আবদুল্লাহিল বাকি:
সালাফী জিহাদী ধারা একটা স্বশস্ত্র আন্দোলন। তারা একদিকে নজদি সালাফী ধারা, অন্যদিকে মিসরের জিহাদী ধারার মোহনায় গড়ে উঠেছে। মিসরের জিহাদী ধারা বলতে, যারা পৃথক হয়ে গেছে ইখওয়ানুল মুসলিমিন থেকে। কারণ, তাদের মতে ইখওয়ান নিজেদের পুঁজিতান্ত্রিক লক্ষ্যে খিলাফাত ও সঠিক ইলমী ধারা থেকে বের হয়ে গেছে।
‘সালাফী জিহাদী ধারা’ পরিভাষাটার উৎপত্তি আশির দশকের দিকে, যখন আনওয়ার আস-সাদাতের আমলে ইসলামের কয়েকটি রাজনৈতিক ধারার উত্থান ঘটে, যারা শুধু জিহাদকেই মনে করত পরিবর্তনের হাতিয়ার, প্রতিটি মুসলমানের উপর আবশ্যক; হোক সেই জিহাদ সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে অথবা ঐসকল দেশীয় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলামী শরিয়াকে মানদণ্ড না বানিয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে মানদণ্ড মানে।[1]
তবে তারা নিজেদেরকে ‘সালাফী জিহাদী ধারা’ বলার চেয়ে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’ বলতেই বেশি পছন্দ করে।[2] তবে এই পরিভাষা সম্পর্কে চমৎকার কথা বলেছেন আবু মুহাম্মদ মাকদিসী। অন্যান্য সালাফী ধারা থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে স্বশস্ত্র ধারাকে ‘সালাফী জিহাদী ধারা’ নামে অভিহিত করার প্রাসঙ্গিকতা কি?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “প্রথমত: আমরা নিজেদেরকে এই নামে অভিহিত করি না। দ্বিতীয়ত: যারা আমাদেরকে এই নামে অভিহিত করে, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা হলো, আমরা একদিকে সালাফে সালেহীনের আকিদা-বিশ্বাস আকড়ে ধরে আছি, অন্যদিকে তাদের নিকট অনুসৃত আমল, বিশেষভাবে জিহাদের বিধানের উপর আমল করি। তৃতীয়ত: যদি সালাফী জিহাদী ধারার সংজ্ঞা দাঁড় করাতে হয়, তাহলে বলব, এটা এমন ধারা, যা সামগ্রিক অর্থ ও মর্মে তাওহিদ ও জিহাদের আহ্বান জানায়। অথবা অন্যভাবে চাইলে বলতে পারেন, এই ধারা সকল প্রকার তাগুতের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মাধ্যমে তাওহিদকে বাস্তবায়ন করতে চায়। এটাই হল সালাফী জিহাদী ধারার আসল পরিচয়। এই পরিচয়ের মাধ্যমে আমাদের ধারা অন্যান্য দাওয়াতী ও জিহাদী ধারা থেকে অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠে।
কিছু জিহাদী ধারা আছে, যারা তাবিজ-কবজ, কবর-মাজার পূজার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু সরকার ও সংবিধানের শিরিকের প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপই করে না। আর কিছু জিহাদী আন্দোলন আছে, যারা নিজেদের দেশের গণ্ডিতেই লড়াই করে। আপন জাতীয় ভূমির বাইরে যেতে তারা একেবারেই নারাজ। আমাদের সালাফী জিহাদী ধারা এই দুই ধারার বিপরীত। সালাফী জিহাদী ধারা— যেখানেই কোন আল্লাহর বান্দা থাকবে, তাদেরকে প্রথমে সামগ্রিক তাওহিদের দিকে দাওয়াত দেবে। এবং তাওহিদের পথেই জিহাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এজন্যই কোন জাতীয় ভূমিতে এই আন্দোলন সীমিত নয়। সারা বিশ্ব আমাদের আন্দোলন ও জিহাদের বিচরণ ক্ষেত্র। অন্যরা যুদ্ধ করে জাতীয়তাসহ অন্যান্য জাহেলী মূলনীতির উপর ভিত্তি করে। আমরা জিহাদ করি ইসলামী রাজনীতি ও নতুন যুগের ইজতিহাদের প্রয়োজনে।”[3]
সালাফী জিহাদী ধারা প্রাথমিকভাবে নজদি চিন্তার কাঠামোতে পোক্তভাবে প্রবেশ করেনি। প্রাথমিকভাবে তা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সালাফী মূলনীতিগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। নজদি চিন্তা পরবর্তীতে তাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। আবদুল কাদের বিন আবদিল আযিয (যিনি সাইয়েদ ইমাম নামে অধিক পরিচিত) আর মিসরের আল-জিহাদুল ইসলামী (EIJ) নজদি চিন্তা দ্বারা চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হয়। অন্যদিকে সৌদি আরবের কিছু আলেম তখন লেখালেখি করছিলেন ‘হাকিমিয়্যাত’, ‘আল-ওয়ালা ওয়াল বারা’সহ এরকম বিভিন্ন বিষয়ে; বিশেষত সাহওয়া ধারার আলেমগণ। কিন্তু তারা নজদি ধারা থেকে অনেকটা সরে আসেন। প্রভাবিত হন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ও তার ছাত্রদের লেখালেখি থেকে। সাথে সাথে আধুনিক কালের আল্লামা আবদুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী ও তার শিষ্য ইবনে উসাইমিনের লেখালেখি থেকেও ব্যাপক উপকৃত হয় সাহওয়া আন্দোলন। শাইখ আবদুর রহমান সাদী আবার প্রভাবিত ছিলেন শাইখ ইব্রাহিম আল-জাসেরের দ্বারা, যিনি নজদীদের বাড়াবাড়িগুলোর প্রচণ্ড বিরোধিতা করতেন। অন্যদিকে আবার জিহাদী-ময়দানের মানুষ শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর গ্রন্থাবলিতে বেশ গভীর প্রভাব দেখা যায় আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ আল-আসেমী নজদি সংকলিত নজদী আলেমগণের লেখালেখির বিরাট বিশ্বকোষ ‘আদ-দুরাসুস সানিয়্যাহ ফিল আজওয়িবাতিল নাজদিয়্যাহ’ গ্রন্থের। তার প্রায় প্রতিটি গ্রন্থে এই বিশ্বকোষের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। নাইন এলিভেনের হামলার পর আমেরিকা হামলা করে বসে আফগানিস্তানে। এরপর তানজিমুল কায়েদার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। আরবে তখন তাদের পক্ষে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন আলেম। যেমন, হামুদ বিন উকালা আশ-শা’বি, আলি খুদাইর, নাসের আল-ফাহদ, আহমাদ আল-খালেদি প্রমুখ। তারা নতুনভাবে নজদি ধারাকে আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। এবং প্রাচীন নজদি চিন্তাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশ প্রয়াস চালিয়েছেন। তবে পূর্ববর্তীদের সাথে কিছু ফারাক অবশ্যই ছিল। এই ধারাকে ‘আধুনিক নজদি ধারা’ বলা হয়।[4]
উল্লেখিত ক্রমবিন্যাস অনুসারে আমরা নজদি আন্দোলন ও চিন্তাধারার বিকাশ থেকে নিয়ে শুরু করে আধুনিক সালাফী চিন্তাধারায় নজদি চিন্তার প্রভাব আলোচনা করার চেষ্টা করব। কিন্তু নজদি চিন্তার যেমন একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা আছে, আছে নির্দিষ্ট একটা ঘরানা, সালাফী জিহাদী ধারার তেমন কোন সুস্পষ্ট একধারায় প্রবাহিত চিন্তাধারা নেই। কারণ, প্রথমত: তাদের ধারায় সাধারণত সকল ইসলামী ভাবধারার লোকেরাই অংশগ্রহণ করে থাকে। দ্বিতীয়ত: যখন তাদের নেতৃত্বে যারা থাকেন, তাদের চিন্তাধারা বা লেখালেখি দ্বারা তারা প্রভাবিত হন। তৃতীয়ত: বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গ্লোবাল জিহাদের দিকে যে আলেমগণ দাওয়াত দেন, তাদের লালিত আকিদা ও ফিকহের ক্ষেত্রেও তাদেরকে প্রভাবিত হতে দেখা যায়। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের প্রত্যেকের ফিকহী ও আকিদাগত চিন্তাধারায় বেশ ফারাক আছে। তাই তাদের মাঝে কোন বিশেষ সুস্পষ্ট ধারণা-সম্বলিত ঘরানা গড়ে উঠেনি। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের স্বাভাবিক কিছু প্রবণতা আছে। তাই আলোচনার সুবিধার্থে ব্যক্তি ও কাল-বিবেচনায় আলোচনায় এগুতে হয়। ইনসাফের স্বার্থেই সরলিকরণের কোন সুযোগ নেই এখানে।
নজদী আন্দোলনের পরিচয়, আকিদা ও চিন্তাধারা
নজদি আন্দোলন বা ওয়াহাবি আন্দোলন বলতে বোঝায়, খ্রীষ্টীয় আঠারো শতকে নজদ অঞ্চলে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদি (১৭০৩ – ১৭৯২) ও আমির মুহাম্মদ বিন সউদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা আন্দোলন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সালাফে সালেহিনের আকিদার প্রচার প্রসার। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই গড়ে উঠেছে আরবে সৌদি রাষ্ট্র। এর বিস্তৃতি ছিল আরব উপদ্বীপ, ইরাক, শাম, ইয়েমেন। তাদের সূচনা ছিল হেজাযের দিরিয়া অঞ্চল থেকে। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব ঘোষণা করেছিলেন, যারাই বিশুদ্ধ তাওহিদের প্রচারে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদেরকেই প্রতিরোধ করা হবে।[5]
ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অধীনেও কিছু গবেষক নজদি ধারার পরিচয় প্রদান করেছেন। যেমন সালেহ ওয়ারদানী লিখেছেন, “নজদি আন্দোলনের দুটি অর্থ আছে। একটা হল বাহ্যিক অর্থ। আরেকটি হল আভ্যন্তরীণ অর্থ। বাহ্যিক অর্থে নজদি আন্দোলন হল একনিষ্ঠার সাথে তাওহিদের দিকে দাওয়াত, শিরক ও বেদআতের বিরোধিতা। কিন্তু তাদের মুখে মুখে এটা থাকলেও তাদের আন্দোলনের বাস্তবতা এটা সমর্থন করে না। আর আভ্যন্তরীণ অর্থে নজদি আন্দোলন হল, মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি, ফেতনা ফাসাদ উস্কে দেয়া, পারস্পারিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া; যা থেকে পশ্চিমা উপনিবেশ ফায়দা হাসিল করেছে। নজদি আন্দোলনের সূচনা থেকে নিয়ে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই পরিচয়ই আমরা দেখে এসেছি।”[6]
মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদির অনুসারীরা নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্তই মনে করে। তারা মনে করে, মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনু কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহর চিন্তাধারার পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। তিনি ফিকহের ক্ষেত্রে হাম্বলী মাযহাবের অনুসরণ করেন, ইবনে তাইমিয়ার পদ্ধতিতে। তবে তালাক ও ওসিলা দিয়ে প্রার্থনা-র মাসআলায় তাদের কিছু মতভেদ আছে ইবনে তাইমিয়ার সাথে।[7]
নজদি আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে ঈমান-আকিদা সম্পর্কে গাফলতি চলে এসেছিল। বেদাত ও শিরকি আমলে লিপ্ত হয়ে তারা ইসলামের সৌন্দর্যকে হারাতে বসেছিল। তখন নজদি আন্দোলন মানুষকে নতুনভাবে সুস্পষ্ট তাওহিদের দাওয়াত দেয়। আহ্বান জানায় শরিয়ত বাস্তবায়নের। তরবারি দিয়ে হলেও মানুষকে তারা সচেতন করার চেষ্টা করে। সৌদ বংশের সহযোগিতা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নজদি আন্দোলনের আকিদা ও চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় সৌদি আরব।
সৌদি আরবকে বর্তমান পর্যায়ে আসতে আরো দুটি ধাপ পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রথম ধাপে, নজদিরা সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর উসমানী খেলাফত তাতে দখলদারিত্ব কায়েম করে। ভেঙে ফেলে তাদের শহর দিরিয়া ১২৩৩ হি.-তে। দ্বিতীয় ধাপে সউদ বংশ উসমানী খেলাফতের সাথে লড়াই করে। ফলে উসমানীরা তাদেরকে আবার রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়। তৃতীয় ধাপ হল বর্তমানের সময়। তারা নিজেদের সীমারেখা এঁকে নিয়েছে তৃতীয় ধাপে। এই ধাপের শুরুতে উসমানীদের সাথে তাদের আর লড়াই হয়নি। রাষ্ট্রীয় শক্তির ভিত্তি থাকার দরুণ সালাফী মানহাজ খুবই দ্রুত জাযিরাতুল আরবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বেদাতী ধারা ত্যাগ করে মানুষ আসতে থাকে সুন্নাহর পথে। তবে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের নজদি দাওয়াতের সাথে বেশ কিছু বিষয়ে পার্থক্য আছে ইবনে তাইমিয়ার শামি দাওয়াতের; যেই পার্থক্যগুলো মারাত্মক অগ্রহণযোগ্য। যেমন-
