সালাফের শেষজীবন : ঈমান, আমল ও তাকওয়া

হুসাইন আহমাদ:

দ্বীনের ক্ষেত্রে যাঁরা আমাদের পূর্বসূরি তাঁরা হলেন সালাফ। আমরা তাঁদের সালফে সালেহিন তথা পূণ্যবান পূর্বসূরি হিসেবে চিনি। ঈমানের দৃঢ়তা, আমলের একাগ্রতা ও তাকওয়ার পবিত্রতা ছিল তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উঠতি যৌবনে তাঁরা যেমন উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের পূর্ণ ধারক ছিলেন, পড়ন্ত পৌঢ়েও ঈমান, আমল ও তাকওয়ায় শোভিত ছিল তাঁদের জীবন। আমরা এখানে কয়েকজন সালাফের পড়ন্তবেলার সময়টুকু তুলে আনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

সালাফের আলোচনায় সর্বপ্রথম যাঁর নাম আসে, তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু। উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক জবানে। পবিত্র কুরআনেও বিবৃত হয়েছে তাঁর গুণ মহিমা। এই মহান ব্যক্তিটি ঈমান ও আল্লাহভীতিতে কেমন ছিলেন? কেমন ছিল অস্তাচলগামী জীবনে তাঁর আমল? আসুন একটু জেনে নেওয়া যাক ইতিহাসের পাতা থেকে।

হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও নরম দিলের মানুষ। নবীজি বলেছেন, আমার উম্মতের প্রতি সবচেয়ে দয়াবান হল আবু বকর। জীবনের শেষসময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অসুস্থ হয়ে নামায পড়াতে পারছিলেন না, হযরত আবু বকরকে নামায পড়াতে খবর পাঠাতে বললেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার আব্বাজান বড় নরম দিলের মানুষ! তিনি আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়াতে পারবেন না। আপনার বিচ্ছেদ সইতে পারবেন না। অন্য কাউকে বলুন। কিন্তু নবীজি যে তাকেই নিজের স্থলাভিষিক্ত করবেন। তাই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কথা আমলে না নিয়ে পুনরায় আদেশ পাঠাতে বললেন।
হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহুর দয়া ও নম্রতা আর ঈমানি দৃঢ়তা ছিল সমান্তরাল। দয়ার সুযোগ নিয়ে ইসলামের ওপর আঘাত করতে পারেনি কেউ।

প্রয়োজনে তিনি কঠোর হয়েছেন। কোষমুক্ত তরবারি হাতে গর্জে উঠেছেন। ইসলাম ও তার বিধান অস্বীকারীদের ফেতনাকে কঠিন হাতে দমন করেছেন। তিনি যেন ছিলেন কুরআনের আয়াত— তাঁরা কাফেরদের ওপর কঠোর ও পরস্পরের প্রতি দয়াশীল— এর শ্রেষ্ঠ ও বাস্তব রূপ।

তাঁর খোদাভীতি সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “হায়! আমি যদি একজন মুমিনের গায়ের লোম হতাম!” কখনো তিনি নিজের জিহ্বা ধরে বলতেন, “যত অনিষ্টের মূল এই বস্তু।” তারপর খুব কাঁদতেন আর বলতেন, “ওরে মন, সময় থাকতে কাঁদো! অন্যথায় আখেরে তোমাকে কাঁদানো হবে!” যখন তিনি নামাযে দাঁড়াতেন, আল্লাহর ভয়ে যেন কাঠ হয়ে যেতেন!

একবার তিনি গাছের ডালে একটি পাখি দেখে বললেন, “হে পাখি, কতো ভাগ্যবান তুমি! গাছের ফল খাও। শীতল ছায়ায় নেচে বেড়াও। মৃত্যুর পরও তুমি এমন স্থানেই যাবে যেখানে হিসাব ও জবাবদিহিতা নাই। আফসোস! আবু বকর যদি এমন হতো!” আবার কখনো বলতেন, “আফসোস! আমি যদি তৃণ হতাম, চতুষ্পদ জন্তু আমাকে খেয়ে ফেলত!”

