সারকাজম: মিডিয়া যেভাবে নারীকে পণ্য বানায়

আবদুর রহমান দাখিল:

আজকাল পত্রিকা খোলা হয়না একেবারেই, বাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিন রাখা হয়। এইতো সেদিন কী মনে করে খবরের কাগজটা খুলতেই চোখে পড়লো পুরো পাতা জুড়ে এক বিশাল নারীমূর্তি; যেন পত্রিকা নয়, ভুল করে রাস্তার বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড হাতে নিয়ে ফেলেছি। এটি এখন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

টেলিভিশনের কথা বাদই দিলাম। ফেসবুক বা অনলাইন পোর্টাল সাইটে স্ক্রল করছেন, ইউটিউবে ওয়াজ, তেলাওয়াত, ইসলামী সংগীত, অনুষ্ঠান বা কোনো ডকুমেন্টরি দেখছেন; পছন্দের এমন নানান জিনিস দেখার ফাঁকে ফাঁকে একটা কমন জিনিস বারবারই আপনাকে দেখতে হচ্ছে—নারীদেহ। বিজ্ঞাপন মানেই আজকাল স্বল্পবসনা, সুন্দরী ও কমনীয় নারীমূর্তির বিচিত্র প্রদর্শনী। গাড়ির অ্যাডের সাথে সাজসজ্জায় অর্ধনগ্ন নারী, পুরুষের ব্যবহৃত পণ্যের সাথে নারী, শিশুদের চকোলেট, আইসক্রিমের অ্যাড, পুরুষের বডি স্প্রে, শেভিং ক্রিমের অ্যাডে যৌনউদ্দীপক নারী, ফ্যাশন শো, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় সবখানেই কেবল নারী দেহ প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা। শুধু মেয়েলি জিনিসের বিজ্ঞাপন নয়, অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা এমনকি সাধারণ ঘরোয়া আসবাবপত্র থেকে শুরু করে গাড়ি-বাড়ির মতো বিলাসী পণ্য— সব জায়গায় মডেল হিসেবে নারীর সরব উপস্থিতি ।
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে পণ্যের বিজ্ঞাপন অপরিহার্য৷ তাই বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের মূলধনের একটা বড় অংশ ব্যয় করে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে৷ কিন্তু এ নিয়ে কি একবারও প্রশ্ন ওঠে না আপনার মনে? মনে হয় না যে, কোনো প্রয়োজন ছাড়া কেন বার বার নারীদের টেনে আনা হচ্ছে? কেন তারা পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তুতে?

আসলে পুঁজিবাদ তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নারীকে জাল হিসেবে ব্যবহার করছে। নারীর রূপ, দেহ ও সন্মানের বিনিময়ে সে নিজের ব্যবসা প্রসারিত করছে।‌ এর ফলে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। পুরো বিশ্বে নারীরা এখন ভোগবাদী ব্যবস্থার কারণে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে ধর্ষিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। ‘মানুষ’ নয়, নারীদের ভোগের উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে বিজ্ঞাপন, ফিল্ম, বইপুস্তকসহ আরো নানা জায়গায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের ভোগবাদী সংস্কৃতি এবং নারীকে পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে সূক্ষ্ম কারসাজি তার ফাঁদে পড়েছে নারীরাও। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা, সুপারহিট হলিউড মুভি, নামী-দামী ফ্যাশন ম্যাগাজিন কিংবা চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের সাহায্যে তারা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করছে নারীদের। বর্তমানে নারীর শরীরের ওজন, প্রতিটি অঙ্গের মাপ, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সাজসজ্জা পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ফ্যাশন, ডায়েট কিংবা কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রিজের দ্বারা। করপোরেট-সমাজের নির্দেশ মানতে গিয়ে তারা নিজেকে পরিণত করে সস্তা বিনোদনের পাত্রে। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে দেখে নিরেট ভোগ্যপণ্য ও মুনাফা হাসিলের উপকরণ হিসেবে। ফলে, নারী সমাজের কোনো সম্মানিত সদস্য হিসেবে বিবেচিত না হয়ে সমাজে প্রচলিত অন্যান্য পণ্যের মতোই পরিণত হয় বিকিকিনির পণ্যে। আর হীন স্বার্থসিদ্ধির মোহে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নারীর তথাকথিত দৈহিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে চালায় জমজমাট ব্যবসা। নারীদেহকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে ফ্যাশন ও পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রিজ।