- যেগুলো দ্বীনের মৌলিক বিষয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে অজ্ঞতাকে কোন উজর হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
- যে ব্যক্তি কোন প্রকার শিরকে লিপ্ত হবে, তার উপর হুজ্জত কায়েমের আগেই সে অমুসলিম মুশরিক হয়ে যাবে। এমন অবস্থায় মারা গেলে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর যার উপর হুজ্জত কায়েম হয়ে গেছে, সে ওইরকমই কাফের মুরতাদ, যাদের সাথে আবু বকর রা. লড়াই করেছেন। হুজ্জত কায়েম হওয়ার পদ্ধতি-তাদের মতে, শুধুমাত্র তাকে সঠিক খবরটা পৌঁছানো। সে যদি খবরটা বুঝতে না পারে, তবুও।
- জাহমিয়া আকিদা ও প্রত্যেক জাহমিয়া আকিদা লালনকারী কাফের। ৫০০ জন আলেমের স্বাক্ষরে।
- যে তাদের দাওয়াতের কথা শুনে বিরোধিতা করবে, বা ভ্রুক্ষেপ করবে না, সে মুরতাদ।
- যে তাদের দাওয়াতের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে মুরতাদ, যদিও সে ভয়ে বন্ধুত্ব করে।
- তাওহিদ সম্পর্কে যে অজ্ঞ থাকবে সে মুরতাদ।
এই মূলনীতিগুলোর প্রয়োগ হয়েছে বড়ই আশ্চর্যজনকভাবে। এসব মূলনীতির আলোকে আরবের মূর্খ বেদুইনরা তাদের মতে কাফের। সুফি ধারা থেকে নিয়ে শুরু করে আশআরি, যাইদি, ইবাদিয়া সবাই কাফের। খেলাফতে উসমানী যেহেতু শিরকের লালন পালনকারী, তাই সেটাও কাফের। এই খেলাফতের সৈন্য-সামন্ত, সহযোগী, আলেম উলামা সবাই কাফের। পরবর্তীতে হাম্বলী সালাফী ধারায় যে আলেমগণ এসেছেন, তারা এসব বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করেছেন। এসবের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন। অবাক হওয়ার মত বিষয় হল, নজদিরা মূল কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কখনোই সেইসব লড়াই করেনি। বরং উনাদের সকল লড়াই ছিল তাদের বিরুদ্ধে, যাদেরকে তারা নিজেদের মূলনীতির আলোকে মুরতাদ বানিয়েছে। যে ব্যক্তিই সৌদি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করত, সে সালাফী মুসলিম হলেও তাকে তাকফির করত নজদিরা। এর অধীনে তারা আলে রাশিদকে তাকফির করেছে। তাদের রক্ত হালাল ঘোষণা করেছে। উসমানী খেলাফতের পররাষ্ট্রনীতিগত বিভিন্ন বিষয়কে ‘মুয়ালাতুল কুফফার’ (কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব)-এর অধীনে এনে খুব সহজেই তাকফির করত তারা। নজদিদের ঐতিহাসিক গ্রন্থ, বিশেষত ইবনে গুনাম ও ইবনে বশিরের লেখা পড়লে দেখা যায়, নজদিরা বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করত সহিংস মূর্তিতে। যারাই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাদেরকে হত্যা করত। নিয়ে যেত তাদের ঘরের সম্পদ গণিমত হিসেবে। মহিলাদের পর্যন্ত মন্দ গালাগাল করত।[8]
এগুলো ছাড়াও নজদি আন্দোলনের উপর সমসাময়িক ও পরবর্তী অনেক আলেমই সমালোচনা করেছেন। বিপরীতে নজদি আলেমগণও সেসবের বিভিন্ন জবাব উপস্থাপন করেছেন। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব যখন আপন দাওয়াত নিয়ে বের হয়েছেন, তখন সর্বপ্রথম তার সমালোচনা করে গ্রন্থ লিখেন তারই আপন ভাই সুলাইমান বিন আবদুল ওয়াহাব। তিনি এই গ্রন্থের কোন নাম দেননি। পাঠিয়েছিলেন পত্র হিসেবে হাসান বিন ঈদান নামক এক ব্যক্তির কাছে। ১৩০৬ হি.-তে বইটি হিন্দুস্তানের ‘নুখবাতুল আখবার’ প্রেস থেকে প্রথম ছাপা হয়। পরবর্তীতে মিসরেও ছাপা হয় বইটি। একেক স্থান থেকে ছাপানোর সময় একেক নাম দেওয়া হয় বইটির। তবে সেটির প্রসিদ্ধ নাম ‘আস–সাওয়াইকুল ইলাহিয়্যাহ ফির রাদ্দি আলাল ওয়াহাবিয়্যাহ’। এখানে তিনি এতটুকু লিখেছেন, “মুহাম্মদের পিতা আব্দুল ওয়াহাব ও শায়েখগণ পর্যন্ত ফিরাসাতের মাধ্যমে অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন যে, সে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।” এই বইয়ে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবকে খণ্ডন করা হয়েছে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়িমের উদ্ধৃতির মাধ্যমে। তবে কথা হল, এই গ্রন্থটা আসলেই সুলাইমান বিন আবদুল ওয়াহাব লিখেছিলেন কিনা, তার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়েও যথেষ্ঠ বিতর্ক আছে। কারণ, নজদি ধারার একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন সুলাইমান। অন্যদিকে এই বইয়ে উল্লেখিত যেসব বিষয় মুহাম্মদের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলো স্বীকার করেন না নজদি আলেমগণ।[9]
এছাড়াও মক্কার শাফেয়ী মাজহাবের মুফতি আহমাদ যাইনি দাহলানও নজদি আন্দোলনের খণ্ডনে রচনা করেছেন দুটি গ্রন্থ; ‘ফিতনাতুল ওয়াহাবিয়্যাহ’ এবং ‘আদ–দুরারুস সানিয়্যাহ ফির রাদ্দি আলাল ওয়াহাবিয়্যাহ’। তিনি শুধু নিজেই ওয়াহাবি আন্দোলনের বিরোধিতা করেননি। চেয়েছেন, সকল স্থানে যেন তাদের প্রচার প্রসার বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দুস্তানে এর প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের পিতা মাজারপন্থী[10] আলেম মাওলানা খায়রুদ্দিনকে নজদিদের বিরুদ্ধে একটা গ্রন্থ রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার কথামত মাওলানা খায়রুদ্দিন দশ খণ্ডের একটা খণ্ডনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। নাম ‘নাজমু… রাজমিশ শায়াতিন’; এই বিশাল গ্রন্থে একশ চৌদ্দটা ইখতিলাফি মাসআলা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর এখানে শায়খ দাহলানকে তিনি সম্বোধন করেছেন ভাই বলে। শায়খ দাহলান মাওলানা খাইরুদ্দিনকে খুশি করার জন্য এবং কিছু রাজনৈতিক কারণে শাফেয়ী মাজহাব ত্যাগ করে হানাফী মাজহাব গ্রহণ করে নেন।[11] হিন্দুস্তানের আহলে হাদিস আলেম মুহাম্মদ বশির সাহসাওয়ানী দেহলবী অবশ্য শায়খ দাহলানের আপত্তির জবাব লিখেছিলেন ‘সিয়ানাতুল ইনসান আন ওয়াসওসাতিশ শাইখ দাহলান’ নামক একটা গ্রন্থে।
হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইবনে আবেদীনও (১৭৮৪ ই. – ১৮৩৬ ই.) তার বিখ্যাত ফিকহী গ্রন্থের ‘কিতাবুল বুগাত’ (বিদ্রোহি সংক্রান্ত অধ্যায়)-এ নজদি আন্দোলনের আলোচনা নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগের যুগের খারেজিরা নবী সা.র সাহাবীদের তাকফির করতো। কিন্তু খারেজি হওয়ার জন্য সাহাবীদের তাকফির করা শর্ত নয়। এটা শুধু আলি রা.এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে বর্ণনামূলকভাবে উল্লেখিত হয়েছে। খারেজি হওয়ার জন্য, যেকোনো মুমিন বিরোধীকে তাকফির করাই যথেষ্ট; যেমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সময়ে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদির অনুসারীদের মাঝে। যারা নজদের ভূমি থেকে বেরিয়ে এসেছে। আধিপত্য বিস্তার করেছে হারামাইনের উপর। তারা নিজেদেরকে হাম্বলী মাজহাবের দিকে সম্বন্ধিত করে। অথচ তারা বিশ্বাস করে, তারাই শুধু প্রকৃত মুসলমান। যারা তাদের আকিদার বিরোধী, তারা মুশরিক। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তারা আহলে সুন্নাতকে হত্যা করা বৈধ করে নিয়েছে। তাই আল্লাহ তাদের শক্তি ভেঙে দিয়েছেন। ধ্বংস করে দিয়েছেন তাদের শহর। তাদের উপর মুসলিম সৈন্যরা বিজয় অর্জন করেছে ১২৩৩ হি. সালে।’[12]
মালেকি মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আহমাদ সাভী (১৭৬১ – ১৮২৫ই.) তাদের ব্যাপারে তাফসিরে জালালাইনের সূরা ফাতির: ৬ নং আয়াতের হাশিয়ায় লিখেছেন, “বলা হয়, এই আয়াতটি নাজিল হয়েছে খারেজিদের ক্ষেত্রে, যারা কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যাকে বিকৃত করে এবং মুসলমানদের ধন-প্রাণ হালাল করার প্রয়াস চালায়; যেমনটা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তাদের মত আরেকটি দলের ক্ষেত্রে। তারা হেজাযের একটি ফেরকা। ওয়াহাবি বলে তাদের পরিচয় দেয়া হয়। তারা মনে করে, নিজেরা সত্যের উপর আছে। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী। শয়তান আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের উপর, ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দলভূক্ত। নিশ্চয় শয়তাদের দল ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন তিনি তাদেরকে উচ্ছেদ করেন।”[13]
এছাড়াও আধুনিক যুগে অনেকেই তাদের সমালোচনা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সৈয়দ আহমাদ ইউসুফ রিফায়ী (তার গ্রন্থের নাম নাসিহাতুন লি–ইখওয়ানিনা মিন নাজদ), ড. রমাজান আল-বুতি (তার গ্রন্থের নাম আস–সালাফিয়্যাহ: মারহালাতুন যামানিয়্যাতুন মুবারাকাহ লা মাজহাবুন ইসলামিয়্যুন), মাহমুদ সাইদ মামদুহ (কাশফুস সুতুর আম্মা আশকালা মিন আহকামিল কুবুর নামক গ্রন্থের ভূমিকায়), সানআনি, আবুল হাদি আস-সাইয়াদি, মুস্তফা সবরি, মুহাম্মদ যাহেদ কাউসারী, হোসাইন আহমাদ মাদানী প্রমুখ। আবার অন্যদিকে নজদি ধারার বাইরের কিছু আলেম তাদের পক্ষেও বই লিখেছেন। যেমন, জামায়াতে ইসলামের বিখ্যাত আলেম মাওলানা মাসুদ আলম নদবী লিখেছেন ‘শাইখ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব: ইয়েক মজলুম দায়ী ওয়া মুসলিহ’। দেওবন্দি ঘরানার মাওলানা মনজুর নোমানীও তার পক্ষে লিখেছেন ‘শাইখ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব কে খেলাফ প্রোপাগান্ডা আওর হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক পর উস কে আসারাত’।
তবে নজদিদের সম্পর্কে ওঠা যৌক্তিক আপত্তিগুলোর একটি হল, তাওহিদের তাকসিম বা বিভাজনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি। এরই জের ধরে তাদের মন মানসিকতায় মুসলমানদেরকে তাকফিরের ক্ষেত্রে শিথিলতা চলে এসেছে। তাওহিদের তাকসিম পূর্ববর্তী আলেমদের নিকট ছিল কি না, এটা নিয়ে দুটি মত আছে।
জর্ডানের কালামবিদ হাসান সাক্কাফের মতে এই বিভাজন নব-আবিষ্কৃত। তিনি বলেছেন, “কিছু বেদাতি আমাদের উপর আপত্তি করে যে, তাওহিদের তাকসিম তো পূর্ববর্তীদের থেকেও প্রমাণিত। কিন্তু সত্য কথা হল, তাওহিদের তাকসিমের ক্ষেত্রে তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য কেউ দেখাতে পারবে না। কিছু অস্পষ্ট উদ্ধৃতি দেখাতে পারবে শুধু; যেগুলো থেকে তাকসিমের ইঙ্গিত পাওয়া যায় কেবল। সর্বপ্রথম তাওহিদের এই তাকসিমের কথা বলেন বিখ্যাত বেদাতি ইবনে বাত্তাহ আল-উকবারী। আর সে সালাফের কেউ নন। আর তিনি এই নব আবিষ্কৃত তাকসিমের ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার পূর্বসূরী। কিন্তু এই তাকসিমের প্রকৃত আবিষ্কারক হলেন ইবনে তাইমিয়া হাররানী।”[14]