আল্লাহর ভয়ে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এভাবেই কাঁদতে থাকতেন। আমরা কি ভেবে দেখেছি? মহান রাব্বুল আলামিন যাঁর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। রহমাতুল্লিল আলামিন যাকে দুনিয়াতেই বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছেন। রোজ কেয়ামতে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কেমন ছিল তাঁর ভয়! আর আমাদের অবস্থান কোথায়? তাহলে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহকে আমাদের কিরূপ ভয় করা উচিৎ?

মৃত্যুর দুয়ারে যখন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উপনীত হলেন, বায়তুল মাল থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করেছেন তার হিসেব করতে আদেশ দিলেন। হিসেব করে জানা গেল, গোটা খেলাফতকালে মোট ৬ হাজার দেরহাম– যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৫ শত টাকা– গ্রহণ করেছেন। বললেন, আমার জমি বিক্রি করে তা ফিরিয়ে দাও। তাই করা হল। এরপর তিনি বললেন, অনুসন্ধান করে দেখ, খেলাফত গ্রহণের পর থেকে আমার সম্পদে কোনো বৃদ্ধি হয়েছে কি না? অনুসন্ধানের পর দেখা গেল, একটি হাবশি গোলাম— যে শিশুদের দেখাশোনা ও মুসলমানদের তরবারি পরিষ্কার নিয়োজিত ছিল, একটি পানি বহনের উট ও একটি চাদর বৃদ্ধি হয়েছে। হিসেব শুনে তিনি নির্দেশ দিলেন, আমার মৃত্যুর পরই যেন এগুলো পরবর্তী খলিফার নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়।

ইন্তেকালের পর যখন উপরোক্ত বস্তুগুলো হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট পাঠানো হল তিনি কেঁদে ফেললেন। চোখের পানি মুছে বললেন, আবু বকর! আপনি আপনার স্থলাভিষিক্তদের দায়িত্ব অনেক কঠিন করে গেলেন! এই ছিল উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষটির শেষবেলার তাকওয়া ও ঈমানি দৃঢ়তার সামান্য নমুনা।

উম্মতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হলেন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু। কেমন ছিল তাঁর শেষজীবন? কেমন ছিল তাঁর ঈমান, আমল ও খোদাভীতির রূপ? খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বসাধারণ মুসলমানকে একত্রিত করে বলেন, “মুসলমানগণ, আপনাদের সম্পদে আমার ঠিক ততটুকু অধিকার রয়েছে যতটুকু কোন এতিমের প্রতিপালকের জন্য এতিমের সম্পদে থাকে। আমার যদি সামর্থ থাকে তবে আপনাদের থেকে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করব না। যদি অসমর্থ হয়ে পড়ি তবে কেবলমাত্র খাওয়া-পরার খরচ গ্রহণ করব। এরপরও আপনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন, যেন অপচয় বা সঞ্চয় করতে না পারি।”

প্রথম দিনের প্রদত্ত এই ভাষণ গোটা খেলাফতকালে তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। কিন্তু নিজের জীবন-জীবিকার কোন উন্নতি তাঁর হয়নি। নিঃস্বতা ও উপবাসকেই নিত্য সঙ্গী করে রেখেছিলেন। কখনো তিনি গরম কাপড় পরেননি। তাঁর জামায় একত্রে বারটি পর্যন্ত তালি থাকত। মাথায় থাকত ছেঁড়া ও জীর্ণ পাগড়ি। পায়ে ছেঁড়া-ফাটা জুতা। একবার জামা ছিঁড়ে গেলে তিনি তালির ওপর তালি দিচ্ছিলেন। হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে বারণ করলে তিনি বলেন, “হাফসা, আমি মুসলমানদের সম্পদ হতে এর অধিক গ্রহণ করতে পারি না।”

