্জাহ ।
তিনি উম্মে আতিয়্যাহ রাদি. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন , যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে অংশ নিতেন এবং আহতদের সেবা করতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনাকারী একজন প্রথম সারির সাহাবিয়া ছিলেন ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট খাদিম আনাস বিন মালিক রাদি. থেকেও তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন । এছাড়াও তিনি বিখ্যাত তাবেয়ী আবুল আলিয়াহ, উম্মুর রায়েহ-সহ আরো অনেকের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন । হাদীসের প্রায় সকল কিতাবেই তাঁর বর্ণিত হাদীস রয়েছে ।
হাফসা রাদি. –এর আরো ৫ জন ভাইবোন ছিল । তাঁরা হলেন মুহাম্মাদ, মাবাদ, আনাস, ইয়াহইয়া, কারীমাহ । তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী ।
তাঁর ছেলের নাম ছিল হুজাইল । এজন্য তাঁর উপনাম হল উম্মুল হুজাইল ।
আবু দাউদ বলেন, তাঁর স্বামীর নাম আব্দুর রাহমান ।
তাঁর কাছে ইলম শিক্ষা করেন আমাদের সালফে সালেহীনের বহু সংখ্যক উলামা মাশায়েখ । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আইয়ূব আসসাখতিয়ানী, আছিম আল আহওয়াল, কাতাদা, মুহাম্মাদ বিন সীরীন, খালিদ আলহাযযা, হিশাম ইবনে হাসসান, আবদুল্লাহ ইবনে আওন । তাঁরা সকলেই বসরার বড় বড় আলিম ছিলেন । তাঁর আরেকজন অন্যতম ছাত্র হলেন, কাযী ইয়াস বিন মুয়াবিয়া যিনি উমর বিন আব্দুল আযীযের জামানায় বসরার বিচারক ছিলেন ।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু ইবাদাতগুজার মহিলা। তিনি তাঁর যৌবনকে ইবাদাত এবং তাকওয়ার মধ্যে কাটিয়ে দেন। তিনি বলতেন, হে যুবক সম্প্রদায় ! যৌবনে আমল করো । কেননা আমি মনে করি , যৌবনকালই আমল করার সময় ।
তিনি প্রতি রাতে অর্ধেক কুরআন পড়তেন । তিনি দুই ঈদ ও আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলো ছাড়া পুরো বছর রোজা রাখতেন।
তিনি সারা রাত নামায পড়তেন এবং এত কাঁদতেন যে , তার দাসী বেচারী ধারণা করে বসেছিল যে, তার মনিবা মনে হয় বড় কোন গুনাহ করেছেন তাই এত কাঁদেন আর নামায পড়েন ।
হিশাম বিন হাসসান বলেন, তিনি নামাযের ঘরে জোহরের সময় ঢুকতেন আর বের হতেন না। ইবাদাতে নিমগ্ন থাকতেন। সেখানে আসর, মাগরিব, ইশা, ফজর পড়ে যখন ভালোভাবে সূর্য উদিত হত তখন নামায পড়ে বের হতেন। এসময় অযু গোসল ও ঘুম সেরে নিতেন। অতপর নামাজের সময় হলে পুনরায় নামাজের স্হানে ফিরে যেতেন। মাহদী বিন মাইমুন বলেন, তিনি ৩০ বছর তাঁর নামাযের স্হানে কাটিয়েছেন । প্রাকৃতিক প্রয়োজন বা বিশ্রামের জন্যই কেবল সেখান থেকে বের হতেন ।
আসিম আল-আহওয়াল তাঁর সম্পর্কে বলেন, একবার আমরা তাঁর নিকট আসলাম। তখন তিনি আপাদমস্তক আবৃত করে ফেললেন । আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন । আল্লাহ তায়ালা কি বলেননি,وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ
অর্থ: যে বৃদ্ধা নারীদের বিবাহের কোন আশা নেই, তাদের জন্য এতে কোন গোনাহ নেই যে, তারা নিজেদের (বাড়তি) কাপড় (বহির্বাস, গায়রে মহিরাম পুরুষদের সামনে) খুলে রাখবে, সৌন্দর্য প্রদর্শনের ইচ্ছা ব্যতিরেকে । ( সূরা নূর : ৬০ )
তিনি বললেন , এরপর কী ? আমরা বললাম, وَأَنْ يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
অর্থ: আর যদি তারা সাবধানতা অবলম্বন করে, তবে সেটাই তাদের পক্ষে শ্রেয় । আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও সকল বিষয় জানেন । ( সূরা নূর : ৬০ )
তখন তিনি বললেন , এটাই পর্দার প্রমাণ।
এভাবেই তিনি শারিয়াকে সর্বদা কঠোরভাবে পালন করতেন । ছাড় দিতেন না ।
তিনি মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করতেন। প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতেন । এমনকি বর্ণিত আছে যে, তিনি একটি কাপড় কাফনের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন । যখন তিনি হজ্বের ইহরাম বাঁধতেন তখন সেটি পরিধান করতেন । রামাদানের শেষ দশদিনেও তিনি তা পরিধান করে রাত্রি জাগরণ করতেন ।
আনাস বিন মালিক রাদি.-এর সাথে হাফসা রাদি.-এর বিশেষ পারিবারিক সম্পর্ক ছিল । আসিম আল-আহওয়াল থেকে বর্ণিত, হাফসা রাদি. বলেন, আনাস বিন মালিক রাদি. আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কেমন মৃত্যু পছন্দ ? আমি বললাম, মহামারীতে মৃত্যু হওয়া। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মহামারীতে মারা যাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত ।
ইয়াস বিন মুয়াবিয়া হাফসা রাদি. সম্পর্কে বলেন, আমি তাঁর চাইতে শ্রেষ্ঠ আর কাউকে পাইনি । ইয়াস রাদি. -এর নিকট হাসান রাদি. এবং মুহাম্মাদ বিন সীরীন রাদি. -এর কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, আমি তাঁর উপর কাউকে প্রাধান্য দেই না।
ইবনে আবি দাঊদ বলেন, তাবিইয়াদের সর্দার হলেন হাফসা বিনতে সীরীন রাদি. ও আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান রাদি. । এরপর হলেন উম্মুদ দারদা আস সুগরা রাদি.।
হিশাম বিন হাসসান বলেন, আমি হাসান এবং ইবনে সীরীনকে দেখেছি । আমি এমন কাউকে দেখিনি যাকে আমার হাফসার চাইতে জ্ঞানী মনে হয়েছে ।
ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, তাঁর সময়ের উপমাহীন এক মহিয়সী । ফাকীহা, সত্যবাদী, মহান মর্যাদার অধিকারী । ১০১ হিজরীতে ৭০ বছর বয়সে বসরায় তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন । তাঁর জানাযায় বসরার বড় বড় আলিমগণ অংশ নিয়েছিলেন । তাদের মধ্যে অন্যতম দু`জন হলেন হাসান বাসরী রাদি. ও মুহাম্মাদ বিন সীরীন রাদি. ।
তথ্যসূত্র :
تاريخ الإسلام ت بشار (3/ 37)
تهذيب الكمال في أسماء الرجال (35/ 152)
سير أعلام النبلاء ط الرسالة (4/ 507)
تهذيب التهذيب (12/ 409)
صفة الصفوة (2/ 241)
الطبقات الكبرى ط العلمية (8/ 352)
الطبقات الكبرى ط العلمية (8/ 333)
أعلام النساء في عالمي العرب و الاسلام (274-272/1)
عناية النساء بالحديث النبوي (73-72)
المعرفة والتاريخ (3/ 27)
تهذيب الأسماء واللغات (1/ 83)