নজদিদের বাইরের ধারার কিছু গবেষক আবার মনে করেন, তাওহিদের তাকসিম অন্যান্য আলেমগণও করেছেন। তবে নজদি আলেমগণ যে অর্থে করেছেন, সেই অর্থে নয়। উসমান মুস্তফা নাবুলুসি বলেছেন, “ওয়াহাবিগণ তাওহিদকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ১. রুবুবিয়্যাহ (প্রতিপালনের একত্ব), ২. উলুহিয়্যাহ (উপাসনার একত্ব)। আবার কখনো কখনো রুবুবিয়্যাহ থেকে তারা তাওহিদে আসমা ও সিফাত (নাম ও গুণাবলির একত্ব)-কে পৃথক করে ফেলেন। তারা ধারণা করেন, মুশরিকরা তাওহিদুর রুবুবিইয়্যাহ-র (আল্লাহর প্রতিপালনের একত্বের) উপর পুরোপুরি ঈমান রাখতো। তারা বিশ্বাস রাখতো, উপকার, ক্ষতি আর পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর কোন শরিক (অংশিদার) নেই। তারা শুধু ‘সৃষ্টির মাধ্যম’ বা ওসিলা গ্রহণ করা ও তার কাছে প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করতো। নজদিগণ এটাও মনে করেন যে, নবী রাসূলগণ তাদের সম্প্রদায়ের সাথে সিফাতুর রুবুবিয়্যাহ-র (প্রতিপালনের গুণের) ক্ষেত্রে কোন মতবিরোধ করতেন না। প্রতিপালনের গুণের ক্ষেত্রে মুশরিক খুবই কম ছিল; যা উল্লেখযোগ্য নয়। এজন্য রাসূলগণ ও তাদের সম্প্রদায়ের মাঝে এ নিয়ে কোন বিরোধ ছিল না।
এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে নজদিগণ পূর্বের আকিদাগ্রন্থসমূহে উল্লেখিত ‘ওয়াজিব’ (অবশ্যম্ভাবী), ‘মুমকিন’ (সম্ভাব্য) ও ‘মুসতাহিল’ (অসম্ভব)-এর আলোচনাগুলোকে অর্থহীন গণ্য করেছেন। তাদের মতে এসব এমন তাওহিদ নিয়ে আলোচনা, যা মুশরিকরাও স্বীকার করতো। এবং এই তাওহিদের মাধ্যমে তারা মুসলিম বলে গণ্য হয়ে যায়নি। যে ব্যক্তি আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের দিকে ঈমান আনার দাওয়াত দেয়, সে এমন তাওহিদের দিকে ডাকে না, যা রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। বরং এমন তাওহিদের দিকে ডাকে, যা মুশরিকদের নিকট বিদ্যমান ছিল।
এবাদত বা উপাসনার অর্থে গলদ বোঝাপড়ার কারণে, কোন সৃষ্টির সামনে বিনয়াবনত হওয়া বা অতিরিক্ত সম্মান দেখানোকে তারা শিরিক হিসেবে গণ্য করেছে। তারা যাচাই করারও প্রয়োজন বোধ করেনি, সে কি আসলে সেই সৃষ্টিকে উপাস্য ভাবে নাকি ভাবে না। তারা ঠুনকো ঠুনকো কারণে বহু মুসলমানকে কাফের বলেছে। তাদেরকে নিয়ে গেছে মূর্তিপূজকদের কাতারে। অনেক পূণ্যবান মানুষের রক্তকেও হালাল করে ফেলেছে তারা নিজেদের তাওহিদের তাকসিমের উপর ভিত্তি করে।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। ওয়াহাবীদের সাথে আমাদের বিরোধ নিছক তাওহিদের বিভক্তিতে নয়। বরং তাওহিদের বিভক্তির মর্মগত অনুধাবণে। কারণ, ওয়াহাবি চিন্তাঘরানার বিরোধী অনেকেই তাওহিদের তাকসিম বর্ণনা করেছেন। যেই শব্দ ওয়াহাবীরা ব্যবহার করেছেন, হুবুহু সেই শব্দই ব্যবহার করেছেন। অথবা কখনো তাদের কাছাকাছি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ওয়াহাবীদের বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যাধারার বিপরীতে।[15]
আগের জাতিগোষ্ঠির মাঝে কিছু লোক ছাড়া সবাই আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রতিপালনের গুণের ক্ষেত্রে ঈমান রাখতো, এই কথাটা স্রেফ বাস্তবতার বিকৃতি। প্রাচীন মিসরের ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, চৈনিক ধর্ম, রোমান ধর্মের কাছে যেতে হবে না; তাদের কথা এখানে বলারই অপেক্ষা রাখে না। ইহুদি নাসারা বা আরবের মুশরিকদের আকিদা দেখলেই তা বুঝে আসে।
ইহুদি আর নাসারাদের সম্পর্কে কোরান বলে, “আর ইয়াহূদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসীহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরী করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে?”[16]
যে আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রুবুবিয়্যাত গুণের ক্ষেত্রে ঈমান রাখে না পরিপূর্ণরূপে। কারণ, আল্লাহর সত্ত্বার ক্ষেত্রে যা অসম্ভব বিষয়, তার ক্ষেত্রে তারা ঈমান আনছে। এর পরের আয়াতে তারা যে রুবুবিয়াতের ক্ষেত্রে একত্ববাদী ছিল না, সেটা আরো স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পন্ডিত ও ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন হক (ইলাহ) নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।’[17]
নজদি আলেমগণ আরেকটি দাবি করে থাকেন, নবী রাসূলগণ তাদের জাতিদেরকে আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রতিপালনের গুণের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেননি। বরং দাওয়াত দিয়েছেন শুধুমাত্র উলুহিয়্যাত বা উপাসনার গুণের উপর ঈমান আনার। এই কথাটিও সত্য নয়।
ইবরাহিম আ. এর ঘটনা কোরানে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আর আমি তো ইতোপূর্বে ইবরাহীমকে সঠিক পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্পর্কে ছিলাম সম্যক অবগত। যখন সে তার পিতা ও তার কওমকে বলল, এ মূর্তিগুলো কী, যেগুলোর পূজায় তোমরা রত রয়েছ? তারা বলল, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি। সে বলল, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা সবাই রয়েছ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য নিয়ে এসেছ, নাকি তুমি খেল-তামাশা করছ? সে বলল, না, বরং তোমাদের রব তো আসমানসমূহ ও যমীনের রব;যিনি এ সবকিছু সৃষ্টি করেছে; এ বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী।’[18]
শেষ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসিরবিদ আবুস সাউদ বলেছেন, তারা যে তাদের মূর্তিগুলোকে নিজেদের রব মনে করতো, সেটার বিপরীতে ইবরাহিম আ. নিজের দাওয়াত পেশ করেছেন।[19]
মক্কার মুশরিকরা যখন নবীজিকে আল্লাহ ছাড়া অন্য রব গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল, তখন নবীজি আল্লাহকে একমাত্র রব হিসেবে গ্রহণ করার দাওয়াত দিয়েছিলেন। কোরানে আছে, “বল, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন রব অনুসন্ধান করব’ অথচ তিনি সব কিছুর রব?”[20]
এরপরও কিভাবে বলা যায়, মুশরিকদেরকে নবী-রাসূলগণ আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রতিপালন গুণের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানাননি; বরং উলুহিয়্যাত গুণের উপর কেবল ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছিলেন?!
এবার আসি তাওহিদে-উলুহিয়্যাত বা তাওহিদে-ইবাদতের আলোচনায়। সকল মুসলমান একমত যে, উপাসনা বা ইবাদতের গুণ শুধুমাত্র আল্লাহর সাথেই যুক্ত। যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। ঈমানের নবায়ন ছাড়া সে আর মুমিন থাকবে না। তবে ওয়াহাবিদের সাথে অন্যদের বিরোধ হলো, কোন্ কাজগুলোর উপর ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ প্রয়োগ হবে, সেক্ষেত্রে।
ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ, ইবাদতের উদ্দেশ্যে আবেদ বা উপাসনাকারীর কাজ। যেই সত্ত্বার ইবাদতের নিয়ত করবে, তার আবেদ (উপাসনাকারী) বলেই সে গণ্য হবে। কারণ, ইবাদত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য নিয়ত জরুরী। ইমাম শাতেবী রহ. বলেছেন, ‘প্রতিটি ইবাদত নিয়তের মাধ্যমেই গণ্য হয়। কাজের ক্ষেত্রে মনের উদ্দেশ্য বিবেচ্য, যেন আদতকে আলাদা করা যায় ইবাদত থেকে।’[21]‘আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ের’ গ্রন্থে একই ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু ওয়াহাবীরা স্বাভাবিকভাবে ইবাদতের কয়েকটি পারিভাষিক অর্থ তুলে ধরে । এর মধ্যে দুটি উল্লেখ করছি। একটি হল, ‘ইবাদত হল, এমন সকল কিছুর নাম, যেগুলো আল্লাহ ভালবাসেন ও পছন্দ করেন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ কাজ ও কথা।’[22]
এই সংজ্ঞার মাধ্যমে তারা বোঝাতে চান, যেই কাজ শরীয়তে প্রমাণিত, আল্লাহ পছন্দ করেন ও ভালবাসেন, তা আল্লাহর জন্য করা হলে আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। কিন্তু যদি আল্লাহর ছাড়া অন্য কারো জন্য করা হয়, তাহলে তাদের মতে, সেটা আল্লাহর সাথে শিরক ও গাইরুল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। অথচ এখানে অনেক ইবাদত এমন আছে, যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা, সন্তুষ্টি ও নৈকট্য কামনা করা হয়, যেমন, ক্ষুধার্তকে আহার প্রদান ও রাস্তা থেকে আবর্জনা সরিয়ে দেয়া। এই কাজগুলো যদি গাইরুল্লাহর জন্য আদায় করা হয়, তাহলেই এটা গাইরুল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হয়ে যায় না। কারণ, কেউ যদি কেবল আল্লাহর জন্য করে, তাহলে আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। কিন্তু যদি এসমস্ত কাজ দ্বারা তার উদ্দেশ্য থাকে উচ্চপদস্ত কারো নৈকট্য অর্জন, তাহলেও সেটি কুফুর বলে গণ্য হবে না, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নিকট।
উপরের সংজ্ঞায় তারা ইবাদতের যে পরিচয় ও সংজ্ঞা পেশ করেছে, তা ইবাদতের সামগ্রিক অর্থের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে, যার মধ্যে তাআহ (আনুগত্য) ও কুরবাহ (নৈকট্য অর্জন)-এর অর্থ রয়েছে। ইবাদতের খাস অর্থের অন্তর্ভূক্ত হবে না কখনোই; যার মাধ্যমে শিরক সাব্যস্ত হয়। অথচ তাআহ, কুরবাহ ও ইবাদত-এই তিন শব্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আশরাফ আলি থানবী রহ. বলেছেন, “তাআহ (আনুগত্য) ইবাদতের চেয়ে সামগ্রিক বিষয়। এজন্যই গাইরুল্লাহর জন্য গুনাহ ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তাআহ (আনুগত্য) বৈধ আছে। কিন্তু গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত বৈধ নয়।”[23]
ইবনে কায়্যিমিল জাওযিয়াহর আরেকটি সংজ্ঞা তারা উল্লেখ করে। তিনি বলেছেন, ‘ইবাদত হল, তাযাল্লুল বা নত হওয়ার পাশাপাশি ভালবাসা। তুমি আল্লাহ ছাড়া যার সামনে নত হবে, আনুগত্য করবে, ভালবাসবে তুমি তারই ইবাদতকারী।’[24]
এখানেও ইবাদতের খাস সংজ্ঞা পেশ করা হয়নি। ভালবাসার সাথে নত হওয়া অনেক গাইরুল্লাহর সামনেই হয়। কিন্তু সেগুলো ইবাদত বলে গণ্য হয় না। যেমন, শরীয়তে নবীজির ভালবাসা, আনুগত্যের পাশাপাশি নত হতে বলা হয়েছে। তেমনিভাবে পিতা-মাতার সামনে ভালবাসার পাশাপাশি নত হতে বলা হয়েছে। তাহলে কি শরীয়ত আমাদেরকে গাইরুল্লাহর সামনে নত হওয়ার আদেশ দেয়?