খাবার গ্রহণেও তিনি ছিলেন খুব হিসেবি। শুধু ক্ষুধা নিবারণের তাড়নাতেই খাবার গ্রহণ করতেন, তবুও তা হতো অতি সাধারণ খাবার দিয়ে। হিজরি ১৮ সনে আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময়ে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর অস্থিরতা ছিল বেদনাদায়ক। তখণ ঘির বদলে তিনি জয়তুন তেলের ব্যবহার শুরু করলেন। ফলে একদিন তাঁর পেটে পীড়া দেখা দিল। তিনি পেটের উপর হাত রেখে বললেন, “দুর্ভিক্ষ যতদিন আছে তোমাকে ইহাই গ্রহণ করতে হবে!” একদিন স্বীয় পুত্রের হাতে তরমুজ দেখতে পেয়ে ভীষণ রাগান্বিত হয়ে বললেন, “মুসলিম জনসাধারণ না খেয়ে মরছে আর তুমি ফল খাচ্ছো!?”

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দাসদাসী ও কর্মচারীদের সাথে নিজের ভাইয়ের মতো আচরণ করতেন। প্রসিদ্ধ ফিলিস্তিন সফর সহ ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনা— তাঁর এই মহৎগুণের সাক্ষ্য বহন করে আসছে। তিনি রাতভর ইবাদত করতেন এবং কাঁদতে থাকতেন। কান্নার তীব্রতায় তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসত। দু‘চোখের অশ্রু প্রবাহের ধারায় দু’টি কালো দাগ পড়ে গিয়েছিল। একবার তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আফসোস, আমি যদি তৃণখণ্ডের মতো নগণ্য হতাম! আমি যদি জন্মই না নিতাম! আমার মা আমাকে যদি পৃথিবীতেই না আনতো!”
সর্বোচ্চ তাকওয়া ও ইবাদতের মধ্যে জীবন কাটানোর পরও তাঁর ভেতর এতো ভয় ছিল যে, একবার বলছিলেন, “যদি আসমান থেকে ঘোষণা হয়, একজন ব্যক্তি ব্যতিত দুনিয়ার সবার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে, তবুও আমার ভয় কাটবে না। আমার মনে হবে, সেই হতভাগ্য মানুষটা বুঝি আমিই!” এই ছিল বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি খলিফায়ে রাশেদ হযরত উমর রাদিয়াল্লাহুর খোদাভীতির সামান্য বিবরণ।

উম্মতের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। যিনি ছিলেন যুন-নুরাইন তথা নবীজির দুই দুইটি নুরের (কন্যা) অধিকারী। ছিলেন আরবের মর্যাদাবান ধনী ব্যক্তিত্ব। ইসলামের জন্য তিনি অকাতরে দান করেছেন। কুরআন সংকলনের পূর্ণতা দানকারীর মর্যাদাও তিনি লাভ করেছেন।
বর্ণনায় এসেছে, তিনি যখন কোন কবরের পাশ দিয়ে যেতেন কান্নায় ভেঙে পড়তেন। তাঁর গণ্ডদেশ ও শ্মশ্রু চোখের পানিতে ভিজে যেতো। জীবনের শেষবেলায় এসে তাঁর ইবাদতের অবস্থা ছিল বিশেষভাবে বর্ণনা করার মতো। তিনি অধিক পরিমাণে রোযা পালন, নামায আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এমনকি ফেতনাবাজ দুর্বৃত্তদের নির্মম আঘাতে যখন শাহাদত বরণ করেন, তখনও তিনি কুরআন তেলাওয়াতরত ছিলেন।