মিডিয়ায় নারীর এ ধরনের পণ্যায়ন নিয়ে কথিত প্রগতিবাদী ও নারীবাদী সমাজে এক ধরনের সমালোচনা প্রচলিত থাকলেও এর নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা নিতান্তই অপ্রতুল। নারীবাদীরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে এর সমালোচনা করেন, দিনশেষে তা নারীকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আরও গভীরে সেঁধিয়ে দিতে চায়। তারা মৌলিকভাবে বিজ্ঞাপনে নারী মডেলের উপস্থিতিকে খারাপভাবে দেখেন না, বরং তাদের আপত্তির জায়গা হচ্ছে, মিডিয়া বিজ্ঞাপনে বরাবরই নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে, যা তাদের কথিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আছে। নারীবাদীদের অভিযোগ, প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীকে সর্বদাই দেখা যায় ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ গৃহবধূ হিসেবে, যার কাজ হচ্ছে ভালো রান্না করে স্বামীর মন জয় করা, কাপড় কাঁচা, থালা বাসন পরাষ্কার করা, স্বামীকে রূপের ফাঁদে ফেলার নানান কৌশল ও জোগাড়-যন্ত্র করা। তারা বলতে চান, নারীকে দেখাতে হবে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কর্মক্ষেত্রে, দেখাতে হবে কর্পোরেট অফিসের বস হিসেবে। এবং আজকাল বায়াস ভাঙার নামে এমন অনেক বিজ্ঞাপন হচ্ছেও। যেমন এক বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, একটি নবজাতকের বাবা ও মা একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। নবজাতকের জন্মের পর বাবা অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাচ্চা পালতে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এদিকে মা সেই চাকরিটা কন্টিনিউ করছেন। এর নাম দেয়া হয়েছে বায়াস ভাঙা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। বলাবাহুল্য যে, বিজ্ঞাপনে নারী উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে নারীবাদীদের এ ধরনের সমালোচনা নারীকে আরও বেশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে, নারীকে

কর্পোরেট ব্যবস্থার সস্থা পণ্যে পরিণত করে। এর ফলে মিডিয়া বিজ্ঞাপনে অর্থহীন ও অশালীন নারী-উপস্থিতির সত্যিকারের ক্ষতিকর দিকগুলো চাপা পড়ে যায়, কোথাও উঠে আসে না। আমরা এখানে এর কিছু নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি নিয়ে আলোকপাত করব।

নৈতিক ক্ষতি

নারী মায়ের জাতি। নারী পরিবারের প্রধান খুঁটি, আর পরিবার একটি সমাজ ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি। পুঁজিবাদ তার মার্কেট বৃদ্ধি ও বাজার প্রসারিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত সমাজকে ভেঙে ভোগবাদ ও ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। এজন্য নারী তার মোক্ষম অস্ত্র। নারীদেহের অশ্লীল প্রদর্শনীর মাধ্যমে একটি সমাজের মূল স্পিরিট নৈতিক মূল্যবোধে আঘাত হানা যায় খুব সহজেই। পুঁজিবাদী মহাজনরা মুনাফা বৃদ্ধির জন্য এটিই করে। মিডিয়ায় নারীর আবেদনময়ী প্রদর্শনী একইসঙ্গে নারী ও পুরুষ উভয়ের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ। দুর্বল নারী রুপালি পর্দার আগুনে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিমিষেই, সন্তান প্রতিপালন ও পরিবারের সুরক্ষায় তার ভূমিকা হতে থাকে ক্ষয়িষ্ণু। এরফলে সন্তানের নৈতিক ও মানসিক প্রবিদ্ধিতে যেমন ছেদ পড়ে, তেমন পারিবারিকভাবে মনমালিন্য বাড়তে থাকে। এভাবেই বৃদ্ধি পায় পারিবারিক অশান্তি, উন্মুক্ত হয় পরকিয়ার দ্বার, দিনশেষে পরিবারের ভাঙ্গন এবং সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে সামাজিক ভাঙ্গনের মাধ্যমে।