এগুলোকে তারা সাধারণত কুফুর বলে না। তাদের উসুল ও মূলনীতি অনুযায়ী যদিও এগুলোকেও কুফুরী বলতে হয়। তারা কুফুরী বলে বিভিন্ন কবিরা ও হারাম কাজকে, যেগুলোকে শরীয়ত করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু সেটাকে কুফুর সাব্যস্ত করেনি। তাছাড়া কিছু ইখতেলাফী বিষয়কেও তারা কুফুর বলে। যেমন, ওসিলা দিয়ে প্রার্থনা করা, নবীজির শাফায়াত প্রার্থনা করা ইত্যাদি। আর যেসব হারাম কাজকে কুফুরী বলে, তার মধ্যে অন্ততম হলো সিজদায়ে তাজিম বা সম্মানের সিজদা। চার মাজহাবের সকল ইমাম সুজুদুত তাহিয়্যাহ বা সম্মানের সিজদাকে কবিরা গুনাহ বলে অভিহিত করেছেন। হানাফী মাজহাবের কিছু আলেম এটাকে কুফরে সুরি বা বাহ্যিক কুফুরী বলেছেন, কুফরে হাকিকী বা প্রকৃত কুফুরী নয়। তাদের কেউ মাখলুকের সামনে সিজদা করাকে কুফরে আকবর বলেননি; যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দিবে। তবে চার মাজহাবের সকল উলামায়ে কেরাম মূর্তি বা সূর্যকে সিজদা করাকে কুফুরী বলেছেন। তবে এজন্য নয়, এই সিজদা করা স্বতন্ত্র কুফুরী। বরং এজন্য যে, এই সিজদা করা তার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা কুফুর ও শিরকের আলামত।[25]
তাওহিদ ও তাওহিদের বিভক্তি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে নজদিদের ভুল পদ্ধতির কারণে, দুটি ক্ষতি হয়েছে। এক. জ্ঞানতাত্ত্বিক, দুই. ব্যবহারিক। জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে তাওহিদের ভুল পদ্ধতির কারণে, নজদ, তুরস্ক, মক্কা-মদিনার অধিকাংশ আলেম তাদের নিকট হয়ে গেছে- কাফের, মুশরিক আলেম।[26] আর ব্যবহারিক দিক থেকে ক্ষতি হয়েছে, মুসলমানদের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জতকে তারা হালাল করে নিয়েছে। উসমানী খেলাফতের সুলতানদের রক্ত-সম্পদের বৈধতা ছিল না তাদের কাছে। তাদের রক্তপাতকে হালাল মনে করা হত। তাই জন্ম নিয়েছে বহু রক্তারক্তি আর সংঘাত, বহু সাহাবীর কবর ভাঙাভাঙি আর কুফুরীর দায় লাগিয়ে বেদাতী হত্যা। আল্লাহ তাদের ভুল কাজগুলো ক্ষমা করে ভাল কাজের সওয়াব দান করুন।
আবুল আ’লা মওদুদি ও সৈয়দ কুতুবের চিন্তাধারা: আকিদার রাজনৈতিক-রুপান্তর
নজদি আন্দোলনের প্রভাব পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন জাগরণমূলক আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করে। কিছু কিছু নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও ইতিবাচক প্রভাবই বেশি দেখা যায় সেসব আন্দোলনের মাঝে। লিবিয়ায় সানুসী আন্দোলন, হিন্দুস্তানে বালাকোট আন্দোলন, বাংলাদেশে ফরায়েজি আন্দোলন, পরবর্তীতে হিন্দুস্তানে জামায়াতে ইসলামী, মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন নজদের বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। নজদি আন্দোলনের মূলধারা বিদ্যমান ছিল সৌদিতে। তারা আবার নাম বদলে নিজেদেরকে সালাফী নামে অভিহিত করে। সালাফী আন্দোলনের বিভিন্ন মতভেদের জের ধরে পরবর্তীতে প্রায় ডজন খানেকের মত ধারা উপধারা বের হয় নজদি আন্দোলনের মূলধারা থেকে।
কিন্তু মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদি রহ. যে চিন্তাধারা রেখে গিয়েছিলেন, সব হুবুহু গ্রহণ করেনি পরবর্তীগণ। ইবনে তাইমিয়ার কিতাবাদির সাথে তুলনামূলক পাঠে তাদের সামনে নজদি চিন্তাভাবনাগুলোর যাচাই বাছাই করা সহজ হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রটি এগিয়ে নিয়েছিলেন শাইখ আস-সাদী। বিশেষত ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে শাইখ সাদীর ছাত্রদের চিন্তার পারস্পারিক আদান প্রদান। তাছাড়া নাসিরুদ্দিন আলবানীও তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা করতেন। ফলে তার অনুসারীদের মধ্যে তাকফির প্রবণতা কমতে থাকে। অন্যদিকে ইমাম হাসান আল-বান্না নিজেই প্রভাবিত হয়েছিলেন সালাফী চিন্তাধারায়; যেমনটা দেখা যায় তার রচিত ‘আল–উসুলুল ইশরীন’ গ্রন্থে।[27]
গত শতকের উপনিবেশ ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিপরীতে হিন্দুস্তান ও মিসরে দুটি রাজনৈতিক আন্দোলনমুখর ধারার জন্ম হয়। এক. জামায়াতে ইসলামী, যার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আ’লা মওদুদি। দুই. ইখওয়ানুল মুসলিমিন, যার অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ কুতুব। তারা দুজনই আগে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মুগ্ধ ছিলেন। পরে ইসলামের গভীর পাঠ তাদেরকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তুলে। তারা পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার সর্বাত্বক চেষ্টা করেন। সাথে সাথে, পাশ্চাত্য সভ্যতার নাড়ি নক্ষত্র যেহেতু তাদের নখদর্পণে ছিল, তাই ইসলামের পক্ষ থেকে তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে আইডিওলজিক্যাল ওয়ার বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন আক্রমণাত্মক ধারায়, আত্মরক্ষামূলক ধারায় নয়। ফলে তাদের লেখায় শক্তি সঞ্চারিত হয়। তাদের লেখালেখি অনেক পাশ্চাত্যমুখী তরুণকে ইসলামের দিকে ফিরে আসতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক ধারায়ই তারা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাত্ত্বিক স্বক্রিয়তা অর্জনের লড়াইয়ের পাশাপাশি ময়দানেও আবির্ভূত হন তারা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্ন দেখেন, সংগ্রাম করেন। এ পর্যায়ে তারা ইসলামী রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মীয় অনেক বিষয়ে কলম ধরেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেহেতু তারা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ছিলেন না, তাই এক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা মূলধারার আলেমদের সামনে আসে। তারাও এ বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করেন।
তাদের উপর যেসব আপত্তি আসে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, ‘ইসলামী রাজনীতি একটা ইবাদত’। সেটাকে তারা আকিদাকরণ করেছেন; বিভিন্ন আকিদা ও কোরানের পরিভাষাকে তার মূল অর্থ থেকে সরিয়ে আধুনিক অর্থে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। আর এক্ষেত্রে তারা নজদি ধারায় স্বীকৃত তাওহিদের তাকসিম বা বিভক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
মওদুদি সাহেবের ‘কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহ’-এর মধ্যে তাওহিদের তাকসিমের প্রভাব স্পষ্ট। এখানে তিনি ইলাহ, রব, এবাদাত, দ্বীন পরিভাষা নিয়ে মৌলিক আলোচনা করেছেন। তার মতে, শুধুমাত্র কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে যারা বিদ্যমান ছিল, তারাই শুধু এসব পরিভাষাকে প্রকৃতভাবে বুঝতে পেরেছেন। এরপর সময় যতই অতিবাহিত হয়েছে, ততই এসব শব্দের মর্ম মানুষের কাছে অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এসব পরিভাষা সম্পর্কে যে ট্রাডিশনাল ব্যাখ্যা প্রচলিত ছিল যুগে যুগে, সেটা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ইলাহ শব্দকে তারা বানিয়ে ফেলেছে মূর্তি শব্দের সমর্থক। রব শব্দকে তারা গ্রহণ করেছে প্রতিপালনকারী অর্থে। ইবাদত শব্দকে তারা বানিয়ে নিয়েছে উপাসনা করা অর্থে। দ্বীন শব্দকে তারা ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। আর তাগুত মানে তাদের কাছে মূর্তি আর শয়তান। ফলে মানুষ কোরানের মৌলিক দাওয়াত বুঝতে পারেনি।”[28]
তাহলে এসবের প্রকৃত মর্ম কী? তার বই পড়লে বোঝা যায়, ইলাহ ও রব মানে তার নিকট প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন সম্রাট। ইবাদতের অর্থ রাষ্ট্রের আনুগত্য; অর্থাৎ কোন রাষ্ট্র ইসলামী না হলে সেটার যেকোন আনুগত্য গাইরুল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। আর দ্বীন মানে সংবিধান। তাগুত মানে রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি। তিনি এক স্থানে লিখেছেন, “ধারাবাহিকভাবে এই আয়াতগুলো পাঠের মাধ্যমে পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়, কোরানে রুবুবিয়্যাত-এর গুণটি হাকিমিয়্যাত ও সার্বভৌমত্ব (sovereignty) শব্দের সমর্থক। কোরান আমাদেরকে বর্ণনা করে, রব হলেন এই পৃথিবীর একজন নিরঙ্কুশ শাসক, একমাত্র আদেশদাতা। এ ক্ষেত্রে তার কোন শরীক নেই।”[29]
হাকিম আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। মওদুদি সাহেব এই গ্রন্থের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আধুনিক যুগে ‘তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ’ বা শাসনের একত্ব-কে পৃথক আকিদায় রূপ দেন। এক্ষেত্রে তিনি নজদি আন্দোলনের তাওহিদের তাকসিমের মর্মবিভ্রাট দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছেন।
তিনি শুধুমাত্র এর তাত্ত্বিক রূপকার। এই ধারণাকে আরো বিস্তৃত করেছেন মূলত সৈয়দ কুতুব। আবুল হাসান নদবী লিখেছেন, “ওস্তাদ মওদুদির এই বই পড়ে বিখ্যাত ইসলামী লেখক ওস্তাদ সৈয়দ কুতুব বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। এর প্রতিটি চিন্তার সাথে তিনি সহমত পোষণ করেছেন। তিনি ‘হাকিমিয়্যাত’কে বানিয়ে ফেলেছেন ইলাহ হওয়ার সবচে’ খাস বৈশিষ্ট্য। অথচ তার কিতাবে জাহিলিয়্যাতের মূর্তিসহ অন্যান্য গাইরুল্লাহর পূজাকে খুব ছোট করে দেখা হয়েছে। তিনি এসবকে বলেছেন প্রাথমিক জাহেলী যুগের কিছু স্বাভাবিক চিত্র।”[30]