ফেতনা সৃষ্টিকারীরা যখন তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে রাখল এবং খাদ্য-পানীয় প্রবেশের সকল পথ বন্ধ করে দিল। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অলীক অভিযোগর দালিলিক জবাব দিচ্ছিলেন, তবুও যখন তাঁরা মানছিল না। বরং ভেতরে ঢুকে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করার জন্য বাসভবনে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। তখন হযরত আবু হুরায়রা রা. সহ বড় বড় সাহাবিগণ বারবার অনুমতি চাচ্ছিলেন যে, আমিরাল মুমিনিন, বাহিনী প্রস্তুত আছে। আপনি শুধু অনুমতি দিন। এই ঘাতকদলকে মদিনা ছাড়া করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁদের জবাবে বলছিলেন, না, আমার তরবারি কোনো মুসলমানের ওপর উদ্যত হতে পারে না। অবশেষে সেই ঘাতকদলের হাতে শহিদ হলেন, তবুও তাঁদের প্রতিহত করলেন না। কারণ তারাও যে মুসলমান পরিচয় বহন করছিল!

আমিরুল মুমিনিন হযরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর শেষজীবনও তাঁর পূর্ববর্তীদের মতোই ছিল ইবাদতমুখর। তিনিও ঈমানের দৃঢ়তা ও খোদাভীতিতে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। মারাত্মক জখম হওয়ার পর যখন আততায়ীকে বন্দী করা হল, তখন তিনি পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, এই ব্যক্তি বন্দী; তার সাথে ভালো ব্যবহার কর। তাকে ভালো খেতে দাও, নরম বিছানা দাও। যদি বেঁচে থাকি তবে আমার রক্তের সবচেয়ে বড় দাবীদার আমি হবো। তার থেকে প্রতিশোধ নেবো বা ক্ষমা করে দেবো। আর যদি মরে যাই তাকে আমার পেছনেই পাঠিয়ে দিও আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমা চাইবো।
হে বনী মুত্তালিব, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত শুরু করে দিও না। সাবধান! আমার হন্তা ব্যতিত অন্য কাউকে হত্যা কোরো না। তারপর বললেন, হাসান, তার এই আঘাতে যদি আমার মৃত্যু হয় তবে তার থেকে অনুরূপ আঘাতে কেসাস নিও। তার নাক-কান কেটে দিয়ে পাপ কোরো না। কেননা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাবধান! নাক-কান কেটো না, যদিও সে কাফের হয়। এরপর দীর্ঘ এক অসিয়ত নামা লিখলেন এবং মহান রবের দরবারে চলে গেলেন।

নবীজি ও মুসলমানদের দুর্দিনের নিষ্ঠবতী সহায়িকা আম্মাজান হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহার সম্পর্কে আমরা জানি। তিনি প্রথম যুগের সেই কঠিন সময়গুলোতে নবীজির সান্ত্বনা ও আশ্রয় হয়েছিলেন। নবীজির দাওয়াতের প্রেরণা ছিলেন। তিনি নিজের অঢেল সম্পদ প্রিয়নবীর চরণতলে সঁপেছিলেন। জীবনের শেষবেলায় এসে ইসলামের জন্য হাজারো কষ্ট সয়েছেন। শিয়াবে আবু তালেবের গিরিপথে দীর্ঘ তিনটি বছর তিনি নবীজির সাথে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে কাটিয়েছেন। অথচ বয়সের বিবেচনায় ওই সময়টাতে ছিল তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা জীবনের বেলাভূমিতে এসে আল্লাহর ইবাদতে অধীর থাকতেন এবং রবের ভয়ে চোখের পানিতে আঁচল ভেজাতেন। আম্মাজান খাদিজার ত্যাগ, ভালোবাসা ও ঈমানের ওপর অবিচলতা এবং আম্মাজান আয়েশার ইলম, ইবাদত ও খোদাভীরুতা ইতিহাসে অমর ও আমাদের উত্তম আদর্শ হয়ে আছে।