সামাজিক ক্ষতি

নৈতিক অবক্ষয়ের সমাপ্তি ঘটে সামাজিক ক্ষতির মাধ্যমেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারীকে যৌন-আবেদনময়ী হিসেবে তুলে ধরে সমাজে যৌনতাকে যেভাবে উস্কে দেয়, তার ফলশ্রুতিতেই সমাজে নানান অপরাধের জন্ম হয়। বর্তমানে সবচেয়ে বড় ও জঘন্য সামাজিক অপরাধ হচ্ছে ধর্ষণ। এই অপরাধের পেছনে নারীদেহের অশ্লীল ও নগ্ন প্রদর্শনী-ই যে সবচেয়ে বেশি দায়ী, কোনো বুদ্ধিমান মানুষ তা অস্বীকার করতে পারবে না। এটাকে চিরন্তন সত্য যে, স্বভাবগতভাবে নারীরা সৌন্দর্য সচেতন, আর পুরুষেরা নারীর এই সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল। এই ভাবধারাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পণ্য বাজারজাতকরণের পলিসি। এজন্য শুরু হয়েছে নারীদের আরো কত যৌন আবেদনময়ী করা যায়, তার বিকৃত ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নারীদের টিভি-মিডিয়ায় যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, কোনো সভ্য সমাজ সেটা মেনে নিতে পারে না। যখন বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন আর সেখানে সভ্যতা বলতে কিছু থাকে না। বলাবাহুল্য যে, এমন অসভ্য সমাজেই আমরা আজ নিশ্চুপ বসবাস করছি।

সাংস্কৃতিক ক্ষতি

শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশের সাংস্কৃতি নিঃসন্দেহে ইসলামী সংস্কৃতি হবে, এমনটাই উচিত ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়নি। বাঙালি সংস্কৃতির নামে ব্রাক্ষণ্যবাদী কোলকাতার ভৃত্য বাঙালি এলিটরা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এদেশের মুসলমানদের উপর, যে সংস্কৃতিতে নারীর কোনো সন্মান-মর্যাদা বলতে কিছুই নেই। সেইসব এলিটরাই আবার পুঁজিবাদের হাত ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতির আমদানি করেছে দেশে, মিডিয়া-বিজ্ঞাপনে নারীর অশ্লীল উপস্থাপনা যার অংশ। অথচ আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি বলে, নারী সবসময় ঘরের রানী হিসেবে থাকতেই পছন্দ করে। পরপুরুষের দৃষ্টিতে পড়া তো দূরের কথা, নিজের ছায়াও পরপুরুষ দেখুক, এ ছিল নারীর জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানের খবর। যুগ যুগ ধরে বাঙালি সমাজে প্রচলিত ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’ কথাটি এদিকেই ইঙ্গিত করে। পক্ষান্তরে বিজ্ঞাপনগুলো যেন লজ্জাহীনতাকেই নারীর ভূষণ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। ফলে পশ্চাত্য প্রভাবিত মিডিয়া-বিজ্ঞাপন যে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির উপর কুঠারাঘাত করছে, তা আর অস্পষ্ট নয়।

বিজ্ঞাপনের নামে নারীকে পণ্যবস্তুতে রুপান্তরিত করার এই ঘৃণ্য প্রতিযোগিতার লাগাম এখনই টেনে না ধরলে আমাদের নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছু আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। একটি সভ্য সমাজে কখনোই এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কাম্য নয়। নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে অধঃপতনে আমরা নিপতিত আছি, তা নিয়ে এখনই যদি আমাদের ভেতর ভাবনার উদ্রেক না হয়, তাহলে সর্বগ্রাসী ধ্বংসের উত্তাল ঝড় শীঘ্রই আমাদের কালের গর্ভে বিলীন করে দিবে।

আগের সংবাদশবে বরাত উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজন
পরবর্তি সংবাদনারী ফেকাহবিশারদ ও তাঁদের পরিচালিত পাঠ্যসভা