সৈয়দ কুতুব বলেছেন, “আজকের জাহিলিয়্যাত দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহর ক্ষমতার সাথে শত্রুতার উপর। দাঁড়িয়ে আছে উলুহিয়্যাতের সবচে’ খাস বৈশিষ্ট্য হাকিমিয়্যাতের প্রতি শত্রুতার উপর। এই জাহিলিয়্যাত মানুষের দিকে হাকিমিয়্যাত সম্বন্ধিত করে। কিছু মানুষকে বানিয়ে দেয় কিছু মানুষের রব।”[31]
তাদের এই ব্যাখ্যার সমস্যা হল, তাকে সঠিক বলে ধরে নিলে রাজনীতিই হয়ে দাঁড়ায় ধর্মের সামগ্রিক রূপ। অথচ রাজনীতি একটা ইবাদত মাত্র। তাদের ব্যাখ্যায় রাজনীতি হয়ে পড়ে ইসলামের মৌলিক আকিদার অংশ; তাদের ব্যাখ্যার বিপরীতে কারো ইখতেলাফ থাকলেই সেটা বিভ্রান্তি বলে বিবেচিত হয় তাদের সামনে। এই ব্যাখ্যাগুলোর স্পর্শকাতরতা ও গুরুতর ক্ষতি যখন আলেমদের সামনে আসল, তখন তারা বাধ্য হয়ে এ সম্পর্কে কলম ধরেছেন। হাসান আল-বান্নার পরে ইখওয়ানের আধ্যাত্মিক মুরব্বী ওস্তাদ হাসান ইসমাইল আল-হুদাইবি তাদের আকিদাগত চিন্তাধারার খণ্ডনে লিখেছেন ‘দুআতুন লা কুদাতুন..’। প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার বই।
এখানে তিনি লিখেছেন, “কিছু মানুষের মুখে ‘হাকিমিয়্যাত’ শব্দটা বেশ শোনা যাচ্ছে। কোরান ও হাদিসে উল্লেখিত কিছু মর্ম ও বিধান বোঝাতে তারা এই শব্দ ব্যবহার করছেন। এই শব্দকে আবার আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করেও বলা হচ্ছে ‘হাকিমিয়্যাতুল্লাহ’।
আল্লাহর দিকে এই শব্দ সম্বন্ধিত করে তারা একের পর এক বিধান বের করে চলেছেন। বলা হচ্ছে, আল্লাহর হাকিমিয়্যাতের অর্থ অমুক তমুক। এর দাবি হল, মানুষকে অমুক তমুকের ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতে হবে। অমুক তমুক করা ফরজ। যদি সে ওই ফরজ কাজ না করে অন্য কাজ করে তাহলে সে আল্লাহর হাকিমিয়্যাতের আকিদার বাইরে। সুতরাং সে… অমুক তমুক…
অথচ আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি- ‘হাকিমিয়্যাত’ শব্দটা কোনস্থানেই বর্ণিত হয়নি- না কোরআনে না হাদিসে; আল্লাহর দিকে এই শব্দের সম্বন্ধ দূরে থাক।”[32]
সূরা মায়িদার ৪৪, ৪৫, ৪৭ নং আয়াত সামনে রেখে অনেকেই এই মাসআলাকে সরলিকরণ করে ফেলে। হুকুম দিয়ে ফেলে ‘আমভাবে’; তাও এমন বিষয়ের ক্ষেত্রে যে সম্পর্কে ইসলামে চূড়ান্ত সতর্ক করা হয়েছে। তবে বাস্তব কথা হল, এই আয়াতের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেমদের অনেক বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে।[33] এই আয়াতের অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দ্বারা যারা শাসন করবে না, তারা সামগ্রিকভাবে কাফের হবে না।[34] ইকরিমা বলেছেন, “আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তা অনুযায়ী কেউ যদি শাসন না করে ‘অস্বীকারবশত’, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। কিন্তু যে আল্লাহর বিধান স্বীকার করা সত্ত্বেও সে অনুযায়ী বিচার করবে না, সে পাপী ও জালেম বলে বিবেচিত হবে।”[35] এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাউস বলেছেন, “এটা এমন কোন কুফর নয়, যা ইসলাম থেকে বের করে দিবে।”[36]
ইবনে আবিল ইয রহিমাহুল্লাহ ‘আকিদাতুত তাহাবিয়্যাহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় এই মাসআলা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আল্লাহর নাজিলকৃত আইনে ফায়সালা না করা কখনো কখনো এমন কুফুরি হয়ে যায়, যা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। কখনো আবার সেটা শুধুই পাপ বলে গণ্য হয়। তবে সেটা শাসকের অবস্থা বিবেচনায়। যদি কেউ বিশ্বাস করে, আল্লাহর বিধান শাসনে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক নয়, অথবা কোন শাসক আল্লাহর বিধান নিশ্চিতরূপে জানার পরও সেটা সম্পর্কে তুচ্ছতা প্রকাশ করে, তাহলে সেটা বড় কুফুর। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর বিধানকে আল্লাহর বিধান বলে স্বীকার করে, কিন্তু ফায়সালা সে অনুযায়ী করে না, সে বেশির চেয়ে বেশি ফাসেক জালিম; কাফের নয়। আর কেউ দ্বীন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করার পরও যদি আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে, তাহলে এটি তার উজর বলে বিবেচিত হবে। তার ভুল আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।”[37]
আর শাসক নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা যায়, খিলাফত, আল-ইমামাতুল উজমা, ইমারতুল মুসলিমীন— ফুকাহাদের নিকট এই তিনটি শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দ তিনটির অর্থ হলো— ‘দুনিয়া এবং ধর্মের স্বার্থ রক্ষার্থে ইসলামী হুকুমতের নেতৃত্ব প্রদান।’ মুতাকাল্লিম ওলামাগণ অবশ্য ইমামতকে ‘আকাইদে সামঈয়া’ (কোরআন হাদিসে উল্লেখিত বিষয়)-এর কাতারে উল্লেখ করেছেন। তারা এর সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন— ইমামত হল, ধর্ম ও পার্থিব রাজনীতি রক্ষার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্ব। কোরআন হাদিসের বক্তব্য ও ইসলামী ইতিহাসের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকটা সামনে রেখে ফকিহগণ কোন নির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করে সেটার উপর বিধান আরোপ করে দেননি যে, এটি খিলাফত, আর সেটি ইমারত। ইসলামী ইতিহাসে শাসনের বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা গিয়েছে। শুরু হয়েছিল খিলাফত দিয়ে। এরপর এসেছে ইমারত ও সালতানাত। এরই ধারাবাহিকতায় উপনিবেশের পর রাষ্ট্রের বর্তমান রূপটি এসে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাচীন ও আধুনিক যুগে, আহলে ইলমদের মধ্যে হতে কেউ বলেননি, এটাই ইসলামের নির্দিষ্ট শাসন কাঠামো। সকলেই একমত যে, কোরআন এবং সুন্নতে নববী— শাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেনি। তবে কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে শাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, বিধান ও সামগ্রিক মূলনীতি রয়েছে—যেগুলোর মাধ্যমে ইসলামী শাসন অন্যান্য মতবাদ অথবা মানবগঠিত আইন থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এছাড়া অন্যান্য শাখাগত অনেক মাসালা ইজতিহাদী বিষয়। এজন্যই শাফয়ী মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম জুয়াইনি রহ. বলেছেন— ‘ইমামত অধ্যায়ের অধিকাংশ মাসায়েল কাতয়ী বা সুনির্দিষ্ট ধারার মধ্যে পড়ে না। এগুলো সম্পর্কে ইয়াকিন বা চূড়ান্ত বিশ্বাস করাও যায় না।’ অর্থাৎ এগুলো ফকীহগণের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা শরীয়তের মূলনীতি ও সামগ্রিক ধর্মীয় স্বার্থকে সামনে রেখে যুগ বিবেচনায়, এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেবেন।[38]
এই মাসআলায় বাড়াবাড়ির কিছু নেতিবাচক ফলাফল আছে। এর কারণেই তাকফিরের ব্যাপ্তি ও সরলিকরণ হয়। সারা পৃথিবী জাহিলিয়াতে ডুবে আছে বলে মত দেয়া হয়।[39] এবং বিভিন্ন বৈধ শাসনের বৈধতাটুকুও কেড়ে নেয়া হয়। খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ শেষ হবার পর আর কোন খেলাফত ‘আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ’ বা নবীর যুগের পদ্ধতিতে কায়েম হতে পারেনি। সবাই শুধু সেই দৃষ্টান্তের কাছাকাছি, যতটুকু পারেন পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। তাই বলে কি, তাদের বৈধতা ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে? হাকিমিয়্যাতের ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে মওদুদি সাহেব উসমান, মুআবিয়া রা. থেকে নিয়ে পরবর্তী যুগের বিভিন্ন খেলাফতের বৈধতার প্রশ্ন তুলেছেন। সৈয়দ কুতুব সাহেব ‘আল–আদালাতুল ইজতিমাইয়্যাহ ফিল ইসলাম’ গ্রন্থে সামাজিক ন্যয়নিষ্ঠার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে একটা প্রবন্ধে উসমান, মুআবিয়া রা.এর শাসন, উমাইয়া, আব্বাসী খেলাফতের ন্যয়নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।[40]
উসমান রা. সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “শেষে উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হল। হক বাতিল মিশে গেল। কিন্তু যে ইসলামের দৃষ্টিতে বিষয়টা দেখবে, এবং বিষয়টা অনুভব করবে ইসলামের রূহ নিয়ে, সে স্বীকার করতে বাধ্য হবে, সেই বিদ্রোহটা ইসলামের রূহ থেকেই আগত, (অর্থাৎ ওসমান রা. এর নেতৃত্ব থেকেও বিদ্রোহটি ছিল ইসলামের অধিকতর নিকটবর্তী।) যদিও এই বিদ্রোহের পেছনে ইহুদি ইবনে সাবার চক্রান্ত ছিল- আল্লাহর লানত তার উপর।”[41] মুআবিয়া রা. সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “যখন মুআবিয়া ও তার সাথী আমর বিন আস মিথ্যা, ধোকা, ঘুষ ও নেফাককে গ্রহণ করে নিলেন, তখন যে তারাই বিজয়ী হবেন, এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, আলি রা. তো এতটা নিচে নামতে পারেন না। তিনি পরাজয় বরণ করলেন। আর এই পরাজয় হাজার বিজয়ের চেয়েও ভাল।”[42] তিনি উসমানী খেলাফত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন, সুফিবাদকে কেন্দ্র করে। জিহাদী ধারার সৌদি আলেম নাসের আল-ফাহদ তো উসমানী খেলাফতকে তাকফির পর্যন্ত করেছেন একটা পুস্তিকা লিখে।