ফেকাহর প্রসিদ্ধ চার ইমামের ইলম, আমল, তাকওয়া ও ঈমানী দৃঢ়তার ইতিহাস কমবেশি সবাই আমরা জানি। তাঁদের জীবনের শেষ সময়গুলোতেই রচিত হয়েছে তাঁদের মাযহাব এবং ঈমানি অবিচলতার ঐতিহাসিক দাস্তান। দুনিয়ার পদমর্যাদা তাঁদের পদচুম্বন করেছে বারবার, কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইতিহাসে প্রসিদ্ধ, খলিফা আবু জাফর মনসুর ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহকে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ইমাম তা প্রত্যাখ্যান করে দেন। কারণ তিনি জনগণের ওপর জুলুমকারীদের সহযোগী বানাতে চাননি নিজেকে। চাননি এমন কোন শৃংখল গলায় পরতে, হক ও সত্য বলতেই যাতে টান পড়বে। আর বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে সত্যের বাণী। ফলাফল এই দাঁড়ালো, খলিফা ভীষণ রেগে গেলেন। পদ গ্রহণ না-করায় ইমাম আবু হানিফাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। জুলুমের জল্লাদকে আবু হানিফার গর্দানের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখলেন। নির্দেশ দিলেন প্রতিদিন নিয়ম করে ইমামকে চাবুক মারতে। তাই মারা হতে থাকল। নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকল। এতো নির্যাতনের পরেও যখন রাজি করানো গেল না, তখন তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হল। ইমাম আবু হানিফা জীবন দিলেন, তবুও হকের আওয়াজ বন্ধ হয় এমন কোনো পদ গ্রহণ করলেন না!

ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহর ওপরও সত্য বলার অপরাধে খলিফা মনসুরের মদিনার শাসক চড়াও হয়েছিল। ইমাম মালেককে ঘোরার পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘুরিয়ে বেত্রাঘাত করেছে সে। কিন্তু ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ হক বলা থেকে একবিন্দু সরে আসেন নি।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহর কারা-নির্যাতন ভোগের ইতিহাস বড় বেদনাদায়ক। মামুন, মুতাসিম ও ওয়াসিক ধারাবাহিক এই তিনজন খলিফার অমানুষিক নির্যাতনের সাক্ষী ছিল বাগদাদের কারাগার। নির্যাতনের প্রচণ্ডতা তাঁর জীবনের আশা কেড়ে নিয়েছিল। তবুও তাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি হকের ওপর থেকে। ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহকে এতো পরিমাণ বেত্রাঘাত ও কষ্ট দেওয়া হয়েছে যে, একটি হাতির পক্ষেও তা সহ্য করা সম্ভব ছিল না। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী না চিনলেও সাধারণ মানুষ ঠিকই ছিনেছিল তাকে। এই মজলুম মানুষটি যখন মৃত্যুবরণ করেন, গোটা শহর জুড়ে তখন কান্নার রোল পড়ে যায়। প্রায় আট লক্ষাধিক মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন।

সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা ছিলেন আমাদের সালাফ, পূণ্যবান পূর্বসূরি। সালাফগণ নিজেদের জীবনে নববি আদর্শের বাস্তব প্রয়োগ দেখিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁদের জীবন জুড়ে ছিল ঈমান, আমল ও আল্লাহভীতির উজ্জ্বল উদাহরণ। বিশেষ করে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সেই উজ্জ্বলতা যেন অনির্বাণ শিখার রূপ ধারণ করতো। আমরা যদি সালাফের জীবন থেকে ঈমানি দৃঢ়তা, ইবাদতমুখরতা ও আল্লাহভীতির শিক্ষা নিয়ে তাঁদের পথের পথিক হতে পারি, দুনিয়াতে তাঁদের অনুসারী হতে পারি। তাহলে অনন্ত আখেরাতেও তাঁদের সাথী হতে পারব ইনশাআল্লাহ।

আগের সংবাদছাগল চুরির অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে
পরবর্তি সংবাদমাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত: গেটম্যানের বিরুদ্ধে মামলা