হিন্দুস্তানের ইসলামী চিন্তাবিদ ও দায়ী আবুল হাসান আলি নদবীও এসব চিন্তাধারার উপর খণ্ডনমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং হাসান আল-হুদাইবির খণ্ডনকে সমর্থন করেছেন। যদিও সালাফী জিহাদী ধারা হাসান আল-হুদাইবি বা আবুল হাসান নদবীর খণ্ডনকে গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেছেন আবুল আ’লা মওদুদি ও সৈয়দ কুতুব রহিমাহুমুল্লাহর চিন্তাধারা। তবুও তারা বুঝে শুনেই সৈয়দ কুতুব ও সৈয়দ আবুল আলা মওদুদির প্রমাদের দায়ভার নিবেন না। তবে হাকিমিয়্যাতের আকিদাকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে যেই সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সংকট সামনেও যে সৃষ্টি হবে না, বা বর্তমানে সৃষ্টি হচ্ছে না, এমনটা হলফ করে বলা যায় না।
সালাফী জিহাদী চিন্তাধারার বিখ্যাত তাত্ত্বিক, দায়ী ও স্বশস্ত্র মুজাহিদ আবু মুসআব সুরি সালাফী জিহাদী ধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, “পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের অনন্য অনবদ্য ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আবুল আ’লা মওদুদি রহিমাহুল্লাহর গ্রন্থাবলি জিহাদী চিন্তাধারার ক্রমবর্ধনের ক্ষেত্রে মৌলিক ভিত্তি নির্মাণ করেছে। তিনি নিজের দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার সমালোচনা করেছিলেন, যেই ট্রাডিশনাল (তাকলিদী) ধর্মীয় পরিবেশে বসবাস করেছেন। তিনি তার গ্রন্থাবলি, রচনাবলি, পত্র-পত্রিকা, জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শরয়ী রাজনীতির মাসআলা মাসায়েল আমাদের সামনে রেখে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মুসলমানদের বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তিনি তাওহিদের দাবিগুলো নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন ‘আল-ওয়ালা ওয়াল বারা’ আকিদার ভিত্তি নিয়ে। জিহাদের পরিচয়, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সংজ্ঞায়ন করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে জন্ম নেয়, এর বৈশিষ্ট্য কি, সংবিধান কি, কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, এগুলো নিয়ে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন। আধুনিক জিহাদী চিন্তাধারার অনেক ভিত্তিগত মাসআলা তার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘আল-মুসতালাহাতুল আরবাআ ফিল কোরআন’ (উর্দু নাম: কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইসতেলাহ, বাংলা নাম: কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা)-এর মধ্যে আছে।
তার পরে, কোন সন্দেহ নেই, আধুনিক যুগে জিহাদী চিন্তাধারার নকিব ছিলেন ওস্তাদ শহিদ সৈয়দ কুতুব রহিমাহুল্লাহ…
ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ট্রাডিশনাল ধারা সৈয়দ কুতুবের চিন্তাধারার বিপরীত মরুতে দাঁড়িয়ে যায়। সৈয়দ কুতুব হাকিমিয়্যাত, আল-ওয়ালা ওয়াল বারা, জাহিলিয়্যাত সম্পর্কে যে ডিসকোর্স দাঁড় করেছিলেন, তা থেকে তারা সরে আসে। তারা গ্রহণ করে অন্য একটি পথ, যেন সরকারের সাথে সংঘাত এড়িয়ে চলা যায়। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আধ্যাত্মিক মুরু্ব্বী হাসান হুদাইবি রহিমাহুল্লাহ লিখলেন প্রসিদ্ধ কিতাব ‘দুআতুন লা কুদাতুন’। সৈয়দ কুতুবের ‘মাআলিম ফিত তারিক’ ও ‘ফি যিলালিল কুরআন’ গ্রন্থদ্বয়ে যে বৈপ্লবিক চিন্তা দেয়া হয়েছে, সমাজ পরিবর্তন, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার জাহিলিয়্যাত নিয়ে যেসব কথা আছে, সেসবের খণ্ডন করেছেন হাসান হুদাইবি। এখানেই ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আন্দোলন ও আধুনিক রাজনৈতিক জিহাদী জাগরণ দুই ঘরানায় ভাগ হয়ে যায়।
এক. সৈয়দ কুতুবের লেখালেখি ও চিন্তাধারা রূপ দেয় হাকিমিয়্যাতের আকিদার, সমাজ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার। অন্যদিকে শিক্ষা দেয়, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর কুফুরি ও নাস্তিকতার বিধান আরোপ করার। এসব ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দর্শনের উপর সুস্পষ্ট জিহাদের দাওয়াত দেয় সৈয়দ কুতুবের লেখালেখি। সাথে সাথে এই জিহাদের মানচিত্র এঁকে দেয়।
দুই. অন্যদিকে ছিল হুদাইবির গ্রন্থ ‘দুআতুন লা কুদাতুন’ (আমরা আহ্বানকারী, বিধানদাতা নই)। এই গ্রন্থের নাম থেকেই ধারা বুঝে আসে। এটি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নতুন ধারার সূচনা করে। এই গ্রন্থের মৌলিক চিন্তাধারা ছিল ইসলামী রাজনীতির নেতাদের কর্তব্য আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়ে যাওয়া, সাথে সাথে সংস্কারকামিতা। তারা সরকার ও মানুষদের উপর ফায়সালাকারী নয়। কে ইসলামে আছে আর কে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে, সে বিষয়ে বিধানদাতা নয় তারা। এই গ্রন্থটি আধুনিক ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারায় মুরজিয়াবাদের ধারণাগুলোকে বর্ধমান করেছে।”[43]
সালাফী জিহাদী ধারায় হাকিমিয়্যাতের মাসআলায় বিস্তৃতকরণের ক্ষেত্রে অবশ্য তারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছেন নজদি ধারা থেকে; যদিও নজদি ধারায় পূর্ববর্তীদের লেখালেখিতে ‘হাকিমিয়্যাত’ শব্দটি স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত হয়নি। আবু মুসআব সুরি (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন) বলেছেন, “সালাফী চিন্তাধারা, বিশেষত ওয়াহাবি আন্দোলনের অনেক আকিদা ও ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী রাজনীতির অনেক মাসআলার উত্তর দিয়ে গিয়েছে; পূর্বেকার ইসলামী বিশ্বে বিদ্যমান জাহেলী শাসন রীতি-নীতির বিরুদ্ধে। তেমনিভাবে সালাফী জিহাদী ধারা ওয়াহাবিদের ফিকহ ও আকিদার দলিলাদির মাধ্যমে সরকারদের কুফর সাব্যস্ত করতে পেরেছে, যারা মুসলমানদের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আবশ্যকীয়তা, তাদের বৈধতা নাকচ করা ও তাদের সহযোগীদের হত্যা করাসহ ইত্যাদি মাসআলা নজদি ধারা থেকে আগত।
যখন আধুনিক যুগের অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলন গণতান্ত্রিক ধারা গ্রহণ করে নেয়, তখন সংকটের সমাধান দেবার জন্য তারা বিভিন্ন ফিকহি ও চিন্তাগত দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করে। কিন্তু এই সময় তাদের ফিকহ ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে জিহাদী ধারার জন্য মৌলিক ভিত্তি ও দলিলাদি জোগাড় করে দেয় ইবনে তাইমিয়ার ফিকহ, সালাফী মানহাজ এবং ওয়াহাবি ঘরানার কিতাবাদি।”[44]
সালাফী জিহাদী ধারায় চিন্তাগত বিকাশ
সৈয়দ কুতুব ছাড়াও সালাফী জিহাদী চিন্তাধারায় প্রভাব বিস্তার করে শহিদ আবদুল কাদের আওদার লেখালেখি। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যগণ যখন কারাগারে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন একে একে, তখন যুবকগণ বেশ কিছু সালাফী শাইখ থেকে আন্দোলনের প্রেরণা লাভ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খলিল হাসান হাররাস। তারই ছাত্র ছিলেন ড. আইমান জাওয়াহেরী। এছাড়া মিসরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে প্রভাব ফেলতে থাকেন উমর আবদুর রহমান। তিনি একজন সালাফী আলেম ছিলেন। তার সংস্পর্শে এসে প্রভাবিত হয়ে বিপ্লবী মুসলিম ছাত্ররা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের চলাফেরার ধরণ থেকে ফিরে আসতে লাগল। দাঁড়ি লম্বা করল, সাথে দীর্ঘ সুন্নতি জোব্বা। আন্দোলনের নারী সদস্যরা পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা করতে লাগল। তখন ধীরে ধীরে সৈয়দ কুতুবের লেখালেখির পাশাপাশি ইবনে তাইমিয়া ও তার ছাত্রদের লেখালেখির পঠন পাঠন তাদের মাঝে শুরু হয়। আবদুস সালাম ফারাজ রচনা করলেন আল-ফারিদাতুল গায়িবাহ’ (হারানো ফরজ) ও ‘হুকমুত তাওয়াইফিল মুমতানিয়াহ’ (অবৈধ বিদ্রোহী দলগুলোর বিধান)। এখানে বেশিরভাগ উদ্ধৃতিই ছিল ইবনে তাইমিয়ার গ্রন্থাবলি থেকে।
এ পর্যায়ে উমর আবদুর রহমানের জামায়াতে ইসলামী ও তানজিমুল জিহাদ দলের মাঝে কিছু মাসআলায় ইখতিলাফ হয়। যেমন, তাওহিদ অজ্ঞতার ক্ষেত্রে ওজর গ্রহণযোগ্য কিনা, অথবা তাগুতদের সহায়তাকারীর বিধান। এসময় তানজিমুল জিহাদ এ দুই মাসআলায় কঠোরতার পক্ষে রায় দিল। এক্ষেত্রে তারা নজদি আলেমদের কিতাবাদির সাহায্য নেয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তাদের এই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে মত দেয়। এসব ইখতিলাফ স্পষ্ট হয়ে উঠে শাইখ আবদুল কাদের বিন আবদুল আযিয (সৈয়দ ইমাম নামে পরিচিত)-এর লেখা ‘আল-জামে ফি তালাবিল ইলম’ গ্রন্থে। সেখানে তিনি তাগুতের সহায়তাকারীকে সরাসরি কাফের বলেছেন এবং তাওহিদ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির কোন ওজর না গ্রহণ করে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[45]
আশির দশকের শুরুতে আফগানে দলে দলে যুবকরা যেতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য। সেক্ষেত্রে শহিদ আবদুল্লাহ আযযামের গভীর প্রভাব ছিল। আরব, হিজায, মিসর, ইয়েমেন থেকে যুবকদল ছুঁটে যায় সেখানে। সেই মুহূর্তে আবদুল্লাহ আযযাম বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজ বলে ফতোয়া দেন। এ সম্পর্কে যে গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন, তার নাম ‘আদ-দিফা আন আরাদিল মুসলিমিন আহাম্মু ফুরুদিল আয়ান’ (মুসলমানদের ভূমি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করা সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ফরজে আইন)। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই ফতোয়ার বিরোধিতার ক্ষেত্রে মূলধারার আলেমরা এগিয়ে থাকলেও যাদের মাধ্যমে এতদিন জিহাদী ধারা শক্তিশালী হয়েছিল, তাদের অনেকেও এই ফতোয়ার বিরোধিতা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ড. সফর বিন আবদুর রহমান আল-হাওয়ালী। তিনি রচনা করলেন ‘মাফহুমুল জিহাদ’ (জিহাদের মর্ম)। পরবর্তীতে এটি ‘রদ্দুন আলাশ শাইখ আবদিল্লাহ আযযাম’ নামেও বের হয়।
ড. শহিদ আবদুল্লাহ আযযামের মাধ্যমে প্রভাবিতদের অন্যতম শাইখ উসামা। তারা দুজনই বিশ্বাস করতেন, জিহাদ বর্তমানে সকল মুসলমানের উপর ফরজ। স্বশস্ত্র সংগ্রামই বর্তমানে পৃথিবীর জাহেলিয়াত দূর করার একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা হল, আগে বহিরাগত শত্রুকে নিঃশেষ করে পরবর্তীতে মুসলিম দেশের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। দুজনই আধুনিক সালাফী চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তবে তাদের মাঝে মানসিকতাগত কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। আযযাম যেখানে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি সেখানে শাইখ উসামা দ্রুততার সাথে আপন চিন্তার প্রকাশে তৎপর।
১৯৮৪ সালে যখন পাকিস্তানের পেশোয়ারে আফগান সার্ভিসেস ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হল তখন সবাইকে লক্ষ্য করে আযযাম বলেছিলেন, “প্রথম দিন থেকেই আমাদের কর্মপদ্ধতি হল, যুবকরা নিজেদের মধ্যে কোন চিন্তাগত ও দলগত মতভেদ করবে না। কোন তাবলিগি আসলে আমরা তাকে আহলান সাহলান বলে স্বাগত জানাবো। কোন ইখওয়ানী আসলে আমাদের মাথায় তুলে রাখবো। সালাফী আসলে আমাদের অন্তরে জায়গা দেব। আর জিহাদী ভাই তো আমাদের রুহের ভেতর ঠাঁই করে নেবেন। সবার থাকবে কেবল এক চেতনা.. জিহাদ.. জিহাদ..”[46]
অন্যদিকে শাইখ উসামা ইরাক যুদ্ধের পর বিভিন্ন বক্তৃতায় বলছিলেন, “এই সকল সরকারদের কুফুরীর বিষয়ে কোন ইখতেলাফ থাকতেই পারেনা।”[47] “তাগুত থেকে নিজের মুক্ততা ঘোষণা করা কোন নফল কাজ নয়। বরং সেটি তাওহিদের একটি রুকন। এটি ছাড়া কারো ঈমান ঠিক থাকতে পারে না।”[48] এছাড়াও কোন ইসলামী দলের পার্লামেন্টারিতে অংশগ্রহণ, ভোটে অংশগ্রহণ ইত্যাদি মাসআলায় দুজনের মাঝে বেশ মতভিন্নতা রয়েছে। এসব ইখতেলাফ থেকে অনেকটা অনুমিত হয়, আবদুল্লাহ আযযামের চিন্তাধারায় উসুল ও ফিকহের গভীর প্রভাব ছিল, যা ভিন্ন মতালম্বি ইসলামী রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে উদারতার শিক্ষা দেয়। এর অন্যতম কারণ ছিল হয়ত তিনি ময়দানে আসার আগে ১৯৭০ সালে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুল ফিকহের উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ফ্যাকাল্টির প্রভাষকও ছিলেন। অন্যদিকে শাইখ উসামার চিন্তাধারায় নজদি চিন্তার প্রভাব ছিল, যা ইখতেলাফকে লঘু দৃষ্টিতে দেখতে পারে না।
তাদের দুজনের পরে জিহাদী ধারা আধুনিক নজদি আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন, মিদহাত বিন হাসান আল-ফারাজ, আবু মুহাম্মদ মাকদিসী, সৌদির হামুদ বিন উকালা শাবী, আলি খুদাইর, নাসের আল-ফাহদ, আহমাদ খালেদী প্রমুখ। তারা জিহাদী ধারার সাথে নজদি আকিদা ও ফিকহকে মিলিয়ে দেন। তবে হ্যাঁ, নজদি কিতাবাদিতে শিআ, সুফি, মুতাকাল্লিমিন সম্পর্কে যে অস্বীকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেখান থেকে অনেকটা সরে আসতে চেয়েছেন আবু মুহাম্মদ মাকদিসী, যেমনটা দেখা যায় তার ‘আস–সালাসিনিয়্যাহ’ গ্রন্থে। তাছাড়া দেওবন্দি তালেবানদের ক্ষেত্রেও তাদের উদারতা ছিল।[49]
কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে আবু মুহাম্মদ মাকদিসী বিভিন্ন বিষয়ে অন্যান্য মুজাহিদ নেতাদের সাথে মতভেদ রাখতেন। যেমন শুরুতে তিনি আবদুল্লাহ আযযামের কাছেই ছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ আযযামের চিন্তাভাবনা তার ভাল লাগত না। পরবর্তীতে তার দল থেকে তিনি বেড়িয়ে যান। তার যেসব বিষয়ে মাকদিসী সমালোচনা করতেন-
- আফগানী মুজাহিদদের মাঝে ‘শিরক’-এর বিস্তার সম্পর্কে আবদুল্লাহ আযযাম চুপ ছিলেন।
- আবদুল্লাহ আযযাম আকিদা ও ফিকহ নিয়ে আফগানিদের সাথে বিরোধ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলেন।
- যে কোন এক মাযহাবের ফিকহী তাকলিদ করার ক্ষেত্রে যে ইজমা সংঘঠিত হয়েছে, সেটা স্বীকার করতেন আযযাম।
- আফগানের বিভিন্ন দলের নেতাদের প্রশংসা করতেন তিনি।
- পাকিস্তানের জিয়াউল হকের প্রশংসা করতেন আযযাম। তার সাথে সম্পর্কও রাখতেন। অন্যদিকে মাকদিসী সরাসরি তাকে তাকফির করেন।
- যুবকদেরকে আযযাম কঠোরভাবে নিষেধ করতেন তাকফিরের মাসআলায় না ঢুকতে।[50]
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনকারী দল হামাসের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইয়াসিন সম্পর্কে আবু মুহাম্মদ মাকদিসী বলতেন ‘ইমামুদ দ্বলাল’ (ভ্রান্তির নেতা)। বলতেন, “তিনি এমন কিছু কাজ করেন ও কথা বলেন, যা সুস্পষ্ট তাওহিদের বিপরীত।”[51]
আবু কাতাদা ফিলিস্তিনির সাথেও তার মতভিন্নতা ছিল। তারা দুজন একমত ছিলেন যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনীতে অংশগ্রহণ করা কুফুরি। কিন্তু যেসব ইসলামী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সেসব দলের ক্ষেত্রে উজর বিবেচনায় আবু কাতাদা তাকফির করতেন না।[52] কিন্তু আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর নিকট এক্ষেত্রে উজর গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তার নিকট কুফুরী বিষয়ের বাস্তবতা না জানার উজর গ্রহণযোগ্য। তেমনিভাবে আইএসকে আবু কাতাদা মনে করেন সুস্পষ্ট খারেজি দল; যাদেরকে আদ জাতির মত কচুকাটা করা উচিত। কিন্তু মাকদিসী তাদেরকে নিছক ‘গুলাত’ (কট্টর) মনে করেন। সিরিয়ায় তাদেরকে সাহায্য করা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন সালাফী জিহাদী ধারার সামনে।
এসব মতবিরোধ সত্ত্বেও তাদের মাঝে সম্মানের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তাও ভেঙে যায়, যখন আবু কাতাদা সমর্থন করে বসেন হাইয়াতু তাহরিরিশ শাম দলকে (যারা আল-কায়েদা থেকে আলাদা হয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছে), অন্যদিকে আবু মুহাম্মদ মাকদিসী কঠোর বিরোধিতা করেন এই দলের ও এদের মিত্রশক্তি জিহাদী দল গার্ডিয়ান্স অব রিলিজিয়াস অর্গানাইজেশন-এর। তিনি সিরিয়া সিভিল ওয়ারের ক্ষেত্রে যুবকদেরকে জাবহাতুন নুসরাহ-তে যোগ দিতে বলতেন। দায়েশের দিকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বলতেন। পরে এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষত টেলিগ্রামে বাকযুদ্ধ শুরু হয়। আবু কাতাদা একটা পোস্টের মাধ্যমে মাকদিসীকে তাকফিরী ও কট্টরপন্থী বলেন। মাকদিসী যে আহমাদ ইয়াসিনকে ইঙ্গিতে তাকফির করেন, সেটাও তুলে ধরেন।[53]
অন্যদিকে মাকদিসী এর উত্তরে পোস্ট করে লিখেন, “এই রকম লোকের থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। যে কিনা তাওহিদের ইমামদের অগ্রাহ্য করতে চায়, অথচ সম্মান করে ঐ সকল আলেমদেরকে যারা গণতন্ত্রের দিকে ডাকে, যারা তাগুতের পক্ষে সাফাই গায়। তার কথা আর কি বলব, তিনি তো শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েন সরকারী আলেমদের কথা শুনলে!”[54] তাওহিদের ইমাম বলতে মাকদিসী হয়ত বুঝিয়ে থাকবেন নজদি আলেমদের কথা; যাদেরকে আবু কাতাদা ফিলিস্তিনী প্রায়ই আক্রমণ করে কথা বলতেন। আর গণতন্ত্রের আহ্বানকারী বলতে হয়ত সাদিক আল-গারিয়ানী ও আহমাদ ইয়াসিনের দিকে ইঙ্গিত করে থাকবেন।
তানজিমুল কায়েদার আধ্যাত্মিক গুরু মুফতি ড. আতিয়্যাতুল্লাহ লীবির সাথেও মাকদিসীর ইখতেলাফ হয়। মাকদিসী সাধারণত মুরজিয়া ট্যাগ লাগাতেন ঐসকল ইসলামী আন্দোলনকে, যারা বিদ্যমান সরকারদেরকে কাফের বলতে রাজি না, যদিও তারা মুজাহিদ দল হয়। তাদেরকে আমভাবে তাকফির করাকে আহলে সুন্নাহর স্বাভাবিক রীতি মনে করতেন। কিন্তু আতিয়্যাতুল্লাহ মনে করতেন, এখানে ইখতেলাফ থাকতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। তিনি শুধুমাত্র এই মাসআলার কারণে কাউকে মুরজিয়া ট্যাগ লাগাতেন না।[55] যারা সংশোধনের নিয়তে ও ইসলামী আইনের পক্ষে কথা বলার লক্ষ্যে পার্লামেন্টারিতে অংশগ্রহণ করবে, তাদের উজরকে বিবেচনায় নিয়ে আতিয়্যাতুল্লাহ তাকফির করতেন না। কিন্তু মাকদিসী করতেন।[56] শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহ জিহাদী যুবকদেরকে বিশেষত জেনারেল শিক্ষিতদেরকে নিষেধ করে রেখেছিলেন, ব্যক্তি ও দলের তাকফিরের মাসআলায় ঢুকতে। ব্যক্তি ও দলের তাকফির কেবল করতে পারেন সতর্কতার সাথে প্রাজ্ঞ আলেমগণ। আল্লাহর উপর ইজমালি (সামগ্রিক-সংক্ষিপ্ত) ঈমান ও তাগুতের প্রতি ইজমালি কুফুরই যথেষ্ট। মাকদিসী এর সাথে একমত ছিলেন না।[57]
আতিয়্যাতুল্লাহ সাহেব বুঝতে পারলেন, মাকদিসী সাহেব তার সাথে অনেক বিষয়েই দ্বিমত পোষণ করছেন। একবার যুবকদেরকে সম্মোধন করে তিনি বললেন, “আমি দেখছি একজন ব্যক্তিকে নিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণমূলক বাড়াবড়ি চলছে। শাইখ মাকদিসীকে অনেকেই বলছে ‘জিহাদের নেতা’, ‘জিহাদী আন্দোলনের তাত্ত্বিক’। আর কেউ কেউ তো তাকে জিহাদের সবচে’ বড় দায়ী বানিয়ে ফেলছে। আমার মতে এটা বাস্তবতার বিপরীত মরুতে। ন্যায়নিষ্ঠ ইনসাফকারীদের জন্য এটা বোঝা কঠিন কিছু নয়।”[58]
আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর লেখালেখির মাধ্যমে বেশ প্রভাবিত হন আবু মুসআব যারকাউয়ী। কিন্তু তিনি মাকদিসীর থেকেও আরো কঠোর হয়ে উঠেন। তার পদ্ধতির সাথে তানজিমুল কায়েদার অনেক কিছুই মিল ছিল না। তাছাড়া তিনি শীআদেরকে সামগ্রিকভাবে তাকফির করতেন, যেটা মাকদিসী করতেন না। তার গঠিত দল তানজিমুল কায়েদা ফি বিলাদির রাফেদাইন থেকেই পরবর্তীতে ইসলামিক স্টেট নামক দলের জন্ম হয়। তবে হ্যাঁ.. আইএস গঠিত হবার পর আবু মুহাম্মদ মাকদিসী তানজিমুল কায়েদাকে অগ্রাধিকার দেন। আর আইএস যেখানে মাকদিসীর গ্রন্থাবলি থেকে বিপুল উপাদান নিতে পারত, সেখানে তারা আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর গ্রহণযোগ্যতা নিজেদের দল থেকে পুরোপুরি খারিজ করে দেয়। বরং তাকে তাকফির পর্যন্ত করে। কিন্তু মাকদিসী তাদেরকে তাকফির করেন না।
শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহর শাহাদাতের পর মাকদিসীর প্রভাব তানজিমুল কায়েদার মাঝে খুবই বৃদ্ধি পায়। মাকদিসীর মাধ্যমে প্রভাবিত অনেকেই বিভিন্ন দেশে দাওয়াতী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ড. ইয়াদ আল-কুনাইবি হাফিজাহুল্লাহ অন্যতম।
এভাবেই সালাফী জিহাদী ধারা প্রাথমিকভাবে ইখওয়ানী ভিত্তির উপর গড়ে উঠলেও বিভিন্ন পর্যায়ে বিপ্লব ও আন্দোলন সমর্থনকারী বিচিত্র চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছে। পরবর্তী ধাপে সৈয়দ ইমাম থেকে শুরু করে অন্যান্য সালাফী জিহাদী তাত্ত্বিকদের মাঝে ইবনে তাইমিয়া ও নজদি আন্দোলন একাকার হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
[1] মাহের ফারাগলি, আস–সালাফিয়্যাতুল জিহাদিয়্যাহ: আল–মাফহুম ওয়াল মা’না,
https://www.almarjie-paris.com/10004
[2] দেখুন, বায়ান সেন্টারে ২০০৭ জুনে প্রকাশিত শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহর বিশেষ সাক্ষাতকার
[3] ড. আকরাম হিজাযী, দিরাসাতুন ফিস সালাফিয়্যাতিল জিহাদিয়্যাহ, পৃ. ৩৬-৩৮, আল-আসর ম্যাগাজিনে ১৪২৩ হি.তে প্রকাশিত আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর এক বিশেষ সাক্ষাতকার
[4] শরিফ হাসান আল-কাত্তানী, আদ–দাওয়াতুন নাজদিয়্যাহ ওয়াল হারাকাতুল জিহাদিয়্যাহ,
[5] আবদুল মুনয়িম আল-হাশেমি, তারজামাতুল ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদিল ওয়াহাব,
http://saaid.net/monawein/t/7.htm#3
[6] সালেহ ওয়ারদানি, আল–খাতারুল ওয়াহাবিয়্যু: ছালাছু রাসায়েল দিদ্দাল ওয়াহাবিয়্যাহ, পৃ. ২০
[7] প্রস্তুতকরণে, আন-নাদওয়াতুল আলামিয়া সংঘের যুবকবৃন্দ, আকিদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ,
http://saaid.net/feraq/mthahb/0.htm
[8] শরিফ হাসান আল-কাত্তানী, প্রাগুক্ত
[9] বিস্তারিত দেখুন, ড. মুহাম্মদ বিন সাদ আশ-শুওয়াইর, সুলাইমান বিন আবদিল ওয়াহাব: আশ–শাইখুল মুফতারা আলাইহি,
https://saaid.net/monawein/sh/19.htm
[10] সৈয়দ আহমাদ রেজাখান বেরেলভি সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘ইনি হলেন সুন্নতে নববীর সাচ্চা আশেক, সহি আকিদার ধারক।’ শহিদ ইসমাইল রহ. ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ নামে যে গ্রন্থটা লিখেছিলেন, সেটাকে বলতেন ওয়াহাবী ধারার বই। আর এর খণ্ডনে মওলভি ফজলে রাসূল বাদায়ুনী ‘সাওতুর রহমান’ নামে যে গ্রন্থটা লিখেছিলেন, সেটা তার মতে ছিল ‘হানাফিয়্যাত’ ও ‘সুন্নিয়্যাত’এর মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। – (দেখুন: মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, আজাদ কি কাহানী খোদ আজাদ কি যুবানি, পৃ. ১০০)
[11] মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, আজাদ কি কাহানী খোদ আজাদ কি যুবানি, পৃ. ৫৬ – ৫৭, অনুলিখন: কবি মালিহাবাদী
[12] মুহাম্মদ আমিন বিন উমর বিন আবদেল আযিয আবেদিন হানাফী দেমাশকি, রদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার, খ.৪, পৃ.২৬২
[13] আহমাদ বিন মুহাম্মদ আস-সাভী আল-মালেকী, হাশিয়াতুল আল্লামা আস–সাভী আলা তাফসিরিল জালালাইন, প্রকাশ: দারু ইহয়াইত তুরাস আল-আরাবী, খ.৫, পৃ.৭৮। ওয়াহাবিদের প্রসঙ্গে উদ্ধৃত বাক্যটি বেশ কয়েকটা নতুন সংস্করণ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। গোল্ডেন শামেলায় পুরো বাক্যটাই নাই করে দেয়া হয়েছে। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া থেকে যে সংস্করণ বের হয়েছে, তাতে অন্যান্য সংস্করণে যে মুছে ফেলা হয়েছে, এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। পুরাতন কয়েকটি সংস্করণ থেকে মুছে ফেলার ক্ষেত্রেও প্রুফের সাহায্য নেয়া হয়েছে। দারুল জীল, বৈরুত থেকে প্রকাশিত প্রাচীন একটা সংস্করণে মুছে ফেলাটা স্পষ্ট দেখা যায় (খ.৩, পৃ.২৮৮)
[14] হাসান বিন আলি সাক্কাফ, শরহু আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ আও আল–মানহাজুস সাহিহ ফী ফাহমি আকিদাতি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামায়াহ মাআত তানকিহ, পৃ. ৯৯ প্রকাশ: দারুল ইমাম আর-রাওয়াস, বৈরুত, ২০০৭ ই.
[15] উসমান মুস্তফা নাবুলুসী, আর–রু’য়াতুল ওয়াহাবিয়্যাহ লিত–তাওহিদ ওয়া আকসামিহ: আরদুন ওয়া নাকদ, প্রকাশ: দারুন নুরিল মুবিন, ২০১৭ ই. পৃ. ১১ – ১৩
[16] সূরা তাওবা, আয়াত: ৩০
[17] সূরা তাওবা, আয়াত: ৩১
[18] সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৫১ – ৫৬
[19] তাফসিরে আবিস সাউদ, খ.৬, পৃ.৭৩
[20] সূরা আনআম, আয়াত: ১৬৪
[21] ইমাম শাতেবী, আল–মুআফাকাত, খ.৩, পৃ.৭
[22] সালেহ আলে শাইখ, আত–তামহিদ লি–শারহি কিতাবিত তাওহিদ, প্রকাশ: দারুল মিনহাজ, পৃ. ১৩৬
[23] আশরাফ আলি থানবী, কাশশাফু ইস্তিলাহাতিল ফুনুন, খ.২. পৃষ্ঠা.১১২৩
[24] ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ, মাদারিজুস সালিকীন, খ.২, পৃ.১৭৯
[25] উসমান মুস্তফা নাবুলুসী, প্র্রাগুক্ত, পৃ.১৬২
[26] বিস্তারিত দেখুন, আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ ফির আজউয়িবাতুন নাজদিয়্যাহ, (১০/৫১), (১০/৭-৮)
[27] শরীফ হাসান আল-কাত্তানী, প্রাগুক্ত
[28] সৈয়দ আবুল আ’লা মওদুদী, আল–মুস্তালাহাতুল আরবাআ ফিল কুরআন, আরবি অনুবাদ: মুহাম্মদ কাজেম সিবাক প্রকাশ: মাকতাবাতু দারিল ফাতহ, দেমাশক, পৃ. ১০
[29] সৈয়দ আবুল আ’লা মওদুদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩
[30] সৈয়দ আবুল হাসান আলি নদবী, আত–তাফসিরুস সিয়াসিয়্যু লিল–ইসলাম, প্রকাশ: দারু আফাকিল গাদ, পৃ. ৬৮
[31] সৈয়দ কুতুব, মাআলিম ফিত তারিক, প্রকাশ: দারে দিমাশক, পৃ. ৯
[32] হাসান ইসমাইল আল-হুদাইবি, দুআতুন লা কুদাতুন, প্রকাশ: দারুস সিদ্দিকিয়া, পৃ. ৮৩
[33] নজদি ধারারই একটা কিতাবের নাম উল্লেখ করছি, বিস্তারিত দেখুন শেখ মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম আলে শাইখের তাহকিমুল কাওয়ানিন, পৃ.৫-৭
[34] দেখুন, ইবনে জাবির তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাফসীরি আয়িল কুরআন, ইবনে আবি হাতেম, তাফসিরুল কুরআন, ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম
[35] ইবনে আবি হাতেম, তাফসিরুল কুরআন, খ.৪, পৃ.১১৪৩
[36] ইবনে জাবির তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাফসীরি আয়িল কুরআন, খ.৬, পৃ.২৫৬
[37] ইবনে আবিল ইয, শরহুল আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২৩ – ৩২৪
[38] https://www.aljumhuriya.net/ar/233
[39] সৈয়দ কুতুবের এই মতের উপর আবুল হাসান নদবী কঠিনভাবে খন্ডণ করেছেন ‘আত–তাফসিরুস সিয়াসি লিল–ইসলাম’ গ্রন্থে। সারা উম্মতের অধিকাংশ অংশ কখনোই জাহিলিয়্যাত ও ভ্রান্তিতে ডুবে থাকতে পারে না। এটা উম্মত সম্পর্কে তার বদ ধারণা।
[40] প্রবন্ধের নাম ‘মিনাল ওয়াকিয়িত তারিখিয়্যি ফিল ইসলাম’
[41] সৈয়দ কুতুব, আল–আদালাতুল ইজতিমাইয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ১৬০ – ১৬১
[42] সৈয়দ কুতুব, কুতুবুন ওয়া শাখশিয়্যাত, পৃ. ২৪২
[43] আবু মুসআব সুরি, দাওয়াতুল মুকাওয়ামাতিল ইসলামিয়্যাতিল আলামিয়্যাহ, পৃ. ৬৯১ – ৬৯৩
[44] আবু মুসআব সুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯৭
[45] শরীফ হাসান কাত্তানী, প্রাগুক্ত
[46] মাওসুআতুল যাখায়ের, খ.৪, পৃ.৪৮৫
[47] শাইখ উসামা, তাওজিহাতুন মানহাজিয়্যাহ, খ.১, পৃ.১১
[48] শাইখ উসামা, প্রাগুক্ত, খ.২, পৃ.১৩
[49] শরীফ হাসান কাত্তানী, প্রাগুক্ত
[50] আবু মুহাম্মদ মাকদিসী, ওয়ালাকিন কুনু রাব্বানিয়্যিন, ভিডিও, প্রকাশ ২০০৯ ই.
https://archive.org/details/Abu_Mohammed_Alma9disi_04/7-Mar7alate.Afran
[51] আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর টেলিগ্রাম অফিসিয়াল চ্যানেল, প্রকাশ ১৮ জুন ২০১৮ ই.
[52] আবু কাতাদা ফিলিস্তিনী, জু’নাতুল মুতায়্যাবীন, পৃ. ৫৮
[53] আবু কাতাদা ফিলিস্তিনীর অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেল, প্রকাশ: ৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ ই.
[54] আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর টেলিগ্রাম অফিসিয়াল চ্যানেল, ওয়ালানা কালিমাতুন হাদিআহ, প্রকাশ: ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ই.
[55] যুবাইর আল-গাযী (সংকলন), আল–আমালুল কামেলা লিশ–শাইখ আতিয়্যাতিল্লাহ আল–লীবি, প্রকাশ: দারুল মুজাহিদীন, ২০১৫ই., পৃ.৩৯০
[56] যুবাইর আল-গাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.৪৭২
[57] যুবাইর আল-গাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.১৮৪
[58] যুবাইর আল-গাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.১৩১৬